সাইকেলের মতো একটি সরল যান আবিষ্কারের পেছনের কাহিনী কিন্তু মোটেও সরল না। বর্তমানে আমরা বাই সাইকেল বা দ্বিচক্রযান বলতে যাকে বুঝাই, তার একক কোনো আবিষ্কারক নেই। সর্বপ্রথম কে সাইকেল আবিষ্কার করেছেন, সেটি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। তার চেয়েও বড় বিতর্ক আছে সাইকেলের সংজ্ঞা নিয়ে। কারণ প্রথম দিকের অনেকগুলো সংস্করণের সাথে বর্তমান যুগের সাইকেলের মিলের পাশাপাশি অমিলও কম নেই। তবে একটি কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সাইকেল আবিষ্কারের ইতিহাস জানতে চাইলে একক কোনো বিজ্ঞানীর অবদান অনুসন্ধান করার চেয়ে বরং একাধিক আবিষ্কারকের প্রচেষ্টা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করাই ভালো, যাদের শত শত বছরের অবিরল প্রচেষ্টার ফসল এই সরল, কিন্তু যুগান্তকারী আবিষ্কারটি।
হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ ঘোড়া, উট প্রভৃতি প্রাণীর পিঠে চড়েই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল করতো। গরু, গাধা এবং ঘোড়ার পেছনে চাকার উপর পাটাতন জুড়ে দিয়ে গাড়ি বানিয়ে তার উপরে চড়ে চলাচলের উদাহরণও বেশ প্রাচীন। কিন্তু কোনো প্রাণীর সাহায্য ছাড়া মনুষ্য চালিত যানের ধারণার প্রথম সন্ধান পাওয়া যায় ১৫৩৪ সালে আঁকা এক ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী জিয়ান জিয়াকোমো ক্যাপ্রোত্তির (Gian Giacomo Caprotti) আঁকা চিত্রকর্মে।
ক্যাপ্রোত্তি ছিলেন ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির একজন শিষ্য, যিনি নিজে অসংখ্য যন্ত্রের প্রাথমিক খসড়া অঙ্কন করেছিলেন। ক্যাপ্রোত্তির এই সাইকেলটি ছিল দুটি কাঠের তৈরি চাকা, চেইন, প্যাডেল বা পা-দানি এবং হাতল সম্বলিত, যা প্রায় আধুনিক যুগের সাইকেলের মতোই। আধুনিক সাইকেলের সাথে এর পার্থক্য ছিল, এতে সামনের চাকা ঘোরানো যেত না। তবে এই মডেলের সাইকেল আদৌ নির্মিত হয়েছিল কি না, তা জানা যায় না। তাছাড়া, ক্যাপ্রোত্তির এই চিত্রকর্মটিও আসল কি না, তা নিয়েও বিতর্ক আছে।
আরেকটি সাইকেলের সন্ধান পাওয়া যায়, যা ১৭৯২ সালে নির্মিত হয়েছিল বলে দাবি করা হয়। ফরাসি হস্তশিল্পী কোঁত মিড ডে সিভরাক Comte Mede De Sivrac) এই সাইকেলটি তৈরি করেছিলেন বলে দাবি করা হয়। এর নাম ছিল Celerifere অথবা Velocifere। এটিও কাঠের কাঠামোর তৈরি। এতে কোনো পা-দানি, হাতল বা সামনের চাকা ঘোরানোর কোনো পদ্ধতি ছিল না। যদিও সে সময় চার চাকা বিশিষ্ট মনুষ্য নির্মিত সাইকেলের অস্তিত্বের কথা জানা যায়, কিন্তু দুই চাকা বিশিষ্ট এই সাইকেলটির দাবিটিকে অনেকে ভুয়া বলে সন্দেহ করেন।
আধুনিক সাইকেলের পথিকৃত হিসেবে নিশ্চিতভাবে সর্বপ্রথম যার নাম পাওয়া যায়, তিনি হলেন জার্মান ব্যারন কার্ল ভন ড্রাইস (Karl Von Drais)। ১৮১৩ সালে তিনি দৌড়যন্ত্র (রানিং মেশিন, জার্মান ভাষায় Laufmaschine) নামে চার চাকা বিশিষ্ট একটি যান তৈরি করেন। চাকা ঘোরানোর জন্য এতে কোনো প্যাডেল বা পা-দানি ছিল না। এর কাজ ছিল অনেকটা ঠেলাগাড়ির মতো, পা দিয়ে হেঁটে হেঁটেই এর চাকাগুলো ঘোরাতে হতো। এই চার চাকা বিশিষ্ট রানিং মেশিনের ধারাবাহিকতায়ই ড্রাইস পরবর্তীতে দুই চাকা বিশিষ্ট সাইকেল তৈরি করেন। তার সেই সাইকেল আবিষ্কারের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
