মুসলিম জাহানের গৌরব আন্দালুসিয়া সময়ের ঘূর্ণাবর্তে কবেই হারিয়ে গেছে। তবে আন্দালুসিয়ার গৌরবময় অতীতের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আধুনিক স্পেনের বুকে আজও দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক আলহামরা প্রাসাদ। আলহামরা আন্দালুসে মুসলিম শাসনের শেষ শতকের স্থাপত্যরীতি ও সংস্কৃতির অনন্য নিদর্শন।
এটি সেই সময়ের মুরিশ স্থপতিদের পরিশ্রম ও মেধার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে গত কয়েক শতাব্দী ধরে। স্পেনের গ্রানাডায় অবস্থিত এই মধ্যযুগীয় স্থাপত্যটি পরিকল্পিত নির্মাণ, জটিল ও কারুকার্যময় সাজসজ্জা, মনোমুগ্ধকর সব বাগান ও ঝর্ণার জন্য বিখ্যাত। আলহামরার সৌন্দর্য্যের প্রশংসা করতে গিয়ে মুরিশ কবিরা বলেছেন, ‘পান্নায় খচিত মুক্তা’।
চারপাশের ঘন সবুজ বনের মাঝে চোখধাঁধানো প্রাসাদের অবস্থানের কারণে এমন বিচিত্র উপমায় ভূষিত হয়েছে আলহামরা। আজকের লেখায় আলোচিত হবে আলহামরার ইতিহাস, স্থাপত্যশৈলী, নামকরণসহ নানা দিক।
অবস্থান
গ্রানাডা শহরের পশ্চিমে সাবিক পাহাড়ের উপরে দুর্লভ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানে অবস্থিত দৃষ্টিনন্দন আলহামরা প্রাসাদ। প্রাসাদের বাঁ দিক দিয়ে বয়ে গেছে দারো নদী। আলহামরা নির্মাণের সময় জায়গা নির্বাচন করা হয়েছে খুবই চাতুর্যের সঙ্গে, যেন আলহামরা থেকে মুরদের পুরনো শহর আলবাইজিন এবং তার সামনের ঢালু তৃণভূমি দেখা যায়।
তাই আলহামরা থেকে গ্রানাডা শহরের অসাধারণ দৃশ্য চোখে পড়ে।
ইতিহাস
ঐতিহাসিক বর্ণনায় প্রথম আলহামরার নাম পাওয়া যায় নবম শতাব্দীতে। আজ যেখানে আলহামরা অবস্থিত, নবম শতাব্দীতে সেখানে ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত এক রোমান দুর্গ। ৮৮৯ সালে সাওয়ার ইবন হামদুন নামের ব্যক্তি সেই দুর্গে আশ্রয় নেন। পরে তিনি দুর্গটি পুনর্নির্মাণ করেন যেন কর্ডোভার খেলাফতকে গুঁড়িয়ে দিয়ে আবার গৃহযুদ্ধে লড়তে পারেন। তারপর জায়গাটি বিস্তৃত হতে থাকে এবং এখানকার লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে।
কারণ ততদিনে জিরি রাজবংশের শাসকরা আলবাইজিন নামের একটি শহরের নির্মাণ শুরু করেন। আলহামরা আর দশটা দুর্গের মতোই ছিল, যতদিন না নাসিরিদ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ বিন আল হামার এখানে আসেন। তিনি এখানে রাজকীয় বাসভবন নির্মাণ করেন। আর তখন থেকেই আলহামরার সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময়ের সূচনা ঘটে।
তার সময়ে দুর্গের পুরনো অংশে ওয়াচ টাওয়ার ও কিপ নির্মাণ করা হয়। দারো নদী থেকে খাল কেটে পানি নিয়ে এসে প্রাসাদের বাগানের নিজস্ব সেচব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। তারপর অন্যান্য দুর্গ ও স্টোররুম তৈরি করা হয়। তবে আজকের যে আলহামরা আমরা দেখতে পাই সেটা নির্মাণের কৃতিত্ব সুলতান প্রথম ইউসুফ ও পঞ্চম মুহাম্মাদের।
