Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আমাদের সবার প্রিয় মীনার নেপথ্য কথা

আমি বাবা মায়ের শত আদরের মেয়ে
আমি বড় হই সকলের ভালোবাসা নিয়ে …  

আপনি যদি বিংশ শতকের শেষ দশক কিংবা একবিংশ শতকের প্রথম দশকে জন্ম নেওয়া কোনো পাঠক হন, তবে নিশ্চয়ই আপনার হৃদয়ে গানটির অনুরণন শুরু হয়ে গেছে। ক্ষণিকের জন্য নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। আমি আপনার পুলক অনুভব করতে পারছি! কারণ, হ্যাঁ, আপনার মতো আমারও ছোটবেলার নির্মল বিনোদনের উৎস মীনা কার্টুন। কেবল আমি বা আপনি নই, এবং কেবল বিনোদনের উৎস হিসেবেই নয়, বরং আমার আপনার মতো হাজারো দর্শকের কাছে অতীব জনপ্রিয় এই মীনা কার্টুনটি সমাজ-সংস্কার ও জ্ঞানের আলোয় মানুষকে সচেতন করে তুলেছে। আজকের লেখায় আমরা মীনার চরিত্র সৃজন ও এর নানা দিক নিয়ে আলোচনা করবো।

শুরুর কথা

সে নব্বইয়ের দশকের কথা। মেয়েদের অধিকার সুংসহত করার ব্রত নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত তৎকালীন সাতটি দেশ (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, ভূটান ও মালদ্বীপ) যৌথভাবে দশকটি ‘কন্যাশিশু দশক’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এ অঞ্চলটিতে সত্যিকার অর্থেই মেয়েদের তখন নাজুক অবস্থা! কী স্বাস্থ্য, কী শিক্ষা- সব ক্ষেত্রেই মেয়েদের করুণ দশা।

দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা, সার্ক; Image Source: preamble of indian constitution

১৯৯০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত ১০ বছর পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে সার্বিক সূচকে মেয়েদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য সার্কভুক্ত দেশগুলো দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করে। আর সেজন্য চাই সামাজিক সচেতনতা। কিন্তু মেয়ে শিশুর অধিকারের ব্যাপারে কীভাবে সচেতন করা যায় এ অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীকে?

যোগাযোগ করা হলো ‘ইউনিসেফ’ এর সাথে। আরো সঠিকভাবে বললে ‘ইউনিসেফ, বাংলাদেশ’ এর সাথে। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কোনো এক বিখ্যাত চরিত্রের দ্বারস্থ হতে হবে, হতে পারে সেটা বাস্তবের কোনো কিংবদন্তী কিংবা কৃত্রিমভাবে সৃজিত কোনো চরিত্র, মানে কোনো এনিমেটেড কার্টুন বা কমিক্স চরিত্র।

Image Source: laotiantimes.com

সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির বিষয়ে সাধারণত কোনো একজন বিখ্যাত ব্যক্তি, যার কথা মানুষ মনোযোগ দিয়ে শুনবে, গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করবে এমন কাউকে সম্পৃক্ত করা হয় এবং তাঁর সুনামকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে সচেতন করা হয়। কিন্তু, কথা নেই, বার্তা নেই, এনিমেটেড চরিত্রের কথা কেন মাথায় এলো? তা-ও আবার সেই যুগে? হ্যাঁ, এই ‘সেই যুগেই’ ইতোমধ্যে সাবেক চেকোস্লোভাকিয়াতে উন্নয়নের জন্য এনিমেটেড ফিল্ম ক্যারেক্টারের দারুণ সফলতা লক্ষ্য করা গেছে। এজন্যই এমন ভাবনার উদয় হয়েছিলো তৎকালীন ইউনিসেফের অনুষ্ঠান ও যোগাযোগ বিভাগের প্রধান নিল ম্যাককির চিন্তায়। [১]

বাংলাদেশের প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার তখন বিটিভিতে ‘মনের কথা’ নামে একটি পাপেট শো করতেন (এখনও করেন)। সেখানে ‘পারুল’ নামে এক বিখ্যাত মেয়ে চরিত্র বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।  

‘মনের কথা’ অনুষ্ঠানের টিভি সেটে  কিংবদন্তী চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার; Image Source: jessore.info

এই পাপেট পারুলের থিম থেকেই একটি কাল্পনিক মেয়ে চরিত্র নির্মাণের কনসেপ্ট গ্রহণ করা হয়। এ কাজে বাংলাদেশ থেকে মুস্তাফা মনোয়ার যুক্ত ছিলেন।

যা-ই হোক, আট-নয় বছর বয়সী মেয়ের কনসেপ্ট মোটামুটি দাঁড়ালো। দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরার জন্য শহুরে নয়, গ্রামীণ আবহ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। এর সাথে থাকবে মেয়েটির বাবা, মা, ছোট ভাই এবং পোষা কোনো প্রাণী।

নাম খুঁজে বের করা

যেহেতু নির্মিতব্য কার্টুনটি দক্ষিণ এশীয় সবগুলো দেশেই প্রচারিত হবে, তাই কেন্দ্রীয় চরিত্রটির এমন একটি জুতসই নাম হওয়া দরকার, যেন নাম শুনে প্রত্যেকটি দেশ মেয়েটিকে নিজেদেরই দেশের প্রতিনিধি বলেই মনে করতে পারে।

কিন্তু এমন নাম খুঁজে পাওয়া খুব সহজ ছিলো না। কারণ, সাত সাতটি দেশেই নামটির গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। অনেক ভেবে-চিন্তে অবশেষে মেয়েটির নাম রাখা হলো ‘মীনা’। কারণ, ভারত-বাংলাদেশ-শ্রীলংকায় এই ধরনের নাম (যেমন- মীনাক্ষী, মীনা কুমারি) খুব প্রচলিত। আবার, শোনা যায়, মীনা নামটির সাথে ‘আমিনা’ নামের কিছুটা সাযুজ্য থাকায় মুসলিম দেশগুলোও, বিশেষত পাকিস্তান, এই নামে আপত্তি করেনি। অবশেষে সব দেশের অনুমোদন সাপেক্ষে চূড়ান্ত হয় ‘মীনা’ নামটি। উল্লেখ্য, সিন্ধী ভাষায় ‘মীনা’ শব্দটির অর্থ ‘আলো’।

মীনা, রাজু ও মিঠু; Image Source: somewhereinblog.net

১৯৯৮ সালে মীনা কার্টুন নিয়ে ভিয়েতনামে প্রচারণা শুরু হয়। ভিয়েতনামি মূল ভাষা এবং আরো ৮টি স্থানীয় ভাষায় ভাষান্তর করা হয় মীনা কার্টুন। মজার কথা হচ্ছে, সেখানে কিন্তু মীনার নাম বদলে রাখা হয় ‘Mai’, যাতে করে নামটা স্থানীয় প্রচলিত নামের মতোই শোনায়!

মিঠু

কার্টুনটিকে একটু মজার, একটু রসাত্মক করে তুলবার জন্যই কোনো একটি প্রাণীর চরিত্র রাখার কথা বিবেচনা করা হয়। আর হাস্যরস সৃষ্টির ব্যাপারে যে বানরের কোনো বিকল্প নেই, তা তো সর্বজনবিদিত। এজন্য প্রস্তাব করা হয়, মীনা কার্টুনে মীনার পছন্দের পোষা প্রাণী হিসেবে থাকবে একটি বানর।

প্রস্তাবটি সব দেশে গ্রহণযোগ্য হলো, তবে বাধ সাধলো শ্রীলংকা। তারা বললো, বানরকে কৌতুক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না, কারণ, শ্রীলংকায় বানরকে ধর্মীয়ভাবে অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানীয় বিবেচনা করা হয়। এ অবস্থায় ভারত প্রস্তাব দিলো, এই পোষা প্রাণী হিসেবে তোতাপাখি ব্যবহৃত হতে পারে। প্রস্তাবটি সব দেশ বিনা ভেটোতে মেনে নিলো। আর ইউনিসেফের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরাও প্রস্তাবটি খুবই পছন্দ করলেন। কারণ, তোতা ব্যবহার করলে কার্টুনটি আরো চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠবে। কেননা, তোতার মুখে বিভিন্ন মজার মজার সংলাপ বসিয়ে দেওয়া যাবে! এ তো বানরের চেয়েও ভাল হলো। কারণ, বানর তো আর কথা বলতে পারে না। এভাবেই আমাদের সবার প্রিয় সেই টিয়াপাখি মানে মিঠু চরিত্রের সৃষ্টি।  

