সাচিকো’স ফিফটিয়েথ অ্যানিভার্সারি
আগস্ট ১৯৯৫
“মোশি মোশি (হ্যালো),” টেলিফোন ধরেই কথা বলে উঠলেন ছাপ্পান্ন বছর বয়সী সাচিকো ইয়াসুই।
টেলিফোনের অপরপ্রান্তে ছিলেন এক এলিমেন্টারি স্কুলের প্রিন্সিপাল। একটি বিশেষ প্রয়োজনেই সাচিকোকে ফোন করেছিলেন তিনি। পারমাণবিক বোমা হামলার পঞ্চাশ বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। এই উপলক্ষে একজন হিবাকুশা হিসেবে সাচিকো সেই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সাথে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে আগ্রহী কি না, এটা জানতেই ফোন করেছিলেন সেই প্রিন্সিপাল।
একটু ইতস্তত বোধ করলেন সাচিকো।
১৯৪৫ সালের ৯ আগস্টের পর কেটে গেছে পাঁচটি দশক।
এখন কি তার কথা বলাটা ঠিক হবে?
“হ্যাঁ,” জবাব দিলেন তিনি প্রিন্সিপালের উদ্দেশ্যে।
… … … …
১৯৯৫ সালের ৯ আগস্ট সন্ধ্যাবেলা; নাগাসাকি পিস পার্কে আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলো ততক্ষণে শেষ হয়ে গিয়েছে। দাদীমার গামলায় রাখা বরফগুলো ততক্ষণে গলে পানি হয়ে গেছে। একটি হোটেলের লবিতে ষষ্ঠ শ্রেণীর একদল শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাচিকো ইয়াসুই।
কর্পূর গাছগুলোর মতোই বলিষ্ঠভাবে সেদিন দাঁড়িয়ে ছিলেন সাচিকো। সামনে থাকা প্রতিটি বাচ্চার দিকেই হাসিমুখে দৃষ্টি বিনিময়ে করে নিলেন। এই ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে আকি, ইচিরো, মিসা, তোশি এবং সেই সাথে নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে গেলো তার। সেদিন মনে কেমন যেন অস্বাভাবিক এক জোর পাচ্ছিলেন তিনি, এক অন্যরকম স্বচ্ছতা বিরাজ করছিলো সেখানে।
কথা বলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন সাচিকো। সাথে সাথেই উপস্থিত শ্রোতাদের কথাবার্তার আওয়াজ থেমে গেলো।
“শান্তি নিয়ে কথাবার্তা বলার জন্য আজকের দিনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ,” সাচিকো বলতে শুরু করলেন। সেই সাথে বাচ্চাদের দিকে চেয়ে আবারও হাসলেন তিনি। “কিন্তু, এই শান্তির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমরা আসলে কী করতে পারি?”
পুরো রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিলো। প্রশ্নটা সাচিকো রেখেছিলেন আগত শ্রোতাদের উদ্দেশ্যেই।
“আমি আপনাদের এমন কিছুই জানাতে চাই, যা আপনাদের মনকে নাড়া দেবে, অতীতের ভয়াবহতার কথা স্মরণ করিয়ে যা আপনাদেরকে আগামী দিনগুলোতে শান্তি বজায় রাখার বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করবে। আর এটা করতে হলে আমার সকল অনুভূতিই শেয়ার করতে হবে… আপনাদের সাথে।”
“আমার মনে হয়, সেই সময়ে আসলে কী ঘটেছিল, সেটা অনুমান করা তোমাদের জন্য খুব একটা সহজ হবে না, কারণ তোমরা সবাই বয়সে খুব ছোট। কিন্তু, আমি চেষ্টা করবো, ভবিষ্যতে জীবনে যখন তুমি নানা রকম সমস্যার মুখোমুখি হবে, তখন একজন মানুষ হিসেবে তুমি কতটা শক্ত হতে পারবে, সেই সম্পর্কেই কথা বলতে।”
এটুকু বলেই সাচিকো পারমাণবিক বোমা হামলার দুঃসহ স্মৃতিগুলো সকলের উদ্দেশ্যে তুলে ধরতে শুরু করলেন। ডিমের গল্পটা দিয়েই শুরু হয়েছিল।
“আমার বয়স ছিল ছ’বছর, বেশ ক্ষুধা লেগেছিল।
ক্ষুধা লেগেছিলো আমার অন্য চার ভাই-বোনেরও, আকি, ইচিরো, মিসা আর তোশি।
ছোট্ট তোশি প্রতিদিনই ডিম খেত, কিন্তু আমাদের মুরগিটা সেদিন কোনো ডিম পাড়েনি।
সেদিন সকালে বিমান হামলার সাইরেনের কথা আমার বেশ ভালো করেই মনে আছে।
এরপর, মা আর তোশি মিলে ডিম খোঁজাখুঁজি করতে লাগলেন। আকি আর মিসা বাড়ির দিকে গেলো। আমি বন্ধুদের সাথে হাড়ি-পাতিল খেলতে থেকে গেলাম। আমরা খোলা আকাশের নিচে কাদামাটির দিয়ে খেলছিলাম।
হঠাৎ করেই উপরে বি-২৯ বিমানের ইঞ্জিন গর্জে উঠলো।
মেঘগুলো সরে গেলো।
পিকাডন! (জাপানী এই শব্দটি দিয়ে মূলত পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণকেই বোঝানো হয়ে থাকে; ‘পিকা’ অর্থ ‘অত্যুজ্জ্বল আলো’ এবং ‘ডন’ অর্থ ‘বিস্ফোরণ’।)
তোশি, আকি, ইচিরো- ওরা সবাই চলে গেছে।
সেই সাথে চলে গেছে মিসাও।
আমার বাবা।
আমার মা।
আমিও প্রায় মরেই গিয়েছিলাম।”
এটুকু বলে থামলেন সাচিকো।
“আমার সাথে যা হয়েছে, তা যেন তোমাদের সাথে কোনোদিন না হয়।”
রুমের কেউ কোনো কথা বলছিলো না। ছেলেমেয়ে এবং তাদের অভিভাবকেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন।
ঘাড় সোজা করে, মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন সাচিকো। বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকে তিনি এটাই বোঝাতে চাচ্ছিলেন যে, পারমাণবিক বোমারও শক্তি নেই মানুষের ভেতরের জীবনীশক্তিকে নিঃশেষ করে দেবার। আবারও কথা শুরু করলেন তিনি।
“সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বেঁচে থাকা। জীবনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ,” সাচিকোর কষ্ঠস্বর আরও জোরালো হয়ে উঠলো, হয়ে উঠলো আরও আত্মবিশ্বাসী। তিনি একে একে বলে গেলেন তার পরবর্তী জীবন সংগ্রামের গল্প, শান্তির বার্তা বয়ে আনা মানুষগুলোর কথা, এবং সেই সাথে যে মানুষগুলো সেই দুর্দিনে তাকে বাঁচিয়েছিলো (বাবা, হেলেন কেলার, মহাত্মা গান্ধী এবং মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র) তাদের কথাও।
বলার আসলে অনেক কিছুই ছিলো। কিন্তু কোন কথাটা বলা আসলে সবচেয়ে বেশি দরকার? সাচিকো তার সামনে বসা ছেলেমেয়েগুলোর চোখের দিকে তাকালেন।
“মনে রেখ-
প্রতিটি শব্দই মহামূল্যবান।
একটি শব্দ তোমার মাঝে ভালবাসাতে জাগাতে পারে। একটি শব্দই আঘাত করতে পারে।
একটি শব্দ তোমাকে কাঁদাতে পারে।
একটি শব্দ তোমার মনকে ভেঙে দিতে পারে।
একটি শব্দই এত রকমের ক্ষতি করতে পারে।
আবার একটি শব্দ অনেক ভালো কিছুও করতে পারে।
এমনকি, একটি শব্দই মানুষকে নেতৃত্ব দিতে পারে।
একটি শব্দ বিশ্বশান্তি বজায় রাখতে পারে।
প্রতিটি শব্দই মহামূল্যবান।”
“তোমরা যখন বড় হবে, তখন আমার গল্পটাও সবার মাঝে ছড়িয়ে দিও। তোমার সন্তানেরা যেন আমার এই কাহিনী একে অপরের আলাপ করে, এরপর তাদের সন্তানেরা, এরপর তাদের…।”
… … …
১৯৯৫ সালের ৯ আগস্টের পর থেকে সাচিকো ইয়াসুই পুরো জাপান ছুটে বেড়িয়েছেন, গিয়েছেন কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সাথে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন তিনি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিয়েছেন, বিভিন্ন রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে দিয়েছেন সাক্ষাৎকার।
২০০৫ সালে, যে বছর পারমাণবিক বোমা হামলার ষাট বছর পূর্তি হলো, নাগাসাকি ফাউন্ডেশন ফর প্রমোশন অফ পিসের কেইশো-বু শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন সাচিকো। সংগঠনটি হিবাকুশাদের অভিজ্ঞতা সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি এর সভাপতি ছিলেন, নিজের কাহিনী ছড়িয়ে দিয়েছেন অনেকের মাঝে এবং কাজ করেছেন শান্তি বজায় রাখতেও।
২০১৪ সালে বিশ্বের তরুণ-তরুণীদের জন্য তিনি এই উপদেশটি দিয়েছিলেন:
“শান্তি আসলে কী?
আমার আসলে কোন ধরনের মানুষ হওয়া উচিত?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে থাকো।”
… … … …
‘সাচিকো – অ্যা নাগাসাকি বম্ব সারভাইভার্স স্টোরি’ বইটি লেখিকা কারেন স্টেলসন সাচিকো ইয়াসুইয়ের বিভিন্ন ইন্টারভিউয়ের উপর ভিত্তি করে লিখেছেন। ইন্টারভিউগুলো নিয়েছিলেন তিনি নিজেই। এ লক্ষ্যে ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারির মাঝে তাকে পাঁচবার জাপানেও যেতে হয়। সেই সাথে চিঠি এবং ফোনে যোগাযোগও চলে ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। এই বইয়ের প্রতিটি অংশই সাচিকো নিজে পড়েছেন এবং তার কাছ থেকে সম্মতিসূচক অনুমতি পেয়েই স্টেলসন একে একে সামনের দিকে এগিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর ভিন্নধর্মী দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা বাস্তবে এ কাহিনীটি এতদিন ধরে ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ সকলকে। ২০টি পর্বের মধ্য দিয়েই সমাপ্তি টানা হলো ভিন্ন আঙ্গিকে দেখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন হিবাকুশার স্মৃতিকথাকে। অনুবাদকের সাথে কোনোরুপ আলাপের জন্য যোগাযোগ করুন এই ইমেইলে: [email protected]