১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক সরকার। পরের সাড়ে ন’মাস কখনো তাকে কারাবন্দি, আবার কখনো গৃহবন্দি থাকতে হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে বিজয় লাভ করলেও বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এত তাড়াতাড়ি হয়নি। নানা ঘটনা ও নাটকীয়তার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ভোররাতে তিনি মুক্তি পান, এবং ১০ জানুয়ারি বেলা ১টা ৪১ মিনিটে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
এর কয়েকদিন পর, ১৮ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ দৈনিক ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর প্রথম পাতায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল “He Tells Full Story of Arrest and Detention”। এখানেই প্রথমবারের মতো তিনি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন একাত্তরে তার গ্রেপ্তার ও বন্দিদশার আখ্যান।
এটি ছিল প্রখ্যাত সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গের (১৯৩৪-২০১৬) একটি বিশেষ প্রতিবেদন। কম্বোডিয়া যুদ্ধে সাহসী সাংবাদিকতার জন্য পুলিৎজার পুরস্কার জেতা এই আমেরিকান সাংবাদিকের বিশেষ ভূমিকা ছিল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেও। মূলত তিনি ১৯৭০-এর গোড়ার দিক থেকে ছিলেন ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর দিল্লি প্রতিনিধি। তবে এ দায়িত্ব পালনের সময় অনেকবারই তাকে ঢাকায়ও আসতে হয়েছে।
একাধারে যেমন শ্যানবার্গ সত্তরের সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় প্রত্যক্ষ করেছেন, সে বছর ডিসেম্বরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয় দেখেছেন, তেমনই খুব কাছ থেকে দেখেছেন ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর-কষাকষিও। সেই সূত্রে এই বাঙালি নেতার সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বও গড়ে তুলেছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে যে ক’জন বিদেশি সাংবাদিক পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার চিত্র স্বচক্ষে অবলোকন করেছিলেন, শ্যানবার্গ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৬ ডিসেম্বর, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যেদিন জেনারেল নিয়াজি বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেন, সেদিনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন শ্যানবার্গ।
সব মিলিয়ে একাত্তরের ১০ মাস শ্যানবার্গ অসংখ্য প্রতিবেদন লিখেছেন, কোনোটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে, কোনোটি দিল্লি বা কলকাতা থেকে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের শরণার্থী শিবিরেও গিয়েছেন তিনি, তুলে ধরেছেন সেখানকার মানুষের অবর্ণনীয় দুর্দশার চিত্র। যুদ্ধ শেষেও তিনি অব্যাহত রাখেন বাংলাদেশ বিষয়ক সংবাদ সংগ্রহ, যার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর প্রথম বঙ্গবন্ধুর ভাষ্যে তার অভিজ্ঞতার কথা গোটা বিশ্ববাসীকে জানানো।
রোর বাংলার পাঠকদের জন্য সেই ঐতিহাসিক প্রতিবেদনটি বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে একটি বিষয় এখানে লক্ষণীয় যে, প্রতিবেদনটিকে কোনোভাবেই শতভাগ নির্ভুল বলা যাবে না। এখানের বিভিন্ন শব্দচয়ন বা ঘটনা বর্ণনায় যে ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে, সেটি স্বীকার করে নিয়েছে স্বয়ং ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ কর্তৃপক্ষই। একটি বড় ভুল লেখার শুরুতেই দেখতে পাবেন, যেখানে ডেটলাইনের জায়গায় ‘ঢাকা, পাকিস্তান’ লেখা হয়েছে, যদিও ঢাকা তখন ইতোমধ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশের অংশ। এর কারণ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল আরো পরে, ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল।
আজ থেকে প্রায় ৪৮ বছর আগে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে ভুল-ত্রুটি থাকাই স্বাভাবিক, এবং একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে আমরা সেগুলো অপরিবর্তিত রেখেই আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
ঢাকা, পাকিস্তান, জানুয়ারি ১৬—তিনি বিদায় নিলেন তার ক্রন্দনরতা স্ত্রী আর সন্তানদের কাছ থেকে, তারা বললেন যা তারাও খুব ভালো করেই জানতেন—যে তিনি হয়তো আর কখনোই ফিরবেন না। এরপর পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে টেনেহিঁচড়ে নিচে নিয়ে গেল, পেছন থেকে রাইফের বাঁট দিয়ে আঘাত করতে করতে। তিনি তাদের জিপ পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন, তারপর স্বভাবসুলভ অভিব্যক্তিতেই বলে বসলেন, “আমি আমার পাইপ আর তামাক নিতে ভুলে গেছি। আমার অবশ্যই পাইপ আর তামাক লাগবে!”
