ক্যারিয়ারের পঞ্চম গোল্ডেন বুট জিতে বছরটা শেষ করলেন লিওনেল মেসি। আবার এই বছরেই ব্যাল ডি’অরের তালিকায় নেমে গিয়েছিলেন পাঁচ নম্বরে। এমন পরস্পর বিরোধী এক বছর নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার।
স্প্যানিশ সংবাদ মাধ্যম মার্কাকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বার্সেলোনা, পরিবার, ডেম্বেলে, রোনালদো এবং নিজের বছর নিয়ে আলাপ করেছেন মেসি
আরও একটা বছর গেলো। আর পঞ্চম গোল্ডেন বুট পেলেন। কেমন লাগছে আপনার? জিততে জিততে কী ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছেন?
এটা স্বীকৃতির জন্য একটা ভালো পুরষ্কার। আর এটা দলের সবার জন্যই। এটা দলের জন্য একটা পুরষ্কার। যেমন একজন গোলরক্ষক যখন জামোরা ট্রফি জেতে, সেটা আসলে দলের একটা পুরষ্কার। আর আমি খুব খুশি যে, আবার পুরষ্কারটা জিততে পেরেছি।
পাঁচটা গোল্ডেন বুট, পাঁচটা ব্যালন ডি’অর। পঞ্চম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপাটা কী মিসিং?
সেটা হলে খুব ভালো হতো। মৌসুমের শুরুতেই আমি যেমনটা বলেছি, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের যে মান, সে কারণেই এটা আমাদের কাছে খুব বিশেষ কিছু। আমরা অবশ্যই আবার এটা জিততে চাই।
জীবনের এই স্তরে এসে ফুটবল কি এখনও আপনার জীবনে অগ্রাধিকার পায়? নাকি পরিবার সেই জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে?
যে সময় থেকে আমার বাচ্চারা এসেছে, তখন থেকে আমার জীবনের অগ্রাধিকার পরিবারের। ওটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অবশ্যই আমি ফুটবল ভালোবাসি এবং ফুটবলের জন্যই বেঁচে আছি। কিন্তু পরিবার সবার ওপরে।
তিনটি বাচ্চা কী যথেষ্ট? নাকি আরও বাচ্চা নেবেন?
চিরো (ছোট বাচ্চা) মাত্র দাঁড়াতে শিখেছে। আন্তোলিনা এবং আমি একটা মেয়ে বাচ্চা হলে খুব খুশি হতাম। কিন্তু দেখা যাক। এখন খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।
আমরা আপনার ছেলে মাতেও ও থিয়াগোকে ক্যাম্প ন্যুতে দেখেছি। ওরা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কোন ধরনের প্রশ্ন করে?
ওরা দুজনই ফুটবল খুব পছন্দ করে। থিয়াগো একটু বেশি বোঝে। কারণ, ও বড়। সে খেলার সবকিছু নিয়েই আলোচনা করে। সে খুব সম্পৃক্ত থাকে।
সে কী বাবার প্রতি খুব চাহিদাপূর্ণ?
হ্যাঁ। আমি এরই মধ্যে ওর কাছ থেকে কিছু সমালোচনা পেয়েছি। সে বার্সেলোনা, লা লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ অনুসরণ করে। সে এগুলো পছন্দ করে, প্রশ্ন করে। যখন কিছু ভালো না হয়, সেটা নিয়ে আমার সাথে কথা বলে।
এটা কি সত্যি যে, বার্সেলোনা হেরে গেলে আপনি বাসায় ফুটবল নিয়ে কথা বলেন না?
আগে তা-ই করতাম। কিন্তু এখন আর না। আসলে খারাপ পারফরম্যান্স আর পরাজয় হজম করা সবসময়ই খুব কঠিন। কিন্তু থিয়াগো এখন আমাকে বাধ্য করে মন্তব্য করতে। কী হয়েছে, কেন আমরা জিততে পারলাম না- এসব নিয়ে। এখন আমরা অনেক বেশি কথা বলি।
আপনার সতীর্থ মার্ক-আন্দ্রে টের স্টেগেন বিশ্বকাপে জার্মানি দলের বেঞ্চে ছিলেন। আপনার কী মনে হয়, তার যে একটা মৌসুম কেটেছিলো এবং ম্যানুয়েল নয়্যারের যেহেতু ইঞ্জুরি ছিলো বায়ার্নে, তাতে স্টেগেনের প্রতি অবিচার হয়েছে?
