২০১৪ সাল। ভারতের বিপক্ষে নটিংহ্যাম টেস্টের সময়কার ঘটনা। দিনের খেলা শেষ হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে এক ঘন্টা। বাউন্ডারি লাইনের পাশে দেখা গেল এক বয়স্ক দম্পতিকে। তাদের পেছনে খালি গ্যালারি পরিষ্কার করা হচ্ছে। সামনে ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা টিম বাসে ওঠার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে। একজন ক্রিকেটারকে দেখা গেল তাদের দিকে মোটামুটি দৌঁড়ে এগিয়ে আসতে। তিনজন মিলে একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে একটা ‘হাডল’ এর মতো তৈরি করলেন।
লম্বামতো বয়স্ক লোকটা সেই ক্রিকেটারের পোশাকের ময়লা ঝেড়ে দিলেন আর বাদামি চুলের বয়স্ক মহিলাটি তার ছোট হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা আইসক্রিমের বক্স বের করে আইসক্রিম তুলে দিলেন সেই ক্রিকেটারের মুখে। অ্যালান ও মেরি প্লাংকেটের ছেলে লিয়াম প্লাংকেটের কথাই বলছি, যাদের পারিবারিক বন্ধন আরো দৃঢ় হয়েছে দু-দুটো ‘মেডিক্যাল ক্রাইসিস’ মোকাবেলা করার পর।
২০১৪ থেকে সাত বছর পেছন ফিরে যাওয়া যাক। বিশ্বকাপের আগে প্লাংকেট ইংল্যান্ড দলে ডাক পেয়েছেন। ঠিক এই সময়টাতে ২২ বছর বয়সী প্লাংকেট প্রায় ক্রিকেট ছেড়েই দিয়েছিলেন। কারণ প্লাংকেট তার বাবাকে কিডনি দান করতে চেয়েছিলেন। প্লাংকেটের বাবার ভাষায়, “এটা একটা জিনগত সমস্যা। আমার বাবার এটা ছিল, এখন উত্তরাধিকারসূত্রে আমার মেয়ের এ সমস্যা আছে। কিন্তু লিয়ামের এ সমস্যা নেই। তার সাথে আমার রক্ত ঠিকভাবে ম্যাচ করে গিয়েছিলো। এজন্য সে তার কিডনি আমাকে দান করতে চায়।“
এই মেডিক্যাল টেস্টগুলো যখন করানো হচ্ছিল, তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন প্লাংকেট। অন্যদিকে, সপ্তাহে বিশ ঘণ্টা ডায়ালাইসিসের উপরে থাকা প্লাংকেটের বাবা খুঁজছিলেন একজন কিডনিদাতা। প্লাংকেট তার বাবাকে এভাবে কষ্টে দিনযাপন করার বিষয়টি সহ্য করতে পারছিলেন না।
“ও বাড়িতে এসেই আমাকে বারবার বলত যে ও খেলা ছেড়ে দেবে এবং ওর বাবাকে কিডনি দেবে, কিন্তু আমি ওকে বারবার বলেছি অপেক্ষা করতে,” বলেছিলেন প্লাংকেটের মা।
আবার ফিরে যাওয়া যাক ২০১৪-তে। টেমস-রিপলের পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। বাবার পীড়াপীড়িতে ক্রিকেটটা চালিয়ে গিয়েছিলেন লিয়াম প্লাংকেট। চার বছর অপেক্ষার পর তার বাবা কিডনিদাতা খুঁজে পান এবং তারপর থেকে সুস্থ জীবনযাপন করছেন। তার মা মেরি প্লাংকেটও দুরারোগ্য ক্যান্সার থেকে সেরে উঠেছেন এবং তার ছেলের খেলা দেখতে প্রায় প্রতিটি ভেন্যুতেই দেখা মেলে প্লাংকেট দম্পতির।
দু’বছর পেছনে ফেরা যাক। ২০১২ সালের গ্রীষ্মে নর্দাম্পটনশায়ার থেকে জ্যাক ব্রুকসকে ইয়র্কশায়ার দলে সাইন করানো হলো। তার জায়গা হলো অন্য একজন নতুন খেলোয়াড়ের সাথে এক রুমে। তার ‘রুমমেট’ ইংল্যান্ডের হয়ে তিন ফরম্যাটেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা ফাস্ট বোলার লিয়াম প্লাংকেট।
কিছুটা হীনম্মন্যতায় ভোগা জ্যাক ব্রুকস ফ্ল্যাটে গেলেন প্লাংকেটকে স্বাগত জানাতে। গিয়ে দেখতে পেলেন তার মা তাকে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। ব্যাপারটা যেন এরকম, একটা বাচ্চাকে প্রথমবার স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তার মা। ব্রুকস সেদিন শিশুসুলভ অনিশ্চয়তা দেখেছিলেন প্লাংকেটের চোখে-মুখে। তার মা তাকে নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার কারণ ছিলো এমন যে, পাঁচ বছরের মাঝে দ্বিতীয়বার মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর জন্য ড্রাইভিংয়ে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন প্লাংকেট।
এর পাঁচ বছর আগে এক নাইট ক্লাব থেকে ফেরার সময় অন্য একটা গাড়ির সাথে সংঘর্ষ হয় তার গাড়ির। এসময় যতটুকু পান করে গাড়ি চালানোর বৈধতা আছে তার দ্বিগুণেরও বেশি মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন প্লাংকেট। পাঁচ বছর পর একই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন তিনি, নিষেধাজ্ঞাটা এবার আসলো ৪০ মাসের জন্য।
যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ের কিছু আগে ডারহামের ২য় একাদশে খেলছিলেন প্লাংকেট। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে গতিসম্পন্ন বোলারদের একজন হওয়া সত্ত্বেও মূল দলে খেলার সুযোগ হচ্ছিল না তার। ২০০৭ এর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে প্রায় হারিয়েই গিয়েছিলেন। নিজেকে খুঁজে ফিরছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটেও।
ডারহামের সাবেক কোচ জিওফ কুক এভাবে স্মরণ করেন সেসময়কার কথা, “আমি আমার সামনে লিয়ামের মধ্যকার ক্রিকেটকে দিনের পর দিন বিলীন হয়ে যেতে দেখছিলাম।“
বছর গড়াচ্ছিল আর প্লাংকেট পথ হারিয়ে ফেলছিলেন। ডারহাম ট্রফি জিতছিল ঠিকই, কিন্তু প্লাংকেট খেলোয়াড় হিসেবে কিছু করতে পারছিলেন না। চেস্টার লি স্ট্রিটের পিচটা কোনোভাবেই গায়ের জোরে বাউন্সার মারার উপযুক্ত ছিলো না, যেটা প্লাংকেটের স্বভাবজাত বোলিংয়ের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। হতাশ হতে হতে প্লাংকেট দ্বারস্থ হলেন অ্যালকোহলের।
কোচ কুক আর প্লাংকেটের পরিবার তাকে নিয়ে প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় ছিল। প্লাংকেট মানসিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন এবং তার উপরে মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু ট্র্যাকে ফিরতে হলে তাকে এটা ছাড়তেই হত। প্লাংকেট ফিরেছিলেন, কিন্তু সময় লেগেছিল।
ইয়র্কশায়ারে এসে চারপাশের মানুষজনের সাথে দ্রুতই মানিয়ে নিলেন প্লাংকেট। এখানে এসে কোচ হিসেবে পেলেন সাবেক অজি ফাস্ট বোলার জেসন গিলেস্পিকে। হেডিংলিতে এসে গিলেস্পির সমর্থন আর প্লাংকেটের উপর তার আস্থার প্রতিদান দিয়ে ইয়র্কশায়ারে যোগ দেয়ার দু’বছরের মাঝে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন করলেন তিনি।
এই প্রত্যাবর্তনের জন্যই প্লাংকেটের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সিভিটা এত অনন্য। ২০০৫ সালে টেস্ট অভিষেক, ২০০৬ সালে পাঁচ ম্যাচ, ২০০৭ সালে তিন ম্যাচের পর এক বিশাল ‘বিরতি’। দলে ফিরলেন ২০১৪ সালে। ২০০৭ পর্যন্ত ওয়ানডে ফরম্যাটে নিয়মিত খেলে বাদ পড়েন বাজে ফর্মের জন্য। ২০১০ ও ২০১১-তে একটি করে ওয়ানডে ম্যাচ খেলেন। আবারো দলে ফিরতে ফিরতে লেগে যায় চার বছর। টি-২০ ক্যারিয়ারের কথা বলতে গেলে তার প্রথম আর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক টি-২০ খেলার মাঝখানে সময় চলে গেছে পুরো নয় বছর!
মাঝখানের এই সময়ে প্লাংকেট লড়েছেন অনেকগুলো লড়াই। বাবার অসুস্থতা, মায়ের দু’ধরনের ক্যান্সার, নিজের ফর্মের সাথে যুদ্ধ, অ্যালকোহলের সাথে যুদ্ধ, যুদ্ধ নিজের সাথেও। এতগুলো যুদ্ধ জয় করে প্লাংকেট ফিরেছিলেন। মাঝে ফেলে এসেছিলেন অনেকগুলো বছর, যে বছরগুলো কাজে লাগাতে পারলে প্লাংকেট হতে পারতেন সফল একজন ফাস্ট বোলার।
পাঁচদিনের ক্রিকেটে তো ফিরেছিলেন, চেনা কন্ডিশন হেডিংলিতে নিয়েছিলেন টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ উইকেট। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই ম্যাচে ২য় ইনিংসে নিয়েছিলেন আরও ৪ উইকেট। ঐ মৌসুমেই ভারতের বিপক্ষে আরো দুটো টেস্ট খেলার পর সাদা পোশাকে ইংল্যান্ডের হয়ে আর সুযোগ হয়নি প্লাংকেটের। এতবার দলে আসা-যাওয়ার মিছিলে খেলতে পেরেছিলেন সবে ১৩ টেস্ট ম্যাচ।
কিন্তু লিয়াম প্লাংকেটের গল্পটা শেষ নয় এখানেই। রঙিন পোশাকে রাঙাতে পেরেছিলেন তার ওয়ানডে ক্যারিয়ার। ২০১৫ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায়ের পর ইংল্যান্ড ক্রিকেটকে ঢেলে সাজানো হয়। মূলত ব্যাটিং ব্যর্থতা এই ফলাফলের জন্য দায়ী হলেও আরেকটি ইস্যু সামনে চলে আসে। সেটি হলো ১১ তম থেকে ৪০ তম ওভারে উইকেট না নিতে পারাটা। প্রতিষেধক হয়ে আসেন লিয়াম প্লাংকেট। দুর্দান্ত গতির সাথে উচ্চতাকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি কাটার, স্লোয়ার, ক্রস সিম ডেলিভারি, লাইন লেন্থের সূক্ষ্ম পরিবর্তন তার সাফল্যের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। মিডল ওভারে উইকেট নেয়ার সমস্যা সমাধান করার পথে ২০১৫ বিশ্বকাপের পর এখন পর্যন্ত ১১ তম থেকে ৪০ তম ওভারে ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন প্লাংকেট।
ফিরে যাই আবার ২০১২ সালে। ডারহাম থেকে ইয়র্কশায়ারে যাওয়ার পূর্বে কোচ জিওফ কুকের সাথে দেখা করেন প্লাংকেট। কুক বলেন, “আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, ‘যাও, ক্রিকেটের প্রতি নিজের ভালোবাসাকে ফিরিয়ে আনো।” সাত বছর পর বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলছিলেন প্লাংকেট, নিয়েছিলেন গুরুত্বপূর্ণ তিনটি উইকেট, যার একটি ছিল নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসনের।
বিশ্বকাপের পর ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে আর খেলা হয়নি প্লাংকেটের। অজানা কারণে বাদ পড়েছেন কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে আমেরিকাগামী হওয়ার কথাও শোনা গেছে। যেকোনো সময় হয়তো অবসরও নিয়ে নেবেন। জীবনসঙ্গিনীর সাথে পাড়ি জমাবেন ফিলাডেলফিয়াতে, আটলান্টিকের কাছে। ২০ বছর বয়সী তরুণ ফাস্ট বোলার যদি মাঝের সময়টা কাজে লাগাতে পারতেন তাহলে কী হতো সেটা প্রশ্নবোধক চিহ্নের ভেতরেই বন্দি রইল। কিন্তু এতগুলো লড়াই লড়ে এসে ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ জেতানোটাই বা কম কীসে! হয়তো এতদূর না-ও আসতে পারতেন প্লাংকেট। কিন্তু হার মানেননি। অজস্র প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে ঠিকই ফিরেছেন রাজার বেশে।