১৯৪৫ সালের শুরুর দিক থেকেই পূর্ব দিক থেকে সোভিয়েতরা এবং পশ্চিম দিক থেকে মার্কিনরা বার্লিন দখলের জন্য এগিয়ে আসতে থাকে, কে কার আগে দখল করতে পারে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। তবে জয়টা হয় সোভিয়েতদেরই, এপ্রিল মাসে জার্মানির রাজধানীতে স্রোতের মতো ঢুকতে শুরু করে রেড আর্মির বহর।
মিত্রবাহিনী পুরো জার্মানিকে যেমন চারভাগে ভাগ করে নেয়, তেমনিভাবে বার্লিনকেও কেটে চার ভাগ করা হয়। বার্লিন সোভিয়েতদের দখলে থাকা পূর্ব জার্মানির মাঝখানে থাকলেও কেন বার্লিন শহরের পশ্চিম অংশ পশ্চিমা শক্তিগুলোর কাছে হস্তান্তর করে?
প্রথমত, এর সবচেয়ে বড় কারণ ছিল বিশ্বযুদ্ধে কোনদিকে এগোবে এবং কে সবার আগে বার্লিন দখল করতে পারবে তা নিয়ে মিত্রশক্তিগুলোর মধ্যে বিভ্রান্তি ছিল। তাছাড়া বার্লিন রাজধানী হওয়ায় এর মর্যাদাগত গুরুত্বও ছিল বেশি। এ কারণে কোনো দলই একে হাতছাড়া করতে চায়নি। ফলে যে-ই আগে বার্লিন দখল করুক না কেন, সবাই জার্মানির মতো বার্লিনের অংশও পাবে, এটি নিয়ে চুক্তিবদ্ধ হয় সবাই।
তবে স্ট্যালিন কথা রাখার মানুষ হিসেবে ততটা পরিচিত নন। তারপরেও রেড আর্মি যখন সবার আগে বার্লিনে পৌঁছে দখল করে নেয়, তাহলেও শহরের দখল কেন হাতছাড়া করেছিলেন তিনি?
প্রথমত, ইউরোপে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও প্যাসিফিক অঞ্চলে তখন পুরোদমে যুদ্ধ চলছিলো। সোভিয়েতরা ভেবেছিল চীন, কোরিয়া এবং জাপানের বেশ কিছু অংশও তাদের হাতে চলে আসবে। আর সেটিকে বাস্তবতায় রূপ দিতে গেলে তাদের পশ্চিমা মিত্রদেরকেও হাতে রাখতে হবে। তাই, পুরো একটি অঞ্চলের বিশাল অংশের পরিবর্তে একটি শহরের সামান্য অংশ খুব একটা কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল না।
দ্বিতীয়ত, স্ট্যালিন ভেবেছিলেন বার্লিনের কাটাকুটি বেশিদিন স্থায়ী হবে না। কারণ তার পুরো পরিকল্পনাই ছিল জার্মানিকে ভাগ না করে পুরো জার্মানিকে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করা, অন্তত স্ট্যালিন তা-ই ভেবেছিলেন। সেক্ষেত্রে সাময়িকভাবে বার্লিনের কিছু অংশ ছেড়ে দেওয়া নিয়ে বেশি ভাবতে হয়নি তাকে।
তৃতীয়ত, পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণে থাকা বার্লিনের অংশের পুরোটাই সোভিয়েত পূর্ব জার্মানি দিয়ে ঘিরে রাখা। স্ট্যালিন ভেবেছিলেন পশ্চিমারা ঝামেলা করলে অবরোধ করে ঝামেলা ভালোভাবেই মিটিয়ে ফেলতে পারবেন তিনি। সে কারণে পশ্চিমারা যখন বার্লিন শহরেই অ্যান্টি-সোভিয়েত অবস্থান গড়ে তোলে, স্ট্যালিন বার্লিন দেয়াল তুলে শহরকে দু’ভাগে ভাগ করে ফেলেন।
স্ট্যালিন জানতেন খাবারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম বন্ধ করে দিলে পশ্চিমারা বেশিদিন টিকতে পারবে না। তবে তিনি একটি ভুল করে ফেলেছিলেন, চুক্তির সময়ে আকাশসীমানার কথা উল্লেখ করা হয়নি একবারও। ফলে সোভিয়েতরা যখন বার্লিন অবরোধ করে রাখলো, তখন এক বছরেরও বেশি সময় ধরে রয়্যাল এয়ার ফোর্স এবং মার্কিন এয়ারফোর্স বিমান থেকে খাবার এবং অন্যান্য সরঞ্জাম বিমান থেকে ফেলে চাহিদা মেটাতে লাগলো, যে ঘটনাটি ‘বার্লিন এয়ারলিফট’ নামে পরিচিত।
এরপরই সোভিয়েতরা বুঝতে পেরেছিল মিত্ররা বার্লিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর সহজে ছেড়ে যাবে না। স্ট্যালিনের পর সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ তাই পশ্চিমাদেরকে বার্লিন ছেড়ে যাওয়ার আল্টিমেটাম দেন। মিত্ররাও একবাক্যে “না” বলে দেয়। চেকপয়েন্ট চার্লির শ্বাসরুদ্ধকর কিছু মুহূর্ত ছাড়া আর বড় কিছু ঘটেনি। সোভিয়েতরাও বার্লিনের পশ্চিম অংশ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করেনি, তাদের কৌশলগত ভুল মেনে নেয় এবং বার্লিন দেয়াল ভাঙন ও জার্মানি একত্রীকরণের আগপর্যন্ত এরকম অবস্থাই চলতে থাকে।