ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে, সম্পদ-সাম্রাজ্যের লোভে, প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে কিংবা মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে হত্যাকান্ডগুলো আদিকাল থেকে চলে আসছে। হঠাৎ অতর্কিত হামলায়, নয়তো দীর্ঘ ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে। গুপ্তঘাতক দ্বারা নয়তো কাছের মানুষ হয়ে এই হত্যাকান্ড গুলো সংগঠিত করা হয়েছিলো। হত্যাকান্ডগুলো থেকে বাদ যান নি পৃথিবীর সবচাইতে ক্ষমতাধর মানুষ থেকে শুরু করে জনপ্রিয় রথী মহারথীরাও। ইতিহাসে সাড়া জাগানো এমন কয়েকটি কুখ্যাত হত্যাকান্ডগুলো নিয়েই আজ লেখা।
রোমান সেনাপতি জুলিয়াস সিজার হত্যাকান্ড
রোমান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী খিষ্টপূর্ব ৪৪ অব্দের ১৫ মার্চ ছিল এই রোমান সেনাপতির শেষ দিন। ছুরির পঁয়ত্রিশটি আঘাতে তাকে হত্যা করা হয়। এই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন ৬০ জন রোমান সিনেটর, যারা ছিলেন সিনেটের একাংশ। নিজেদের লিবারেটর হিসেবে পরিচয় দেয়া এই হত্যাকারীদের নেতৃত্বে ছিলেন সিজারের ঘনিষ্ট বন্ধু মার্কোস জুনিয়াস ব্রোটাস এবং গেইয়াস ক্যাসিয়াস লঙ্গিয়াস।
জুলিয়াস সিজার ছিলেন রোমান প্রজাতন্ত্রের এক নায়ক। তার পূর্ববর্তী সাফল্যের জন্য তাকে দশ বছরের জন্য ডিকটেটর হিসেবে মনোনীত করা হয়। এ একনায়কতন্ত্র চলাকালেই সিনেট তাকে ‘ডিকটেটর অফ পারপিরিউটি’ বা ‘অবিরাম স্বৈরশাসক’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। আর এই ঘোষণাই সিনেটের কিছু সদস্যের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারা মনে করেন যে, সিজারকে দেয়া এ ক্ষমতা সিনেটের জন্য সর্বনাশের কারণ হতে পারে।
এই প্রেক্ষিতেই ব্রোটাস তার বন্ধু এবং আত্মীয় লঙ্গিয়াসসহ আরো কয়েকজন সিজার বিরোধী সিনেটরদের নিয়ে হত্যার পরিকল্পনায় বসে। তারা নিজেদের বাসা-বাড়িতে গোপনে এই হত্যার জন্য বিভিন্ন ধরনের সহজ এবং কার্যকরী উপায়ের ব্যাপারে আলোচনা করে। কারো পরিকল্পনা ছিল নির্বাচনের সময় ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের জন্য সিজার যখন ক্যাম্পাস মার্টিয়াসে ব্রিজ পার হয়ে যাবে তখন তাকে হত্যা করা হবে। কেউ আবার প্রস্তাব রেখেছিল গ্লাডিয়েটর শো এর দিন তাকে হত্যা করার কথা। কেননা সেদিন খোলাখুলিভাবে অস্ত্র রাখা যায়। তাই কেউ সন্দেহ করবে না। এছাড়াও আরো নানান উপায় নিয়ে তারা আলোচনা করে। কিন্তু বেশি সংখ্যক সিনেটরদের মত ছিল সিনেটেই তাকে হত্যা করা। কেননা সিনেটের অধিবেশন চলাকালীন সময়ে সিনেটররা ছাড়া অন্য কেউ সেখানে থাকেন না। তারা খুব সহজেই আলখেল্লার ভিতরে অস্ত্র রেখে ভেতরে ঢুকে যেতে পারবে।
