Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক উত্থানের পেছনের গল্প | পর্ব-১

স্যামসাং, এলজি, গ্যাংনাম স্টাইল, কিমচি, কে-ড্রামা কিংবা কে-পপ- নামগুলো পরিচিত মনে হচ্ছে, তাই না? আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুর সাথে এই নামগুলো জড়িয়ে আছে। স্যামসাং ও এলজি দুটি বিশ্ববিখ্যাত প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠান। গ্যাংনাম স্টাইল হচ্ছে ২০১২ সালে জুলাই মাসে ইন্টারনেট দুনিয়ায় প্রকাশিত একটি গান, যেটি পরবর্তীতে মাতিয়ে রেখেছিল পুরো বিশ্বকে। কিমচি একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার, যা দারুণ স্বাদের জন্য খ্যাতি লাভ করেছে। কে-ড্রামা (কোরিয়ান ড্রামা) হচ্ছে কোরিয়ায় নির্মিত ওয়েব সিরিজ, অপরদিকে কে-পপ (কোরিয়ান পপ) হচ্ছে জনপ্রিয় কোরিয়ান গান। মজার বিষয় হচ্ছে, এই সবগুলোর শেকড় হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। আধুনিকতার এই যুগে প্রযুক্তি পুরো দুনিয়াকে নিয়ে এসেছে হাতের মুঠোয়, সাংস্কৃতিক বিকাশের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। বিশ্বায়নের এই সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতি দেশটির গন্ডি পেরিয়ে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে পুরো বিশ্বজুড়ে। বৈদেশিক বাণিজ্যের বদৌলতে দক্ষিণ কোরিয়ার বিখ্যাত প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তুতকৃত পণ্য আমাদের ব্যবহার করার সুযোগ হয়েছে ইন্টারনেটের যুগ শুরু হওয়ারও আগ থেকে।

Gzjfkfkckv
বর্তমান বিশ্বের অনেক বিখ্যাত ব্র্যান্ডের ভিত্তি হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ায়; image source: businesskorea.co.kr

আজকের দিনে দক্ষিণ কোরিয়া উন্নতির শিখরে আরোহণ করা একটি দেশ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এই সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলো দক্ষিণ কোরিয়ার, যে প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণার পেছনে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করে থাকে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতাসম্পন্ন দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকেরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাফল্যের সাথে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। দেশটির আধুনিক শহরগুলোর বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত। এশিয়ার চারটি দেশ ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে পৃথিবীর অনেক দেশের জন্য রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। হংকং, তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুরের পাশাপাশি আরেকটি ‘এশিয়ান টাইগার’ হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু আজ থেকে সত্তর বছর আগেও এই চিত্র ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। অনেক চড়াই উতরাই পেরোনোর পর আজকের দক্ষিণ কোরিয়া শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছে। একসময়ে যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষেরা তিন বেলা ঠিকমতো খেতে পারতেন না, সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের মাথাপিছু আয় বছরে ত্রিশ হাজার ডলারেরও বেশি!

Ufkgogogkg
আজকের দিনে দক্ষিণ কোরিয়া উন্নতির শিখরে আরোহন করা একটি দেশ; image source: eastasiaforum.org

ইতিহাসের দিকে একটু ফিরে যাওয়া যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোরীয় উপদ্বীপ ছিল সাম্রাজ্যবাদী জাপানের একটি উপনিবেশ। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান জড়িয়ে পড়লে মিত্রপক্ষের দুই পরাশক্তি দেশ আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপানে হামলা চালিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল ফৌজ গতানুগতিক যুদ্ধকৌশল অনুসরণ করে জাপানের উত্তরাঞ্চল দখল করে নিলেও আমেরিকা রীতিমতো পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে এশিয়ার এই দেশটির উপর। যুদ্ধ শেষ হলে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন– দুটি দেশই নিজেদের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল কোরিয়ায়। শেষ পর্যন্ত আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা আলোচনার টেবিলে বসে দীর্ঘ আলোচনার পর আটত্রিশ ডিগ্রি অক্ষরেখা বরাবর কোরীয় উপদ্বীপকে ভাগ করতে সম্মত হন। উত্তর কোরিয়ার কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করা হয়, অপরদিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতিষ্ঠা করা হয় পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র। জন্মলগ্ন থেকেই দুই কোরিয়ার সম্পর্ক মোটেও ভালো ছিল না। সবসময় এক দেশ তার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডা ছড়াত, দুই দেশের জনগণ একে অপরকে ঘৃণা করতে।

