Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ম্যাক্সিমিলিয়ান রোবস্পিয়ার: সন্ত্রাসবাদী, ফরাসি বিপ্লবী ও বিপ্লবের নির্মম বলি

রাষ্ট্রে শাসকগোষ্ঠীর অবহেলা ও উন্নাসিকতার জন্য শাসক ও শাসিতের সামাজিক পার্থক্য আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে। পার্থক্য তৈরি হয় জীবনযাত্রার মানে, প্রাপ্য মর্যাদায়, প্রাপ্য অমানবিক বৈষম্যে, নিষ্করুণ বঞ্চনায় আর সহায়হীনের অমোচনীয় লাঞ্ছনায়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবার উপক্রম হলে সময়ে সময়ে নিপীড়িত মানুষ বঞ্চনার প্রতিশোধ নিতে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। ইতিহাসে দেখা যায়, এমন পরিস্থিতি প্রায়শই বিপ্লবের জন্ম দেয়। সেজন্য বিপ্লব স্বাভাবিকভাবেই অভিজাত শ্রেণীর জন্য ভীতিকর।

তবে পুঞ্জিভূত গণক্ষোভ থেকে বিপ্লবের জন্ম হয় বলে এর স্বভাবজাত হিংস্রতা কম নয়। এজন্য বলা হয়, বিপ্লব জন্মগ্রহণ করলে তা সবার আগে নিজের অভিভাবক ও সন্তানের রক্তপাত করতেও কুণ্ঠিত হয় না। ১৭৮৯ সালের বিশ্ববিশ্রুত ফরাসি বিপ্লব তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কথিত আছে, আধুনিক পৃথিবীতে বিপ্লব ও জনবিক্ষোভের জন্মলগ্নের সব দোষ-গুণের অন্যতম উৎস ফরাসি বিপ্লব। বিপ্লব কীভাবে নিজের জনকের প্রাণঘাতী হয়, তার বিশিষ্ট উদাহরণ ম্যাক্সিমিলিয়ান রোবস্পিয়ার। যতদিন মানুষ ফরাসি বিপ্লবের কথা স্মরণ করবে, ম্যাক্সিমিলিয়ান রোবস্পিয়ারের নাম নিঃসন্দেহে প্রাসঙ্গিক হিসেবে এর সাথে আসবেই।

ম্যাক্সিমিলিয়ান রোবস্পিয়ার
ম্যাক্সিমিলিয়ান রোবস্পিয়ার; Image Source: newrepublic.com

ম্যাক্সিমিলিয়ান রোবস্পিয়ারকে ফরাসি বিপ্লবে রাজার পতনের পর তৈরি হওয়া ‘রেইন অব টেরর’ বা সন্ত্রাসের শাসনের মাস্টারমাইন্ড বলা হয়। সে থেকেই ‘টেরর’ শব্দটি অভিধানে স্থান তৈরি করে নেয়। এসময় প্রতিপক্ষ শক্তিকে গণহারে গিলোটিনে মৃত্যুদন্ড দেওয়া নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এটাই যে, সেই ঘটনা পরিক্রমা আগ্রাসী হতে হতে শেষ অবধি নিজের মাস্টারমাইন্ড রোবস্পিয়ারকেই গিলোটিনে নিষ্ঠুরভাবে ঠেলে দেয়।

ম্যাক্সিমিলিয়ান রোবস্পিয়ার ১৭৫৮ সালের ৬ মে ফ্রান্সের আরাস নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি জ্ঞানপিপাসু ছিলেন। ভালো ছাত্র হবার সুবাদে বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলেন। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি আইনে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ধ্রুপদী রোমান সাহিত্য ও দর্শন দ্বারা তিনি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। এছাড়া জ্যাঁ জাক রুশোর লেখা তাকে আকর্ষণ করত।

১৭৮৯ সালে আরাসের এস্টেট জেনারেলের কার্যালয়ে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। এই এস্টেট পরে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি নামে আত্মপ্রকাশ করে। সে বছর ছিলো ফরাসি বিপ্লবের প্রথম স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠার সময়। সেসময় বিপ্লবের প্রকাশ্য অথবা গোপন সমর্থকরা উগ্র বামপন্থী, মধ্যপন্থী ও ডানপন্থী মতবাদের অংশীদারে বিভক্ত ছিলেন। রোবস্পিয়ার বিপ্লবী সংগঠনের সাথে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। সাধারণ মানুষের অধিকারের প্রবক্তা ও দৃঢ় নাগরিক নৈতিকতার কারণে তিনি ক্রমশ ‘দ্য ইনকরাপ্টিবল’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। ১৭৯০ সালে ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম সংগঠন জ্যাকোবিন ক্লাবের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।

১৭৯০ সালের ১৯ মে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি শাসনকার্যে অভিজাতদের অংশগ্রহণ বিলোপ করার ঘোষণা দেয়। বোঝা যাচ্ছিলো যে, বড় আকারের কোনো আমূল রক্তক্ষয়ী পরিবর্তনের জন্য ফ্রান্সের প্রস্তুতি চলছিলো। রোবস্পিয়ার অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে দাবি তোলেন যে, জনসাধারণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুইকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। এই বক্তব্যের ফলে তিনি অনেক ক্ষমতাবান শত্রুপক্ষের জন্ম দেন। তবে প্যারিসের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ক্রমাগত বেড়ে চলছিলো।

