১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশে দেশে শ্রমিক আন্দোলন ও কম্যুনিস্ট পার্টিগুলোর রাজনৈতিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে তৎকালীন পৃথিবীর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কম্যুনিজম অনিবার্য বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বে পরিবর্তিত পরিবেশে কম্যুনিজম নতুন ভীতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইউরোপে নাৎসিবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধে অন্যদের মতো কম্যুনিস্টরাও অংশগ্রহণ করে। ফলে যুদ্ধপরবর্তী বিধ্বস্ত ইউরোপে কম্যুনিস্ট আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়। এতে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে মার্কিন প্রশাসন শঙ্কিত হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে কম্যুনিস্ট খোঁজার হিড়িক পড়ে যায়। মার্কিন সিনেটর জোসেফ ম্যাকার্থি এই কম্যুনিস্টবিরোধিতাকে রীতিমতো ক্রুসেডে পরিণত করেন। এজন্য একে ‘ম্যাকার্থিজম’ও বলা হয়।
জোসেফ রেমন্ড ম্যাকার্থি ১৯০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উইসকন্সিনে এক আইরিশ ক্যাথলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মার্কুয়েট ইউনিভার্সিটি থেকে অধ্যয়ন শেষ করে ১৯৩৫ সালে অ্যাটর্নি হন। ১৯৩৯ সালে উইসকন্সিনের ইতিহাসে কনিষ্ঠতম সার্কিট কোর্ট জজ হবার বিরল সম্মান অর্জন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে নৌ বাহিনীতে যোগ দেন এবং ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। ১৯৪৪ সালে যুদ্ধকালীন দেশপ্রেমকে পুঁজি করে রাজনীতিতে আসেন এবং ১৯৪৬ সালে উইসকন্সিন থেকে জুনিয়র সিনেটর নির্বাচিত হন। ১৯৫০ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের জন্মদিন উপলক্ষ্যে দেওয়া এক ভাষণে পররাষ্ট্র দপ্তরে কর্মরত ২০৫ জন সম্ভাব্য কম্যুনিস্টের নাম প্রকাশ করে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন। এই ঘটনাকে ‘ম্যাকার্থিজম’ এর আনুষ্ঠানিক জন্মের মুহূর্ত বলে ধরে নেওয়া যায়।
মার্কিন রাজনীতিতে কম্যুনিজমের এই মাত্রাহীন জুজুর ভয় একদিনে শুরু হয়নি। ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমবারের মতো নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। একই সালে চীনে পশ্চিমা মদদপুষ্ট চিয়াং কাইশেকের জাতীয়তাবাদী সরকারকে জনযুদ্ধে পরাস্ত করে মাও সে তুং এর নেতৃত্বে কম্যুনিস্টরা ক্ষমতায় আসে। ফলে পশ্চিমা বিশ্বের রাজনীতিতে কম্যুনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলো উৎসাহিত হয়ে তাদের কাজের পরিধি আরো বাড়িয়ে তুলতে থাকে।
দেশব্যাপী অসন্তোষ তৈরির মাধ্যমে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের কথাও অনেক রাজনীতিবিদকে আতঙ্কিত করে তুলেছিলো। বলা বাহুল্য, এহেন পরিস্থিতিই জোসেফ ম্যাকার্থির মতো উগ্র ডানপন্থী রাজনীতিবিদের কাজ আরো অনুকূল ও সহজ করে তুলেছিলো। তিনি বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে কম্যুনিস্ট ও কম্যুনিস্ট-দরদী নাগরিকদের খুঁজে বের করতেন।
এমন রাজনৈতিক পরিবেশে জোসেফ ম্যাকার্থির দাবি সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করলে তাকে শাসনযন্ত্রের সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। এই অভূতপূর্ব শক্তিবৃদ্ধি হওয়ায় তিনি সেই ক্ষমতার যথাযথ সদ্ব্যবহার করা শুরু করেন। তার নেতৃত্বে সিনেট কমিটি সম্ভাব্য কম্যুনিস্ট ও কম্যুনিস্ট-দরদী নাগরিকদের বিশেষ ক্ষমতাবলে বিচারের আওতায় নিয়ে আসেন।
২০০৩ সালে উন্মুক্ত হওয়া তৎকালীন সিনেট শুনানির নথিপত্র থেকে ম্যাকার্থির অভিনব তদন্ত পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়। কোনো রকম বাস্তবিক প্রমাণ ছাড়াই অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো, জিজ্ঞাসার প্রশ্নাবলী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর হতো। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য জেলহাজতের ভয় দেখানো ও হুমকি দেওয়া নিয়মিত পদ্ধতির অংশ ছিলো। এ ধরনের পদ্ধতির ফলে নির্দোষ অভিযুক্তদের অনেকেই স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে একেবারে অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন।
শুরু থেকেই রাজনীতিবিদ ও প্রশাসকরা জোসেফ ম্যাকার্থির এহেন কাজকর্মের প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু ম্যাকার্থিজম শুরু হবার সময়কালের রাজনৈতিক আবহাওয়া এসব প্রতিবাদের জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল ছিলো। তাই প্রতিবাদের নৈতিক জোরও প্রথমদিকে বেশ দুর্বল ছিলো। তাই তা তেমন কার্যকর হয়নি। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন স্বয়ং হ্যারি এস ট্রুম্যানও এর প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তা যথারীতি নিষ্ফল হয়েছিলো।
জোসেফ ম্যাকার্থির সাঁড়াশি অভিযান থেকে হলিউডের শিল্পী ও কলাকুশলীরাও মুক্ত ছিলেন না। কোনো রকম অকাট্য প্রমাণ ছাড়াই নিছক সন্দেহের বশে হলিউডের এসব শিল্পীদের বিরুদ্ধে কম্যুনিস্ট অথবা কম্যুনস্টদরদী হবার ভ্রান্ত অভিযোগে ক্রিমিনাল কেস করা হয়। প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে এসব শিল্পীর মধ্য থেকে ১৯৪৭ সালের ২৫ নভেম্বর ব্ল্যাকলিস্ট প্রণীত হয়।
হলিউডের চিত্রপরিচালক, স্ক্রিপ্টরাইটার ও অন্যান্য পেশার কুশলী মিলিয়ে ১০ জনের বিরুদ্ধে কম্যুনিস্টদরদী হবার অভিযোগ আনীত হয়। এদের মধ্যে ছিলেন অ্যালভা ব্যাসাই, হার্বার্ট বিবারম্যান, লেস্টার কোল ও এডওয়ার্ড ডিমিট্রিকের মতো চিত্রপরিচালক ও স্ক্রিপ্টরাইটাররা।
এই ১০ জন অভিযুক্ত সিনেটর কমিটির সামনে কোনো প্রকার সাক্ষ্য ও অন্যান্য বিবৃতি প্রদান করতে অস্বীকার করেন। ফলে তাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস করা হয় এবং কংগ্রেসনাল কোর্টে উপস্থিত হতে বাধ্য করা হয়। অভিযুক্তরা একরকম একতরফাভাবে দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাদের ৮ জনকে এক বছরের ও ২ জনকে ৬ মাসের হাজতবাসের শাস্তি প্রদান করা হয়।
একটি সংবাদ সম্মেলনে এই দশজনের নাম জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়, যা ‘ওয়াল্ডর্ফ স্টেটমেন্ট’ নামে পরিচিত হয়েছিলো। যুক্তরাষ্ট্রের কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে অতীতে বা বর্তমানে কোনো রকম সম্পর্ক থাকা বিষয়ক জেরা ‘দ্য সিক্সটি ফোর ডলার কোয়েশ্চেন’ নামে কুখ্যাত। ক্রমান্বয়ে জোসেফ ম্যাকার্থির এই কম্যুনিস্টবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান লাগামহীন হতে থাকে। যতই দিন যাচ্ছিলো, ম্যাকার্থিজম ততই মধ্যযুগীয় ক্রুসেডের আকার নিয়েছিলো। আর এর বেশিরভাগ ভুক্তভোগী ছিলো বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার নিতান্তই নিরীহ মানুষ।
অন্যান্য শ্রেণী ও পেশার মানুষজনের পর এবার ম্যাকার্থিজমের সাঁড়াশি মার্কিন সেনাবাহিনীর উপরও পড়লো। তখন মার্কিন প্রশাসনের সর্বত্র সোভিয়েত চর বিষয়ক আতঙ্ক চলছিলো। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন কোরিয়ার যুদ্ধ আরম্ভ হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সশস্ত্রভাবে এতে জড়িয়ে পড়ে। স্নায়ুযুদ্ধের তীব্রতা এই যুদ্ধে যেন আরো বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলো। ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে কোরিয়ার যুদ্ধ সমাপ্ত হলে অনেক আহত সেনানায়ক দেশে ফিরে আসেন। এদের মধ্যে অনেকেই যুদ্ধকালীন নৃশংসতার তীব্র বিরোধী ছিলেন। ফলে জোসেফ ম্যাকার্থি তাদেরও বাঁকা চোখে দেখা শুরু করলেন।