দুই কোরিয়ার মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর পাশাপাশি বাইরের দেশগুলোর অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল দেশগুলোর জন্য। একপর্যায়ে ১৯৫০ সালে উত্তর কোরিয়া তার প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার উপর আক্রমণ করে বসলে পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ বেধে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পৃথিবী যে স্নায়ুযুদ্ধের যুগে প্রবেশ করে, সেই যুদ্ধের দুই প্রধান প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকা এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় নতুন মাত্রা লাভ করেছিল এই কোরিয়া উপদ্বীপের যুদ্ধ। উত্তর কোরিয়ার পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও এশিয়ার আরেক শক্তিশালী দেশ চীন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, অপরদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে জাতিসংঘ তথা আমেরিকা। তিন বছরের যুদ্ধের পর ১৯৫৩ সালে যুদ্ধ শেষে দুটি দেশই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলেও কোন দেশই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে পারেনি। দুটি দেশেরই প্রধান শহরগুলো কার্যত ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, শিল্পকারখানাগুলো পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তুপে, কর্মক্ষম জনসংখ্যার বিশাল অংশ স্রেফ উধাও হয়ে গিয়েছিল এই যুদ্ধের পর। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়ার পরও যে দক্ষিণ কোরিয়া তিন দশকের মাথায় শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে গেল, বিশ্ব-অর্থনীতিতে নিজেদের সগর্ব উপস্থিতি ঘোষণা করল, একে বিশেষজ্ঞরা আখ্যায়িত করেছেন ‘মিরাকল অব দ্য হান রিভার’ হিসেবে।

Ufckvlvlvl
কোরীয় উপদ্বীপের যুদ্ধের পর দক্ষিণ কোরিয়ার ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল; image source: nytimes.com

দক্ষিণ কোরিয়ার যে বিশ্বখ্যাত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা না করলে দেশটির অর্থনৈতিক উত্থানের গল্প অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। আজকের দিনে স্যামসাং স্মার্টফোন কিংবা ল্যাপটপের মতো যন্ত্রের জন্য খ্যাতি লাভ করেছে, হুন্দাই কোম্পানির গাড়ির কদর রয়েছে পুরো বিশ্বজুড়ে, এলজি কোম্পানির তৈরি উচ্চমানের রেফ্রিজারেটর অসংখ্য মানুষের বাড়ি কিংবা দোকানে স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রথমদিকে এসব কিছুই বিক্রি করত না এই বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাতকরণকে কেন্দ্র করে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। বর্তমানের স্যামসাং একসময় চিনি এবং উল উৎপাদনের সাথে জড়িত ছিল, এলজি তৈরি করতো বিভিন্ন প্লাস্টিকজাত পণ্য, চাল উৎপাদন ঘিরে হুন্দাই কোম্পানি তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যেত। আরেকটি উল্লেখ করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, অন্য সব বহুজাতিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতো এই প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রথমে জাতীয় গন্ডিতে নিজেদের আবদ্ধ রেখেছিল।

কোরীয় উপদ্বীপের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষমতার্পণ করা হয় সামরিক শাসক পার্ক চুং-হির হাতে। তিনি ১৯৬১-৭৯ সাল পর্যন্ত দেশটির অর্থনৈতিক উত্থানের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেন। তিনি যখন ক্ষমতা হাতে পান, তখন দক্ষিণ কোরিয়া রীতিমতো ধুঁকছিল। কোরীয় উপদ্বীপের যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি তখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি, দারিদ্র্যের কষাঘাতে দেশটির নাগরিকদের জীবন ছিল বিপর্যস্ত। অধিকাংশ দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক দিনে একবেলা খাবার জোটাতে হিমশিম খেত। অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার মাথাপিছু আয় যেখানে ছিল ১৪০ মার্কিন ডলার, সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল বছরে মাত্র ৯৪ ডলার! এরকম খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি দেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচানোর গুরুদায়িত্ব নিয়ে অগ্রসর হওয়ার চাপ ছিল পার্ক চুং-হির কাঁধে, যে চাপ তিনি উতরে গিয়েছেন সফলভাবে।

Gshdjcjc
পার্ক চুং-হির নেয়া নীতিগুলো দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার ঘটায়; image source: alchetron.com

একদিকে প্রতিবেশী উত্তর কেরিয়ার চোখরাঙানি, অপরদিকে দেশের অর্থনীতির দুরবস্থা, পার্ক চুং-হি বুঝতে পেরেছিলেন- অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যতীত কোনো কিছুরই সমাধান সম্ভব নয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তার দেশের বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভর্তুকি প্রদান করলেন, অতিরিক্ত করের বোঝা লাঘব করে দিলেন, পরিবহন সুবিধা বাড়ানোর জন্য রাস্তাঘাটের আধুনিকায়ন ঘটান। এছাড়া বাইরের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো দেশটির বাজার দখল করে নিয়ে স্থানীয় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যেন হুমকি তৈরি করতে না পারে, সেজন্য তিনি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তবে বৈদেশিক বিনিয়োগের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়– এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত ছিলেন তিনি। তার নেয়া পদক্ষেপগুলোর জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় অর্থনীতিতে স্থানীয় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, যেমন: স্যামসাং, হুন্দাই কিংবা এলজি-র বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের সম্প্রসারণ ঘটে। এই সম্প্রসারণের ফলে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান হয়, বেকারত্বের হার কিছুটা কমে আসতে শুরু করে।

Related Articles