হত্যাকান্ডের দিন সিজারের কিছু বন্ধু, ডাক্তার, এমনকি তার স্ত্রী ক্যালপুর্ণিয়া তাকে সিনেটে যেতে মানা করে। কিন্তু বন্ধু এবং ষড়যন্ত্রকারী ব্রোটাসের উস্কানিতে সেদিন সিজার সিনেটের অধিবেশনে যান। সিনেটে প্রবেশের পর সম্মানের সাথে সিনেটররা উঠে দাঁড়ান। হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্রকারীরা ছিলেন সিজারের পাশেই। তার ডান পাশে ছিলেন টিলিয়াস কিম্বার। নির্বাসনে পাঠানো ভাইয়ের একটি পিটিশন নিয়ে কিম্বার সিজারের সাথে কথা বলেন। সে সময় ষড়যন্ত্রকারীরা কিম্বারে আশেপাশে আসেন তার সমর্থনে। তখনই কিম্বার সিজারের ঘার ধরে পরিধানরত আলখেল্লা খুলে ফেলে। সবাই নিজেদের ছুরি বের করে আক্রমনের জন্য প্রস্তুতি নেন। প্রথম আক্রমণ করেন সার্ভিলিয়াস কাসকা নামের একজন সিজারের বাম কাঁধে। কিন্তু তা লক্ষভ্রষ্ট হয়। এরপরই সবাই তার উপর হামলে পড়েন এবং পম্পেইয়ের থিয়েটার সংলগ্ন সিনেটেই গ্লাডিয়েটর শো মঞ্চস্থ হয়। প্রত্যেকেই সেদিন সিজারকে আঘাত করে খুনের অংশ নিয়েছিলেন।
আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম প্রেসিডেন্ট হত্যাকান্ড
১৪ এপ্রিল ১৮৬৫ সালের সন্ধ্যাটা আব্রাহাম লিংকনের জন্য কিছুটা অন্য রকমই ছিল। তাই তো স্ত্রী মেরি টডের সাথে কমেডি শো আওয়ার আমেরিকান কাজিন দেখতে এলেন ওয়াশিংটন ডিসি ফোর্ড থিয়েটারে। গৃহযুদ্ধ তখন শেষের দিকে। উত্তরের ইউনিয়ন তখন দক্ষিনের দাস প্রথা চালু রাখার ব্যাপারে সমর্থনকারী কনফেডারেটের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান প্রায় পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। আর সাম্প্রতি কনফেডারেট আর্মির বড় রেজিমেন্টগুলো আত্মসমর্পণ করেছে। টানা পাঁচ বছরের গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ছিল দাস প্রথা বাতিলের পরবর্তী আরেকটা জয়। নিজেদের দেশে আরেকটা শুভক্ষণ যখন এগিয়ে আসছে তখন তো শান্তিতে থাকারই কথা। কিন্তু অদৃষ্ট তার শান্তি মেনে নিতে পারে নি। আততায়ী জন উইকিস বুথের হাতে প্রাণ হারান আমেরিকার ১৬তম এবং সবচাইতে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট।
বুথ ছিলেন একজন অভিনেতা এবং দক্ষিণের কনফেডারেটর স্টেট অফ আমেরিকার একজন সহযোগী। দক্ষিণের সবার মত তিনিও কালোদের উপর সাদাদের প্রভুত্ব বহাল রাখার আন্দোলনের সাথে একমত ছিলেন। আব্রাহাম লিংকনের দাস প্রথা বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিল তার অবস্থান। গৃহযুদ্ধের শেষের দিকে কনফেডারেটের হাজার হাজার সৈন্য, নেতারা উত্তরের ইউনিয়নের কারাগারে। উইকিস বুথ প্রথমত লিংকনকে অপহরণ করে জিম্মি হিসেবে রিচমন্ডে রাখতে চেয়েছিলেন। তার পরিকল্পনা ছিলো- যদি লিংকনকে জিম্মি হিসেবে ধরে রাখা যায়, তাহলে তার প্রাণের বিনিময়ে কনফেডারেটের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা কারাবন্দীদের ছাড়িয়ে আনা যাবে। কিন্তু তার এই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
এরপর তিনি এবং তার সহযোগী ষড়যন্ত্রকারীরা নতুন ছক আঁকেন। তার ধারণা ছিল যদি লিংকনসহ ভাইস প্রেসিডেন্ট এন্ড্রো জনসন, রাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম সিউয়ার্ডকে হত্যা করা যায়, তাহলে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া গৃহযুদ্ধ আবার শুরু করা যাবে। কিন্তু পরিকল্পনা মতো তারা ভাইস প্রেসিডেন্ট উপর হামলা সম্পন্ন করতে পারেন নি। এমনকি সিউয়ার্ডের উপর আক্রমনও সফল হয় নি। যদিও আক্রমণে রাষ্ট্র সচিব এবং তার ছেলে আহত হয়েছিলেন।
