Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কোরেগাঁও যুদ্ধ: মারাঠাদের পতন যখন দলিতদের জয়ের ইতিহাস

এই ভারত উপমহাদেশে ইংরেজদের ২০০ বছরের শাসনকালে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে বহু বিপ্লব, আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। এসব আন্দোলনের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে নানা ঘটনাবহুল কাহিনী। সেসব কাহিনীর মধ্যে ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য স্বদেশপ্রেমের ইতিহাস যেমন রচিত হয়েছে, ঠিক তেমনি কিছু কিছু আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে আছে সেসময়ের সামন্তবাদী উচ্চশ্রেণী জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কাহিনীও। কিন্তু কোরেগাঁওয়ের যুদ্ধ অন্য এক ইতিহাসের গল্প শোনায় আমাদের।

ভীমা কোরেগাঁও যুদ্ধ কী ছিল?

পুনে শহর থেকে ৪০ কি.মি. দূরে অবস্থিত একটি গ্রাম ভীমা কোরেগাঁ। ১৮৮২ সালের পহেলা জানুয়ারি এই গ্রামে মারাঠা শাসক দ্বিতীয় বাজিরাওয়ের নিয়োজিত পেশোয়ার সৈন্যবাহিনী এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা ভীমা কোরেগাঁও যুদ্ধ নামে পরিচিতি পায়।

১৮১৮ সালের দিকে পুনে পুনর্দখলের চেষ্টায় দ্বিতীয় বাজিরাও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। সেইসময় তার সাথে ছিল পাঁচ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী। এই বাহিনী নিয়ে পেশোয়া সম্রাট দ্বিতীয় বাজিরাও সাতারা থেকে পুনের দিকে এগোতে শুরু করেন।

পুনে শহর থেকে মাত্র ৪০ কিমি দূরে কোরেগাঁওয়ের অবস্থান; Source: The Indian Express

মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরেগাঁও গ্রামের কাছে এই পেশোয়া সৈন্যবাহিনীর সামনে পড়ে যায় ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর একটা অংশ। সেই দলে সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৮০০ জন। ওই ইংরেজ সৈন্যরা মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূল বাহিনীর সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য পুনের দিকেই অগ্রসর হচ্ছিল। কারণ, সেখানেই ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান সেনা দপ্তর। এই ৮০০ সৈন্যের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিস।

এই বিরাট মারাঠা বাহিনীর সামনে অপ্রস্তুত ইংরেজ বাহিনী আত্মরক্ষার জন্য কোরেগাঁও গ্রামের ভিতরে আশ্রয় নেয়। পেশোয়া বাজিরাও তার তিনটি চৌকস পদাতিক বাহিনীকে কোরেগাঁও প্রেরণ করেন সেই গ্রামে আশ্রয় নেওয়া ইংরেজ বাহিনীর সাথে লড়াই করার জন্য। প্রত্যেক পদাতিক বাহিনীতে ছিল ৬০০-৮০০ সৈন্যের একটি দল। বাজিরাও প্রায় ২,০০০ সৈন্যের এই দলকে ৮০০ সৈন্যের ইংরেজ বাহিনীকে পর্যুদস্ত করার দায়িত্ব দেন এবং যত দ্রুত সম্ভব কোরেগাঁও দখলের নির্দেশ দেন। কিন্তু সেই যুদ্ধে মারাঠা সৈন্যদের নির্মম পরাজয় ঘটে।

মহার সৈনিকরা ইস্ট ইন্ডিয়ার কোম্পানির সেনাদের সাথে যুক্ত হয়ে মারাঠা সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তোলে; Source: wikifeed.in

কোরেগাঁও গ্রামে অবস্থানকারী ব্রিটিশ সৈন্যরা ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত প্রতিরক্ষা দেওয়াল গড়ে তোলে। এই সময় ইংরেজদের ৮০০ সৈন্যবাহিনীর সাথে যোগ দেয় মহার দলিত সম্প্রদায়ের লোকজন। অধিকার বঞ্চিত এই অচ্ছুত শ্রেণীর লোকদের কাছে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ইংরেজ সৈন্য ও মহারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে মারাঠা সৈন্যদের পরাজয় ঘটে।

কী কারণে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়?