১৮১৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার মাউন্ট টাম্বোরার আগ্নেয়গিরিতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। বিশ্বব্যাপী এই অগ্ন্যুৎপাতের প্রভাব ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। ইন্দোনেশিয়া সহ প্রায় সমগ্র এশিয়া এবং আফ্রিকার আকাশ অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট ছাইয়ের মেঘে ঢেকে যায়। এসব এলাকার তাপমাত্রা কিছুটা নেমে যায়। ফলে শষ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খেতে না পেয়ে অন্যান্য পশুপাখির পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক ঘোড়াও মারা যায়। ফলে ঘোড়ার গাড়ির উপর নির্ভরশীল তৎকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ড্রাইস এমনিতেই তার রানিং মেশিনটিকে আরো উন্নত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। ঘোড়ার সংকটের কারণে তিনি তার গবেষণায় আরো মনোযোগ দেন এবং ১৮১৭ সালে প্রথম দুই চাকা বিশিষ্ট সাইকেল তৈরি করতে সক্ষম হন। তার আবিষ্কৃত সাইকেলের ওজন ছিল ২৩ কেজি। এর চাকা দুটো ছিল কাঠের তৈরি, যার সাথে সংযুক্ত ছিল একটি কাঠের কাঠামো। কাঠামোর উপরে একটি চামড়ার আসন ছিল, যার উপরে বসে পা দিয়ে হেঁটে হেঁটে সাইকেলটি চালাতে হতো। এই সাইকেলে সামনের চাকা ঘোরানোর সুবিধা ছিল, ফলে ইচ্ছেমতো দিক পরিবর্তন করা যেত।
ড্রাইসের সাইকেলটি ছিল প্রথম দুই চাকাবিশিষ্ট সাইকেল, যার প্যাটেন্ট করানো হয়েছিল। এই সাইকেলে চড়ে তিনি মাত্র ১ ঘন্টায় ১৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিলেন। ড্রাইসের তৈরি এই সাইকেলটি তার নামানুসারে ড্রাইসিন (Draisienne) নামে পরিচিত হয়। এছাড়াও এই জাতীয় যানকে তখন সাধারণভাবে দ্রুতপদ বা ভেলোসিপেড (Velocipede), শখের ঘোড়া বা হবি হর্স (Hobby Horse) বা ড্যান্ডি হর্স (Dandy Horse) নামেও আখ্যায়িত করা হতো।
১৮১৮ সালে ব্রিটেনে ডেনিস জনসন নামে আরেকজন উদ্ভাবক জনসন’স হবি হর্স নামে একটি সাইকেলের প্যাটেন্ট করান। এটি ছিল ড্রাইসিনেরই উন্নত সংস্করণ। জার্মানি, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনে সে সময়ের ধনীদের মধ্যে ড্রাইস এবং জনসনের সাইকেলের মডেল মোটামুটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু ফসল উৎপাদন স্বাভাবিক হওয়ার পর পুনরায় ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার বেড়ে যায় এবং একপর্যায়ে পদচারী ও ঘোড়ার গাড়ির জন্য বিপজ্জনক হসেবে চিহ্নিত করে এই সাইকেলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
ড্রাইসিন নিষিদ্ধ হওয়ার পরে প্রায় চার দশক পর্যন্ত সাইকেলের অগ্রগতি থমকে থাকে। এর মধ্যে ১৮৩৯ সালে কার্কপ্যাট্রিক ম্যাকমিলান নামে স্কটল্যান্ডের এক কর্মকার এবং ১৮৪৫ সালে গ্যাভিন ড্যালজেল নামে আরেকজন স্কটিশের কথা শোনা যায়, যারা প্যাডেল যুক্ত সাইকেল আবিষ্কার করেছেন বলে দাবি করা হয়। তবে এসব দাবির পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না।
দুই চাকা এবং প্যাডেল বিশিষ্ট সাইকেল সত্যিকার অর্থে জনপ্রিয় এবং বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা শুরু হয় ১৮৬০ এর দশকের ফ্রান্সে। ঠিক কে প্রথম এরকম প্যাডেল বিশিষ্ট সাইকেল আবিষ্কার করেছিলেন, সেটি অবশ্য বিতর্কিত। দুজন ফরাসি ঘোড়ার গাড়ি নির্মাতা পিয়েরে মিশোঁ (Pierre Michaux) এবং পিয়েরে ল্যালমোঁকে (Pierre Lallement) পৃথক পৃথকভাবে সাইকেল আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তারাই সর্বপ্রথম সাইকেলের সামনের চাকায় প্যাডেল সংযুক্ত করেন, যার ফলে এটি চালানো অনেক সহজ হয়ে যায় এবং এর গতিও বৃদ্ধি পায়। যদিও পিয়েরে ল্যালেমেন্ট ১৮৬৬ সালে সর্বপ্রথম প্যাডেলযুক্ত সাইকেলের প্যাটেন্ট করেন, কিন্তু তিনি তা আবিষ্কার করেছিলেন আরো আগে, ১৮৬৩ সালে। ধারণা করা হয়, তারও কয়েক বছর আগে পিয়েরে মিশোঁ সর্বপ্রথম প্যাডেল যুক্ত সাইকেল নির্মাণ শুরু করেছিলেন।