‘মীনা’ চরিত্রের সার্বজনীনতা

এক ‘মীনা’ যেহেতু পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে প্রতিনিধিত্ব করবে, তাই মীনার গড়ন এবং বসন-ভূষণ এমন হতে হবে যেন প্রত্যেক দেশের সাথেই সেটা খাপ খেয়ে যায়। সেটা করা অতটা সোজা ছিলো না। এজন্য ‘মীনা ইনিশিয়েটিভ’ এর তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক র‍্যাচেল কার্নেগি উপমহাদেশের কোনো চিত্রশিল্পীকে খুঁজছিলেন, যিনি নিজ অঞ্চলের মানুষদের জীবনাচরণের ভিন্নতাকে মাথায় রেখে একটি সর্বজনগ্রাহ্য মীনার চরিত্র সৃষ্টি করবেন।

এ লক্ষ্যেই  ভারতের রাম মোহন বাবুর সাথে যোগাযোগ করা হয়। মীনার গেট-আপে একটি গ্রহণযোগ্যতা আনার জন্য রাম মোহন বাবু মীনার হরেক রকম স্কেচ আঁকতে থাকেন। কোনোটাতে মীনাকে সালওয়ার কামিজ, কোনোটাতে লেহেংগার (স্কার্ট) সাথে ব্লাউজ, শার্ট কিংবা ওড়না ইত্যাদি ছবি এঁকে তিনি মানুষের কাছে যেতেন এবং তাদের মতামত নিতেন। অবশেষে, মীনার লং-স্কার্টের পোশাকটিই চূড়ান্ত করা হয়। এতে অবশ্য পাকিস্তানের স্থানীয় পোশাকের ছাপ স্পষ্ট, তবে এতে অন্যরা আপত্তি করেনি। এভাবেই অনেক ভেবে-চিন্তে মীনা কার্টুন চরিত্রটিকে গড়ে তোলেন রাম মোহন বাবু।

অন্যান্য চরিত্রের পোশাক-পরিচ্ছদ

মীনা কার্টুন ছবিটিতে সার্বজনীনতা আনার জন্য অন্যান্য চরিত্রের বেশভূষার দিকেও পরিচালকদের বেশ নজর দিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে পুরুষদের পোশাক নিয়ে খুব একটা ঝামেলায় পড়তে হয়নি। কেবল একটা শার্ট আর একটা লুঙ্গি পরিয়ে দিয়েই কাজ চালানো গেছে। কেননা, এই সবগুলো দেশেই পুরুষদের পোশাক হিসেবে শার্ট-লুঙ্গি বেশ জনপ্রিয়।

কিন্তু বিপত্তি বাধলো নারী পোশাক নিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সংস্কৃতি খুব কাছাকাছি হলেও পোশাকে বেশ ভিন্নতা কিন্তু রয়েছে, বিশেষত মহিলাদের পোশাক। এই পোশাকগুলো যে কেবল বৈচিত্র্যময় তা-ই নয়, বরং একেক পোশাক দেখে আপনি একেক দেশকে চিহ্নিত করতে পারবেনও বটে। এটা প্রত্যেক জাতির নিকট খুব গৌরবের ব্যাপার বটে, কিন্তু এই বিষয়টিই মীনার পরিকল্পকদের গলদঘর্ম করে তোলে যে, কীভাবে মহিলাদেরকে উপস্থাপন করা যায়, যাতে করে কোনোভাবেই মহিলাটির কারণে তাকে কোনো বিশেষ দেশের নাগরিক বলে মনে হয়। কেননা, তাহলে ঐ চরিত্রটির কারণে কার্টুনটি বিশেষ কোনো একটি দেশে গ্রহণযোগ্যতা হারাতে পারে।

মহিলা চরিত্রকে যদি শাড়ি পরিহিতা দেখানো হয়, তবে বাংলাদেশ ও ভারতে বেশ ভালোই চালিয়ে দেয়া যাবে, কিন্তু পাকিস্তান এটা গ্রহণ না-ও করতে পারে। আবার, যদি মহিলা চরিত্রকে সালওয়ার-কামিজ পরানো হয়, তাহলে স্পষ্টতই বোঝা যাবে যে, কার্টুনটি বুঝি পাকিস্তানের। এত সব ঝামেলা এড়াতে কী করা হলো? সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে, মহিলা চরিত্রকে লং স্কার্ফ দ্বারা মাথা ঢাকিয়ে রাখা হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মহিলা চরিত্রকে, বিশেষত মীনার মাকে উপবিষ্ট হবার মতো করে রাখা হবে। এতে করে আদৌ মহিলা চরিত্রটি কী পরেছেন, সেটাই বোঝা যাবে না! এভাবেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মীনা কার্টুনের প্রতিটি চরিত্রকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলার কাজটি সম্পাদন করা হয়।

দেখুন, কীভাবে মীনার মাকে আড়াল করে তার পোশাকি পরিচয়ের সমস্যাটি নিরসন করা হয়েছে;
Image Source: ru-clip.net

মীনা ও বাংলাদেশ

মীনা কার্টুন চরিত্রটি সৃজনে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা আছে। নিল ম্যাককী মূল ধারণাটি গড়ে তোলেন। আর বাংলাদেশ থেকে শিশির ভট্টাচার্য, রফিকুন নবী এবং মুস্তাফা মনোয়ার পরিকল্পনা প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন। শিশির ভট্টাচার্য এবং মুস্তাফা মনোয়ার এ কাজে ফিলিপাইনের ম্যানিলাতে অবস্থিত হান্না-বারবারা স্টুডিওতেও যান এবং মীনার স্বরূপ চিত্রায়নে কাজ করেন।

১৯৯২ সালে মীনার প্রথম পর্বটিও কিন্তু বাংলায় ডাব করে প্রথম বিটিভিতে প্রদর্শন করা হয়।

স্টুডিও

বিখ্যাত হান্না-বারবারা স্টুডিওতে মীনার নির্মাণ কাজ শুরু হয়। হান্না-বারবারা খুবই প্রখ্যাত এনিমেশন ফিল্ম নির্মাণের জন্য। এখানে, টম এন্ড জেরিসহ আরো অনেক অনেক ভুবনজয়ী কার্টুনও নির্মিত হয়েছে। এনিমেশন ফিল্ম নির্মাণের জন্য এটি একটি পরীক্ষিত স্টুডিও। এখানেই মীনার প্রথম দিককার বেশ কিছু পর্ব নির্মিত হয়।

বিখ্যাত হান্না-বারবারা স্টুডিও; Image Source: Wikimedia Commons

পরে ভারতের রাম মোহন স্টুডিওতে মীনার বাকি পর্বগুলো নির্মাণ করা হয়। সিরিজগুলো পরিচালনা করেন রাম মোহন নিজে।

মীনা কার্টুন নির্মাণে আর্থিক সহায়তা করে ডেনমার্ক। এখনকার পর্বগুলোতে জাপান, নরওয়ে, ব্রিটেন, আমেরিকা, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ড প্রভৃতি দেশেরও সহযোগিতাও রয়েছে।

মীনার প্রথম অন-এয়ার

অবশেষে মীনা কার্টুনের প্রথম পর্বটি নির্মাণ সমাপ্ত হয়। এর পাণ্ডুলিপি নির্মাণ করেন র‍্যাচেল কার্নেগি। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে সর্বপ্রথম মীনা কার্টুন সম্প্রচার করা হয়। বিটিভি সহ সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত হয় মীনা কার্টুন।

প্রথম পর্বটি ছি- ‘সব মুরগী আছে।‘ প্রথম পর্ব দিয়েই মীনা জয় করে নিলো দর্শক হৃদয়। সবাই দেখলো- মীনা খুব হাসিখুশি একটা মেয়ে, যে কি না স্কুলে যেতে চায়, লেখাপড়া শিখতে চায়। গ্রামের সবার মঙ্গল করতেই সে খুব উদ্যমী। সে ঘরের কাজের পাশাপাশি পড়ালেখাও করে।

বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত মীনার প্রথম পর্ব; Image Source: Google

কেবল মীনা নয়, মীনার ভাই রাজু, মীনার বাবা-মা, মিঠু সবাইকে দর্শক বেশ আপনজন হিসেবে গ্রহণ করে নিলো। পরের পর্বগুলোতে মীনার দাদি, মীনার ফুফু, দোকানদার, প্রতিবেশী রিতা, দুষ্ট ছেলে দিপু প্রমুখ চরিত্রগুলোও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

মীনা কার্টুনের থিম সং

শুরুতেই বলছিলাম মীনা কার্টুনের থিম সং নিয়ে। সেই যে বিখ্যাত ‘আমি বাবা মায়ের শত আদরের মেয়ে…’  

অসম্ভব সুন্দর এই গানটি রচনা করেছেন প্রখ্যাত সঙ্গীতকার আরশাদ মাহমুদ  এবং ফারুক কায়সার। আর গানে মিষ্টি কণ্ঠটি দিয়েছেন সুষমা শ্রেষ্ঠা, যিনি সেই সত্তরের দশকের শুরু থেকে বিগত দশক পর্যন্ত দর্শক শ্রোতাদেরকে অসংখ্য কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন। গানটি পাকিস্তানে রচনা ও রেকর্ড করা হয়। [২]

প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সুষমা শ্রেষ্ঠা; Image Source: Wikimedia Commons

সুষমা শ্রেষ্ঠা একজন প্লে-ব্যাক সঙ্গীতশিল্পী। তিনি শিশুদের গানও করে থাকেন। টিনা সানিও গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন। চমৎকার বাণীসমৃদ্ধ সেই গানটি (বাংলা সংস্করণ) শুনে নিতে পারেন আরেকবার এখান থেকে।

বাংলার পাশাপাশি হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি সংস্করণেও গানটি ইউটিউবে আছে। বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি সংস্করণ শুনতে পারেন এখান থেকে।

ইংরেজি ও হিন্দি সংস্করণের সাথে বাংলা সংস্করণে গানটির কিছুটা ব্যতিক্রম আছে, বাংলায় গানটি মীনার আত্মবচনে বর্ণিত হয়েছে। গানের বাণীর দিকে তাকালে দেখা যাবে কত চমৎকারভাবে একটি মেয়ে শিশুকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আকুল প্রার্থনা উচ্চারিত হচ্ছে।

মীনার কণ্ঠ

মীনা কার্টুনের মীনার অবয়বের মতো ওর কণ্ঠস্বরও দারুণ জনপ্রিয় ও চির-পরিচিত হয়ে উঠেছে। প্রথম দিককার পর্বগুলোতে মীনার কণ্ঠ প্রদান করেছেন ভারতের রাজশ্রী নাথ। তিনি নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী এবং হিন্দি ভাষায় ডাবিং করা হ্যারি পটার সহ বিভিন্ন ছবিতে কণ্ঠ দিয়েছেন। আর মিঠুর কণ্ঠটি দিয়েছেন চেতন শশীতল। সাম্প্রতিক পর্বগুলোতে অন্যরা কণ্ঠ দিচ্ছেন।

এখন বাংলাদেশে নির্মিত বাংলা মীনা কার্টুনে মীনার কণ্ঠটি দিচ্ছেন প্রমিতা গাঙ্গুলি

বর্তমান বাংলা সংস্করণে মীনার কণ্ঠ দিচ্ছেন প্রমিতা গাঙ্গুলি; Image Source: prothomalo.com