তারা শহরটিকে আরো বিস্তৃত করেন। অনেক মসজিদ ও হাম্মামখানা নির্মাণ করেন। আলহামরার অতুলনীয় ও জমকালো অভ্যন্তরীণ সজ্জা তাদের হাত ধরেই এসেছিল। ১৪৯২ সালে গ্রানাডার পতনের পর আলহামরা ব্যবহৃত হতো রাজা ফার্ডিন্যান্ড ও রানী ইসাবেলার রাজসভা হিসেবে। তাদের বিজয়ের পর আলহামরার কিছু নকশা চুনকাম করে ঢেকে ফেলা হয়, কিছু নষ্ট করে ফেলা হয়।
রাজা প্রথম চার্লস আলহামরার শীতকালীন প্রাসাদের অনেকটা অংশ ভেঙে সেখানে রেনেসাঁর স্টাইলে নিজের দুর্গ নির্মাণ করেন। এরপর মুরিশ শিল্পের ধ্বংসসাধন চলতে থাকে। ১৮১২ সালে এক যুদ্ধে ফরাসিরা টাওয়ারগুলো ধ্বসিয়ে দেয়। ১৮২১ সালে ভূমিকম্পেও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয় আলহামরার। এখন যেটুকু টিকে আছে সেটুকুকেই ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে। আলহামরা বর্তমানে স্পেনের অন্যতম সেরা পর্যটন আকর্ষণ।
নামকরণ
আলহামরা আরবি কালা’ত আলহামরার সংক্ষিপ্ত রুপ। এর অর্থ লাল দুর্গ। আলহামরার নাম কেন আলহামরা হলো সে সম্পর্কে তিনটি মতবাদ পাওয়া যায়।
এক. এর লাল রঙের দেয়ালের কারণে।
দুই. নাসিরিদ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ আলহামার এর নামানুসারে।
তিন. নাসিরিদ রাজবংশের অন্য নাম ছিল বানু আলহামার। এই নামানুসারেও আলহামরার নামকরণ করা হয়ে থাকতে পারে।
স্থাপত্যশৈলী
আলহামরার প্রাসাদগুলো স্থাপত্যশৈলী খুবই জটিল। অসংখ্য কলাম, তোরণ, ঝর্ণা, প্রবাহিত পানি এবং স্বচ্ছ পুকুরগুলো এর নান্দনিক সজ্জার জটিল স্থাপত্যশৈলীকে আরো জটিল করেছে। প্রাসাদগুলোর বাইরের দিকটা অবশ্য সাদামাটা রাখা হয়েছে। এমনভাবে আলহামরা ডিজাইন করা হয়েছে যেন ভেতরে প্রচুর আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে। প্রাসাদের ভেতরের দেয়ালগুলো মুরিশ কবি ইবন জামরাকের কবিতা খোদাই করে সাজানো হয়েছে। এছাড়া রয়েছে নানারকম জটিল জ্যামিতিক কারুকাজ এবং অ্যারাবেস্কের কাজ।
অ্যারাবেস্ক হচ্ছে কোনো পৃষ্ঠতলে পরস্পর জড়াজড়ি করে থাকা ফুলপাতার নকশা। ছন্দময় রৈখিক প্যাটার্নে পরস্পর আপতিত সরলরেখার কাজও অ্যারাবেস্কের মধ্যে পড়ে। আরো রয়েছে মুসলিম বিশ্বে ব্যবহৃত আলকাটাডো টাইলসের কাজ, গাণিতিক নকশা ল্যাসেরিয়ার কাজ, স্টাকো এবং ফোলিয়েট অর্নামেন্টসের কাজ। প্রাসাদের সিলিংয়ের সাজেও আছে বৈচিত্র্য। কাঠের তৈরি গম্বুজাকার সিলিং সাজানোর জন্য মাকার্নাসের নকশা।
আন্দালুসিয়ার এই নান্দনিক অভ্যন্তরীণ সজ্জা ছিল গ্রানাডার বিকাশমান আন্দালুসিয়ান শিল্পের অবদান। মুরিশ শিল্পীরা নতুন এই শিল্পের আবিষ্কারের উপাদান সংগ্রহ করেছেন বাইজেন্টাইন ও সমকালীন আব্বাসীয় খেলাফতের থেকে। কিছু কিছু নিজেরাও উদ্ভাবন করেছেন, যেমন- অলঙ্কৃত তোরণ এবং গম্বুজাকৃতির সিলিংয়ের কারুকাজ। গ্রানাডার শেষ সময়ে বিকশিত এই স্থাপত্যকৌশলের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে আজকের আধুনিক মুসলিম স্থাপত্যগুলোতে, বিশেষ করে মাগরেবে।
