তিনি ছিলেন রুশ বিপ্লবের ‘সন্তান’দের একজন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রাশিয়ার গৃহযুদ্ধের বীর যোদ্ধা ছিলেন তিনি। মধ্য এশিয়ায় সোভিয়েত শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার বিস্তারে তার ছিল অসামান্য অবদান। রুশ, আর্মেনীয়, তুর্কি, ফার্সি ও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন তিনি। অথচ ভাগ্যের পরিহাসে রুশ বিপ্লবের সেই সন্তান একটি মেয়ের জন্য সোভিয়েত রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন এবং রাষ্ট্রের চরম শত্রুতে পরিণত হন।
গিওর্গি আগাবেকভের প্রকৃত নাম ছিল গিওর্গি সের্গিয়েভিচ আর্তুইয়ুনভ। ১৮৯৫ (মতান্তরে ১৮৯৬) সালে তৎকালীন রুশ সাম্রাজ্যের জাকাস্পিয়স্কায়া ওব্লাস্তের (Закаспийская область, ‘ট্রান্স–কাস্পিয়ান অঞ্চল’) রাজধানী আসখাবাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। আশগাবাৎ (Aşgabat) শহরটি বর্তমানে তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী। আগাবেকভের পরিবারটি ছিল জাতিগতভাবে আর্মেনীয়। আগাবেকভ তৎকালীন রুশ সাম্রাজ্যের তুর্কিস্তান গভর্নরেট–জেনারেলের (Туркестанское генерал-губернаторство) রাজধানী তাসখন্দের একটি জিমনেসিয়ামে পড়াশোনা করেন। তাসখন্দ শহরটি বর্তমানে উজবেকিস্তানের রাজধানী।
১৯১৪ সালের ১ আগস্ট জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এসময় ১৯ বছর বয়সী আগাবেকভকে বাধ্যতামূলক সামরিক আইন অনুযায়ী রুশ সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত করা হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করা হয়। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে জার্মান ও অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পর ১৯১৬ সালের অক্টোবরে তাকে তাসখন্দের সৈনিকদের স্কুলে প্রেরণ করা হয় উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য।
প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর আগাবেকভকে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করা হয়, এবার রোমানিয়ায়। রোমানিয়ায় আগাবেকভ রুশ সেনাবাহিনীর ৪৬তম পদাতিক রেজিমেন্টের একটি প্লাটুনের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন এবং এর পাশাপাশি রেজিমেন্টটির সদর দপ্তরে তুর্কি ভাষার অনুবাদক হিসেবেও কাজ করেন। ১৯১৭ সালের মার্চে রুশ রাজধানী পেত্রোগ্রাদে (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং আগাবেকভ এই বিপ্লবকে সোৎসাহে সমর্থন করেন। এসময় রাশিয়ার নতুন সরকার রুশ সেনাবাহিনীতে নির্বাচনের মাধ্যমে অফিসার নিয়োগের প্রথা প্রবর্তন করে এবং আগাবেকভের রেজিমেন্টের সৈন্যরা তাকে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার হিসেবে নির্বাচিত করে।
১৯১৭ সালের নভেম্বরে ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিকরা রাশিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং রুশ সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দেয়। আগাবেকভ সেনাবাহিনী ত্যাগ করে তুর্কিস্তানে ফিরে যান এবং ১৯১৮ সালের মার্চে তুর্কিস্তানের ‘লাল রক্ষীবাহিনী’র (Красная гвардия) একটি ইউনিটে যোগদান করেন। উল্লেখ্য, লাল রক্ষীবাহিনী ছিল রুশ বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে শ্রমিক, কৃষক ও কসাক এবং কিছু সংখ্যক সৈনিক ও নাবিককে নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী বিকেন্দ্রীকৃত আধা–সামরিক বাহিনী (paramilitary), যেটি রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় বলশেভিকদের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠত।