সৈন্যরা হতভম্ব, বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু তারা ঠিকই তাকে তার বাড়ির ভিতর ফিরিয়ে নিয়ে গেল, যেখানে তার স্ত্রী তার হাতে তুলে দিলেন পাইপ ও তামাকের ডিব্বা। এরপর তাকে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে সাড়ে নয় মাসের জন্য কারাবন্দি করে রাখতে নিয়ে যাওয়া হলো। তার অপরাধ, তিনি পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন।
এমনটিই ছিল আজ শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের বিবৃতি, যখন প্রথমবারের মতো তিনি বর্ণনা করছিলেন তার গ্রেপ্তার ও কারাবাসের আখ্যান এবং মৃত্যুর মুখ থেকে অল্পের জন্য ফিরে আসা—এবং এক সপ্তাহ আগে তার মুক্তি।
আজ তিনি নিশ্চিন্ত, আবার মনের মধ্যে খানিকটা তিক্ততাও রয়েছে। মাঝেসাঝে নিজেই নিজের সৌভাগ্যে হেসে উঠছেন। এমন অবস্থাতেই বাংলাদেশ নামক নবঘোষিত রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলছেন আমেরিকান সংবাদপত্রের হাতেগোনা কয়েকজন সংবাদদাতার সাথে। তিনি হেলান দিলেন বসা ঘরের কাউচটির উপর। এটি অস্থায়ী সরকারি নিবাস তাকে বন্দিকারী, পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের, যিনি নিজেই এখন গৃহবন্দি রয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তানে। এবার তিনি (শেখ মুজিব) শুরু করলেন একদম শুরু থেকে—সেই ২৫ মার্চের রাত থেকে।
তার পাইপ আর তামাকের ডিব্বা পড়ে রইল তার সামনে রাখা কফি টেবিলের উপর। তিনি জানালেন, তিনি একটি ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরেছিলেন যে পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা তাকে হত্যা করবে, এবং সেই দায় চাপিয়ে দেবে বাঙালিদের উপর। “যখনই আমি বাড়ির বাইরে আসব,” তিনি ব্যাখ্যা করলেন, “তারা আমার গাড়িতে একটি গ্রেনেড ছুঁড়ে মারবে, এবং তারপর বলবে যে বাঙালি চরমপন্থীরা এটি করেছে, এবং সে কারণেই সেনাবাহিনীর এগিয়ে আসতে হয়েছে, আমার জনগণের উপর অ্যাকশন নিতে হয়েছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি অবশ্যই বাড়ির ভিতরেই অবস্থান করব, যাতে তারা আমাকে আমার বাড়ির ভিতরে এসেই মারে, এবং সবাই জানতে পারে তারাই আমাকে মেরেছে, এবং আমার রক্ত শোধিত করে আমার জনগণকে।”
ওইদিন, ২৫ মার্চ, খবরের পর খবর আসছিল যে সেনাবাহিনীর একটি অভিযান অত্যাসন্ন। তাদের অভিযানটি হবে জনগণ নির্বাচিত সেই আন্দোলনের বিরুদ্ধে, যার লক্ষ্য পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বাঞ্চলে পশ্চিম পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের আধিপত্য ও শোষণের অবসান ঘটানো। এসব খবর জানতে পেরে শেখ মুজিব তার বড় ছেলে, কামাল, এবং তার দুই কন্যাকে আগেভাগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন লুকিয়ে থাকতে। তবে তার স্ত্রী ছোট ছেলে রাসেলকে সঙ্গে রেখে দেন, এবং অসম্মতি জানান ঢাকার ধানমন্ডি সেকশনে অবস্থিত তাদের দোতলা বাড়িটি ছেড়ে যেতে।
নিজ ঘরে ঘুমন্ত
একটি কথা তারা কেউই জানতেন না যে, তাদের মেঝো ছেলে জামাল বাড়িতেই রয়েছেন, নিজের ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায়।
রাত দশটার দিকে শেখ মুজিব জানতে পারেন পাকিস্তানি সৈন্যরা অবস্থান নিয়েছে সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণ চালাতে। এর কয়েক মিনিট পরই সৈন্যরা তার বাড়িটিকেও চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে, এবং খুব কাছেই কোথাও একটি মর্টার শেল বিস্ফোরিত হয়।