১৭৯১ সাল ফরাসি বিপ্লবের আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ বছর পোপ ষষ্ঠ পায়াস বিপ্লব ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ডিক্রি দেন। একই বছরের ২৭ আগস্ট অস্ট্রিয়া ও প্রুশিয়ান সাম্রাজ্য ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের পক্ষে বলিষ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করে। সহজেই বোঝা যাচ্ছিলো, চলমান পরিস্থিতি শুধু ফ্রান্স নয়, সমগ্র ইউরোপের রাজন্যবর্গ ও অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করতে শুধু সফলই হয়নি, রীতিমতো তার ভিত কাঁপিয়ে দেবার মত সঙ্গিন পরিস্থিতি তৈরি করেছিলো। একই বছর রোবস্পিয়ারের জীবনেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। এসময় তিনি লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি থেকে পদত্যাগ করেন এবং জ্যাকোবিন ক্লাবের সদস্য হিসেবে আরো বেশি সক্রিয় হতে শুরু করেন।

১৭৯২ সালের ২০ এপ্রিল ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে উদার মধ্যপন্থী সংগঠন ‘গিরোন্ডিন’ এর নেতারা এতে সমর্থন দেন। রোবস্পিয়ার এ যুদ্ধের বিরোধিতা করায় অনেকের রোষানলে পড়েছিলেন। উল্লেখ্য, ১৭৯২ সালেই প্রথমবারের মতো গিলোটিনে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। এ বছরই ১০ আগস্ট বিক্ষুব্ধ জনতার আক্রমণে টুইলারিস প্রাসাদ বিধ্বস্ত হয়। ফরাসি রাজতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ও ইতিহাস বিখ্যাত ‘ফ্রেঞ্চ রিপাবলিক’ ঘোষণার মাধ্যমে বিপ্লবের সফলতা ঘোষিত হয়।

টুইলারিস প্রাসাদে আক্রমণ
টুইলারিস প্রাসাদে আক্রমণ; Image Source: alphahistory.com

রাজতন্ত্রের পতনের পর ইন্সারেকশনারি প্যারিস কমিউন গঠিত হলে রোবস্পিয়ার এর সদস্য নির্বাচিত হন। নব্য প্রজাতন্ত্রের প্যারিস ডেলিগেশন টু নিউ ন্যাশনাল কনভেনশনের প্রধান নিযুক্ত হন।

নবগঠিত ন্যাশনাল কনভেনশনে তার আগমনের মাধ্যমে ‘গিরোন্ডিন’ সদস্যদের বিপরীতে জ্যাকোবিনদের শক্তি বৃদ্ধি পায়। তার শক্ত অনড় অবস্থানের কারণেই হতভাগ্য রাজা ষোড়শ লুইয়ের মৃত্যুদন্ড প্রদানের পথ সুগম হয়। ১৭৯৩ সালে সামরিক পরাজয় ও তীব্র খাদ্যাভাবের জন্য রাজতন্ত্রবিরোধী গণজাগরণের ডাক দেন। এই ঘোষণা তাকে গিরোন্ডিন সদস্যদের ক্ষমতাহীন করতে সাহায্য করে। এ বছরই ষোড়শ লুই ও মারিয়ে এন্তোনেত্তের মৃত্যুদন্ড গিলোটিনের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়।

গিলোটিনে ষোড়শ লুই এর মৃত্যুদন্ড
গিলোটিনে ষোড়শ লুইয়ের মৃত্যুদন্ড; Image Source: historyhit.com

১৭৯৩ সালের ২৭ জুলাই রোবস্পিয়ার পাবলিক সেফটি কমিটির কার্যত প্রধান নির্বাচিত হন। এর কাজ ছিলো বৈদেশিক সম্পর্ক নির্বাহ এবং অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক শত্রুর বিরুদ্ধে দেশরক্ষা করা। তার নেতৃত্বে এই কমিটি ফরাসি সরকারের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এ সময় ফ্রান্সের প্রধান ঝুঁকি ছিলো গৃহযুদ্ধ ও বৈদেশিক আক্রমণ। এছাড়া জ্যাকোবিন ক্লাব ছাড়া বিপ্লবের সমর্থক অন্য গোষ্ঠীর প্রতিপক্ষতার ব্যাপারও উত্তেজনার কারণ ছিলো। ফলে বিপ্লবী সরকার সেপ্টেম্বরে লাগামহীন ‘রেইন অব টেরর’ এর ঘোষণা দেয়। ফলে এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বিপ্লব ও জনগণের শত্রুতার অভিযোগে ৩ লক্ষ লোককে গ্রেফতার করা হয়। কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষ জেল হাজতে মৃত্যুবরণ করে, প্রায় ১৭ হাজার মানুষকে গিলোটিনে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এই নিষ্ঠুর অবস্থানের মাধ্যমে রোবস্পিয়ার তার প্রতিপক্ষকে শক্ত হাতে দমন করেন।

