
প্যারাগুয়ে
‘প্যারাগুয়ে প্রজাতন্ত্র’ (স্পেনীয়: República del Paraguay; গুয়ারানি: Tetã Paraguái) দক্ষিণ আমেরিকায় অবস্থিত একটি মাঝারি আকৃতির রাষ্ট্র। ৪,০৬,৭৯৬ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রের উত্তর–পশ্চিমে বলিভিয়া, উত্তর–পূর্ব ও পূর্বে ব্রাজিল এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমে আর্জেন্টিনা অবস্থিত। প্যারাগুয়ে ভৌগোলিক দিক থেকে একটি ব্যতিক্রমধর্মী রাষ্ট্র, কারণ রাষ্ট্রটি স্থলবেষ্টিত, কিন্তু তাদের উপকূল ও সমুদ্রসৈকত রয়েছে। শুধু তাই নয়, প্যারাগুয়ে ও পারানা নদীতে রাষ্ট্রটির সমুদ্রবন্দরও রয়েছে। রাষ্ট্রটির সরাসরি সমুদ্রসীমা নেই, কিন্তু পারানা–প্যারাগুয়ে জলপথের মাধ্যমে রাষ্ট্রটি আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত। অর্থাৎ, বিখ্যাত ব্রিটিশ নৌবহরের প্যারাগুয়েতে নৌপথে আক্রমণ পরিচালনা করার সুযোগ ছিল এবং বাস্তবিকই একসময় ব্রিটিশ নৌবাহিনী অঞ্চলটিতে উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা প্যারাগুয়ের ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনা করেনি।
ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেনীয়রা বর্তমান প্যারাগুয়ের ভূখণ্ডে উপনিবেশ স্থাপন করে এবং পরবর্তী প্রায় তিন শতাব্দী জুড়ে প্যারাগুয়ে স্পেনীয় সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। স্পেন ও ব্রিটেনের মধ্যে দীর্ঘদিনব্যাপী দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল এবং ব্রিটেন বিভিন্ন স্পেনীয় উপনিবেশে বহুবার আক্রমণ পরিচালনা করেছে। কিন্তু প্যারাগুয়েতে তারা কখনো আক্রমণ পরিচালনা করেনি। ১৮১১ সালে প্যারাগুয়ে স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, অবশ্য সেসময় প্যারাগুয়ের ভূখণ্ড বর্তমান ভূখণ্ডের চেয়ে বড় ছিল। স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী কয়েক দশক প্যারাগুয়ে বিশ্বের বাকি অংশ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখে।
১৮৪৫ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স আর্জেন্টিনার ওপর একটি নৌ অবরোধ আরোপ করে। সেসময় উরুগুয়েতে চলছিল এবং সেই গৃহযুদ্ধে আর্জেন্টিনা ‘পার্তিদো ব্লাঙ্কো’ বা ‘শ্বেত দল’কে সমর্থন করছিল। অন্যদিকে, ব্রিটেন ও ফ্রান্স এই যুদ্ধে ‘পার্তিদো কলোরাদো’ বা ‘লাল দল’কে সমর্থন করছিল। ‘শ্বেত দল’কে সমর্থন প্রদান থেকে আর্জেন্টিনাকে বিরত রাখা এবং আর্জেন্টিনার নৌ বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়ার জন্য ব্রিটেন ও ফ্রান্স আর্জেন্টিনার ওপর ‘রিও দে লা প্লাতা নৌ অবরোধ’ নামে পরিচিত এই অবরোধ আরোপ করে। শুধু তাই নয়, এসময় ব্রিটিশ ও ফরাসি নৌবাহিনী ব্রিটেন ও ফ্রান্সে তৈরি পণ্যসামগ্রী ব্রিক্রির জন্য আর্জেন্টিনার জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে, কারণ আর্জেন্টিনার তদানীন্তন সরকার রাষ্ট্রটির দুর্বল অর্থনীতি সচল রাখার জন্য বিদেশি পণ্য আমদানির ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছিল।

ব্রিটেন এই যুদ্ধে প্যারাগুয়েকে নিজেদের পক্ষে অংশগ্রহণ করাতে চাচ্ছিল এবং এজন্য ১৮৪৫ সালে ব্রিটিশ কমোডর চার্লস হোথামের নেতৃত্বাধীন একটি ব্রিটিশ–ফরাসি যৌথ কনভয় আর্জেন্টাইনদের বারবার আক্রমণ সত্ত্বেও একটি লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে প্যারাগুয়ের সীমানায় পৌঁছে। কমোডর হোথাম প্যারাগুয়ের রাজধানী আসুনসিওনে উপস্থিত হন এবং প্যারাগুয়ের সরকারের সঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত হন। ব্রিটেন প্যারাগুয়েকে স্বীকৃতি প্রদান করতে এবং রাষ্ট্রটির সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে আগ্রহ প্রকাশ করে, বিনিময়ে প্যারাগুয়েকে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে আহ্বান জানায়। কিন্তু প্যারাগুয়ের সরকার এই প্রস্তাবে আগ্রহী ছিল না এবং তারা প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে ব্রিটিশ–ফরাসি কনভয়টিকে আবার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আর্জেন্টাইনদের আক্রমণের মধ্য দিয়ে ফিরে যেতে হয়।