কয়েক মাস পর আগাবেকভ শ্রমিক ও কৃষকদের লাল ফৌজে (Рабоче-крестьянская Красная армия) যোগদান করেন। এটি ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার সশস্ত্রবাহিনী। ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত তিনি লাল ফৌজের বিভিন্ন ইউনিটের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রথমে তিনি তুর্কিস্তানে বিভিন্ন বলশেভিক–বিরোধী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং পরবর্তীতে সাইবেরিয়া ও উরাল অঞ্চলে বলশেভিক–বিরোধী শ্বেত ফৌজের (Белая армия) কমান্ডার এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রুশ রাষ্ট্রপ্রধান অ্যাডমিরাল আলেক্সান্দর কোলচাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোলচাক বলশেভিকদের হাতে বন্দি হন এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
একই বছর আগাবেকভ বলশেভিক দলে যোগদান করেন এবং এর অল্প কিছুদিন পরেই সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ‘চেকা’য় যোগদান করেন। এসময়ই তাকে ‘আগাবেকভ’ ছদ্মনাম প্রদান করা হয়। এসময় তাকে প্রথমে একাতেরিনবুর্গে লাল ফৌজের অভ্যন্তরীণ সৈন্য ব্যাটালিয়নের সামরিক কমিশার নিযুক্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে তিনি একাতেরিনবুর্গ প্রাদেশিক ‘চেকা’র একজন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। একাতেরিনবুর্গ অঞ্চলে সোভিয়েত–বিরোধীদের নিশ্চিহ্নকরণ এবং তিউমেন অঞ্চলে একটি কৃষক বিদ্রোহ দমনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
আগাবেকভ তুর্কি ও ফার্সি ভাষায় অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। এজন ১৯২১ সালের অক্টোবরে তাকে মস্কোয় ডেকে পাঠানো হয় এবং ‘চেকা’র প্রাচ্যবিষয়ক সেকশনে নিযুক্ত করা হয়। ১৯২২ সালে তাকে আবার মধ্য এশিয়ায় প্রেরণ করা হয় এবং তুর্কিস্তান ফ্রন্টে ‘চেকা’র প্রধান লাতভীয় বলশেভিক জেকাবস পিটার্সের অধীনে অপারেশন্স অফিসার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এসময় তিনি তুর্কিস্তান অঞ্চলে সোভিয়েত–বিরোধী মুসলিম গেরিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।
এসময় তুর্কিস্তানে সোভিয়েত–বিরোধী মুসলিম গেরিলাদের সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন প্রাক্তন ওসমানীয় রাষ্ট্রনায়ক এনভের পাশা। এনভের পাশা ছিলেন ১৯০৮ সালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যে সংঘটিত ‘তরুণ তুর্কি বিপ্লব’–এর নেতা, দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের বীর নায়ক এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের যুদ্ধমন্ত্রী ও প্রকৃত শাসক। বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পরাজয় ও পতনের পর একপর্যায়ে তিনি মস্কোয় যান এবং সোভিয়েত নেতাদের আস্থা অর্জন করেন। ১৯২১ সালের নভেম্বরে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী লেনিন তুর্কিস্তানের বুখারায় চলমান বিদ্রোহ দমনে স্থানীয় বলশেভিক সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য এনভেরকে সেখানে প্রেরণ করেন।
বৃহত্তর–তুর্কি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এনভের বুখারায় পৌঁছে পক্ষ পরিবর্তন করেন এবং বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেন। তুর্কিস্তান অঞ্চলে সক্রিয় সবগুলো সোভিয়েত–বিরোধী মুসলিম গেরিলা দলকে একত্রিত করে এনভের তাদের সর্বোচ্চ নেতা নিযুক্ত হন। তিনি জার্মান সশস্ত্রবাহিনীর ধাঁচে তার বাহিনীকে গড়ে তোলেন এবং প্রাক্তন ওসমানীয় সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা তার গেরিলাদের নেতৃত্বে ছিলেন। তুর্কিস্তানে সোভিয়েত শাসনের প্রতি এনভের মারাত্মক এক হুমকি হয়ে উঠেছিলেন।
সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ‘চেকা’কে এনভেরের গুপ্ত ঘাঁটি খুঁজে বের করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এবং আগাবেকভও এই কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এনভেরের গেরিলা বাহিনীর সদর দপ্তর ছিল বর্তমান তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবে শহরের নিকটবর্তী আব–ই–দেরিয়া গ্রামে। আগাবেকভ ১৯২২ সালের আগস্টে এই ঘাঁটির সন্ধান লাভ করেন এবং সোভিয়েত সরকারকে অবহিত করেন। ৪ আগস্ট লাল ফৌজের বাশকির অশ্বারোহী ব্রিগেড ঘাঁটিটির ওপর আক্রমণ চালায় এবং এনভের সম্মুখযুদ্ধে নিহত হন। এর ফলে তুর্কিস্তানে সোভিয়েত–বিরোধী মুসলিম গেরিলারা আবার বিভিন্ন দল–উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং সোভিয়েত সরকার তাদেরকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়।