অনেক শুভানুধ্যায়ী তাকে সেনাবাহিনীর মতো সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানে ম্যাকার্থিজমের ছায়া ফেলতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু কোনো প্রকার সতর্কবাণীর তোয়াক্কা না করেই সন্দেহভাজন সেনাসদস্যদের মধ্য থেকে ‘সোভিয়েত চর’ খুঁজে বের করতে অত্যুৎসাহী হয়ে পড়লেন। বহু সেনাসদস্যকে যুদ্ধকালীন ট্রমার পর এহেন অপমানজনক জেরার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
১৯৫৪ সালে জোসেফ ম্যাকার্থি কর্তৃক মার্কিন সেনাসদস্যদের জেরা করার দৃশ্য টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়। ফলে প্রশাসন, কংগ্রেস ও প্রচারমাধ্যম সর্বত্র ম্যাকার্থিবাদের বিরুদ্ধে জনরোষ উপচে পড়তে থাকে। আলোচ্য শুনানিতে কোনোরকম শক্ত প্রমাণ ছাড়াই সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতা, কম্যুনিস্ট দরদী ও সোভিয়েত চর হবার অভিযোগ আনীত হয়। অত্যন্ত তীব্র ও আপত্তিকর ভাষায় তাদের পেশাজীবনের আনুগত্য ও দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলে একেবারে সরাসরি যোগ্যতার দিকে আঙুল তোলা হয়। ফলে আগে এই জনবিরোধী তৎপরতার যে প্রতিবাদ স্তিমিত আকারে ছিলো, এবার তা তীব্র হয়ে উঠলো।
তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের ভেতরে জোসেফ ম্যাকার্থির সমমনা মানুষ ধীরে ধীরে কমে আসছিলো। এমনকি সমমনা ব্যক্তিবর্গও ম্যাকার্থিজমের এই বাড়াবাড়ি ও বল্গাহীন উগ্রতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। খোদ প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারও জোসেফ ম্যাকার্থির কার্যকলাপে বিব্রত ও নাখোশ ছিলেন। ফলে তীব্র বিরোধিতা ও রোষের মুখে তার বিরুদ্ধে সিনেটে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়।
১৯৫৪ সালে ম্যাকার্থির বিরুদ্ধে সিনেট তদন্ত কমিটির শুনানি শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে আইনজীবী হিসেবে এসেছিলেন বোস্টনের বহু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অ্যাটর্নি জোসেফ ওয়েলচ। তার যুক্তিসম্পন্ন প্রশ্নমালা, উপযুক্ত অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণ, সংবিধান ও সাংবিধানিক বিষয়ে অপ্রতিরোধ্য যুক্তি ম্যাকার্থিজমের কবর রচনা শুরু করেছিলো। প্রায় ৬ সপ্তাহ ধরে এই শুনানি চলেছিলো। জোসেফ ম্যাকার্থির পক্ষে রয় কোহনের মতো ঘাঘু উকিলও চোখে সরষে ফুল দেখছিলেন। মজার ঘটনা এই যে, এমন শুনানির সময়ও ম্যাকার্থির দম্ভ কিছুমাত্র কমেনি, উপরন্তু ওয়েলচকেও আচমকা আক্রমণ করে বসেন। এই বর্ষীয়ান আইনজীবী জবাবে বিন্দুমাত্র উগ্রতা না দেখিয়ে ম্যাকার্থিকে আইনের কথা মনে করিয়ে দেন।
জোসেফ ম্যাকার্থির পায়ের নিচের মাটি আস্তে আস্তে সরে গেলো। সিনেটরদের ভোটে ৬৬-২২ ভোটে তার পরাজয় হলো। সিনেট কমিটি তার কৃতকর্মের ভিত্তিতে আইনগত কৌশলে তাকে কার্যত ক্ষমতাহীন করে দিলেন। তৎকালীন স্নায়ুযুদ্ধের আবহাওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকা হয়েছিলো।
মার্কিন অভিধান ‘মারিয়াম ওয়েবস্টার’ এ ম্যাকার্থিজমের প্রতিশব্দ হয়ে গেলো প্রমাণহীন অভিযোগের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত করার আরেক নাম! ম্যাকার্থিজমের প্রতিবাদে ১৯৫৩ সালে আর্থার মিলার রচনা করেছিলেন ‘দ্য ক্রুসিবল’ নাটক। ২০০৬ সালে একই বিষয় নিয়ে ‘গুড নাইট এন্ড গুড লাক’ নামে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, যাতে অভিনয় করেছিলেন জর্জ ক্লুনির মতো সাড়া জাগানো অভিনেতা। ১৯৫৭ সালের ২ মে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ম্যাকার্থি মারা যান। জনবিরোধী কৃতকর্ম যে ব্যক্তির নামকেও কুখ্যাত করে তুলতে পারে, তার প্রমাণ জোসেফ ম্যাকার্থি ও ম্যাকার্থিজম।