এমন কোনো আক্রমণের জন্য তিনি আগে থেকেই গোপন প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বন্দর নগরী চট্টগ্রামের একটি গোপন আস্তানায় কল করেন, এবং তার জনগণের জন্য একটি শেষ বার্তা বিবৃত করেন। এই বার্তাটি রেকর্ড করা হয়, এবং পরবর্তীতে গোপন ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রচারও করা হয়।
ওই সম্প্রচারের সারকথা ছিল এই যে তাদের (জনগণের) নেতার যা-ই হোক না কেন, তারা যেন সেনাবাহিনীর আক্রমণকে প্রতিহত করে। সেই সাথে তিনি কথা বলেন পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের স্বাধীনতার ব্যাপারেও।
শেখ মুজিব বলেন যে এই বার্তা পাঠানোর পর তিনি চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (একটি আধাসামরিক একক) এবং তার নিজের দল আওয়ামী লীগের লোকদের, যারা তাকে পাহারা দিচ্ছিলেন।
পুরো শহরজুড়ে পশ্চিম পাকিস্তানি আক্রমণ শুরু হয় রাত ১১টার দিকে, এবং অচিরেই সেটির প্রাবল্য চরমে পৌঁছে যায়। মধ্যরাত থেকে রাত ১টার মধ্যে সৈন্যরা শেখ মুজিবের বাড়ির ভেতরও গুলিবর্ষণ শুরু করে। তিনি তার স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে ঠেলে পাঠিয়ে দেন উপরতলার ড্রেসিং রুমে। তারা সকলে মেঝেতে শুয়ে পড়েন, আর বুলেট তাদের মাথার উপর দিয়ে সশব্দে বর্ষিত হতে থাকে।
এর কিছুক্ষণ পরই সৈন্যরা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে। প্রথমেই তারা হত্যা করে একজন প্রহরীকে, যিনি ওই বাড়ি ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এরপর তারা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসে। শেখ মুজিব বলেন, তিনি ড্রেসিং রুমের দরজা খুলেছিলেন এবং তাদের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন: “গুলি চালানো বন্ধ কর! গুলি চালানো বন্ধ কর! কেন তোমরা গুলি চালাচ্ছ? যদি তোমরা আমাকে মারতে চাও, তাহলে আমাকে মারো; আমি এখানেই আছি, কিন্তু তোমরা কেন আমার জনগণ আর আমার সন্তানদের উপর গুলি চালাচ্ছ?”
আরো কিছুক্ষণ গুলিবর্ষণের পর, একজন মেজর ওই সৈন্যদেরকে থামান, এবং বলেন যে আর কোনো গুলিবর্ষণ হবে না। এরপর তিনি শেখ মুজিবকে বলেন যে তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তবে তার (শেখ মুজিব) অনুরোধে তাকে কিছু সময় দেয়া হয় আপনজনদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার জন্য।
তিনি পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে চুমু খান, এবং যেমনটি তিনি স্মরণ করেন, তিনি তাদেরকে বলেছিলেন: “ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। আমি হয়তো আর কখনো তোমাদের দেখব না। কিন্তু আমার জনগণ একদিন মুক্ত হবে, এবং আমার আত্মা সেটি দেখে সুখী হবে।”
এরপর জিপ চালিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় গণপরিষদ ভবনে, “যেখানে আমাকে একটি চেয়ার দেয়া হয়।”
“তারা আমাকে চায়ের অফার দিয়েছিল,” অনেকটা উপহাসের স্বরে তিনি স্মরণ করেন, “আমি বলেছিলাম, ‘এটা চমৎকার। চমৎকার পরিস্থিতি। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় চা পানের জন্য।'”
কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি “অন্ধকার ও নোংরা ঘরে”, যেটি ছিল সেনা ক্যান্টনমেন্টের একটি স্কুলে। এরপর ছয়দিন ধরে তিনি তার দিনগুলো কাটান ওই ঘরে, আর রাতগুলো—মধ্যরাত থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত—মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের বাসভবনের একটি ঘরে। এই টিক্কা খানই হলেন সেই ব্যক্তি যাকে বাঙালিরা সবচেয়ে বেশি দায়ী করে সামরিক নিপীড়নের জন্য, যার ফলে নির্যাতিত ও খুন হয়েছে লক্ষ লক্ষ বাঙালি।
