আমাদের মস্তিষ্ক বড় অদ্ভুত। সে অনেক সময় নিজের মতো করে রিয়েলিটি বানায়
পরিচিত লাগছে? উপরের উক্তিটি চঞ্চল চৌধুরী অভিনীত দেবী চলচ্চিত্র থেকে নেয়া। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের কালজয়ী সৃষ্টি মিসির আলীর চরিত্রভিত্তিক ‘দেবী’ উপন্যাস অবলম্বনে বানানো হয়েছিল চলচ্চিত্রটি।
মিসির আলী ভুল বলেননি। আমাদের মস্তিষ্ক আসলেই অদ্ভুত। আর শুধু অদ্ভুত বললেও কম বলা হবে, তার কার্যবিধি বড়ই রহস্যময়। সর্বত্রই এর প্রমাণ লক্ষণীয়। যেমনটা আমরা দেখেছিলাম গত পর্বে; বিশেষত, একটি ছবিতে। যে ছবির মাঝ বরাবর আঙ্গুল ধরলে আঙ্গুলের দু’পাশে একই রঙ দেখা গেলেও আঙ্গুল সরিয়ে নেয়া মাত্রই তাদের রঙ ভিন্নভাবে পরিস্ফুটিত হয়। এর কারণ হচ্ছে, আগে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার আলোকে আমাদের মস্তিষ্ক যেকোনো নতুন ঘটনাকে মেলানোর চেষ্টা করে। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে সে উপরের পৃষ্ঠকে আলোতে দেখে একে উজ্জ্বল ধূসর হিসেবে ধরে নেয়। পক্ষান্তরে, নিচের পৃষ্ঠের সাথে একটি ছায়াকে সন্নিহিত দেখে সে ধরে নেয় এটি অনুজ্জ্বল সাদা রঙের, যেমনটা আমরা যেকোনো ছায়ার ক্ষেত্রেই দেখে আসি। এই দুটো অনুসিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে আমাদের মস্তিষ্ক দুটো রঙকে দু’ভাবে উপস্থাপন করে আমাদের কাছে, যদিও দুটোই আসলে সদৃশ। যে মুহূর্তে আমরা তাদের সংযোগস্থলকে আঙ্গুল দিয়ে ঢেকে মস্তিষ্ককে জানান দেই যে, এখানে পৃষ্ঠ দুটো নয়, একটি, তখনই তাকে আর সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের কঠিন সমীকরণের সম্মুখীন হতে হয় না।
কাজেই যেকোনো কিছু খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলে আমরা উপলব্ধি করতে পারবো যে, আমাদের মস্তিষ্ক খুব বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম নয়। সেখান থেকেই প্রশ্নটা আসে, আমরা আমাদের আশপাশ আসলে ঠিক কতটুকু মনোযোগ দিয়ে দেখি? বা মনোযোগ দিয়ে কোনো কিছু করা বিষয়টিই বা কী আসলে। এ প্রশ্নগুলোর উত্তরের জন্য এ পর্বে থাকছে ‘মনোযোগ’। শুরুতে একটা ছবি দেখে নেয়া যাক।
অনেক পাঠকই এটা আগেই দেখে থাকতে পারেন। যারা আগে দেখেননি, তাদের জন্য বলছি, ছবিতে বেশ কিছু শব্দ দেয়া আছে। এই শব্দগুলো টানা পড়ে যেতে হবে শব্দগুলোর রঙ অনুযায়ী, শব্দ অনুযায়ী নয়। চেষ্টা করে দেখুন।
