হৃদপিন্ড কোনোদিন ছিলো কি ছিলো না—
কৈফিয়ত অদরকারী।
সব কিছু পেয়েছিলে, যা-কিছু আমার বুকে ছিলো।
বিনা প্রত্যাশায় আমি নিরাকার
প্রিয়মন্যতার পকেট ভরিয়ে নিয়ে
এইবারে দ্বীপে চ’লে যাবো।
সেই দ্বীপে কোনোদিন তোমাদের জাহাজ যাবে না।
দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা এই সব্যসাচী সাহিত্যিকের বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। শরীরে ক্যান্সার থাকা সত্ত্বেও মাথা নোয়াবার পাত্রী ছিলেন না নবনীতা দেব সেন। দীর্ঘ একটা সময় ধরে এই ক্যান্সারটাকে ভুলিয়ে রেখেছিলেন নিজের হাস্যোজ্জ্বল চেহারার গহীনে। এমনকি মৃত্যুর কিছুদিন আগেও কলকাতার এক সংবাদপত্রে লিখেছিলেন, কীভাবে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে ছিলেন।
বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র এই সাহিত্যিক নবনীতা দেব সেন গত ৭ই নভেম্বর ইহলোক ত্যাগ করেছেন। আসলে, এভাবে না বলে কবির নিজের সুরেই বলা ভালো হবে। নবনীতা দেব সেন সেই দ্বীপে চলে গেছেন, যে দ্বীপে কোনোদিন ভিড়বে না আমাদের কোনো জাহাজ।
সেই অচেনা দরিয়ায় বৈঠাবিহীন এক নৌকায় চড়ে ওপারের উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন নবনীতা দেব সেন; আর ভক্ত এবং পাঠকদের সারা জীবন ভালোবাসায় সিক্ত রাখলেও এবার অশ্রুতে সিক্ত করতে বাধ্য করলেন।
নবনীতা দেব সেনের একজন সাহিত্যিক হিসেবে জীবনের সবচাইতে বড় অর্জন এটাই যে, তার কলমের কালি কখনো ফুরোয়নি তবে ফুরিয়ে গেল তার জীবনের মেয়াদ। ৮১ বছর বয়সে নিজের জন্মস্থান কলকাতার ৭২ নং হিন্দুস্তান পার্কের সেই ‘ভালো-বাসা’ বাড়িটিতেই নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহীয়সী সাহিত্যিক।
১৯৩৮ সালের ৭২ নং হিন্দুস্তান পার্কের ‘ভালো-বাসা’ তে জন্ম হয় ‘খুকু’র। বাবা ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক নরেন্দ্র দেব। আর মাতা ছিলেন সেই সময়ের নারী সাহিত্যিক হিসেবে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলা রাধারাণী দেবী; যার ছদ্মনাম ছিল অপরাজিতা দেবী। এই দুই সাহিত্যিকের ছোট্ট খুকুর নাম ঠিক করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নবনীতা নামে।
অপরদিকে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মৃত্যুশয্যায় শুয়েও স্নেহের রাধুর (রাধারাণী দেবী) সন্তানের নাম দিয়েছিলেন অনুরাধা। নামকরণের ঠিক তিনটে দিন পর ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেয়া নামটাই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় খুকু তথা নবনীতা দেব সেনের কাছে।
বাবা-মা দু’জনেই কবি দম্পতি নামে বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিলেন তখনকার সময়ে। সে সুবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রমথ চৌধুরী, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, জলধর সেন, হেমেন্দ্রকুমার রায় সহ সমসাময়িক সব সাহিত্যিকদের সাথেই ছিল নিবিড় যোগাযোগ। তাই, স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় যে এরকমই এক সাহিত্যঘেরা পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন খুকু।
গোখেল মেমোরিয়াল স্কুল থেকে স্কুলের পাট চুকিয়ে ভর্তি হন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। তারপর সেখান থেকে যান প্রেসিডেন্সি কলেজে, তারপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষক ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তাই ধারণা করা যায় যে, নবনীতা দেব সেনের সব্যসাচী সাহিত্যিক হওয়াটা ঈশ্বর প্রদত্তই বটে।
যাদবপুর থেকে বুদ্ধদেব বসুর আর্শীবাদ নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান বিদেশ-বিভূঁইয়ে। সেখানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হন মাস্টার্সের পড়াশোনা শেষ করার আশায়। তারপর ব্লুমিংটনের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যের উপর পিএইচডি করেন।
এবং নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সাথে বিয়ের পর যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকাজ পরিচালনা করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালে বহিরাগত অধ্যাপক হিসেবে কলম্বিয়া, শিকাগো, হার্ভার্ড এবং কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নামীদামী আরো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় কাটিয়ে ছিলেন।
এছাড়াও, কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া এবং টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়েও পরিদর্শক হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলেন। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, মেক্সিকো এবং জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহও নবনীতা দেব সেনকে সম্মানের সাথে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শন অধ্যাপক হিসেবে ডেকেছিল।
তবে সম্মানজনক অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাধাকৃষ্ণ মেমোরিয়াল লেকচার সিরিজে মহাকাব্যিক বক্তৃতা দেয়ার জন্য তিনি সম্মানিত হয়েছিলেন এবং পরিচিতিও লাভ করেছিলেন বেশ। বিয়ের পর বিদেশের পাট চুকিয়ে ফেলেন এবং দেশে ফিরে আসেন। সেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েই ফিরে আসেন তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে এবং কর্মজীবনের অংশ হিসেবে এখানেই ছিলেন তিনি। অতঃপর ২০০২ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৫৯ সালে সাহিত্যে পদার্পণ ঘটে ‘প্রথম প্রত্যয়’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের মাধ্যমে। এরপর বছরের পর বছর ধরে, তিনি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন তার রচনার মাধ্যমে। প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, রম্যরচনা, আত্মজৈবনিক, ভ্রমণকাহিনী এবং নাটক মিলিয়ে প্রায় আশিখানেক গ্রন্থের রচয়িতা নবনীতা দেব সেন। সাহিত্যের এমন কোনো দিক ছিল না, যেখানে অবাধ বিচরণ ছিল না এই গুণী মানুষটির।
রূপকথা এবং দুঃসাহসিক অভিযান কাহিনী লেখার জন্যে বিশেষ করে কিশোরদের কাছে অতি পরিচিত নাম ছিল নবনীতা দেব সেন। আর সাধারণত তার লেখায় নারীরাই হতো প্রধান চরিত্র।
বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত ও অনুষ্ঠিত সাহিত্য এবং একাডেমিক সম্মেলনগুলোতে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। এমনকি, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ সেমিওটিক এবং স্ট্রাকচারাল স্টাডিজ এবং ইন্টারন্যাশনাল কম্পারেটিভ লিটারেচার অ্যাসোসিয়েশনের কার্যনিবাহী পদে অধিষ্ঠিত হবার সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি।