১ এপ্রিল, শেখ মুজিব বলেন, তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় রাওয়ালপিন্ডি, পশ্চিম পাকিস্তানে—যেটি পূর্ব পাকিস্তান হতে বিচ্ছিন্ন এক সহস্রাধিক মাইল ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা—এবং তারপর তাকে নেয়া হয় মিয়ানওয়ালি কারাগারের একটি কনডেম সেলে। এর পরের নয়টি মাস তিনি কাটান ওই কারাগার, এবং আরো দুইটি কারাগার, লায়ালপুর ও সাহিওয়ালে, যার সবগুলোই অবস্থিত পাঞ্জাব প্রদেশের উত্তরাংশে। সামরিক সরকার তার বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ এনে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে, যার মধ্যে ছয়টির সাজা ছিল মৃত্যুদণ্ড। একটি ছিল “পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা।”
শেখ মুজিব, যিনি নিজে একজন আইনজীবী, জানতেন যে তার কোনো আশা নেই খালাস পাওয়ার। তাই তিনি শুরু করেন সময়ক্ষেপণের কৌশল। “আমিও তাদের সাথে একটি খেলা খেলছিলাম,” তিনি হাসতে হাসতে বলেন। “আমি চেষ্টা করছিলাম কিছু সময় পাওয়ার।”
সর্বোচ্চ আইনজীবী দাবি
প্রথমেই তিনি দাবি জানান যেন আদালতে তার পক্ষে লড়ে এ. কে. ব্রোহি, পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে খ্যাতিমান উকিল, যিনি সকল শ্রেণীর মানুষের কাছেই সম্মানিত। শেষ পর্যন্ত ব্রোহিকে তার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়, এবং তিনি লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন। কয়েক মাস পর লায়ালপুরে যখন বিচার শুরু হয়, শেখ মুজিব হঠাৎ করে মত বদল করে বসেন। তিনি ঘোষণা দেন যে তার পক্ষে কারো লড়ার প্রয়োজন নেই, সুতরাং ব্রোহিকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া যেতে পারে।
তখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একটি নতুন সামরিক আইন জারি করেন যে শেখ মুজিবের একজন আইনজীবী থাকতেই হবে, তিনি চান কিংবা না চান। “দেখতেই পাচ্ছেন কীভাবে তারা আমার ‘অধিকার রক্ষা’ করতে চাচ্ছিল,” শেখ মুজিব বলেন। “আসলে তারা স্রেফ একটি সার্টিফিকেট চাচ্ছিল আমাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর।”
বিচার শেষ হয় ৪ ডিসেম্বর—ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন, যেটির জন্ম হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কটের মধ্য দিয়ে, এবং শেষ হয়েছিল ভারতীয় বিজয় এবং বাংলাদেশ নামে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে।
“ইয়াহিয়া সামরিক আদালতের সকল সদস্যকে রাওয়ালপিন্ডি ডাকেন যেন তারা দ্রুত তাদের রায়ের খসড়া জমা দেন,” শেখ মুজিব বলেন, “কিন্তু তারপর তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন যুদ্ধ নিয়ে।”
একটি পূর্ণাঙ্গ মাত্রার যুদ্ধের মাঝে একটি রায় ঘোষণা অদ্ভূতই দেখাত। তবে শেষ পর্যন্ত সেই রায় কখনোই ঘোষিত হয়নি। ৭ ডিসেম্বর শেখ মুজিবকে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয় মিয়ানওয়ালিতে। ১৫ ডিসেম্বর, পূর্বে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের একদিন আগে, শেখ মুজিবকে নিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পরিকল্পনা কাজ করতে শুরু করে, যেটির ব্যাপারে তিনি পরদিন সকালে জানতে পারেন।
