টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এক উইকেটে জয়ের ঘটনা ঘটেছে ১৩ বার। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো এক উইকেটে জয় পেয়েছিলো ইংল্যান্ড, ১৯০২ সালের ১১ আগস্ট দ্য ওভালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এক উইকেটে ম্যাচ জিতেছিলো তারা। এক উইকেটে সবচেয়ে বেশি জয় পাওয়ার রেকর্ডও ইংল্যান্ডের দখলে। তারা তিনবার এক উইকেটে জয় পেয়েছিলো। সর্বশেষ এক উইকেটে জয় পেয়েছে শ্রীলঙ্কা। কুশল পেরেরা অকল্পনীয় ইনিংসের সুবাদে তারা দক্ষিণ আফ্রিকাকে এক উইকেটে পরাজিত করেছে।
চলুন, এক উইকেটের জয়ে অবদান রাখা সেরা কিছু ব্যক্তিগত ইনিংস সম্পর্কে জেনে আসা যাক।
ডেভ নার্স, ৯৩* বনাম ইংল্যান্ড
১৯০৬ সালের ২ জানুয়ারি, জোহানসবার্গে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। দল হিসাবে তখন ইংল্যান্ডের ধারেকাছেও ছিল না স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা। ম্যাচের প্রথম ইনিংস শেষে সেটা আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। সিরিজের প্রথম টেস্টে টসে জিতে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের অধিনায়ক পেলহ্যাম ওয়ার্নার। যার মুখ থেকে ম্যাচ শেষে শোনা গিয়েছিলো, এমন ম্যাচে পরাজিত দলে থাকাটাও গৌরবের।
ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ড ১৮৪ রান সংগ্রহ করেছিলো। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ড মাত্র ৯১ রানেই সবক’টি উইকেট হারায়। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ১৯ রান করেছিলেন স্নুক। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের ইনিংস এসেছিলো ডেভ নার্সের ব্যাট থেকে, তিনি অপরাজিত ১৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। প্রথম ইনিংসে ৯৩ রানে এগিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ১৯০ রান সংগ্রহ করেছিলো ইংল্যান্ড, যার ফলে জয়ের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন পড়ে ২৮৪ রানের; প্রথম ইনিংসে ৯১ রানে গুটিয়ে যাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য যা সাঁতরে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার সমান ছিল। মাত্র ২২ রানে দুই উইকেট হারানোর পর তা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
এক পর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ১০২ রান তুলতেই ছয় উইকেট হারিয়ে বসে। তখন স্বাগতিকদের পরাজয় ছিল সময়ের ব্যাপারমাত্র। তবে আট নাম্বারে নামা ডেভ নার্স এবং মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যান গর্ডন হোয়াইটের ব্যাটে জয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু করছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা। এই দুইজন ৭ম উইকেট জুটিতে ১২১ রান যোগ করেছিলেন। হোয়াইট ৮১ রান করে ফিরে গেলে দ্রুত আরও দুই উইকেট হারায় তারা। অধিনায়ক পার্সি শেরওয়েল এবং ডেভ নার্স যখন শেষ উইকেট জুটিতে জোট বাঁধেন, তখনও জয়ের জন্য ৪৫ রান প্রয়োজন ছিল। ঐ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটরক্ষক এবং অধিনায়ক পার্সি শেরওয়েল এগারো নাম্বারে ব্যাট করেছিলেন, যদিও তিনি এগারো নাম্বার ব্যাটসম্যান নন। শেষ পর্যন্ত তার এগারো নাম্বারে ব্যাট করার কারণেই ডেভ নার্স দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছানোর জন্য একজন সঙ্গী পেয়ে যান। তারা শেষ উইকেট জুটিতে অবিচ্ছিন্ন ৪৮ রান যোগ করে দলকে এক উইকেটের ঐতিহাসিক জয় এনে দেন। এই জয়ে গর্ডন হোয়াইট এবং পার্সি শেরওয়েলের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় অবদান ছিল আট নাম্বারে ব্যাট করতে নামা ডেভ নার্সের। তার অপরাজিত ৯৩ রানের ইনিংসের উপর ভর করেই জোহানেসবার্গে জমজমাট এক ম্যাচে শেষ হাসি হেসেছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা।