১৮০২ সাল; ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে মারাঠা সম্রাট দ্বিতীয় বাজিরাও রাজ্যচ্যুত হন। রাজধানী পুনে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর তাকে পুনে থেকে নির্বাসিত করা হয়। পুনে ছেড়ে তিনি আশ্রয় নেন সাতারায়।

পেশোয়া সম্রাট দ্বিতীয় বাজিরাও; Source: wikifeed.in

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মারাঠা সাম্রাজ্য অধিকার করে নেয়। এরপর মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের শাসনভার বিভিন্ন রাজার উপর দেওয়া হয়। যেমন- পেশোয়ারদের পুনে, সিন্ধিয়াদের গোয়ালিওর, গায়কোয়াডদের বারোদা, ভোসলেদের নাগপুর- এমনিভাবে মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলকে ভাগ করে দিয়ে তৎকালীন মারাঠা সম্রাট দ্বিতীয় বাজিরাওয়ের শক্তিকে দুর্বল করার ব্যবস্থা করা হয়।

পরাজিত হয়েও দ্বিতীয় বাজিরাও ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য ঘুঁটি সাজাতে থাকেন। ইংরেজদের কাছ এ খবর অজানা থাকে না। গভর্নর লর্ড হেস্টিংস দ্বিতীয় বাজিরাওকে এক অপমানজনক চুক্তিতে সই করতে বাধ্য করেন। দ্বিতীয় বাজিরাওয়ের পক্ষে এই অপমানজনক চুক্তি মেনে নেওয়া কিছুতেই সম্ভব ছিল না। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

কারা এই মহার জাতিগোষ্ঠী?

ঐতিহাসিকভাবে মহার জাতিগোষ্ঠী ছিল নিম্নবর্ণীয় দলিত শ্রেণীর প্রতিনিধি। সমাজে তাদেরকে অস্পৃশ্য ভাবা হতো। কিন্তু তাদের কাজের ধরনের কারণে প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনীতে তাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। ফলে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সাথে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের একধরনের দূরত্ব থাকলেও কর্মক্ষেত্রে তাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সপ্তদশ শতকে মারাঠা সম্রাট শিবাজী মারাঠা সেনাবাহিনীতে কিছু সংখ্যক মহারদের নিয়োগ দেন। সেনাবাহিনীতে তারা প্রহরী এবং সৈন্য হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেতো। পেশোয়া সৈন্যদের সাথে এই মহার সৈন্যরা পাশাপাশি থেকে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং বীরত্বের পরিচয় দেয় ।

কোরগাঁও যুদ্ধে মারাঠা সৈন্যদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়; Source: wikifeed.in

এই দুই জাতিগোষ্ঠীর মিলিত মারাঠা বাহিনী সেসময় পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ সহ অনেক যুদ্ধ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু দ্বিতীয় বাজিরাও যখন মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রধান অধিপতি হন, তখন থেকেই পেশোয়া ও মহার সৈন্যদের মধ্যে বিভেদের দেয়াল উঠতে থাকে। সেসময় প্রতিনিয়ত মহার সৈন্যদের অপমান করা হতো, বিনা কারণে শাস্তি দেওয়া হতো। অনেক ক্ষেত্রে এই সম্প্রদায়ের লোকদের সেনাবাহিনী থেকে বিতাড়ণের ঘটনাও ঘটে। পরবর্তীতে মহার সম্প্রদায়ের লোকদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মহার জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হতে থাকে, যার বিস্ফোরণ ঘটে ভীমা কোরেগাঁও যুদ্ধে।

যুদ্ধের পরিণতি

মাত্র ৮০০ জনের ইংরেজ বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে দলিতরা রুখে দেয় দুই হাজার সৈন্যের পেশোয়ার বহিনীকে। যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ২০০-৩০০ জন সদস্য প্রাণ হারালে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয় পেশোয়া বাহিনীর। এক তথ্যমতে, এই যুদ্ধে পেশোয়া বাহিনীর প্রায় ৫০০-৬০০ জন সদস্যের মৃত্যু হয় বলে শোনা যায়। এই বিপুল ক্ষতির ফলে মারাঠা বাহিনী কোরেগাঁওতে ঢোকার চেষ্টা ত্যাগ করে। পুনে থেকে বড়সড় ইংরেজ সেনাদের দল চলে আসলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বেড়ে যেতে পারে, এই ভেবে মারাঠা বাহিনী ধীরে ধীরে পিছু হঠতে শুরু করে। যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয় মারাঠা বাহিনী

দলিতদের অধিকার আদায়ে এই যুদ্ধের গুরুত্ব

উনবিংশ শতকে পেশোয়ারদেরকে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ হিসেবে এবং মহারকে সমাজের অস্পৃশ্য শ্রেণী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। উচ্চবর্ণের পেশোয়ারদের কাছে নিয়মিত নিগৃহিত হতো মহার সম্প্রদায়ের লোকেরা। দ্বিতীয় বাজিরাওয়ের শাসনকালে এই মহার সম্প্রদায়ের ওপর পেশোয়া বাহিনী চরম অত্যাচারই শুধু করেনি, তারা নানা অধিকার থেকেও বঞ্চিত হতে থাকে। ফলে এই কোরেগাঁওয়ের যুদ্ধ জয় তাদের কাছে অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান বলে বিবেচিত হতে থাকে।

কোরেগাঁওয়ের যুদ্ধকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য স্থানটিতে বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা হয়। ১৮৫১ সালে ইংরেজদের হাতে নির্মিত হয় এই স্মৃতিবেদী। ‌সে স্তম্ভে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে ৪৯ জন মৃত সৈন্যের নাম, যার মধ্যে মহার সম্প্রদায়ের ২২ জন লোকের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যারা সে যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

দলিতদের বিজয়ের প্রতীক কোরেগাঁওয়ে স্থাপিত এই বিজয় স্তম্ভ; Source: Pune Mirror

এই যুদ্ধ দলিতদের আত্মাভীমানের প্রতীক। তারা এই দিনকে ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে পালন করেন। ১৯২৭ সালের ১ জানু্য়ারি ভিমরাও আম্বেদকর এই সৌধের সামনে স্মরণ সভার আয়োজন করেন। তারপর থেকে প্রতি বছর ১লা জানুয়ারি সেখানে হাজির হন দলিতরা। তাদের কাছে এই স্থানটি যেন একটি তীর্থক্ষেত্র। তীর্থ যাত্রার মতোই তারা ভিড় করেন ভীমা কোরেগাঁওতে।

দলিতদের অধিকাংশই সেদিনের যুদ্ধকে ‘উচ্চবর্ণীয়’ মারাঠা বনাম ‘নিন্মবর্ণীয়’ দলিতের যুদ্ধ হিসেবেই দেখে থাকেন। তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই জয়কে দলিতদের এক বৃহৎ অংশই নিজেদের জয় হিসেবে মনে করেন।

দলিত শ্রেণীর প্রতিনিধি, ভারতের সংবিধান প্রণেতা ভিমরাও আম্বেদকর; Source: wikifeed.in

যুদ্ধে পরাজয়ের দাগ এখনও শুকায়নি

ভীমা কোরেগাঁও যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় দুইশ বছর আগে। কিন্তু সেই যুদ্ধের দাগ এখনও অনেকেই জিইয়ে রেখেছেন মনের মধ্যে। মহার সম্প্রদায়ের কাছে মারাঠা সেনাদের সেই পরাজয় উচ্চবর্ণের মারাঠাদের অহংকারে এক বড়সড় আঘাত। এখনো অনেকেই এই পরাজয়কে মেনে নিতে পারেনি। তাই প্রতি বছর ১ জানুয়ারি আসলে তাদের স্মৃতি প্রবলভাবে জেগে উঠে। অনেকের মনে প্রতিশোধের বারুদ যেন লেলিহান শিখার মতো জ্বলতে থাকে। তাই প্রতি বছর এই দিনটিতে কোনো না কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেই থাকে। তেমনি এক ঘটনা ঘটেছিল চলতি বছরের ১লা জানুয়ারিতে। এই বছর কোরেগাঁও যুদ্ধের দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য বিপুল সংখ্যক দলিত সম্প্রদায়ের লোকের আগমন ঘটে কোরেগাঁও গ্রামে। সেখানে তাদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে উচ্চবর্ণ এবং কট্টরবাদী মারাঠাদের নানা সংগঠন। এই সংঘর্ষে একজন মারাও যান, আহত হন বেশ কয়েকজন।

২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি কোরেগাঁও যুদ্ধের দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপনে অংশগ্রহণকারী দলিতদের ওপর আক্রমণ চালায় উচ্চবর্ণ এবং কট্টরবাদী মারাঠাদের বেশ কয়েকটি সংগঠন; Source: sangbadpratidin.in

ভীমা কোরেগাঁওয়ের এই যুদ্ধের সাথে জড়িয়ে আছে মহারদের উত্থানের কাহিনীও। মহাররা ‘অস্পৃশ্য’ হলেও তাদের যুদ্ধের দক্ষতাকে কেউ অস্বীকার করতে পারেনি। শিবাজির সেনাদলে তাদের অংশগ্রহণ থাকলেও পেশোয়াররা শাসন ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাদেরকে অচ্ছুৎ করে রাখা হয়। মহাররা সেনাদলে ঢুকতে চাইলেও উচ্চবর্ণের হিন্দু পেশোয়াররা তাদের নেয়নি। ব্রিটিশরা তাদেরকে সেনাদলে নেওয়ার মধ্য দিয়ে মহারদের সেই ক্ষোভ প্রশমিত হয়। অনেক বিশিষ্ট দলিত বিশেষজ্ঞ, চিন্তাকর্মী ও লেখক কোরেগাঁও যুদ্ধকে দলিত ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে মনে করেন। এই যুদ্ধজয়কে দীর্ঘদিনের বাজিরাও সাম্রাজ্যে অধিকার বঞ্চিত হওয়া দলিত সম্প্রদায়ের জেগে ওঠার প্রয়াস বলে মনে করেন তারা।

ফিচার ইমেজ- storytrails.in

Related Articles