কেমন করলেন? অনুশীলন না থাকলে প্রথমবারে এটি বেশ কষ্টসাধ্যই। এরকমটা হওয়ার কারণ আর কিছুই নয়, আমাদের মনোযোগ। একবারে একই সাথে দুটি ভিন্ন জিনিসের দিকে মনোযোগ দেয়া বেশ দুঃসাধ্য ব্যাপার। আমাদের মস্তিষ্কে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স আর প্যারাইটাল লোব নামে দু’প্রান্তে দুটো অংশ আছে। আমরা যখন আমাদের মনোযোগ একটি বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে নিয়ে যাই, মনোযোগ পরিবর্তনের এ কাজটি হয় এ দুটো অংশের সমন্বয়ের মাধ্যমেই। চর্চা না থাকলে এ সমন্বয়ের কাজটি খুব নিপুণতার সাথে করা হয়ে পড়ে দুরূহ। উৎসাহী পাঠকদের এ বিষয়ে আরও জানার ইচ্ছা থাকলে Stroop Effect লিখে অনুসন্ধান করতে পারেন।
যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও প্রায় ২ হাজার বছর আগে থেকে আজ অবধি আমরা চেষ্টা করে চলেছি আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন কাজের কার্যকারণ খুঁজে বের করতে, আমাদের বিভিন্ন কাজকর্মের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে। এই প্রচেষ্টা থেকে যে বিজ্ঞানের জন্ম, তার নাম নিউরোসায়েন্স। বর্তমানে বিজ্ঞানের এ শাখার অগ্রযাত্রা হচ্ছে দুরন্ত গতিতে। নিচের ভিডিও ক্লিপটি দেখলে তার কিছুটা আভাস পাওয়া যেতে পারে।
ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে। কথা হচ্ছিল মনোযোগ নিয়ে। একটু আগেই দেখিয়েছি, মনোযোগ কত প্রয়োজনীয় এবং একইসাথে এর নিয়ন্ত্রণ কত দুরূহ। এর মূলে রয়েছে আমাদের শারীরিক সীমাবদ্ধতা। উপরের Stroop Effect এর ছবিটাতে যেমন দেখা যাচ্ছে, পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের মনোযোগ সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়তে পারে। যদিও বলা হয়েছে শব্দের রঙ উচ্চারণ করতে, যেটি মোটেও কঠিন কোনো কাজ নয়। তারপরও প্রথম দর্শনেই সহজে বোধগম্য শব্দটির দিকেই ধাবিত হয় আমাদের মনোযোগ। নিউরোসায়েন্সের ভাষায় একে বলা হয় ‘বিভক্ত মনোযোগ’, ইংরেজিতে ‘Divided Attention’।
Divided Attention বা বিভক্ত মনোযোগ হচ্ছে, যখন আমাদের একবারে একের অধিক বিষয়ে খেয়াল রাখতে হয়। আমরা প্রতিনিয়তই এটি করে থাকি, জেনে বা না জেনে। হয়তো গাড়ি চালাতে চালাতে ফোনে কথা বলছেন, টিভি দেখতে দেখতে ফোনে কথা বলছেন, গান শুনতে শুনতে অঙ্ক কষছেন- এসবই বিভক্ত মনোযোগের উদাহরণ। নিচের ভিডিওটি দেখুন।