ইনজামাম-উল হক, ৫৮* বনাম অস্ট্রেলিয়া
১৯৯৪ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর, করাচিতে দুই শক্তিশালী দল পাকিস্তান এবং অস্ট্রেলিয়া মুখোমুখি। দুই দলেই বেশ কয়েকজন তারকা ক্রিকেটার ছিল। করাচিতে সিরিজের প্রথম টেস্টে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া। ব্যাট করতে নেমে বেভান, ইয়ান হিলি এবং স্টিভ ওয়াহ’র অর্ধশতকের উপর ভর করে ৩৩৭ রান সংগ্রহ করেছিলো অস্ট্রেলিয়া। জবাবে পাকিস্তান নিজেদের প্রথম ইনিংসে ২৫৬ রানে সবক’টি উইকেট হারায়।
অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ডেভিড বুন এবং মার্ক ওয়াহর ব্যাটে চড়ে বড় সংগ্রহের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। এক পর্যায়ে তাদের সংগ্রহ ছিল দুই উইকেটে ১৭১ রান। সেখান থেকে ওয়াসিম আকরাম এবং ওয়াকার ইউনুসের বোলিং তোপের মুখে পড়ে ২৩২ রানেই সবক’টি উইকেট হারায় সফরকারীরা। ডেভিড বুন ১১৪ রান করে অপরাজিত ছিলেন। প্রথম ইনিংসের লিডসহ পাকিস্তানকে ৩১৪ রানের জয়ের লক্ষ্য দেয় অস্ট্রেলিয়া, চতুর্থ ইনিংসে যা বেশ কঠিন লক্ষ্য। সেসময় শেন ওয়ার্নও বেশ ফর্মে ছিলেন। তবে পাকিস্তানের জন্য সুসংবাদ এবং অস্ট্রেলিয়ার জন্য দুঃসংবাদ ছিল যে, ম্যাকগ্রা এবং টম মে দুইজনই ইনজুরিতে আক্রান্ত ছিলেন। তাই বোলিং ডিপার্টমেন্টের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে শেন ওয়ার্নের কাঁধে।
চতুর্থ ইনিংসে ম্যাকগ্রাকে না পেলেও স্পিন সহায়ক উইকেটে শেন ওয়ার্ন ঠিকই বাজিমাত করছিলেন। এক পর্যায়ে পাকিস্তানের সংগ্রহ ছিল সাত উইকেটে ১৮৪ রান। তবে তখনও তাদের জয়ে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আট নাম্বারে ব্যাট করতে ইনজামাম-উল হক। তিনি প্রথমে ৮ম উইকেট জুটিতে রশিদ লতিফের সাথে ৫২ রান যোগ করেছিলেন, এরপর ৯ম উইকেট জুটিতে ওয়াকার ইউনুসের সাথেও ২২ রান তুলেছিলেন। এই দুই জুটির পরও অবশ্য অস্ট্রেলিয়া উপমহাদেশের মাটিতে বিরল জয়ের দোরগোড়ায় ছিল। জিততে হলে পাকিস্তানের তখনও ৫৬ রান প্রয়োজন ছিল। ক্রিজে ছিলেন ইনজামাম এবং ১১ নাম্বার ব্যাটসম্যান মুশতাক আহমেদ। মুশতাক আহমেদের দায়িত্ব ছিল স্রেফ টিকে থাকা, তবে তিনি তার চেয়েও বেশি কিছু করছিলেন। জয় থেকে মাত্র তিন রান দূরে থাকতে ইয়ান হিলি কঠিন একটা স্ট্যাম্পিং মিস করেন। ঐ মিসের পরই অস্ট্রেলিয়া জয় মিস হয়ে যায়। ইনজামামের অপরাজিত ৫৮ রান এবং মুশতাক আহমেদের ২২* রানের উপর ভর করে পাকিস্তান এক উইকেটে জয় পেয়েছিলো সেদিন।
ব্রায়ান লারা, ১৫৩* বনাম অস্ট্রেলিয়া
১৯৯৯ সালের ২৬শে মার্চ, ব্রিজটাউনে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে জয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৩০৮ রানের লক্ষ্যমাত্রা ছুঁড়ে দিলো অস্ট্রেলিয়া। গ্লেন ম্যাকগ্রা, জেসন গিলেস্পি, শেন ওয়ার্ন এবং স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলের মতো বোলারদের বিপক্ষে এই রান তাড়া করে জেতা যেকোনো দিনে, যেকোনো পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের জন্য বেশ কঠিন কাজ। সেই অসাধ্য সাধন করেছিলেন ব্রায়ান লারা।
ব্রায়ান লারা যখন ব্যাট হাতে মাঠে নামেন, তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সংগ্রহ ছিল তিন উইকেটে ৭৮ রান। লারা স্বাভাবিকভাবেই ব্যাট করেছিলেন, কিন্তু তার সঙ্গীরা ব্রিজটাউনে অজি বোলারদের সামনে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলো না। কার্ল হুপার যখন ৫ম ব্যাটসম্যান হিসাবে সাজঘরে ফেরেন, তখন ওয়েস্ট ইনিংসের রান সংখ্যা ছিল মাত্র ১০৫। জয় থেকে তখনও ২০৩ রান স্বাগতিকরা। ৬ষ্ঠ উইকেট জুটিতে জিমি অ্যাডামসকে নিয়ে উইকেটে থিতু হয়ে যান লারা। এই দুইজন ১৩৩ রান যোগ করেছিলেন, যার মধ্যে অ্যাডামসের সংগ্রহ মাত্র ৩৮ রান!