মিয়ানওয়ালি অবস্থিত লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ. এ. কে. নিয়াজির নিজ জেলা শহরে। নিয়াজিই পূর্ব পাকিস্তানে সেনাপতি হিসেবে জেনারেল টিক্কা খানের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। ১৫ তারিখে কারাগারের বন্দিদের, যারা সকলেই ছিল ওই জেলার, বলা হয়েছিল যে যুদ্ধে বাঙালিদের হাতে মৃত্যু হয়েছে জেনারেল নিয়াজির। তাদেরকে আরো বলা হয়েছিল যে পরদিন যখন তাদের সেলের দরজা খুলে দেয়া হবে, এবং তাদের করণীয় হবে শেখ মুজিবকে হত্যা করা। তারা সকলে খুবই উৎসাহের সাথে এতে সম্মত হয়েছিল।
পরদিন ভোর ৪টায়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের ঘণ্টা দুয়েক আগে, প্রিজন সুপারিনটেন্ডেন্ট এসে শেখ মুজিবের সেলের দরজা খুলে দেন। শেখ মুজিবের সাথে তার অনেকটাই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তাই শেখ মুজিব তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি কি আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে নিচ্ছেন?” এর কারণ শেখ মুজিব দেখতে পেয়েছিলেন কারাকর্মীরা তার সেলের বাইরে কমপাউন্ডে একটি কবর খুঁড়ছে (যদিও তারা বলেছিল এটি নাকি তার নিরাপত্তার জন্য খোঁড়া একটি পরিখা ছিল, যদি ভারতীয় বিমানবাহিনী হামলা চালিয়ে বসে)। ওই সুপারিনটেন্ডেন্ট, যিনি খুবই উত্তেজিত হয়ে ছিলেন, শেখ মুজিবকে নিশ্চিত করেন যে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য নেয়া হচ্ছে না।
কিন্তু এরপরও শেখ মুজিবের মন থেকে সন্দেহ দূর হচ্ছিল না। “আমি তাকে বলেছিলাম, ‘যদি আপনারা আমাকে মেরে ফেলেন, দয়া করে আমাকে কয়েক মিনিট সময় দিন শেষবারের মতো নামাজ পড়ার।'”
“না, না, কোনো সময় নেই!” সুপারিনটেন্ডেন্ট শেখ মুজিবকে টানতে টানতে বলেছিলেন। “আপনাকে এখনই আমার সাথে আসতে হবে।”
বাইরে বেরিয়ে আসার পর সুপারিনটেন্ডেন্ট শেখ মুজিবের কাছে পুরো ষড়যন্ত্রটি ব্যাখ্যা করেন। এরপর তিনি তাকে (শেখ মুজিব) তার নিজের বাড়িতে নিয়ে যান, যেটি মাইলখানেকের মতো দূরে ছিল। পরের দুটি দিন তাকে তিনি সেখানেই রাখেন। যুদ্ধ তখন প্রায় শেষের পথে, এবং সরকারি মহলে যথেষ্ট বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৮ ডিসেম্বর সুপারিনটেন্ডেন্ট শেখ মুজিবকে জানান যে তাকে নিয়ে আসার বিষয়টি বাইরে ফাঁস হয়ে গিয়েছে।
এরপর ওই সুপারিনটেন্ডেন্ট শেখ মুজিবকে আরো কয়েক মাইল দূরে একটি পোড়ো বাড়িতে নিয়ে যান। ওই বাড়িতেই শেখ মুজিব নয়দিন ছিলেন। সৈন্যরা যখন সুপারিনটেন্ডেন্টের কাছে জানতে চায় যে শেখ মুজিব কোথায়, তখন তিনি বলেন তিনি জানেন না। কিন্তু তখন অফিসার ইনচার্জ তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে শেখ মুজিবকে লুকিয়ে রাখা বা ঘাবড়াবার কোনো কারণ নেই। জুলফিকার আলি ভুট্টো, পাকিস্তানের যে রাজনীতিবিদ ১৯ ডিসেম্বর জেনারেলদের কাছ থেকে ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন, তিনি স্রেফ শেখ মুজিবের সাথে কথা বলতে চান।
এরপর শেখ মুজিব দেখা দেন, এবং তাৎক্ষণিকভাবে তাকে রাওয়ালপিন্ডি উড়িয়ে নেয়া হয়। সেখানে প্রেসিডেন্টের গেস্ট হাউজে তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।
এর কয়েকদিন পর, পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা ভুট্টো যিনি পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক অভিযান পূর্ববর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়েছিলেন, তিনি শেখ মুজিবকে দেখতে যান। শেখ মুজিব বলেন তিনি এভাবে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন: “ভুট্টো, তুমি এখানে কী করছ?” শেখ মুজিব জানতেন যে ভুট্টো ক্ষমতায় বসেছেন, তারপরও তিনি তার সাথে একটু মজা করতে ছাড়েননি।