এটা আমার জন্য একটা চমক ছিলো। মার্ক অসাধারণ একটা বছর কাটাচ্ছিলো। কিন্তু ব্যাপারটা তাদের (জার্মানির) ওপরই নির্ভর করে।
কোনটা বেশি পছন্দ করবেন- লিওরি সানেকে দলে পাওয়া, নাকি আবার পেপ গার্দিওলার সাথে কাজ করা?
সেরা খেলোয়াড়দের সাথে খেলাটা সবসময় অসাধারণ ব্যাপার। যদিও ব্যাপারটা খুব কঠিন, তারপরও আমি আবার গার্দিওলার সাথে কাজ করতে চাই। সে বিশ্বের সেরা কোচদের একজন।
আপনার অসম্ভব স্বপ্নটা কী? যেটা আপনি অর্জন করতে চান, কিন্তু পারবেন না?
কিছুই অসম্ভব নয়। আমাদের লড়াই করতে হবে এবং নিজেদের সর্বোচ্চ দিতে হবে এবং যা যা অর্জন করার মতো আছে, তার সবই অর্জন করতে হবে। এই মানসিকতা নিয়ে কাজ করলে এবং পরিশ্রম করলে কিছুই অসম্ভব নয়।
সম্প্রতি আপনি বলেছেন, আপনার পেনাল্টি নেওয়ার মান বাড়াতে হবে। কোন জায়গাটায় উন্নতি করতে হবে? আপনি কি গোলরক্ষকদের ভিডিও দেখেন? বা মহড়া করেন?
ট্রেনিং ও দেখা। আজকাল আমরা সবকিছুই বিশ্লেষণ করি: ফাউল, পেনাল্টি, খেলা। প্রতিটা জিনিসিই বিশ্লেষণ করা হয়। কিছুই সুযোগ নেওয়ার জন্য ছাড়া হয় না।
যা-ই হোক, আপনি যখন ফ্রি-কিকের জন্য বল রাখেন, মনে হয়, অর্ধেক গোল হয়ে গেছে। পেনাল্টি আর ফ্রি-কিকের মধ্যে পার্থক্য কী?
এটা আলাদা। একটাতে আপনার সামনে বাঁধা থাকবে, দূরত্ব বেশি। এটা (ফ্রি-কিক) ভিন্ন ধরনের শট। এখানে আপনার গোল করার চাপ থাকে না। আর পেনাল্টিতে পাওয়ার চেয়ে হারানোর শঙ্কাই বেশি থাকে। এখানে গোলরক্ষক বরং স্বচ্ছন্দে থাকে। চাপটা একেবারেই ভিন্ন।
গত বছর বার্সেলোনা আক্রমণের চেয়ে রক্ষণের রেকর্ড বেশি করেছে। কিন্তু এ বছর কেন বেশি গোল হজম করছে?
এ বছর আমরা আবার ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলছি। গত বছর আমরা চারজনের দুটো লাইন রেখেছিলাম রক্ষণে। ফলে ওখানে খুব কম জায়গা ছিলো এবং গোল তৈরি করা কঠিন ছিলো। এখন ৪-৩-৩ ফর্মেশনে আমরা বলের দখল বেশি রাখতে পারছি এবং ভালো খেলছি। কিন্তু ডিফেন্সে আমরা একটু আলগা হয়ে গেছি। আর প্রতিপক্ষ দলগুলো বেশি জায়গা পেয়ে যাচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক খেলাগুলোতে রক্ষণের জায়গাতেও আমরা উন্নতি করেছি। আশা করছি, এটা আরও ভালো হবে।
যুবদল থেকে যেসব খেলোয়াড় উঠে আসছে, তাদের দেখে কি বিস্মিত হচ্ছেন?