অর্থাৎ, ব্রিটিশ নৌবাহিনী প্যারাগুয়ের সীমান্তে উপস্থিত হয়েছিল, কিন্তু প্যারাগুয়ের ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনার কোনো উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। এজন্য একে প্যারাগুয়ের ওপর ব্রিটিশ আক্রমণ হিসেবে অভিহিত করা চলে না, বরং এটি ছিল একটি কূটনৈতিক অভিযান। অবশ্য প্যারাগুয়েতে ব্রিটিশদের কূটনৈতিক কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয় এবং ১৮৫০ সাল নাগাদ ব্রিটেন ও ফ্রান্স আর্জেন্টিনার ওপর থেকে নৌ অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হয়।
১৮৫৯ সালে প্যারাগুয়েতে একদল ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা প্যারাগুয়ের রাষ্ট্রপতি কার্লোস আন্তোনিও লোপেজকে একটি থিয়েটারে গুলি করে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে একজন ছিল সান্তিয়াগো কনস্তাৎ এবং সে ছিল একজন ব্রিটিশ নাগরিক। প্যারাগুয়ের সরকার কর্তৃক একজন ব্রিটিশ নাগরিককে কারাগারে নিক্ষেপ করার বিষয়টিকে ব্রিটিশরা ভালো চোখে দেখেনি। এজন্য প্যারাগুয়ের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য ব্রিটিশ নৌবাহিনীর দুটি জাহাজ ‘এইচএমএস বাজার্ড’ ও ‘এইচএমএস গ্র্যাপলার’ রাষ্ট্রটির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এসময় প্যারাগুয়ের একমাত্র যুদ্ধজাহাজ ‘তাকুয়ারি’ আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আয়ার্স থেকে প্যারাগুয়েতে ফিরছিল। ব্রিটিশ জাহাজগুলোর উদ্দেশ্য ছিল ‘তাকুয়ারি’কে জব্দ করা।

কিন্তু ব্রিটিশদের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ব্রিটিশ জাহাজগুলো প্যারাগুয়ের যুদ্ধজাহাজটির ওপর গোলাবর্ষণ করে, কিন্তু সেটি আটক করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অবশ্য এই ঘটনার পর প্যারাগুয়ে বুঝতে পারে যে, ব্রিটেনের দাবি মেনে নেয়া না হলে ব্রিটেন ও প্যারাগুয়ের মধ্যে যুদ্ধ নিশ্চিত। এসময় প্যারাগুয়ের ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সামর্থ্য ছিল না, সুতরাং তারা বাধ্য হয়ে কনস্তাৎকে মুক্তি প্রদান করে। এর মধ্য দিয়ে তথাকথিত ‘কনস্তাৎ অ্যাফেয়ারে’র অবসান ঘটে।
এই ঘটনাটি ব্রিটেন ও প্যারাগুয়ের মধ্যে সামরিক সংঘাতের একমাত্র উদাহরণ। সুতরাং অনেকে এটিকে প্যারাগুয়ের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের আগ্রাসন হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। কিন্তু এই সংঘাতটি প্যারাগুয়ের জলসীমার বাইরে সংঘটিত হয়েছে এবং ব্রিটিশ সৈন্যরা প্যারাগুয়ের ভূখণ্ডে কোনো আক্রমণ পরিচালনা করেনি। এজন্য এই ঘটনাকে প্যারাগুয়ের ভূখণ্ডে ব্রিটিশ আক্রমণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় না।
১৮৬৪–৭০ সালের প্যারাগুয়ের যুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ নৌবাহিনী পুনরায় প্যারাগুয়ের জলসীমায় প্রবেশ করে। এই যুদ্ধে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি জোট প্যারাগুয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল এবং রাষ্ট্র তিনটির নৌবাহিনী প্যারাগুয়ের ওপর নৌ অবরোধ আরোপ করে রেখেছিল। এই যুদ্ধে প্যারাগুয়ে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। যুদ্ধের ফলে প্যারাগুয়ের ৬৯% অধিবাসী নিহত হয় এবং প্যারাগুয়ে তার মোট ভূখণ্ডের ২৫% থেকে ৪০% প্রতিপক্ষের কাছে স্থায়ীভাবে হারায়। শুধু তা-ই নয়, ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলীয় ও আর্জেন্টাইন সৈন্যরা প্যারাগুয়ে দখল করে রাখে।

দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত এই যুদ্ধে ব্রিটেন অংশগ্রহণ করেনি। কিন্তু প্যারাগুয়েতে যেসব ব্রিটিশ নাগরিক অবস্থান করছিল, তাদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে ব্রিটেন দায়বদ্ধ ছিল। এজন্য ব্রিটিশ নৌবাহিনী প্যারাগুয়ের ওপর তাদের প্রতিপক্ষ কর্তৃক আরোপিত নৌ অবরোধ উপেক্ষা করে যুদ্ধবিধ্বস্ত প্যারাগুয়ে থেকে নিজেদের নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা চালায়। এই প্রচেষ্টা কতদূর সফল হয়েছিল, সেটি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানা যায়নি, কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত যে, একে প্যারাগুয়ের ভূখণ্ডে ব্রিটিশ আক্রমণ হিসেবে গণ্য করা যায় না।
সামগ্রিকভাবে, ব্রিটিশ নৌবাহিনী ইতিহাসে দুইবার প্যারাগুয়ের জলসীমায় প্রবেশ করেছে এবং একবার প্যারাগুয়ের জলসীমার বাইরে প্যারাগুয়ের যুদ্ধজাহাজের সঙ্গে লড়াই করেছে। কিন্তু প্যারাগুয়ের ভূখণ্ডে তারা কোনো আক্রমণ পরিচালনা করেনি। এজন্য প্যারাগুয়ে সেই বিরল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি, যাদেরকে ব্রিটিশ আক্রমণের মোকাবিলা করতে হয়নি।
বলিভিয়া
‘বলিভিয়া বহুজাতিক রাষ্ট্র’ (স্পেনীয়: Estado Plurinacional de Bolivia; গুয়ারানি: Tetã Hetãvoregua Mborivia; আইমারা: Wuliwya Suyu; কেচুয়া: Puliwya Mamallaqta) দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম–মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত একটি বৃহৎ স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। ১০,৯৮,৫৮১ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটির উত্তর ও পূর্বে ব্রাজিল, দক্ষিণ–পূর্বে প্যারাগুয়ে, দক্ষিণে আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ–পশ্চিমে চিলি এবং উত্তর–পশ্চিমে পেরু অবস্থিত। বলিভিয়া দক্ষিণ আমেরিকার একমাত্র পূর্ণ স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। উল্লেখ্য, দক্ষিণ আমেরিকার আরেকটি রাষ্ট্র প্যারাগুয়েও স্থলবেষ্টিত, কিন্তু অভ্যন্তরীণ জলপথের মাধ্যমে রাষ্ট্রটির সমুদ্রের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, বর্তমান বলিভিয়ার ভূখণ্ডের সঙ্গে সমুদ্রের কোনো ধরনের সংযোগ নেই।

বর্তমান বলিভিয়ার ভূখণ্ড একসময় ইনকা সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেনীয়রা বলিভিয়ায় উপনিবেশ স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করে এবং পরবর্তী প্রায় তিন শতাব্দী বলিভিয়া স্পেনীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্রিটিশ–স্পেনীয় দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে স্পেনীয় উপনিবেশ বলিভিয়ায় ব্রিটেনের আক্রমণ পরিচালনার উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু বলিভিয়া স্পেনের উপনিবেশ থাকাকালে ব্রিটেন কখনো এই অঞ্চলে আক্রমণ চালায়নি। অবশ্য তাই বলে যে এই অঞ্চলে ব্রিটিশ সৈন্যদের উপস্থিতি একেবারেই ছিল না, তা কিন্তু নয়।