“আমি প্রেসিডেন্ট, এবং একই সাথে চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর,” ছিল ভুট্টোর প্রত্যুত্তর। আর শেখ মুজিব বলেছিলেন, “চমৎকার পরিস্থিতি।”
ভুট্টো এরপর বলেন, জেনারেল ইয়াহিয়া খান যখন তার হাতে ক্ষমতা তুলে দিচ্ছিলেন, তখন তিনি নাকি বলেছিলেন যে তার একটি বিশাল বড় আফসোস তিনি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারেননি। এরপর তাকে (ভুট্টো) জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি “এই একটি কাজ” করতে পারবেন কি না। এরপর ভুট্টো শেখ মুজিবকে আরো জানান যে জেনারেল নাকি তাকে এই প্রস্তাবও দিয়েছিলেন যে তিনি কাগজপত্রের তারিখ কয়েকদিন পিছিয়ে দিতে পারেন, যাতে মনে হয় শেখ মুজিবকে হত্যা তার সময়ই করা হয়েছিল। কিন্তু ভুট্টো এই প্রস্তাবে অসম্মতি জানিয়েছিলেন।
আজ শেখ মুজিব বলেন যে ভুট্টোর এই অসম্মতির কারণ ছিল মূলত রাজনৈতিক। যেমনটি ভুট্টো যুক্তি দেখিয়েছিলেন, যদি এই বাঙালি নেতাকে মারা হয়, তাহলে তারা (বাঙালিরা) হত্যা করবে ওই লাখের কাছাকাছি পাকিস্তানি সৈন্যকে, যারা পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণ করেছে। আর তারপর পাঞ্জাব এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মানুষ—যেখান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ সৈন্য এসেছে—ভুট্টোকেই দায়ী করবে, এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে জেগে উঠবে।
শেখ মুজিব বলেন যে ভুট্টো তার উপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন যেন তিনি সমঝোতা করেন এবং দুই পাকিস্তানি অঞ্চলের মধ্যে কিছু সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন, তা সে যত নগণ্যই হোক না কেন।
‘তুমি নও, আমি’
“আমি তাকে একটি জিনিস জিজ্ঞেস করেছিলাম প্রথমে—আমি কি মুক্ত নাকি মুক্ত না?” শেখ মুজিব বলেন। “যদি আমি মুক্ত হই, আমাকে যেতে দাও। যদি আমি না হই, তাহলে আমি কথাও বলতে পারব না।”
“তুমি মুক্ত,” শেখ মুজিবকে ভুট্টো বলেছিলেন, “কিন্তু আমার এখনো কয়েকদিন সময় প্রয়োজন তোমাকে যেতে দেয়ার আগে।”
শেখ মুজিব জানান, মুক্তির প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পরও, তিনি ভুট্টোর সাথে কোনো ধরনের রাজনৈতিক আলোচনা করা থেকে বিরত থাকেন।
আরেক পর্যায়ে, যখন ভুট্টো যুক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করছিলেন যে পাকিস্তানের দুটি অংশ এখনো আইন ও ঐতিহ্যের মাধ্যমে একতাবদ্ধ রয়েছে, তখন শেখ মুজিব তাকে মনে করিয়ে দেন যে সর্বশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল, কিন্তু সেই ফলাফলকে তারা কখনোই সম্মান করেনি। তিনি বলেছিলেন, “বেশ তো, পাকিস্তান যদি এখনো এক দেশ হয়, তাহলে তো তুমি প্রেসিডেন্ট নও, চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটরও নও; ওগুলো আমি।”
৭ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট (পাকিস্তানের) শেখ মুজিবের সাথে তৃতীয় ও শেষবারের মতো সাক্ষাৎ করতে যান। বাঙালি নেতা তাকে বলেন: “আজ রাতেই তোমার আমাকে মুক্ত করতে হবে। দেরি করার আর সময় নেই। হয় তুমি আমাকে মুক্তি দেবে, নয়ত হত্যা করবে।”
শেখ মুজিব বলেন, ভুট্টোর জবাব ছিল এমন যে এত অল্প সময়ের মধ্যে কোনো ব্যবস্থা করা খুবই কঠিন। তবে অবশেষে তিনি তাকে (শেখ মুজিব) লন্ডনে যেতে দিতে সম্মত হন। শেখ মুজিব জানান, যখন ভুট্টো তাকে বিদায় জানাচ্ছিলেন, তখনো তিনি তাকে অনুরোধ জানাচ্ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ
১) মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধু