
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনী যখন দুর্বার গতিতে একের পর এক দেশ দখল করে নিচ্ছিল, তখন সেসব দেশের মূল্যবান অনেক সম্পদই তাদের হস্তগত হয়। জার্মান সেনা কর্মকর্তাদের কাছে প্রায়শই সেসব জিনিসের তালিকা থাকত। কোনো ভূখণ্ড জার্মানদের অধিকারে আসার পর পরই তারা জাদুঘরসহ আরো অন্যান্য জায়গাতে হামলা চালাত, যেখানে সংরক্ষিত থাকত বহু ঐতিহাসিক ও অমূল্য সামগ্রী। তাদের ঝোঁক ছিল বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবি, আর্টিফ্যাক্ট ইত্যাদির দিকে।
ধারণা করা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপের শতকরা বিশ ভাগ আর্টই এভাবে লুটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে এর কিছু অংশ উদ্ধার করা সম্ভব হলেও এখনও এক লাখের উপরে জিনিসের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি, যার মধ্যে একটি অ্যাম্বার রুম, হারিয়ে যাবার আগে যাকে অনেক পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বলে মনে করত। এর কাহিনী নিয়েই সাজানো হয়েছে দুই পর্বের এই ধারাবাহিক।
অ্যাম্বার
অ্যাম্বার রুম নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে এটি অ্যাম্বারের তৈরি কোনো ঘর হবে। কিন্তু কী এই অ্যাম্বার? এ নিয়ে এত মাতামাতিই বা কেন? অ্যাম্বার মূলত গাছের নিঃসৃত রস জমে তৈরি হওয়া একরকম পদার্থ। বাতাস, ঝড়ঝঞ্ঝা বা কোনো আঘাতে গাছের বাকল ফেটে একপ্রকারের রস বেরিয়ে আসে। সূর্যতাপে এর উদ্বায়ী অংশটুকু বাষ্পীভূত হয়ে গেলে যা পড়ে থাকে তা বহু বছর ধরে আস্তে আস্তে জমাট বেধে ফসিলের রূপ নেয়। এই সময়ের মধ্যে এর মাঝে ছোট ছোট পোকামাকড়ও আটকে যেতে পারে। জুরাসিক পার্ক চলচ্চিত্রের কথা মনে পড়ে? সেখানে একখণ্ড অ্যাম্বারের ভেতর থাকা মশার থেকেই কিন্তু ডাইনোসরের ডিএনএ বের করা হয়েছিল।
অ্যাম্বার হতে পারে স্বচ্ছ বা অস্বচ্ছ। আকার আর রঙের বেলাতেও ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। হলুদাভ থেকে শুরু করে দুধসাদা, কমলা, বাদামি, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে লাল অ্যাম্বারও পাওয়া যায়। রত্নপাথর হিসেবে গাঢ় স্বচ্ছ বা ঈষদচ্ছ অ্যাম্বারের বিরাট চাহিদা আছে। কারণ এর এই রকম অ্যাম্বার খুব সহজলভ্য নয়। সারা পৃথিবীর মধ্যে বাল্টিক সাগর তীরবর্তী বালুতে সবচেয়ে বেশি অ্যাম্বার ডিপোজিট আছে বলে মনে করা হয়। এই ডিপোজিট ৪০-৬০ মিলিয়ন বছরের পুরোনো। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে এই অঞ্চলে অ্যাম্বারের রমরমা ব্যবসা ছিল। বহু হস্তশিল্পঈ শুধু অ্যাম্বারের কাজই করতেন। তৎকালীন জার্মানির রাষ্ট্র প্রুশিয়ার ডানজিগ (বর্তমান পোল্যান্ডের এলাকা), কনিগসবার্গ (বর্তমান রাশিয়ার কালিনিনগ্রাদ) আর স্যাক্সোনির ড্রেসডেনে ছিল অ্যাম্বারের সবচেয়ে বড় শিল্প।
পেছনের কথা
অ্যাম্বার রুমের কথা বলতে গেলে অবশ্যম্ভাবীভাবেই চলে আসবে রাশিয়া আর প্রুশিয়ার কথা। কারণ এই দুই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবেই এর ব্যবহার হয়েছিল। কাজেই আগে দেখে নেয়া যাক কীভাবে সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো।
১৬৯৮ সালে ভাই আইভান আর বোন সোফিয়ার সাথে উত্তরাধিকারের সংঘাতে বিজয়ী হয়ে রাশিয়ার মসনদে বসলেন সতের বছর বয়স্ক রোমানভ বংশীয় জার প্রথম পিটার (পিটার দ্য গ্রেট নামে পরিচিত)। উচ্চাকাঙ্ক্ষী পিটার চাইছিলেন রাশিয়াকে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলির ন্যায় আধুনিকভাবে গড়ে তুলতে। শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে তার আগ্রহ ছিল, আর রত্নপাথর, বিশেষত অ্যাম্বারের প্রতি ছিল তার দুর্নিবার আকর্ষণ। তিনিই রাশিয়ান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।

১৬৯৭-৯৮ এর মধ্যে ষোল মাস ধরে পিটার বেনামে নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের মতো তৎকালীন পরাশক্তির রাজ্য ভ্রমণ করেন। দেশে এসে তিনি নানা সংস্কার কর্মসূচী হাতে নেন। এর ভেতর ১৭০০ সালে তিনি সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধও ঘোষণা করেন। কারণ বাল্টিক সাগরের দিকে যাবার রাস্তা ছিল সুইডেনের অধিকারে। পিটার এই এলাকা নিজের দখলে আনতে চাচ্ছিলেন, যাতে সাগরপথে ব্যবসাবাণিজ্য সহজে করা যায়। একুশ বছর লড়াইয়ের পর তিনি সফল হন।
এদিকে যুদ্ধ চলাকালেই ১৭০৩ সাল থেকে পিটার রাশিয়ার নতুন রাজধানী নির্মাণ করতে থাকেন। নেভা নদীর অববাহিকাতে অবস্থিত এই শহরের নাম দেয়া হয় সেন্ট পিটার্সবার্গ। ১৭১২ সালে মস্কো থেকে রাজধানী এখানে সরিয়ে নেয়া হলো। এরই কেন্দ্র থেকে ২৪ কিলোমিটার পূর্বে সুইডেনের নিয়ন্ত্রণাধীন বেশ কিছু এলাকা আগেই পিটার ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। সেখানে তার আদেশে রানী প্রথম ক্যাথেরিনের জন্য ১৭০৮ সালে বানানো হলো বিশাল রাজকীয় ভবন। নাম দেয়া হলো জারের গ্রাম (The Royal Village/ রাশিয়ান ভাষায় Tsarskoye Selo), এখন যা পরিচিত ক্যাথেরিন প্রাসাদ নামে। এক ঘিরে পরবর্তীতে গড়ে উঠেছিল পুশকিন নগরী।

এদিকে রাশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে বাল্টিকের কাছাকাছি আছে ডাচি (একজন ডিউক বা ডাচেসের অধীন অঞ্চল) প্রুশিয়া। এর পূর্বাংশের রাজধানী কনিগসবার্গ, আর মূল রাজধানী বার্লিন। এখানকার ক্ষমতায় পিটারের সময় ছিলেন রাজা প্রথম ফ্রেডেরিক। একসময় এই ডাচির মূল ক্ষমতা ছিল পোলিশ রাজার হাতে। ১৬৫৫ সালে সুইডেন পোল্যান্ড আক্রমণ করলে প্রথম ফ্রেডেরিকের বাবা ফ্রেডেরিক উইলিয়াম প্রুশিয়ার একক ক্ষমতা লাভের স্বার্থে প্রথমে সুইডেনের পক্ষাবলম্বন করেন। পরে ১৬৫৭ সালে পোল্যান্ড তার কাছ থেকে সামরিক সহায়তার বিপরীতে প্রুশিয়াকে সার্বভৌমত্ব দিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। ফ্রেডেরিক উইলিয়াম এরপর রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেন এবং নিজের ক্ষমতাকে আরো পোক্ত করেন। তার ছেলে সুইডেনের বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়াকে সমর্থন দেয়ার বিনিময়ে ১৭০১ সালে নিজের জন্য রাজা উপাধি আদায় করে নেন, হয়ে উঠলেন প্রুশিয়ার রাজা প্রথম ফ্রেডেরিক। কনিগসবার্গ থেকে তিনিই রাজধানী শহর সরিয়ে নিয়েছিলেন বার্লিনে।তিনি ও তার স্ত্রী সোফি-শার্লট দুজনেই শিল্প-সাহিত্য আর জ্ঞানচর্চার অনুরাগী ছিলেন। এসবের পেছনে বেহিসাবি টাকাপয়সা ওড়ানো হতো। তখনই সম্ভবত ১৭০০ সালের দিকে সোফি-শার্লট স্বামীকে পরামর্শ দিলেন বার্লিনের শার্লটেনবার্গ প্রাসাদে অ্যাম্বার দিয়ে একটি ঘর তৈরি করতে।

কাজ শুরু হলো
১৭০১ সালে ফ্রেডেরিক স্ত্রীর ইচ্ছাকে কাজে পরিণত করার পরিকল্পনা হাতে নিলেন। রাজদরবারের প্রধান স্থপতি, আন্দ্রেয়াস শ্লুটাকে (Andreas Schlüter) দায়িত্ব দেয়া হলো এই রুমের ডিজাইন করতে। অনেকে বলে থাকেন শ্লুটা নয়, সোফি-শার্লট চেয়েছিলেন আরেক প্রথিতযশা জার্মান আর্কিটেক্ট ইয়োহান ফ্রিডরিখ ইয়োজান্ডাকে। কিন্তু তিনি দেশের বাইরে থাকায় শিকে ছেড়ে শ্লুটার ভাগ্যে। কিন্তু ইয়োজান্ডা ফিরে এলে নাকি তাকেই প্রধান ডিজাইনার করা হয়। নিজের থেকে পঁচিশ বছরের ছোট ইয়োজান্ডার অধীনে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে শ্লুটা পদত্যাগ করেন। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধারণা এই যে, শ্লুটাই অ্যাম্বার রুমের কাজ করেন, সুতরাং আমরা সেই ধারণা ধরেই এগোবো।
কাজ চলতে থাকে পুরোদমে। শ্লুটার নকশা বাস্তবায়ন করতে একসাথে করা হলো সেকালের বিখ্যাত সব অ্যাম্বারের কারিগরদের। তাদের প্রধান ড্যানিশ হস্তশিল্পি উলফ্র্যাম, আর তাকে সহায়তা করেন ডানজিগের শাখট আর থুহাও। শ্লুটার পরিকল্পনা ছিল মূল্যবান কাঠের প্যানেলের উপর অ্যাম্বার আর সোনার পাতা বসিয়ে কারুকার্য করা হবে। এরপর সব প্যানেল বসিয়ে এগুলো মোম দিয়ে জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা হবে এই রুম। এর মধ্যে থাকবে চারটি ফ্রেম যা সজ্জিত করা হবে মূল্যবান আয়না দিয়ে।
এদিকে ১৭০৫ সালে সোফি-শার্লট নিউমোনিয়াতে মারা যান। কাজ থামল না। ১৭০৭ সালে ঊর্ধ্বতনদের সাথে বাকবিতণ্ডার জের ধরে শ্লুটাও চলে গেলেন। কিন্তু উলফ্র্যাম একমনে কাজ করে গেলেন ১৭০৯ সাল পর্যন্ত। এরপর থেমে থেমে কাজ চলতে থাকে ১৭১৩ সাল অবধি। এদিকে প্রুশিয়া আর রাশিয়ার ভাল সম্পর্কের সূত্র ধরে শ্লুটা ১৭১২-তে পিটারের সাথে কাজ করতে সেন্ট পিটার্সবার্গে পাড়ি জমান। সেখানেই ১৭১৩ সালে তার মৃত্যু হয়। একই বছর মারা যান রাজা প্রথম ফ্রেডারিক।
অ্যাম্বার রুম বিনিময়
প্রুশিয়ার শূন্য সিংহাসনে বসলেন নতুন রাজা ফ্রেডারিক ভিলহেম। তিনি অত্যন্ত মিতব্যয়ী শাসক ছিলেন। যেকোন জাঁকজমক ছিল তার দুচোখের বিষ। অ্যাম্বার রুমের পেছনে খরচ করা তিনি পুরোপুরি অপচয় মনে করতেন। রাজা হয়েই তাই তিনি কাজ বন্ধ করে দেন। তিনি মনোযোগী হলেন প্রুশিয়ার রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির কাজে। তখন সুইডেন আর রাশিয়ার তুমুল সংঘর্ষ চলছিল। ভিলহেম নিজে সুইডেনের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন। কাজেই এই সুযোগে তিনি রাশিয়ার সাথে আরো গভীর সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইলেন। ১৭১৬ সালে পিটার তিন দিনের সফরে প্রুশিয়া এলেন। কোথায় কোথায় ভিলহেম তার অ্যাম্বারের প্রতি আগ্রহের কথা জানতে পারলেন, আর পিটার জানতে পারলেন অ্যাম্বার রুমের কথা। কেল্লা ফতে! ভিলহেম তো খুশিতে আত্মহারা। গলায় কাঁটার মতো বিঁধে থাকা অ্যাম্বার রুম পাঠিয়ে দেয়া যাবে রাশিয়াতে, আর বিনিময়ে জারের থেকে নেয়া যাবে অনেক সুবিধা। অবিলম্বে যে ক’টি প্যানেল তৈরি হয়েছিল সব আঠারটি বিশাল বাক্সবন্দি করা হলো। ১৭১৭ সালে সেই বাক্স এসে পৌঁছল সেন্ট পিটার্সবার্গ।

রাশিয়া আর সুইডেনের যুদ্ধ চলমান থাকায় অ্যাম্বার রুম পড়ে থাকল সেভাবেই ১৯২১ সাল অবধি। সেই বছর লড়াই শেষ হলেও সাম্রাজ্য পুনর্গঠনে পিটার ব্যস্ত হয়ে পড়েন। চার বছর পর তার মৃত্যু হলে জারিনা হিসেবে ক্ষমতা নিলেন পিটারের কন্যা এলিজাবেথ। তিনি ইটালিয়ান আর্কিটেক্ট বার্তোলমিউ আরাস্ট্রেল্লিকে (Bartolomeo Rastrelli) ভার দিলেন অ্যাম্বার রুমের কাজ শেষ করবার।