এই সাফল্যের পর আগাবেকভকে তাসখন্দে প্রেরণ করা হয় এবং সমগ্র তুর্কিস্তানে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার বিদেশি গুপ্তচর ও চোরাচালান–বিরোধী বিভাগদ্বয়ের প্রধান নিযুক্ত হন। একইসঙ্গে তিনি স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার স্থানীয় রাজনৈতিক শাখার সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় সোভিয়েত তুর্কিস্তান বিদেশি গুপ্তচরে ছেয়ে গিয়েছিল এবং আগাবেকভ এই গুপ্তচরদের দমনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
১৯২৪ সালের এপ্রিলে আগাবেকভকে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ‘ওজিপিইউ’–এর বৈদেশিক বিভাগে বদলি করা হয় এবং কূটনীতিক হিসেবে আফগানিস্তানে প্রেরণ করা হয়। এসময় আগাবেকভ ছিলেন আনুষ্ঠানিকভাবে কাবুলে অবস্থিত সোভিয়েত দূতাবাসের প্রচার বিভাগের প্রধান নিকোলাই ফ্রিদগুতের সহকারী, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন ‘ওজিপিইউ’–এর প্রতিনিধি এবং আফগানিস্তানে সংগৃহীত যাবতীয় তথ্য সাঙ্কেতিক ভাষায় রূপান্তরিত করে মস্কোয় প্রেরণ করা ছিল তার দায়িত্ব।
১৯২৬ সালের শেষের দিকে আগাবেকভকে আফগানিস্তান থেকে ইরানে বদলি করা হয় এবং তিনি তেহরানে ‘ওজিপিইউ’–এর ‘রেজিদিয়েন্ত’ (резидент) বা স্টেশন চিফ নিযুক্ত হন। এসময় ইরানে কর্মরত বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গুপ্ত সংকেতের মর্মার্থ উদঘাটন এবং ইরানিদের মধ্যে সোভিয়েত গুপ্তচর নিয়োগে আগাবেকভ বিশেষ সাফল্য অর্জন করেন। তদুপরি, সেসময় ইরানের ওপর প্রভাব বিস্তার নিয়ে ব্রিটেনের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিযোগিতা চলছিল এবং আগাবেকভ ইরানের বিভিন্ন গোত্রীয় নেতার মধ্যে ব্রিটিশ–বিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন।
১৯২৮ সালের ১ জানুয়ারি সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিনের ব্যক্তিগত সহকারী বোরিস বাঝানভ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ইরানে পালিয়ে যান এবং আগাবেকভকে দায়িত্ব দেয়া হয় বাঝানভকে বন্দি করে মস্কোয় প্রেরণ অথবা খুন করার জন্য। কিন্তু ইরানি সরকার বাঝানভকে কঠোর নিরাপত্তাধীনে রাখার কারণে আগাবেকভের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। একই বছরের এপ্রিলে আগাবেকভকে মস্কোয় ডেকে পাঠানো হয় এবং ‘ওজিপিইউ’–এর বৈদেশিক বিভাগের মধ্যপ্রাচ্য অধিদপ্তরের প্রধান নিযুক্ত করা হয়।
১৯২৯ সালের অক্টোবরে আগাবেকভ ‘নের্সেস ওভসেপিয়ান’ ছদ্মনামে একজন ধনী আর্মেনীয় বণিকের ছদ্মবেশ নিয়ে ইরানি পাসপোর্ট ব্যবহার করে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেন প্রজাতন্ত্রের ওদেসা বন্দর হয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে পৌঁছান। সেসময় ইস্তাম্বুলে ওজিপিইউ–এর ‘রেজিদিয়েন্ত’ ছিলেন ইয়াকভ ব্লুমকিন, যিনি ছিলেন রাজনৈতিকভাবে প্রাক্তন সোভিয়েত যুদ্ধমন্ত্রী লিওন ত্রতস্কির অনুসারী। ব্লুমকিন তুরস্ক ছাড়াও মিসর, হিজাজ, ব্রিটিশ–নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিন এবং ফরাসি–নিয়ন্ত্রিত সিরিয়ায় বহুসংখ্যক ‘বেআইনি’ গুপ্তচর নিয়োগ করেছিলেন। ব্লুমকিনকে মস্কোয় ডেকে পাঠিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয় এবং তার স্থলে আগাবেকভকে ইস্তাম্বুলে ওজিপিইউ ‘রেজিদিয়েন্ত’ নিযুক্ত করা হয়।