১৭৯৪ সালের ১০ জুন আদালতে দোষীপক্ষের আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার বাতিল করে আইন পাশ করা হয়। এক মাসের মধ্যে বিপ্লবের শত্রু হিসেবে আরো ১৭০০ লোককে গিলোটিনে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। বিপ্লব পরবর্তী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি জানান দিচ্ছিলো যে, বিপ্লব পরবর্তী রক্তক্ষয় কখনও একতরফা হয় না- সমর্থক প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোও এর নির্দয় পরিণাম ভোগ করে, অথবা করতে বাধ্য হয়।

'রেইন অব টেরর' চলাকালের নিষ্ঠুরতা
‘রেইন অব টেরর’ চলাকালের নিষ্ঠুরতা; Image Source: alamy.com

এমন দুরবস্থায় রোবস্পিয়ার ও তার অনুসারীদের সন্ত্রাস প্রতিরোধ করতে তার প্রতিপক্ষ গিরোন্ডিন ও অন্যান্য গোষ্ঠী একজোট হয়। ১৭৯৪ সালের ২৭ জুলাই নাটকীয়ভাবে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি রোবস্পিয়ার ও তার প্রধান সমর্থকদের গ্রেফতারির অধীনে নিয়ে আসে। প্যারিসের লুক্সেমবার্গ কারাগারে তাকে নিয়ে আসা হয়। কারাগারের পরিচালক তার অনুরাগী ছিলেন, তার সাহায্য নিয়ে তিনি পালাতে সক্ষম হন। তার বেশ কয়েকজন সশস্ত্র সমর্থক তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু রোবস্পিয়ার এসময় বেশ বুঝতে পারছিলেন যে, তার নিষ্ঠুরতা প্রতিপক্ষের অনড় অবস্থান গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। পাল্টা কিছু করার চেষ্টা পতনের পথ আরো পিচ্ছিল করা ছাড়া আর কিছুই করবে না।

ন্যাশনাল কনভেনশন তার অবস্থান ও কার্যকলাপ অবৈধ ঘোষণা করে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেয়। এ সময় তিনি আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। কিছু পরেই ন্যাশনাল কনভেনশন সশস্ত্র প্রহরী পাঠিয়ে রোবস্পিয়ার ও তার অনুসারীদের আটক করে।

দিনটি ছিলো ১৭৯৪ সালের ২৮ জুলাই। বিকেলে ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম নায়ক ম্যাক্সিমিলিয়ান রোবস্পিয়ার ও তার ২১ সহকর্মীকে বিনা বিচারে গিলোটিনে শিরোশ্ছেদ করা হয়। আরো কিছুদিন পরে তার আরো ৮২ অনুসারীকে একইভাবে প্রাণদন্ড দেওয়া হয়। সমাপ্ত হয় কুখ্যাত ‘রেইন অব টেরর’ এর শ্বাসরুদ্ধকর সময়। পাবলিক সেফটি কমিটিকে ক্ষমতাহীন করা হয়। ফরাসি বিপ্লবের চরমপন্থা ও চরমপন্থীদের দুঃসময়ের সমাপ্তি ঘটে।

গিলোটিনে রোবস্পিয়ারের মৃত্যুদন্ড কার্যকরের দৃশ্য
গিলোটিনে রোবস্পিয়ারের মৃত্যুদন্ড কার্যকরের দৃশ্য; Image Source: rezonville.com

ম্যাক্সিমিলিয়ান রোবস্পিয়ারকে এখন অনেকে হিটলার, মুসোলিনি, স্টালিন ও পল পটের মতো একনায়কের পূর্বপুরুষ মনে করেন। রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি অভিজাত ও রাজতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন। ষোড়শ লুইয়ের রাজত্বের চোখ ধাঁধানো জৌলুস ও জনসাধারণের অনাহারে মৃত্যুর সমান্তরাল পরিক্রমা তার মন বিষিয়ে তুলেছিলো। এই তীব্র ঘৃণা তাকে চরমপন্থী রাজনীতির দিকে টেনে আনে। কথায় বলে, কারও মন্দ কৃতকর্মের জন্য মাত্রাতিরিক্ত ঘৃণা করা উচিত নয়। কেননা, তাতে ঘৃণার শিকার ও ঘৃণাকারী অনেক সময় এক সারিতে এসে পড়তে পারে। অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সে এমনই এক বিতর্কিত বিরাট ব্যক্তিত্ব ছিলেন ম্যাক্সিমিলিয়ান রোবস্পিয়ার। ইতিহাসবিদগণ এখনও তার বিপ্লব ও পরবর্তী প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করেন।

Maximilien Robespierre was a french revolutionary and mastermind of the 'reign of terror'. After the french Revolution, he took control over the government and ordered execution of many of his oposition men. He was executed by his rivalries. 

References: 

01. Biographie : éléments essentiels de sa vie - amis-robespierre.org

02. Maximilien Robespierre, Master of the Terror - people.loyno.edu

03. Why Robespierre Chose Terror - City Journal

04. Robespierre overthrown in France - History

Related Articles