এখানে প্রথমে বলা হয়েছে, পর্দায় কতগুলো হলুদ তারার আবির্ভাব ঘটে তা গণনা করার জন্য, যা খুব খুব কঠিন কিছু নয়। কিন্তু, ক্ষণকাল পরেই যখন আবার নির্দেশ দেয়া হয় যে, হলুদ তারার পাশাপাশি পর্দায় কতগুলো লাল ক্রস চিহ্নের আবির্ভাব ঘটে তা গোণার জন্য, তখনই হয় সমস্যাটি। তখন আমাদের একমুখী মনোযোগে ছেদ পড়ে মনোযোগ হয়ে পড়ে দ্বিমুখী। আর তার সাথে যখন যুগপৎভাবে বক্তার কথার দিকেও যখন মনোযোগের এক অংশ রাখতেই হয়, তখন এই ত্রিমুখী মনোযোগের জটিলতায় শ্রোতাকে হয়ে পড়তে হয় চূড়ান্তভাবে বিভ্রান্ত। ফলাফল নিশ্চয়ই টের পাচ্ছেন।
এটি ছাড়াও মনোযোগকে আরও তিনটি ধরনে বিশেষায়িত করা যায়। এগুলো হলো-
- বিশেষ মনোযোগ (Selective Attention)
- অমনোযোগের কারণে দর্শন সীমাবদ্ধতা (Inattentional Blindness)
- পরিবর্তনের প্রতি দর্শন সীমাবদ্ধতা (Change Blindness)
আগের ভিডিওটি আবার দেখুন। হলুদ তারা আর লাল ক্রস গণনার ভিড়ে কি একটি হলুদ স্মাইলি ফেস আপনার চোখে পড়েছিল? যদি চোখে না পড়ে থাকে তো এতে হতাশ হওয়ার বা খারাপ লাগার কিছু নেই। ঐ যে বললাম, আমাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা খুবই সীমিত। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতার এই সীমাবদ্ধতাকে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগায় ম্যাজিশিয়ান বা জাদুকরেরা। তাদের কাজই হচ্ছে, আমাদের মনোযোগকে একটি নির্দিষ্ট দিকে প্রভাবিত করে অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে আমাদের চোখের সামনেই তার খেল দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেয়া। একে আরও কাজে লাগায় বিজ্ঞাপন নির্মাতারা। কোনো একটি ছবিতে অনেকগুলো অনুজ্জ্বল আলোর মাঝে একটি উজ্জ্বল আলোর উপস্থিতি, অথবা অস্বাভাবিক কিছু আমাদের আকর্ষণ কেড়ে নেয়। ক্ষেত্রবিশেষে একে পপ-আউট ইফেক্টও বলা হয়ে থাকে।
এই যে মনোযোগকে একটি নির্দিষ্ট দিকে প্রভাবিত করা হচ্ছে, একে বলা হয় বিশেষ মনোযোগ। এর কারণে আমরা বিশেষ কোনো কিছুর দিকে আমাদের মনোযোগের পুরোটা কাজে লাগাই। উদাহরণ হিসেবে এই ভিডিওটি দেখে নিতে পারেন-
আপনি যদি বল ড্রপ করার সংখ্যা সঠিকভাবে নিরূপণ করতে পারেন, আপনার মস্তিষ্কের গণনক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার কিছু নেই। তবে, যদি সেই গরিলা সদৃশ জলজ্যান্ত বস্তুটিকে খেয়াল করতে ভুলে যান, তবে নিশ্চয়ই সময় এসেছে একজন নিউরোলজিক্যাল ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার। তা না হলেও অন্তত চোখের ডাক্তার দেখানো তো অবশ্যকর্তব্য। দিনের আলোতে এমন ভুল কীভাবে হতে পারে!