আগাবেকভের মতে, ১৯৩০ সালের আগ পর্যন্ত ওজিপিইউ তুরস্ককে একটি মিত্ররাষ্ট্র হিসেবেই বিবেচনা করত, কিন্তু এরপরও তারা তুর্কি পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার পারস্পরিক সহযোগিতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ওজিপিইউ–এর বৈদেশিক বিভাগের প্রধান মিখাইল ত্রিলিসসের ইস্তাম্বুলকে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত গোয়েন্দা কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন এবং আগাবেকভকে এই দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ইস্তাম্বুলে থাকা অবস্থায় আগাবেকভ ইসাবেল স্ট্রেটার নামক একজন ইংরেজি ভাষা শিক্ষিকার প্রেমে পড়েন। অনেকেই ধারণা করেন, ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা আগাবেকভকে পক্ষ পরিবর্তন করানোর উদ্দেশ্যে ইসাবেলকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছিল, যদিও এটি সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
১৯৩০ সালের জুনে আগাবেকভ পক্ষ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন এবং ইস্তাম্বুল থেকে ফ্রান্সে পালিয়ে যান। ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা গর্ডন ব্রুক–শেফার্ডের মতে, ইসাবেলের সঙ্গে প্রেমের কারণেই আগাবেকভ পক্ষ পরিবর্তন করেছিলেন। কিন্তু আগাবেকভের নিজের বক্তব্য অনুযায়ী, তার পক্ষ পরিবর্তনের কারণ ছিল রাজনৈতিক ও আদর্শিক। সোভিয়েত ইউনিয়নে আমলাতন্ত্রের বিস্তার, কমিউনিস্ট পার্টিতে গণতন্ত্রের বিলুপ্তি এবং স্তালিনের একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে তিনি তার পক্ষ পরিবর্তনের কারণ হিসেবে দায়ী করেন। কারণ যা-ই হোক, আগাবেকভ ছিলেন সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার প্রথম উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।
প্যারিসে পৌঁছানোর অল্প কিছুদিন পর ফরাসি সরকার ১৯৩০ সালের আগস্টে আগাবেকভকে বহিষ্কার করে এবং তিনি বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে চলে যান। সেখানে তিনি নিজের প্রকৃত নাম ‘আর্তুইয়ুনভ’ ব্যবহার করতেন। সেখানে তিনি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং ইসাবেলকে বিয়ে করতে সক্ষম হন।
১৯৩১ সালে আগাবেকভ ‘ওজিপিইউ: দ্য রাশান সিক্রেট টেরর’ নামে ইংরেজি ভাষায় একটি বই লেখেন। বইটিতে তিনি ওজিপিইউ–এর প্রচুর গোপন তথ্য ফাঁস করে দেন। এর ফলে ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্রে বহু সংখ্যক সোভিয়েত গুপ্তচর ও সমর্থক ধরা পড়ে এবং এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইরানের মধ্যে সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে। তিনি আরো জানান, ওজিপিইউ সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে ও বাইরে গোয়েন্দা কর্মকাণ্ডের জন্য আর্মেনীয় ধর্মীয় নেতাদের ব্যবহার করে থাকে। পরবর্তীতে তিনি জার্মানির বার্লিনে রুশ ভাষায় আরো ২টি বই প্রকাশ করেন এবং এগুলো ছিল মূলত আত্মজীবনীমূলক।
আগাবেকভের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত গোয়েন্দা কর্মকাণ্ডের মারাত্মক ক্ষতি হয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই মস্কো আগাবেকভের ওপর যারপরনাই ক্রুদ্ধ হয় এবং তাকে খুন করার প্রচেষ্টা চালায়।
আগাবেকভকে খুন করার জন্য সোভিয়েত গোয়েন্দাদের বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অবশেষে ১৯৩৭ সালে সোভিয়েত গোয়েন্দা কর্মকর্তা আলেক্সান্দর করোতকভ আগাবেকভকে খুন করার জন্য একটি বিশেষ পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ফ্রান্সের প্যারিসে বসবাসরত একজন প্রাক্তন ওসমানীয় তুর্কি সেনা কর্মকর্তাকে (যার নাম জানা যায়নি) কৌশলে আগাবেকভের অবস্থান জানিয়ে দেয়া হয়। আগাবেকভ তার আত্মজীবনীতে প্রাক্তন ওসমানীয় রাষ্ট্রনায়ক এনভের পাশার মৃত্যুতে তার ভূমিকা সম্পর্কে লিখেছিলেন এবং এর ফলে এনভের পাশার সমর্থকরা তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। প্যারিসে বসবাসরত সেই প্রাক্তন তুর্কি সেনা কর্মকর্তাও ছিলেন এনভের পাশার সমর্থক। তিনি আগাবেকভকে খুন করেন এবং আগাবেকভের লাশ অজ্ঞাত কোনো স্থানে দাফন করেন। এভাবে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার ইতিহাসের প্রথম বিশ্বাসঘাতক কর্মকর্তার জীবনাবসান ঘটে।