১৯৯৬ সালে মিত্র এন্ড ঘোষ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশ পাওয়া তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘নব-নীতা’; এই আত্মজীবনী মূলক রম্যরচনাটি পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে তাকে সাহিত্য অ্যাকাদেমি পুরস্কার এনে দেয়।
আর সাহিত্যে সুবিশাল প্রভাব আর অবদানের জন্য ভারত সরকার পরের বছর, অর্থাৎ ২০০০ সালে তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা (বেসামরিক) পদ্মশ্রীতে ভূষিত করে। এছাড়াও, কমলকুমার জাতীয় পুরস্কার, গৌরী দেবী মেমোরিয়াল পুরস্কার, ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, মহাদেবী বার্মা পুরস্কার, হারমনি পুরস্কার, রকফেলার সোসাইটির দেয়া সেল্লি পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার এবং ভাগলপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেয়া শরৎ পুরস্কার তো আছেই তার অর্জনের ঝুলিতে।
আশির দশকের দিকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে উইমেন স্টাডিজের চল শুরু হয়। সে সময় থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ অবধি কেবল লেকচারার হিসেবেই নয় বরং হাতে কলমের প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেছেন নবনীতা দেব সেন।
আর শুধু কাজেকর্মেই নয়, তার রচিত সাহিত্যেও বিভিন্নভাবে নারীদের বিষয়গুলোকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। ২০০০ সালে পদ্মশ্রী পাওয়ার প্রাক্কালে মা-রাধারাণী দেবীর জন্মদিন উপলক্ষে লেখিকাদের নিয়ে একটি সংঘ তৈরি করেন ‘সই’ নামে।
নারীদের প্রতি তার মমত্ববোধ আর ভালোবাসার অন্যতম নিদর্শন ছিল নারীদের নিয়ে করা বইমেলা, যার নাম হয়েছিল ‘সইমেলা।’ সম্ভবত এটিই বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র বইমেলা ছিল যেখানে কেবল নারীদের প্রাধান্য ছিল; হোক তা লেখিকা হিসেবে কিংবা প্রকাশক অথবা স্টলের কর্মী।
আর এই সংগঠনের প্রকাশনা থেকেই তার রচিত ‘অভিজ্ঞান দুষ্মন্ত’ নাটকটি প্রকাশ পেয়েছিল; যে রাজা প্রণয়িনীকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন- তারই অন্য পিঠ রচনা করেছিলেন তিনি।
এমনকি রামকথা নিয়ে দীর্ঘদিন আলাপ-আলোচনায় যুক্ত থাকলেও তিনি সীতার দৃষ্টিভঙ্গিতে থেকেই তা আলোকপাত করেছেন। ষোড়শ শতাব্দীর দুই ব্রাহ্মণ নারী ছিলেন তার গবেষণার মূল কেন্দ্রবিন্দু। ব্রাহ্মণ হয়েও সাহিত্যের অন্ধকার যুগে থেকেও কি করে দুই নারী রামায়ন অনুবাদ করেছিলেন বাংলা আর তেলেগু ভাষায়, তা-ই ছিল তার গবেষণার মূল প্রসঙ্গ।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী এবং একদম সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা তেলেগু ভাষার কবি মোল্লাকে নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছিলেন তিনি। এছাড়া, একজন নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্যের বিচার বিশ্লেষণ করার রসদ ছিল তার বাসার তিনতলাতেই, তার মা রাধারাণী দেবীর জীবন।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে এলাহাবাদের ইঞ্জিনিয়াস সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সাথে রাধারাণীর বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বছর ঘোরার আগেই স্বামীর মৃত্যুতে বিধবা হন তিনি। আর সে সময়ের কথা হিসেবে যা অকল্পনীয় আর অবিশ্বাস্য ছিল, সেটিই ঘটেছিল তার জীবনে। তার শ্বাশুড়ির উৎসাহেই পড়াশোনা এবং লেখালেখি আবারো পূর্ণ উদ্যমে চলতে থাকে। তখন তার লেখা কবিতা ছাপা হতো ‘অপরাজিতা দেবী’ নামে।