এ সময় সাইকেলের চাকাগুলো কাঠের তৈরি হওয়ায় উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে চলার সময় প্রচন্ড ঝাঁকুনির সৃষ্টি হতো। এ কারণে এ সময়ের সাইকেলগুলো বোন শেকার (Boneshaker) নামেও পরিচিত ছিল। তাছাড়া এ সময়ের সাইকেলগুলোতে চেইনের ব্যবহার না থাকায় প্যাডাল লাগানো থাকতো সামনের চাকায়। সেই সামনের চাকাকেই আবার ডানে-বামে ঘুরিয়ে সাইকেলের দিক পরিবর্তন করতে হতো। ফলে এই সাইকেলগুলো চালানো বেশ কঠিন ছিল। মিশোঁ এবং তার ব্যবসায়িক সঙ্গী অলিভিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় তাদের আবিষ্কৃত এই সাইকেলগুলো ইংল্যান্ডে প্রদর্শন করেছিলেন। সাইকেলগুলো সেখানকার শৌখিন ধনীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
পরবর্তী কয়েক বছর সাইকেলের বিভিন্ন সংস্করণ বাজারে আসতে থাকে। ১৮৭০ সালে বাজারে আসে অদ্ভুতদর্শন এক সাইকেল, যার পেছনের চাকার তুলনায় সামনের চাকা ছিল অনেক বড়। প্যাডেলযুক্ত সামনের চাকা আকারে বড় হওয়ায় এর গতি ছিল আগের তুলনায় অনেক বেশি। তাছাড়া এতে স্টিলের চাকা ব্যবহার করায় ঝাঁকুনিও কিছুটা কমে গিয়েছিল। এই ধরনের সাইকেলের নাম ছিল পেনি-ফার্দিং বাই সাইকেল বা হাই হুইল বাই সাইকেল। পেনি এবং ফার্দিং ছিল সে সময় প্রচলিত দুইটি কয়েনের মুদ্রার নাম, যাদের একটি ছোট, অন্যটি বড়। সাইকেলের চাকার সাথে আকৃতিতে মিল থাকার কারণেই এই নামকরণ।
সাইকেলের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার সেফটি বাই সাইকেল। এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই সাইকেল বর্তমানের চেহারা লাভ করে। এর পূর্ব পর্যন্ত শুধুমাত্র শক্তসমর্থ পুরুষদের পক্ষেই সাইকেল চালানো সম্ভব ছিল। তারপরেও তাতে বেশ ঝুঁকি ছিল। কিন্তু ১৮৮৫ সালে জন কেম্প স্টার্লি (John Kemp Starley) নামে এক ব্রিটিশ উদ্ভাবক সর্বপ্রথম সেফটি বাই সাইকেল আবিষ্কার করেন। এতে দুইটি চাকাই ছিল সমান এবং সামনের চাকার পরিবর্তে এখনকার মতো পেছনের চাকার সাথে চেইনের মাধ্যমে প্যাডেল যুক্ত ছিল। ফলে সাইকেল সাইকেল চালানো একইসাথে অনেক নিরাপদ এবং সহজ হয়ে যায়।
এর পর ধীরে ধীরে গত দেড়শো বছরে সাইকেলের অনেক উন্নতি হয়েছে। স্টিলের চাকার পরিবর্তে বায়ুভর্তি রাবারের চাকা এসেছে, মেয়েদের চালানোর উপযোগী নিচু কাঠামো বিশিষ্ট সাইকেল তৈরি হয়েছে, ব্রেকের উন্নতি ঘটেছে, কিকস্ট্যাড সংযুক্ত হয়েছে, ব্যাটারি চালিত মোটর সংযুক্ত হয়েছে, কিন্তু যুগান্তকারী কোনো পরিবর্তন বা সংযোজন হয়নি।
সাইকেল বলতে আমরা এখনও যা বুঝি, তা প্রধানত পিয়েরে মিশোঁ, পিয়েরে ল্যালমোঁ এবং জন কেম্প স্টার্লি এই তিনজন মিলেই তৈরি করে দিয়ে গেছেন আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে। যুগ যুগ ধরে তাদের আবিষ্কারের সুফল ভোগ করেছে বিশ্বের শত শত কোটি মানুষ। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মোটর সাইকেল, গাড়ি সহ অনেক যানবাহনই আবিষ্কৃত হয়েছে, ফলে সাইকেলের ব্যবহারও কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু তা বিলুপ্ত হয়নি। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও এখনও স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের জন্য মানুষ সাইকেলই ব্যবহার করে।
ফিচার ইমেজ- Wikimedia Commons