ফারজানা ইসলাম তিথির কণ্ঠেও শোনা যায় মীনার কণ্ঠটি। রাজুর কণ্ঠটি এখন দিচ্ছে আবরার সাজিদ পাশা।

রাজুর কণ্ঠ দিচ্ছে সাজিদ; Image Source: prothomalo.com

তবে কোনো কোনো পর্বে রাজুর কণ্ঠদাতা হিসেবে সাকিবের নামটিও দেখা যায় পর্বের শেষে। আর আমাদের সবার প্রিয় মিঠুর কণ্ঠটি বাংলাদেশ থেকে দিয়ে থাকেন কামাল আহসান বিপুল।

দেশে দেশে মীনা

মীনা কার্টুন শুধু বাংলা ভাষায় তৈরি হয়নি। হিন্দি, উর্দু, নেপালি, ইংরেজিসহ কমপক্ষে ২৯টি ভাষায় মীনা তৈরি হয়েছে। আরবিতেও মীনা কার্টুন ডাবিং করা হয়েছিলো। প্রথমে মীনার ১৩টি পর্ব বানানো হয়েছিল। প্রচার করা হয় সার্কভুক্ত সাতটি দেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে। এখন মীনার ৩৭টি পর্ব রয়েছে। মীনার কার্টুন ছবি নিয়ে ২৩টি কমিক বইও বের হয়েছে। এসব বই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ের ওপর টেলিভিশন ও বেতারের জন্য স্পট তৈরি করা হয়।

কার্টুন ছাপিয়ে মীনা

ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভের পর মীনা কেবল একটু কার্টুন চরিত্র হয়েই থাকেনি। বরং মীনা চরিত্র নিয়ে সৃজিত হয়েছে বই, কমিক্স। মীনাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে পালাগান, বাউলগান, মীনার পাপেট শো, রেডিও জিঙ্গেল, গান, নাটিকা প্রভৃতি। মীনার ছবি-সংবলিত টি-শার্ট, মগ, বাসন, শুভেচ্ছা কার্ড, মীনা ও মিঠুর পুতুল, স্টিকার প্রভৃতি বানানো হয়।

মীনা পুরস্কার

ইউনিসেফ বাংলাদেশ ২০০৫ সাল থেকে শিশুদের নিয়ে বা শিশুদের জন্য নির্মিত বিনোদনমূলক, সংবাদভিত্তিক ও জীবনধর্মী প্রতিবেদন, প্রকাশনা ও অনুষ্ঠানের জন্য মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড দিয়ে আসছে। পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় নগদ টাকা, ক্রেস্ট ও সনদ। প্রথম পুরস্কার ৫০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় পুরস্কার ২৫ হাজার টাকা ও তৃতীয় পুরস্কার হিসেবে ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

মীনা দিবস

মীনার তুমুল জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করে সার্কভুক্ত দেশগুলো ১৯৯৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরকে মীনা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। সেই থেকে প্রতিবছর সাড়ম্বরে দিনটি উদযাপিত হয়ে আসছে। এ বছর মীনা দিবসের ২০ বছর পূর্তি হলো।

মীনার জনপ্রিয়তা

১৯৯৩ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ১১ বছর ধরে বাংলাদেশ বিমান তাদের ফ্লাইটের অভ্যন্তরীণ বিনোদন কর্মসূচিতে মীনা কার্টুন অন্তর্ভুক্ত করে। প্রতিটি ফ্লাইটে মীনা কার্টুন প্রদর্শিত হতো।

এছাড়া ঢাকা শহরের জায়গায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বিলবোর্ডে স্থান পেয়েছে মীনা। বিভাগীয় শহরগুলোর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে মীনার ১১টি দেয়ালচিত্র।

মীনা কার্টুন যে এদেশের আপামর জন সাধারণের কাছে কতটা প্রিয় হয়ে উঠেছে, তা বোঝা যায় রিকশাচিত্র থেকে। ঢাকা শহরের বহু রিকশামালিক তাঁদের রিকশার পেছনে চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাদের পাশাপাশি মীনার চরিত্রটি এঁকেছেন, যা প্রমাণ করে, মীনা কতটা জনপ্রিয়!