প্রথমে তো অবশ্যই। কিন্তু এরপর ওরা আমাদের সাথে ট্রেনিং করছে বেশ কিছুদিন ধরে। আর এরপর আমি বুঝতে পারছি, এরা আসলেই ভালো খেলোয়াড়। ক্লাব ওদের উন্নতি অসাধারণ কাজ করছে। ওদের আমাদের সাথে ট্রেনিং করাচ্ছে। ফলে ওরা দ্রুত বড় হয়ে উঠছে। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মডেল।
আপনার কী মনে হয়, বার্সেলোনা আবার একদিন এগারোজন যুব দল থেকে আসা খেলোয়াড় নিয়ে মাঠে নামতে পারবে?
এটা জটিল। আমি মনে করি, ওরা (যুব দলের খেলোয়াড়রা) মনে করে, প্রথম দলে পৌঁছানোটা এখন অসম্ভব নয়। ফলে এটা ভবিষ্যতে আবার ঘটতে পারে। তবে সময় লাগবে।
আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাকে কি মিস করেন?
অবশ্যই। মাঠে ও মাঠের বাইরে। আমরা অনেকগুলো বছর ধরে অনেককিছু ভাগাভাগি করেছি: অনেক সময়, অনেক ট্রেনিং সেশন, অনেক ম্যাচ এবং ফুটবলের বাইরের অনেক ঘটনা। অবশ্যই ওকে ছাড়া সময়টা একটু আজব।
লা লিগা কি এ বছর যেকোনো মৌসুমের চেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ?
আজকাল যেকোনো দলের বিপক্ষেই জেতা কঠিন। লিগ এখন অনেক কঠিন এবং এটা জেতাও অনেক কঠিন।
এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। তারপরও আপনি কি ব্যালন ডি’অরে পঞ্চম স্থানে থাকায় বিস্মিত হয়েছেন?
আমি যদি সত্যি কথা বলি, তাহলে আমি এটাতে অতটা গুরুত্ব দেই না; যদিও এটা অনেক বড় পুরষ্কার। আমি জানি, এই মৌসুমে যে অবস্থা ছিলো, তাতে আমার এটা জেতার সম্ভাবনা ছিলো না। তাই বিস্মিত হইনি।
এ বছর আপনার দল চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বেশ ভালো খেলছে। বিশেষ কোনো অনুপ্রেরণা কাজ করছে?
প্রতি বছরই আমাদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার আকাঙ্ক্ষা থাকে। এটা অনন্য, বিশেষ কিছু এবং আমার খেলা সবচেয়ে সুন্দর প্রতিযোগিতা। আমরা যা যা জিততে চাই, তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে ভিন্ন।
টটেনহ্যামের বিপক্ষে উসমানে ডেম্বেলের গোলটা অসাধারণ ছিলো। কিন্তু মাঠের বাইরে মনে হয় তার আরও পরিণত হওয়া দরকার।
মাঠে সে একজন ফেনোমেনন। এটা এখন তার ওপর নির্ভর করে। তার সামনে সে যা হতে চায়, তা-ই হওয়ার সুযোগ আছে। সে বিশ্বের সেরা হতে পারে। অন্যদিকে সে খুব তরুণ একটা ছেলে, যে নতুন একটা ক্লাব ও শহরে মানিয়ে নিচ্ছে। এ নিয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই ভালো। এখন জরুরি হচ্ছে, ওকে শান্ত হওয়ার জন্য সময় দেওয়া। সে এরই মধ্যে নিজের ভুলগুলো বুঝতে পেরেছে এবং সেগুলো শুধরাচ্ছে। আমরা সবাই ওকে ফুটবলেই মন দিতে সহায়তা করছি।
রিয়াল মাদ্রিদ যে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে এত মিস করছে, তাতে কি অবাক হচ্ছেন?
মৌসুমের শুরুতে আমি বলেছিলাম, ওরা একটা গ্রেট ক্লাব, বিশ্বের সেরা ক্লাবগুলোর একটা। তাদের দলে অনেক ভালো খেলোয়াড় আছে। কিন্তু যেকোনো দলই ক্রিস্টিয়ানোকে মিস করবে। সে অনেক গোল স্কোর করে। আর দলকে অনেক কিছু দেয়। ফলে বিষয়টা আমাকে অবাক করেনি।