অ্যাডামস ফিরে যাওয়ার পর আবারও সঙ্গীহারা হয়ে যান লারা। ২৪৮ রানে আট উইকেট হারানোর পর ক্রিজে আসেন দশ নাম্বার ব্যাটসম্যান কার্টলি অ্যামব্রোস। তিনি ১২ রানের মহামূল্যবান ইনিংস খেলতে ক্রিজে ছিলেন ৮২ মিনিট। এই সময়েই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জয়ের নিকটে নিয়ে আসেন লারা। দলীয় ৩০২ রানের মাথায় ৫৪ রানের জুটি গড়ে যখন অ্যামব্রোস সাজঘরে ফিরে যান, তখনও জয় থেকে ছয় রান দূরে ছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এমন সময়ে ক্রিজে এসে কোনো রান না করলেও পাঁচ বল মোকাবেলা করে ব্রায়ান লারাকে বাকি রান তুলে নিতে সাহায্য করেন কোর্টনি ওয়ালশ। ব্রায়ান লারা তার ‘ট্রেডমার্ক’ কাভার ড্রাইভে চার মেরে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে এক উইকেটের অবিশ্বাস্য জয় এনে দেন। তার অপরাজিত ১৫৩ রানের অনবদ্য ইনিংসের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৮ রান করেছিলেন জিমি অ্যাডামস।
জিমি অ্যাডামস, ৪৮* বনাম পাকিস্তান
২০০০ সালের ২৫শে মে সেন্ট জোন্সে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে মুখোমুখি হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং পাকিস্তান। একসময় ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করা ওয়েস্ট ইন্ডিজ সময়ের সাথে সাথে নিজেদের সুদিন পিছনে ফেলে এসেছিলো। কিন্তু তখনও তাদের মাটিতে তাদেরকে হারানো সহজ কাজ ছিল না। পাকিস্তান সিরিজের প্রথম দুই টেস্ট ড্র করার পর তৃতীয় টেস্টে লারাবিহীন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জয় পেতে পেতে শেষ পর্যন্ত এক উইকেটে পরাজিত হয়েছিলো। তাদের জয়ে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক জিমি অ্যাডামস।
সেন্ট জোন্সে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জয়ের জন্য ২১৬ রানের টার্গেট দিয়েছিলো পাকিস্তান। লারাবিহীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ এক পর্যায়ে তিন উইকেটে ১৪৪ রান তুলে জয়ের পথেই ছিল। কিন্তু ওয়াসিম আকরামের বিধ্বংসী এক স্পেলের পর জয়ের পথ দুর্গম হয়ে যায় তাদের জন্য। তিন উইকেটে ১৪৪ রান থেকে ১৯৭ রান তুলতেই নয় উইকেট হারিয়ে বসে তারা। সতীর্থদের আসা-যাওয়ার মিছিলেও উইকেটে থিতু হয়ে গিয়েছিলেন জিমি অ্যাডামস। নয় উইকেট পড়ে যাওয়ার পর শেষ ১৯ রান তুলতে তার সাথে জুটি বাঁধেন কোর্টনি ওয়ালশ। এর আগেও তিনি এক উইকেটের জয়ে অবদান রেখেছিলেন। বেশ কয়েকবার আউটের সম্ভাবনা তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত অ্যাডামস-ওয়ালশ জুটি ৭২ মিনিট ব্যাট করে কাঙ্ক্ষিত ১৯ রান তুলে নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের এক উইকেটের জয় নিশ্চিত করেন। অ্যাডামস ২১২ বল মোকাবেলা করে কোনো বাউন্ডারি না হাঁকানো সত্ত্বেও অপরাজিত ৪৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। তার এই লড়াকু ইনিংসের কল্যাণে ওয়েস্ট ইন্ডিজ শেষ পর্যন্ত জয়ী দল হিসাবেই মাঠ ছেড়েছিলো।
ইনজামাম-উল হক, ১৩৮* বনাম বাংলাদেশ