একটি প্রলম্বিত স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৮২৫ সালে বলিভিয়া স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। এই স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রিটিশ উপদ্বীপ থেকে আগত স্বেচ্ছাসেবকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। অবশ্য কেবল বলিভিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধেই নয়, দক্ষিণ আমেরিকার আরো বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবকদের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান ছিল। কিন্তু নানাবিধ কারণে দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবকদের ভূমিকা ইতিহাসের প্রায় অনুল্লেখিত একটি অধ্যায় হিসেবেই রয়ে গেছে।
বলিভিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামে যেসব ব্রিটিশ নাগরিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন ফ্রান্সিসকো ও’কনর। ও’কনর ছিলেন জাতিগতভাবে আইরিশ (সেসময় আয়ারল্যান্ড ব্রিটেনের অন্তর্ভুক্ত ছিল), এবং তিনি বলিভিয়ায় যুদ্ধরত ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অ্যালবিয়ন রেজিমেন্টের একজন লেফটেন্যান্ট ছিলেন। বছরের পর বছর তিনি বলিভিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করেন এবং এক পর্যায়ে বলিভিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
এরকম আরেকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন কর্নেল স্যার বেলফোর্ড উইলসন। ব্রিটেনের প্রখ্যাত স্যান্ডহার্স্ট সামরিক অ্যাকাডেমিতে কয়েক বছর প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর এই ব্রিটিশ নাগরিক ১৮২২ সালে দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা সিমন বলিভারের সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করেন এবং বলিভিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। শুধু তা-ই নয়, বলিভিয়ার জন্য বলিভার যে সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন, নবগঠিত রাষ্ট্রটির জনসাধারণের কাছে সেটি ঘোষণা করার দায়িত্বও তার ওপর অর্পণ করা হয়েছিল।

অর্থাৎ, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্রিটিশ নাগরিক বলিভিয়ার ভূখণ্ডে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু একে বলিভিয়ার ভূখণ্ডে পরিচালিত ব্রিটিশ আক্রমণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। কারণ, বলিভিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্রিটিশ নাগরিকরা ছিল স্বেচ্ছাসেবক এবং বলিভিয়ায় তাদের কার্যক্রমের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। শুধু তা-ই নয়, উক্ত ব্রিটিশ নাগরিকরা বলিভিয়ার ভূখণ্ডে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা বলিভিয়ার বিরুদ্ধে নয়, বলিভিয়ার পক্ষে। এজন্য এটি ‘আক্রমণ’ ছিল না। পরবর্তীতেও ব্রিটেন কখনো বলিভিয়ার ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনা করেনি।
অবশ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ব্রিটেন বলিভিয়া আক্রমণ করতে চেয়েছিল, এই মর্মে একটি গল্প প্রচলিত আছে। এই গল্প অনুযায়ী, ১৮৬৮ সালে বলিভিয়ার তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি জেনারেল মারিয়ানো মেলগারেহো তার নতুন প্রেমিকাকে স্বাগত জানানোর জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে একজন ব্রিটিশ কূটনীতিবিদকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু উক্ত ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ এই ধরনের অনুষ্ঠানে যোগদানকে নিজের মর্যাদার বরখেলাপ হিসেবে বিবেচনা করে সেই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি সেই কূটনীতিবিদকে শাস্তি দেয়ার নির্দেশ দেন। শাস্তিস্বরূপ সেই কূটনীতিককে জোরপূর্বক একটি গাধার পিঠে উল্টোমুখী করে বসিয়ে বলিভিয়ার রাজধানী লা পাজের কেন্দ্রীয় স্কয়ারের চারপাশে তিনবার ঘোরান হয়!
প্রচলিত গল্পটির বক্তব্য অনুসারে, এই ঘটনা জানতে পেরে ব্রিটেনের রাণী ভিক্টোরিয়া খুবই ক্ষিপ্ত হন এবং বলিভিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। তখন রানীর পরামর্শদাতাদের বাধ্য হয়ে তাকে বোঝাতে হয় যে, বলিভিয়া সাগর থেকে বহু দূরে অবস্থিত এবং সেখানে আক্রমণ চালানোর জন্য ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে প্রেরণ করা সম্ভব নয়!
এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, গল্পটি খুবই হাস্যরসাত্মক, কিন্তু সেই সঙ্গে এটিও স্পষ্ট যে, মানুষ এই গল্প যতই বিশ্বাস করুক না কেন, এই গল্পটিকে সত্যি হিসেবে ধরে নেয়ার কোনো কারণ নেই।
প্রথমত, এই গল্পে বর্ণিত ঘটনা যে বাস্তবে ঘটেছে, তার কোনো প্রমাণ নেই। তদানীন্তন কোনো সংবাদপত্রে বা কোনো কূটনৈতিক বার্তায় কিংবা কোনো বইয়ে এই ঘটনার কোনো উল্লেখ নেই। এজন্য ধারণা করা যেতে পারে যে, ঘটনাটি লোকমুখে ছড়িয়ে পড়া একটি মুখরোচক গল্প মাত্র।

দ্বিতীয়ত, গল্পে বর্ণিত ঘটনাটি যদি ১৮৬৮ সালে ঘটে থাকে, সেক্ষেত্রে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জন্য বলিভিয়ায় আক্রমণ পরিচালনা করা অসম্ভব ছিল না। কারণ, বলিভিয়া এখন স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র ঠিকই, কিন্তু ১৮৬৮ সালে বলিভিয়া স্থলবেষ্টিত ছিল না। বস্তুত ১৮২৫ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে বলিভিয়ার একটি বিস্তৃত সীমান্ত ছিল। ১৮৭৯–৮৪ সালে সংঘটিত প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধে বলিভিয়া চিলির কাছে পরাজিত হয় এবং চিলি বলিভিয়ার সম্পূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল দখল করে নেয়। এর মধ্য দিয়ে বলিভিয়া একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
অর্থাৎ, ১৮৭৯–৮৪ সালের আগে বলিভিয়া স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র ছিল না এবং এজন্য ব্রিটেন যদি ১৮৬৮ সালে বলিভিয়ায় আক্রমণ চালাতে চাইত, তাহলে তারা অনায়াসে তাদের নৌবহর পাঠিয়ে বলিভীয় ভূখণ্ডে সৈন্য মোতায়েন করতে পারত। কিন্তু উপরে বর্ণিত গল্পটিতে দাবি করা হচ্ছে, ১৮৬৮ সালে ব্রিটেন বলিভিয়া আক্রমণ করতে চেয়েছিল, কিন্তু বলিভিয়া স্থলবেষ্টিত হওয়ায় তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। এই দাবিটি যে অযৌক্তিক, সেটি বলে দেয়ার প্রয়োজন নেই। এবং এই গল্পে যেহেতু বলিভিয়াকে স্থলবেষ্টিত হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে, সেহেতু ধারণা করা যায় যে, ১৮৭৯–৮৪ সালের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বলিভিয়া স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পর এই গল্পটি প্রচলিত হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে, বলিভিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সেই যুদ্ধে বলিভীয় স্বাধীনতাকামীদের পক্ষে ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবকদের অংশগ্রহণ ছাড়া বলিভিয়ার ভূখণ্ডে ব্রিটেন কখনো কোনো ধরনের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করেনি। এজন্য বলিভিয়া হচ্ছে জাতিসংঘের সেই ২২টি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি, যাদের ভূখণ্ডে কখনো ব্রিটিশ আক্রমণ পরিচালিত হয়নি।