কথিত আছে, সে সময় পত্রিকাপাড়ার কমবেশি সকলেই এটা বিশ্বাস করতো যে, নারীর ছদ্মনামে লিখেন আসলে একজন পুরুষ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও শুনতে হয়েছিল এমন কথা। আর তার অবিশ্বাসের কারণেই এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে রাধারাণী আর রবীবাবুর মধ্যে।
এই নিবিড়তার মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে রাধারাণীর পরিচয় হয় আরেক কথাসাহিত্যিক ও কবি নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে। আর সকল কুসংস্কার দূরে ঠেলে এবং সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিধবা নারীর আবারো নতুন করে বিবাহ দেন রাধারাণীর সেই মহীয়সী শ্বাশুড়ি নিজেই। এমনকি এই বিয়েতে সম্পূর্ণ সহমত প্রকাশ করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রমথ চৌধুরীসহ তখনকার সময়ের সব গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
সে সময়ের অনুপাতে একজন বিধবা নারী নিজ ইচ্ছায় আবারো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন- ব্যাপারটা সত্যিকার অর্থেই অকল্পনীয় আর অভাবনীয়। সেজন্যে পরের দিন পত্রিকায় বড় করে শিরোনাম হয়: রাধারাণী-নরেন্দ্র দেব বিবাহ: কন্যার আত্ম সম্প্রদান।
বিয়ের পর প্রথম সন্তান মারা গেলে তারা হিন্দুস্তানের এই ‘ভালো-বাসা’তে এসে ওঠেন এবং এখানেই জন্ম নেন নবনীতা দেব সেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সহ সমসাময়িক অনেক কবি-সাহিত্যিক ছিলেন তাদের প্রতিবেশী।
যেকোনো সম্মেলন থেকে শুরু করে সেমিনারে বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি মায়ের জীবনের এই গল্পগুলো তুলে ধরতেন। গর্ব করে বলতেন তার সেই পিতামহীর কথা, যিনি তার মায়ের আবারো বিবাহ দিয়েছিলেন; নিজের সন্তানের মৃত্যুর পরও। গল্পগুলো থেকে প্রেরণা নিতে বলতেন নারীদের।
শুধু মায়ের কথাই নয়, বাবার কথাও বলতেন তিনি। আর সবচাইতে আশ্চর্যের বিষয়, তিনি তার ‘ভালো-বাসা’ নামক বাড়িটি থেকে কখনোই বের হয়ে আসতে পারেননি। সেটা হোক বাস্তব জীবনের প্রেক্ষাপটে কিংবা হোক তার লেখা রচনাতে। জন্ম আর বেড়ে ওঠা এই বাড়িটিকে ঘিরেই তার সাহিত্যের কাল্পনিক দুনিয়া শাখাবিস্তার লাভ করেছিল।
১৯৫৯ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পাশাপাশি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন নবনীতা দেব সেন। তবে ১৯৭৬ সালে তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। তবে বিচ্ছেদ ঘটলেও তাদের মধ্যে শ্রদ্ধা আর সম্মানের সম্পর্কটা এতটুকুও মলিন হয়নি; আর এ কথা স্বয়ং অমর্ত্য সেনই স্বীকার করেছেন প্রাক্তন সহধর্মিণীর মৃত্যুতে।
নবনীতা দেব সেনের দুই কন্যাসন্তান- অন্তরা দেব সেন এবং নন্দনা দেব সেন। সদ্য নোবেলজয়ী অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জী মাত্র একদিনের জন্য কলকাতা সফরে এসেও সময় নিয়ে দেখা করেছেন নবনীতা দেব সেনের সাথে। আর ঘরে ঢোকা মাত্রই অভিজিতের মাসী খ্যাত নবনীতা দেব সেন বলেছিলেন,
কি যেন একটা প্রাইজ পেলিরে তুই?
সাহিত্য থেকে শুরু করে সমস্ত ক্ষেত্রেই তার প্রভাব ছিল লক্ষনীয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যশোধরা বাগচী, সুবীর রায় চৌধুরী, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত সহ প্রখ্যাত সব সাহিত্যিক ছিলেন নবনীতা দেব সেনের বন্ধু-বান্ধব।
একপাশের গড়িয়াহাট- যেটা কলকাতার মধ্যবিত্ত বাসিন্দাদের কেনাকাটার আদি পীঠস্থান আর অন্যপাশে ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক। এই গড়িয়াহাট লাগোয়া হিন্দুস্থান পার্কের গলিটাই মূলত অভিজাত পাড়া নামেই খ্যাত। এই পাড়ারই কোন এক গলির একদম মুখে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নরেন্দ্র দেব আর রাধারাণী দেবীর ভালো-বাসা নামক বাড়িটি।
মূল ফটকের সামনে শ্বেতফলকে বাড়ির নাম লেখা আর অন্যপাশে নরেন্দ্র দেব আর রাধারাণীর জন্য আলাদা দুটি ফলক। ঠিকানাটা ৭২ নম্বর হিন্দুস্থান পার্ক সড়ক। তিনতলা এই বাড়িটার ঠিক উল্টোদিকেই বাংলাসাহিত্যের প্রখ্যাত আরেক কবির বাড়ি-যতীন্দ্রমোহন বাগচি। আর সড়কের নামটাও তাই যতীন বাগচি।
জন্ম থেকে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি ‘ভালো-বাসা’তেই কাটিয়েছেন তিনি। কলকাতার এক পত্রিকার তার জন্য একটা কলাম বরাদ্দ ছিল, যেখানে তিনি আত্মজৈবনিক রচনা লিখেছিলেন। রচনাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশ পায়।
তার উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে- ভালোবাসার বারান্দা, নটী নবনীতা, কাব্যগ্রন্থ- স্বাগত দেবদূত, নকশালবাদী বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে লেখা- আমি অনুপম, ভ্রমণ নিয়ে লেখা- করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে, হৃদকমল, একটি ইতিবাচক প্রেমকাহিনী, নাট্যারম্ভ, নবনীতার নোট বই, সীতা থেকে শুরু, নব-নীতা সহ ভ্রমণসমগ্র এবং রূপকথা আর কিশোর সমগ্র সমূহ।
তার রচনা শুধুমাত্র বাংলাতেই নয় বরংচ বিশ্বের নানান ভাষায় অনূদিতও হয়েছে বটে। ক্যান্সারের মতো এত মরণঘাতী রোগও নবনীতা দেব সেনের কলমের কালি ফুরাতে আর লেখা থেকে হাতকে বিরত করতে সক্ষম হয়নি।
লিখেছেন তিনি জীবন মেয়াদ ফুরোবার আগ অবধি, বিচরণ করেছেন সাহিত্যের প্রতিটা ক্ষেত্রে, পাগলা এক ঘোড়ায় চড়ে ছুটে চলেছেন বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে; কখনো তা রম্যরচনা বেশে, কিংবা কখনো তা সমকামিতার সামাজিক উপন্যাসে। কখনো তা কবিতার অন্তদর্হনে, অথবা কখনো আত্মজীবনীমূলক গল্প গড়াতে।
খুব কম মানুষের মধ্যেই এমন গুণ লক্ষ করা যায়। মৃত্যুর আগ অবধি তার ঠোঁটের সেই হাসি এতটাই প্রাণবন্ত ছিল যেন তিনি ৮০ বছরের এক তরুণী। বার্ধক্য কেবল শরীরে প্রকাশ পেয়েছে, তবে মনটা যেন এখনো সেই ভালোবাসার খুকু।
যে মৃত্যুর আগদিন অবধি প্রাণোচ্ছ্বলে হেসে হেসে মরণকে উদ্দেশ্য করে, ‘কামেন ফাইট, লেটস ফাইট!’ এসব বলে; তার আর যাই হোক মৃত্যু হতে পারে না। মৃত্যুর মতো এত ভয়াবহ ব্যাপারটাও যেন নবনীতা দেব সেনের কাছে একদমই তুচ্ছ আর নগণ্য একটা ব্যাপার মাত্র। ওপারেও নিশ্চয়ই এমন হাস্যোজ্জ্বল আছেন এই সাহিত্যিক।
নবনীতা দেব সেনের বইগুলো পাবেন এখানে।
বই ও সিনেমা সম্পর্কিত চমৎকার সব রিভিউ আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/