ফোর্ড’স থিয়েটারে বুথের প্রবেশের কোনো বাধা ছিল না। কেননা ভালো অভিনেতা হিসেবে তার নাম ডাক ছিল। এমনকি এই থিয়েটারেই বুথ আগে অভিনয় করে গেছেন। স্বয়ং আব্রাহাম লিংকন ছিল তার অভিনয়ের ভক্ত। আর সে যে কনফেডারেটের গুপ্তচর তাও কেউ জানতো না। তাই থিয়েটারে প্রবেশ নিয়ে কোনো ঝামেলা পড়তে হয় নি বুথের। যখন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন মনোযোগ সহকারে নাটক দেখছিলেন, তখনই বুথ পিছন থেকে তার মাথার বাম পাশে গুলি করেন। খুব কাছে থেকে গুলি করায় তা চোখ দিয়ে বের হয়ে যায়। এর পরদিন অর্থাৎ পনেরো তারিখ সকাল ৭টা ২২ মিনিটে প্রেসিডেন্টের মৃত্যু হয়। এটাই ছিল আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম প্রেসিডেন্ট হত্যাকান্ড।
হত্যাকারীদের হাত থেকে রক্ষা পান নি স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীও
পৃথিবীর সবচাইতে আলোচিত হত্যাকান্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম হত্যাকান্ডটি হচ্ছে ভারতের জাতির জনক হিসেবে খ্যাত রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর হত্যাকান্ড, যাকে পুরো পৃথিবী মহাত্মা গান্ধী হিসেবেই জানে। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারিতে নয়া দিল্লীর বিরলা ভবনে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে সময় তিনি তার পরিবার এবং অনুসারীদের সাথে সন্ধ্যাকালীন পথসভা করছিলেন। সভা চলাকালীন সময়ে নাথুরাম গডসে নামের একজন হিন্দু মৌলবাদী বেরেটা এম১৯৩৪ দিয়ে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে গুলি করে। এর কয়েক ঘন্টা পরেই সত্যাগ্রহ আন্দোলনের এ প্রতিষ্ঠাতা মৃত্যু বরণ করেন।
এর আগেও ১৯৩৪ সাল গান্ধীকে অনেকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। শুধুমাত্র নাথুরাম গডসেই ১৯৪৬ সালের সেপ্টেমবরে প্রথমবার এবং ১৯৪৮ সালের ২০ জানুয়ারিতে দ্বিতীয়বার গান্ধীকে হত্যার চেষ্টা করেন। পূর্বের ব্যর্থ চেষ্টাগুলোর পর অন্য একজন সহযোগী নারায়ন আপতেসহ নাথুরাম গডসে মুম্বাই হয়ে পুনেতে আসেন। সেখান থেকে গঙ্গাধর নামের একজনের সহযোগীতায় বেরেটা এম১৯৩৪ সেমি অটোমেটিক পিস্তল ক্রয় করেন এবং দিল্লি রেল স্টেশনের ছয় নাম্বার কক্ষে হত্যাকান্ডের চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেন। এই তিনজন ছাড়াও হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনায় আরো চারজন অভিযুক্ত ছিল।
এই হত্যাকান্ডের জন্য নাথুরাম গডসের কোনো অনুশোচনা ছিল না। তিনি ব্রিটিশদের সহিংস কাজের বিরুদ্ধে গান্ধীর অহিংস বাণী এবং সত্যাগ্রহের বিপক্ষে ছিলেন। তাছাড়া তিনি মনে করতেন গান্ধী পাকিস্তানকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। গান্ধী আর তার দলের প্রশ্রয়ের কারণে পাকিস্তান ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। স্বাধীন রাষ্ট্রে হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। যদি তা হয়, তাহলে পাকিস্তান ভারতের জন্য বিপদজনক হিসেবে দেখা দিবে। গডসে আদালতে গান্ধী হত্যাকান্ডের কারণ বিশদভাবে বর্ণনা করে।
১৯৪৯ সালের ১৫ নভেম্বর মহাত্মা গান্ধীর এ হত্যাকারীকে আমবালা জেলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।