ডিজিটাল মীনা

ইউনিসেফের ৭০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে গত বছর, ২০১৭ সালের মার্চে বিবিসির সহযোগিতায় চালু করে ‘মীনা গেইম’ নামে একটি বিনামূল্য মোবাইল অ্যাপ। প্লে-স্টোর থেকে চাইলে সহজেই আপনি নামিয়ে নিতে পারেন এই শিক্ষামূলক মজার অ্যাপটি

মীনা গেইম; Image Source: Google Play Store

উল্লেখ্য, এর সাথে মীনার একটি নতুন পর্বও প্রকাশ করা হয়, ‘আমরা খেলতে চাই।’

মীনার সফলতা

মীনার সফলতা নিয়ে ইউনিসেফ এবং সংশ্লিষ্টরা সন্তুষ্ট। কেননা, যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই কার্টুনের অভিযাত্রা শুরু করা হয়েছিল, তা অনেকটাই সফল হয়েছে। মীনা কার্টুন প্রদর্শনের পর থেকে সংসারে ও সমাজে মেয়ে শিশুদের মূল্যায়ন করা শুরু প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে সবখানে। ‘মীনা কি স্কুল ছেড়ে দেবে?’ পর্বটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই মেয়ে শিশুদেরকে স্কুলে পাঠাবার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছেন। এছাড়া, মীনার তিনটি ইচ্ছে, যৌতুক বন্ধ কর, মীনা ও দুষ্টু ছেলে প্রভৃতি পর্বের মধ্য দিয়ে যে সামাজিক সচেতনতা শিক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায় ছিলো, তা অনেকটাই পূরণ হয়েছে।

মীনার ভবিষ্যত অগ্রযাত্রা

প্রায় ৩ দশকেরও বেশি সময় ধরে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে মীনা। তবে, আক্ষেপের সাথে বলতেই হয়, এখনকার মীনা কার্টুনের নতুন নতুন পর্বগুলোতে মান কিছুটা অবনমিত হয়েছে। এখনকার পর্বগুলোর কোনো কোনোটিতে মনে হয়, এখানে কোনো গল্প গাঁথা হয়নি। বরং স্ক্রিপ্ট দেখে মনে হয় একগাদা নৈতিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেবার উদ্দেশ্যেই কাহিনী বিন্যাস করা হয়েছে। প্রমথ চৌধুরীর মতের সাথে মিলিয়ে বলা যায়, মীনা কার্টুন যেন মুখ্যত ‘ট্রেইনিং টুল’ বা ‘এথিক্যাল টুল’ না হয়। এতে বরং হীতে বিপরীত হতে পারে। বরং আনন্দঘন পরিবেশের মাধ্যমেই এটি শিক্ষণীয় ও উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে।

মীনা কার্টুনের শিশুতোষ নস্টালজিয়া থেকে বের হয়ে এবার সমাপ্তি টানতেই হয়। নব্বইয়ের দশকের এই মীনার বয়স এখন রজত জয়ন্তী পেরিয়েছে। তবুও সেই ছোট্টটি হয়েই আমাদের মনে মিশে আছে মীনা, রাজু ও মিঠু। একইসাথে আনন্দদায়ক এবং শিক্ষামূলক কার্টুন সত্যিই বিরল। বিশেষত বর্তমানের কুরুচিপূর্ণ বেশ কিছু কার্টুনের তুলনায় প্রায় ৩ দশক আগের এই কার্টুনের মান ও মনন অনেক অনেক উন্নত।

This article is in Bangla language. It describes the story of how Meena cartoon came into being and the after effects in society. Necessary references have been hyperlinked.

Feature Image: youtube.com

Reference Books

1. Entertainment-Education and Social Change: History, Research, and Practice; Chapter 18: Cartoons and Comic books for changing Norms: Meena, The South Asian Girl; by Neil McKee et el.

2. Evaluation of the Meena Communication Initiative; UNICEF Regional Office for South Asia, Kathmandu; by Paul Chesterton, Australian Catholic University

Related Articles