ঠাট্টা করছি। আসলে চোখের কোনো দোষ নেই এখানে। চোখ হচ্ছে শুধুমাত্র দুনিয়াকে দেখার একটি মাধ্যম। কিন্তু, দেখা ও খেয়াল করার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। আপনি যে মুহূর্তে এই লেখাটি পড়ছেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই হয়তো আপনার মনোযোগই নেই আপনার আশেপাশে ঠিক কত ধরনের শব্দ হচ্ছে, অথবা আপনার আশেপাশে কেউ কোন প্রসঙ্গে কথা বলছে।
আমাদের মনোযোগ একটি দিকমুখী আলো বা স্পটলাইটের মতো। যখন আমরা কোনো দিকে মনোযোগ সহকারে দৃষ্টি দেই (খেয়াল করি), তখন সেই দর্শনক্ষেত্রের (ফিল্ড অফ ভিশন) বাইরের ঘটনাগুলোকে আমরা উপেক্ষা করি, বা বলা চলে, সেগুলো আমাদের স্পটলাইটের বাইরে চলে যায়। ঐ যে বললাম শুরুতে যে, মস্তিষ্ক বড় অদ্ভুত, তার আদর্শ প্রমাণ হিসেবে সে তখন দর্শনক্ষেত্রের বাইরের সেই অংশকে নিজ উদ্যোগেই কম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সাব্যস্ত করে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আর তাতে করে আমরা আমাদের আশপাশের খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকেও অনিচ্ছাসত্ত্বেও এড়িয়ে যাই।
শুরুতে যে হলুদ তারা গোণার ফাঁকে হলুদ স্মাইলিকে এড়িয়ে গেলেন, অথবা পরে যে বাস্কেটবলের পতনসংখ্যা গুণতে গিয়ে গরিলাকে চোখে পড়েনি এ ব্যাপারটিরও একটি নাম আছে। একে বলে অমনোযোগের কারণে দর্শন সীমাবদ্ধতা। এটি তখনই ঘটে যখন আমরা কোনো দিকে আমাদের মনোযোগ এতই একনিষ্ঠভাবে ধরে রাখি যে, আমাদের মস্তিষ্ক বাকি সবকিছুকে বর্জন করে দেয়। কিন্তু, তা-ও হয়তো আমরা মনোযোগ দিয়ে সংবাদপত্র পড়ছি, এর ফাঁকেও ঠিকই ফোন বেজে উঠলে তা আমাদের মনোযোগ এড়ায় না। অথবা গান শুনতে শুনতে সুস্বাদু খাবারের গন্ধও আমরা ঠিকই পাই। একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবো, এর কারণ হচ্ছে, এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের দুটি স্নায়ু কাজ করছে।
আসলে, কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের মস্তিষ্ক একইসাথে প্রচুর সংকেত (স্টিমুলাই) পেতে থাকে তার সেন্সরি করটিসিসের মাধ্যমে। স্নায়ুর নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দেহের অন্যান্য অংশ থেকে প্রাপ্ত সংকেতগুলোকে একত্রিত করে যাচাইবাছাইয়ের পর মস্তিষ্ক ঠিক আগের মতোই পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নেয় যে, কোন সংকেতগুলো অগ্রাধিকারযোগ্য। ফলাফল, প্রতিনিয়তই আমরা আমাদের আশপাশেই ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা খেয়ালই করছি না।
সর্বশেষে, দর্শনের সীমাবদ্ধতার আরেকটি ধরন আছে, একে বলে পরিবর্তনের প্রতি সীমাবদ্ধতা বা Change Blindness। এটি তখনই হয় যখন আমরা আমাদের আশপাশের কোনো কিছুর পরিবর্তন শনাক্ত করতে ব্যর্থ হই। এখানে খেয়াল রাখতে হবে যে, অমনোযোগের কারণে দর্শন সীমাবদ্ধতা আর পরিবর্তনের প্রতি সীমাবদ্ধতা শুনতে একই মনে হলেও এতে সূক্ষ্ম বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান। প্রথমটি হলো কোনো কিছু প্রত্যক্ষ করতে ব্যর্থ হওয়া, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন খেয়াল করতে ব্যর্থ হওয়া। উভয় বিষয়ই একটি দিকে নির্দেশ করে যে, আমরা যখন কোনো কিছুর দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক ঐ লক্ষ্যবস্তুর বাইরের অংশটির জন্য একটি গতিশীল বাস্তবতা তৈরি করে, যাতে করে চারপাশের সবকিছুই স্বাভাবিক বলে মনে হয়, যদি না মস্তিষ্কের মাধ্যমেই আবার কোনো কিছু অস্বাভাবিকভাবে ফুটে ওঠে আমাদের কাছে।
তাহলে আশা করা যেতে পারে, এ লেখাটি পড়ার পর আপনার মনোযোগের প্রভূত উন্নতি ঘটেছে। তাহলে শেষ একটি ভিডিওর মাধ্যমে আপনার মনোযোগ পরীক্ষা হয়ে যাক।