প্রধান প্রধান স্থাপনা
আলহামরায় ১৭৩০ মিটার দেয়ালে ঘেরা শহরের ভেতরে রয়েছে ত্রিশটি টাওয়ার আর চারটি সদর দরজা। এর মূলত তিনটি অংশ- প্রাসাদের নিরাপত্তা দানকারী রাজকীয় সেনাবাহিনীর বাসস্থান বা আলকাজাবা, শাসকের পরিবারের আবাস বা সিটাডেল, আর শহর বা মাদিনা। শহরে রাজসভার কর্মকর্তারা বাস করতো। আলহামরার সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনা তিনটি হলো কোমারিস প্যালেস, কোর্ট অব লায়ন ও পার্টাল প্যালেস। সবগুলোই চতুর্দশ শতাব্দীতে নির্মিত। এখন থাকছে এগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
কোমারেস প্যালেস
এল মেক্সুয়াসের পেছনে রয়েছে ঝর্ণা ও চত্বরে সমৃদ্ধ কোমারেস প্যালেসের সদর দরজা। এই সদর দরজাটি একটি উঁচু প্ল্যাটফর্মের উপর নির্মিত। সদর দরজাটি উন্মুক্ত হয়েছে একটি প্রাঙ্গনে, যেখানে রয়েছে বিশাল চত্বর এবং পুকুর। এই অংশটি কোর্ট অব মার্থিস নামে পরিচিত। এটিই কোমারিস প্যালেসের মূল কেন্দ্র।
আলহামরার সবচেয়ে বড় টাওয়ার হচ্ছে কোমারিস প্যালেস। এখানে রয়েছে সিংহাসন কক্ষ হল অব অ্যাম্বেসেডরস। এই কক্ষের অভ্যন্তরীন সজ্জা খুবই জাঁকালো। কক্ষে রয়েছে ধনুকাকৃতির জানালা। মেঝেতে রয়েছে স্টাকোর কাজ। দেয়ালে রয়েছে জ্যামিতিক নকশার কারুকাজ।
কোর্ট অব লায়ন
এটি কোমারিস প্রাসাদের ঠিক পরেই অবস্থিত। তবে এটি একটি আলাদা ভবন। গ্রানাডার পতনের পর দুটি প্রাসাদকে সংযুক্ত করা হয়। পঞ্চম মুহাম্মাদ কোর্ট অব লায়নকে দেখার মতো করেই বানিয়েছিলেন। জটিল পানিপ্রাবাহ ব্যবস্থা সম্বলিত মার্বেল বেসিনের ঝর্ণাটি অবস্থিত পাথরে খোদাই করা বারোটি সিংহের পেছনে।
এই চত্বরকে ঘিরে রেখেছে সরু কলাম। কোর্ট অব লায়নের পশ্চিম অংশে রয়েছে মাকার্নাস চেম্বার। এই চেম্বারের গম্বুজাকৃতির কারুকার্যখচিত সিলিং আলহামরার অন্যতম সেরা স্থাপত্য।
পার্টাল প্যালেস
এটি পোর্টিকো প্যালেস নামেও পরিচিত। এটি তৈরি হয়েছে ধনুকাকৃতির তোরণ দিয়ে। আরো রয়েছে বড় একটি পুকুর। এটি আলহামরার অন্যতম পুরনো ভবন।
জেনারালাইফ
নাসিরিদ শাসকরা নিজেদের শুধু প্রাসাদের চার দেয়ালের মাঝেই বন্দী রাখেননি। তাদের মনোরঞ্জনের জন্য ছিল মনোরম বাগান জেনারালাইফ।
জেনারালাইফ শব্দটি এসেছে আরবি ‘জান্নাত চল আরিফা’ থেকে। আরবিতে জান্নাত মানে স্বর্গ বা বাগান। নাসিরিদ সাম্রাজ্যের অন্যতম সুরক্ষিত এই স্থাপনায় রয়েছে নানারকম পানির প্রবাহ, ঝর্ণা এবং ফুল।
নাসিরিদরা এখানে লাগিয়েছিলেন গোলাপ, কমলালেবু এবং মার্থেল ফুল। কুরআনে বর্ণিত জান্নাতের কথা মাথায় রেখে এই বাগানটি তৈরি করা হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে “আর তার নিচে থাকবে প্রবাহিত ঝর্ণাধারাসমূহ।” ( সূরা বাকারা: আয়াত ২৫)। এর ভিত্তিতে স্থপতিরা চেষ্টা করেছেন আলহামরাকে পৃথিবীর বুকে ঝর্ণাসমৃদ্ধ একটি স্বর্গে রুপদান করতে।