২০০৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মুলতানে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে মাঠে নেমেছিলো বাংলাদেশ। এই ম্যাচের আগে বাংলাদেশ ২৩টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলো, যার মধ্যে সেরা সাফল্য বলতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটি ড্র। মুলতানে পাকিস্তানকে প্রায় হারিয়েই দিচ্ছিলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জয়ে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ইনজামাম-উল হক। টেল-এন্ডারদের সহায়তায় এবং মোহাম্মদ রফিকের মহানুভবতায় শেষ পর্যন্ত এক উইকেটের জয় পেয়েছিলো স্বাগতিক পাকিস্তান।
ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে হাবিবুল বাশারের ৭২ রান এবং রাজিন সালেহের ৪৯ রানের উপর ভর করে বাংলাদেশ ২৮১ রান সংগ্রহ করেছিলো বাংলাদেশ। জবাবে মোহাম্মদ রফিকের ঘূর্ণিতে এবং খালেদ মাহমুদ সুজনের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে মাত্র ১৭৫ রানে সবক’টি উইকেট হারায় পাকিস্তান। রফিক পাঁচটি এবং সুজন চারটি উইকেট শিকার করেছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ১৫৪ রানে গুটিয়ে গেলেও প্রথম ইনিংসের ১০৬ রানের লিডসহ পাকিস্তানকে ২৬১ রানের লক্ষ্যে ছুঁড়ে দেয় বাংলাদেশ। জবাবে ব্যাট করতে নেমে পাকিস্তান ৯৯ রানে পাঁচ উইকেট এবং ১৬৪ রানে সাত উইকেট হারালে বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট জয়ের সুবাস পাচ্ছিলো। কিন্তু বাংলাদেশের জয়ের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ালেন ইনজামাম। সেই সাথে বাংলাদেশের বাজে ফিল্ডিংও বাংলাদেশকে শেষ হাসি হাসতে দেয়নি। ইনজামাম ৮ম উইকেট জুটিতে সাব্বির আহমেদের সাথে ৩৯ রান এবং ৯ম উইকেট জুটিতে উমর গুলের সাথে ৫২ রান যোগ করেছিলেন। এই ৫২ রানে উমর গুল ৫০ বলে করেছিলেন মাত্র পাঁচ!
ইনজামাম এবং উমর গুলের জুটিতে শুরু থেকেই ওভারের শেষ বলগুলোতে উমর গুল সিঙ্গেল নেওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করেছিলেন। ক্রিকেটের নিয়মানুযায়ী মোহাম্মদ রফিক চাইলে উমর গুলকে ‘ম্যানক্যাড’ করতে পারতেন। তবে তিনি তা না করে উমর গুলকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। জয় থেকে মাত্র চার রান দূরে থাকতে উমর গুল আউট হলেও দলের জয় নিশ্চিত করেই মাঠ ছেড়েছিলেন ইনজামাম-উল হক। তিনি ২৩২ বলে ২০টি চার এবং একটি ছয়ের মারে অপরাজিত ১৩৮ রানের ইনিংস খেলে পাকিস্তানকে বড় ধরনের লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন।
ভিভিএস লক্ষ্মণ, ৭৩* বনাম অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়া তখন নিজেদের সোনালি সময় অতিবাহিত করে নতুন করে দল সাজানোতে ব্যস্ত ছিলেন। বোলিং লাইনআপে বেন হিলফেনহাস, ডগ বোলিঞ্জার তখনও অস্ট্রেলিয়া দলে নতুন নতুন সুযোগ পেয়েছেন। অভিজ্ঞ বলতে ছিলেন মিচেল জনসন। ২০১০ সালের ২০শে সেপ্টেম্বরে ভারতের চন্ডীগড়ে ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।
দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে যেকোনো দলই চায় প্রথম ম্যাচ জিতে সিরিজে এগিয়ে থাকতে। ভারত এবং অস্ট্রেলিয়াও তাই চেয়েছিলো। টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করা অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ৪২৮ রান করেছিলো। জবাবে ভারতের ইনিংস থেমেছিলো ৪০৫ রানে।
দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া ১৯২ রানে সবক’টি উইকেট হারালে জয়ের জন্য ভারতের প্রয়োজন পড়ে ২১৬ রানের। নিজেদের মাটিতে অনভিজ্ঞ অজি বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে এই রান তাড়া করে জয়ের ব্যাপারে বেশ আশাবাদী ছিল স্বাগতিকরা। তবে মাত্র ১২৪ রানে আট উইকেট হারানোর পর পরাজয়ের প্রহর গুনছিলো ভারত। ক্রিজে তখন ছিলেন পিঠের ইনজুরিতে ভোগা ভিভিএস লক্ষ্মণ এবং নির্ভেজাল বোলার হিসাবে খেলা ইশান্ত শর্মা। ইনজুরির কারণে লক্ষ্মণ প্রথম ইনিংসে দশ নাম্বারে ব্যাট করেছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে করলেন সাতে। ইনজুরির কারণে দৌড়াতে সমস্যা হচ্ছিলো বলে সুরেশ রায়নার সাহায্য নিয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ ব্যাটসম্যান বনে যাওয়া ইশান্তকে সাথে নিয়ে ৯ম উইকেট জুটিতে ৮১ রান যোগ করে জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলেন লক্ষ্মণ। জুটিতে ইশান্তের অবদান ৯২ বলে ৩১ রান।
জয় থেকে মাত্র ১১ রান দূরে থাকতে আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে সাজঘরে ফিরেছিলেন ইশান্ত। এরপর শেষ ব্যাটসম্যান হিসাবে মাঠে নেমেছিলেন প্রজ্ঞান ওঝা। ঠাণ্ডা মাথার ক্রিকেটার হিসাবে লক্ষ্মণের বেশ নামডাক ছিল। তবু তার সতীর্থরা যখন পাগলাটে দৌড় দিয়ে তার কষ্টার্জিত প্রচেষ্টায় পানি ঢেলে দিচ্ছিলো, তখন তিনিও মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য শেষ উইকেট জুটিতে কাঙ্ক্ষিত ১১ রান তুলে নিয়ে এক উইকেটের জয় নিয়েই মাঠ ছেড়েছিলেন লক্ষ্মণ এবং ওঝা। ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল’ হিসাবে পরিচিত লক্ষ্মণের এই ইনিংসটিও ভেরি ভেরি স্পেশাল ছিল। ইনজুরি নিয়ে ব্যাট করে ৭৯ বলে আট চারের মারে করা তার অপরাজিত ৭৩ রানের ইনিংসের উপর ভর করেই ভারত জিতেছিলো। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে দ্বিতীয় টেস্টটিও জিতে সিরিজ জিতে নিয়েছিলো ভারত।
কুশল পেরেরা, ১৫৩* বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা
দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সদ্য সমাপ্ত টেস্ট সিরিজে শ্রীলঙ্কা প্রথম এশিয়ান দল হিসাবে সিরিজ জয়ের রেকর্ড গড়লো। গত কয়েকবছর ধরে একাদশে একের পর এক রদবদল এবং মাঠের বাহিরে নানাবিধ ঝামেলার কারণে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। তারা যে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে এসে লড়াই করতে পারবে, সেটাও অনেকের কল্পনার বাইরে ছিল। শেষ পর্যন্ত সবাইকে চমকে দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হোয়াইটওয়াশ করে সিরিজ জিতে নেয় তারা। শ্রীলঙ্কার সিরিজ জয়ে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন হার্ড-হিটার ব্যাটসম্যান কুশল পেরেরা। প্রথম টেস্টে তার অকল্পনীয় ইনিংসের কল্যাণেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এক উইকেটের নাটকীয় জয় পেয়েছিলো শ্রীলঙ্কা।
ডারবানে চতুর্থ ইনিংসে জয়ের জন্য শ্রীলঙ্কাকে ৩০৪ রানের টার্গেট দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রথম ইনিংসে যে দল ১৯১ রানে গুটিয়ে গিয়েছিলো, এই দল চতুর্থ ইনিংসে এই রান তাড়া করে জিতবে, সেটা অনেকেরই ভাবনার বাইরে ছিল। বিশেষ করে যখন ৫২ রানে তিন উইকেট এবং ১১০ রানে দলের অর্ধেক ব্যাটসম্যানের উইকেট হারিয়েছিলো শ্রীলঙ্কা, তখন সবাই অপেক্ষা করছিলো কত দ্রুত দক্ষিণ আফ্রিকা জয় তুলে নেবে সেটা দেখার জন্য। শ্রীলঙ্কার প্রথম তিন ব্যাটসম্যান সাজঘরে ফেরার পর মাঠে নেমেছিলেন কুশল পেরেরা। প্রথম ইনিংসে ৫১ রানের ইনিংস খেলা এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান শুরু থেকেই স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাট করেন। চতুর্থ উইকেট জুটিতে ওশাদা ফার্নান্ডোর সাথে ৫৮ রান যোগ করে সাময়িকভাবে বিপর্যয় সামাল দিয়েছিলেন। ফার্নান্দো ফিরে যাওয়ার পর দলীয় ১১০ রানের সাথে আর কোনো রান না যোগ করেই সাজঘরে ফিরে গিয়েছিলেন নিরোশান ডিকভেলা।
প্রথম সারির পাঁচ ব্যাটসম্যান ফিরে যাওয়ার পর ধনঞ্জয় ডি সিলভার সাথে জুটি বাঁধেন কুশল পেরেরা। এই ৬ষ্ঠ উইকেট জুটিতে বেশ সাবলীলভাবে ব্যাট করে শ্রীলঙ্কাকে ঐতিহাসিক জয়ের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিলেন তারা। দলীয় ২০৬ রানের মাথায় ডি সিলভা ৪৮ রান করে ফিরে গেলে তাদের ৯৬ রানের জুটি ভাঙে। পরের বলে লাকমলও কোনো রান যোগ না করে ফিরে যান। এতে করে ম্যাচ থেকে এক প্রকার ছিটকেই পড়ে তারা। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকা শ্রীলঙ্কা এক পর্যায়ে ২২৬ রান তুলতেই নয় উইকেট হারিয়ে বসে। ৩০৪ তখন ‘দিল্লী দূর অস্ত’।
তখনও আশার আলো হয়ে ছিলেন কুশল পেরেরা। দলকে জেতাতে হলে শেষ উইকেট জুটিতে বিশ্ব ফার্নান্দোর সাথে ৭৮ রান তুলতে হতো তাকে। একের পর এক আক্রমণাত্মক শট খেলে প্রথমে নিজের শতক তুলে নেন তিনি। এরপর জয়ের লক্ষ্যে ব্যাট করতে থাকেন পেরেরা। বিশ্ব ফার্নান্দোও উইকেটে মাটি কামড়ে পড়েছিলেন। যার ফলে শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যায় শ্রীলঙ্কা। ইনিংসশেষে দেখা গেলো, শেষ উইকেট জুটিতে ৭৮ রানের মধ্যে ফার্নান্দোর অবদান ছয় রানের, যার মধ্যে চার রানই এসেছে ওভার-থ্রো’তে!
রানের চেয়ে অবশ্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার উইকেটে টিকে থাকা। ২৭ বল মোকাবেলা করে সেই কাজ ভালোভাবেই করেছিলেন তিনি, যার কল্যাণে কুশাল পেরেরা ২০০ বলে ১২টি চার এবং পাঁচটি ছয়ের মারে অপরাজিত ১৫৩ রানের ইনিংস খেলে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
চতুর্থ ইনিংসে একক নৈপুণ্যে দলকে জেতানো ইনিংসগুলোর মধ্যে ব্রায়ান লারা এতদিন সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তার খেলা অপরাজিত ১৫৩ রানের ইনিংসটির সুবাদে ওয়েস্ট ইন্ডিজ নাটকীয় জয় পেয়েছিলো সেদিন। কুশল পেরেরার ইনিংসটিকেও অনেকে লারার ঐ ইনিংসটির সাথে তুলনা করছেন। তুলনা করারই কথা, তার ইনিংসটিও তো কোনো অংশে কম নয়! দলের ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে স্টেইন, রাবাদা, ফিল্যান্ডার, অলিভিয়ের এবং মহারাজদের মতো বিশ্বমানের বোলারদের বিপক্ষে তিনি এই ইনিংস খেলেছেন। লারার ইনিংসের সাথে তুলনা করলে মোটেও বাড়াবাড়ি হবে না। কে জানে, বছর পাঁচেক পর হয়তো কেউ কেউ কুশল পেরেরাকেই এগিয়ে রাখবেন!