২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই নিজেদেরই এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের সময় সেই কর্মকর্তা একজন এজেন্টের সাথে ‘ডেড ড্রপ’ করছিলেন। ‘ডেড ড্রপ‘ হলো গুপ্তচরদের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের একটি পদ্ধতি। যে পদ্ধতিতে দুজন গুপ্তচর নিরাপত্তার খাতিরে সরাসরি দেখা না করে একটি পূর্বনির্ধারিত জায়গায় তাদের বিনিময়ের বস্তু বা তথ্য ফেলে রেখে আসে। এরপর সুবিধা মতো সময়ে নিজেদের বিনিময়কৃত জিনিস নিয়ে নেয়। ডেড ড্রপ করার সময়ে হাতেনাতে ধরা পড়া সেই এফবিআই এজেন্টের নাম রবার্ট ফিলিপ হ্যানসেন।
রবার্ট ফিলিপ হ্যানসেনকে এফবিআইয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ‘বিশ্বাসঘাতক’ এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আমেরিকার কোর্ট অব জাস্টিস তার এই বিশ্বাসঘাতকতাকে বর্ণনা করেছিল ‘আমেরিকার ইতিহাসে গুপ্তচরবৃত্তির সবচেয়ে বড় বিপর্যয়’ হিসেবে।
কিন্তু কেন হ্যানসেনকে ‘সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক’ কিংবা তার কাজকে ‘এফবিআইয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হলো? আখ্যায়িত করার কারণ, তিনি স্নায়ুযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পরবর্তীতে রাশিয়ার কাছে পাচার করেছিলেন। এফবিআইয়ের ইন্টেলিজেন্স, কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স এবং আমেরিকার পারমাণবিক প্ল্যান্ট-সম্পর্কিত এসব তথ্য পাচারের জন্য তাকে মোটা অংকের অর্থ দেওয়া হয়েছিল। হ্যানসেনের তথ্যের ভিত্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়নে অন্তত দুজন আমেরিকান গোয়েন্দাকে ধরা হয়, যাদের পরবর্তীতে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
১৯৪৪ সালে আমেরিকার ইলিনয় রাজ্যে জন্মগ্রহণ করা রবার্ট হ্যানসেনের পিতা ছিলেন পেশায় পুলিশ কর্মকর্তা। হ্যানসেনের শিক্ষাজীবন ছিল যথেষ্ট বৈচিত্র্যময়। ইলিনয়ের নক্স কলেজ থেকে কেমিস্ট্রিতে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। সেখানে একটা বিদেশি ভাষা নেয়া বাধ্যতামূলক ছিল। তিনি রাশিয়ান ভাষা বেছে নিয়েছিলেন। এরপর নর্থ-ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ডেন্টিস্ট্রি অধ্যয়ন করেন, কিন্তু শেষমেশ আবার এমবিএ করেন হিসাববিজ্ঞানের উপর। কেমিস্ট্রি, রুশ ভাষা ও সাহিত্য, ডেন্টিস্ট্রি, হিসাববিজ্ঞান– নিঃসন্দেহে হ্যানসেনের শিক্ষাজীবন বৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল।
হ্যানসেন ১৯৬৮ সালে বার্নাদেত্তি ওয়াউক নামের এক নার্সকে বিয়ে করেন, যিনি আবার কট্টর ক্যাথোলিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। স্ত্রীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে হ্যানসেন প্রোটেস্ট্যান্ট থেকে ক্যাথলিক খ্রিস্টানে রূপান্তরিত হন এবং তুলনামূলক বেশি রক্ষণশীল ক্যাথলিকদের সংগঠন ‘ওপাস ডেই‘ এর সদস্যপদ লাভ করেন।
প্রথমে ডেন্টাল হাসপাতালে কর্মজীবন শুরু করলেও ১৯৭২ সালে হ্যানসেন শিকাগো পুলিশে যোগদান করেন। সেখানে তাকে এমন একটি ইউনিটের সদস্য করা হয়, যে ইউনিটের কাজ হলো পুলিশ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির তদন্ত করা। চার বছর পুলিশ বিভাগে কাজ করার পর তার গোয়েন্দা হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন পূরণ হয়। দুবার আবেদনের পর অবশেষে ১৯৭৬ সালে এফবিআই তাকে নিয়োগ দেয়। দুই বছর ইন্ডিয়ানা রাজ্যের গ্যারিতে কাজ করার পর নিউ ইয়র্কে ট্রান্সফারের জন্য আবেদন করেন। এফবিআই তার আবেদন গ্রহণ করে এবং নিউ ইয়র্কে তাকে সোভিয়েত কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্সের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়।
তার সুপারভাইজার তাকে উল্লেখ করেছিলেন, একজন স্মার্ট, প্রযুক্তি-জ্ঞানসম্পন্ন, বিশ্লেষণী ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে। নিউ ইয়র্কের এফবিআই কর্তৃপক্ষ কম্পিউটার সিস্টেমের উপর তার দক্ষতা দেখে অভিভূত হয়। কিন্তু ফিল্ড ওয়ার্কে তার দক্ষতার ঘাটতি থাকায় তাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়। এতে তিনি বেশ হতাশ হয়ে যান। তিনি সোভিয়েত ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধে কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এখানে তাকে লাগিয়ে দেওয়া হলো ডাটাবেজ কম্পাইলিংয়ের কাজে।
এফবিআইয়ের এজেন্ট হিসেবে যে বিলাসী জীবনের প্রত্যাশা ছিল, সেটা পূরণ না হওয়ায় আক্ষেপ করতেন হ্যানসেন। একদিকে আর্থিক চাপ এবং অপরদিকে এফবিআইয়ের গোয়েন্দা হতে না পারার হতাশা তাকে ডাবল এজেন্ট হতে প্ররোচিত করে। বলা চলে, অনেকটা অর্থনৈতিক কারণেই হ্যানসেন সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৯ সালের নভেম্বরে হ্যানসেন গুপ্তচরবৃত্তির জগতে পা রাখলেন। একটি কোম্পানির মাধ্যমে রাশিয়ার বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা জিআরইউয়ের সাথে যোগাযোগ করলেন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ডেড ড্রপ পদ্ধতিতে জিআরইউকে অনেক গোপন তথ্য সরবরাহ করেন। এর বিনিময়ে জিআরইউ তাকে ২১,০০০ ডলার প্রদান করে।
১৯৮০ সালের বসন্তে হ্যানসেনের স্ত্রী তার স্বামীর কাছে আসা একটি অদ্ভুত চিঠি দেখতে পান। অনেক জেরার পর হ্যানসেন তার স্ত্রীর কাছে স্বীকার করেন যে, তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছেন। কিন্তু তার স্ত্রীকে এটা বোঝাতে সক্ষম হন যে, তিনি স্রেফ অর্থের জন্য এমন কিছু তথ্য দিয়েছেন যা সোভিয়েতদের কোনো কাজে আসবে না। কিন্তু স্ত্রী তাকে চার্চের যাজকের কাছে এই অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলেন।
স্ত্রীর কথা মতো হ্যানসেন চার্চের যাজকের কাছে স্বীকারোক্তি দেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন যে আর কখনও গুপ্তচরবৃত্তি করবেন না। যাজক তাকে প্রায়শ্চিত্তের জন্য গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত সকল অর্থ চ্যারিটিতে দান করে দিতে বলেন। যাজকের কথানুযায়ী হ্যানসেন সকল অর্থ চ্যারিটিতে দান করেন।
১৯৮১ সালে রবার্ট হ্যানসনকে এফবিআইয়ের ওয়াশিংটন ডিসির অফিসে বাজেট এবং সোভিয়েত অ্যানালিটিক্যাল ইউনিটের দায়িত্ব দিয়ে স্থানান্তর করা হয়। এসময় তিনি পেশাগত কারণে সোভিয়েত গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধে এফবিআইয়ের কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্সের বিপুল পরিমাণ তথ্য হাতে পান। তারপরেও যাজকের কাছে করা প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি গুপ্তচরবৃত্তি থেকে বিরত থাকেন।
তাকে ১৯৮৫ সালে ওয়াশিংটন থেকে নিউ ইয়র্কে এফবিআইয়ের ফিল্ড অফিসে বিদেশি কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স স্কোয়াডের সুপারভাইজার হিসেবে প্রেরণ করা হয়। এটা তাকে এফবিআইয়ের সার্ভারে সোভিয়েত গোয়েন্দা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে অবস্থানরত এফবিআইয়ের সোর্স সম্পর্কে প্রচুর তথ্যে প্রবেশাধিকার দিয়েছিল। এরপর থেকে তিনি আরও এক ধাপ উপরে ওঠে কেজিবির হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির সিদ্ধান্ত নেন।
হ্যানসেন, ‘রোমান গার্সিয়া’ ছদ্মনাম ব্যবহার করে ১৯৮৫ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ডকুমেন্ট ও কম্পিউটার ফাইল আকারে কেজিবি’কে এফবিআই’র কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স সম্পর্কে প্রচুর তথ্য পাঠান। এসব কাজের জন্য কেজিবি তাকে পাঁচ লাখ ডলার ও ডায়মন্ড প্রদান করে।
১৯৯১ সালে হ্যানসেন কেজিবির কাছে তথ্য পাচার থেকে বিরত থাকেন। এর আংশিক কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। আর প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়, তখন এফবিআই নিজেদের ভেতরকার ডাবল এজেন্টদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছিল।
১৯৯২ সালে রবার্ট হ্যানসেন এফবিআইয়ের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির তালিকা ইউনিটের প্রধান পদে উন্নীত হন। পরের বছর রাশিয়ার সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা সংস্থা জিআরইউয়ের এক কর্মকর্তার কাছে তিনি সরাসরি অর্থের বিনিময়ে গুপ্তচরবৃত্তির প্রস্তাব দেন, কিন্তু তাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি হয়। রাশিয়ানরা আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু এফবিআইয়ের তদন্তে আশ্চর্যজনকভাবে তিনি পার পেয়ে যান।
যা-ই হোক, ১৯৯৪ সালে শারীরিক কারণে হ্যানসেনকে সবধরনের ব্যবস্থাপনামূলক কাজের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ১৯৯৫ সালেই আবার তাকে এফবিআই ও ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের বিদেশি মিশন অফিসে জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হয়। ক্যারিয়ারের বাকি পুরোটা সময়ে তিনি এই পদেই ছিলেন এবং তার সুপারভাইজার হিসেবে কেউ ছিল না।
১৯৯৯ তিনি এসভিআর (কেজিবির উত্তরসূরি গোয়েন্দা সংস্থা) এর সাথে গুপ্তচরবৃত্তির চুক্তি নবায়ন করেন। তাদেরকে সোভিয়েত ইউনিয়নে এফবিআইয়ের ইন্টেলিজেন্স ও আমেরিকার কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সম্পর্কে তথ্য পাচার করেন।
এরই মধ্যে এফবিআই-ও নিজেদের ভেতরকার ডাবল এজেন্টদের চিহ্নিত করতে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিল। সম্ভবত রাশিয়ান এক গুপ্তচরের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে হ্যানসেনের উপর নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়। ২০০১ সালের জানুয়ারিতে তাকে আরও কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য এফবিআইয়ের হেডকোয়ার্টারে স্থানান্তর করা হয়। একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনি অনেক গোপন তথ্যসহ একটি ময়লার ব্যাগ ফেলে রাখার সময় (ডেড ড্রপ পদ্ধতি) হাতেনাতে গ্রেফতার হন।
২০০১ সালেরই জুলাইয়ে রবার্ট হ্যানসেনকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। আদালত তার বিরুদ্ধে ১৯৭৯ সাল থেকেই মস্কোর হয়ে আমেরিকায় মোট ১৫ বার গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনে। মৃত্যুদণ্ড এড়াতে তিনি তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ স্বীকার করে নেন। ২০০২ সালে আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি প্রদান করে।
জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে হ্যানসেন বারবার বলেছিল যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে তার এই তথ্য বিক্রি করার উদ্দেশ্য সবসময়ই ‘আর্থিক’ ছিল। নিউ ইয়র্কে ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রায় ব্যয় মেটানো তার গতানুগতিক বেতনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এছাড়া শৈশবে তার পিতার কাছ থেকে পাওয়া দুর্ব্যবহার তাকে কর্তৃপক্ষের বিপক্ষে বিদ্রোহী হতে প্রভাবিত করেছিল। হ্যানসেনের এক বন্ধু পরবর্তীতে সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে, হ্যানসেন মানসিকভাবে বিকৃত ছিলেন। হ্যানসেন নিজেই তার বেডরুমে একটি গোপন ক্যামেরা স্থাপন করেন যাতে তার ও তার স্ত্রীর শারীরিক মিলন সরাসরি সেই বন্ধু দেখতে পারেন। এছাড়াও হ্যানসেন তার সেই বন্ধুকে তার স্ত্রীর সাথে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু তার বন্ধু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
প্রায় দুই যুগের দীর্ঘ গুপ্তচরবৃত্তির ক্যারিয়ারে তিনি হাজার হাজার পাতার গোপন স্পর্শকাতর ডকুমেন্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কাছে পাচার করেন। এই বিশাল তথ্য পাচারের বিনিময়ে তাকে ১৪ লাখ ডলার ও হীরা দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি আমেরিকার কলোরাডো রাজ্যের ফ্লোরেন্সে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন।