Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বুরিয়াতিয়া: বৈকাল হ্রদের তীরবর্তী মোঙ্গল প্রজাতন্ত্রে আঞ্চলিকতাবাদ

মস্কো থেকে ৬,১৩০ কি.মি. পূর্বে, বিশ্বের গভীরতম হ্রদ বৈকালের তীরে, রুশ–মঙ্গোলীয় সীমান্ত বরাবর চিত্তাকর্ষক প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি এবং বিচিত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি প্রজাতন্ত্র অবস্থিত, যেটি আয়তনে মালয়েশিয়া বা ফিলিপাইনের চেয়েও বড়। ৩,৫১,৩৩৪ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই প্রজাতন্ত্রটির নাম ‘বুরিয়াতিয়া প্রজাতন্ত্র’ (বুরিয়াত: Буряад Улас, ‘বুরিয়াদ উলাস’; রুশ: Респу́блика Буря́тия, ‘রেসপুবলিকা বুরিয়াতিয়া’)। প্রায় ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে অঞ্চলটি রুশ রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রজাতন্ত্রটিতে সরকারবিরোধী ও আঞ্চলিকতাবাদী মনোভাবের সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

বুরিয়াতিয়া প্রজাতন্ত্রটি এশীয় রাশিয়ায় অবস্থিত এবং ভৌগোলিকভাবে পূর্ব সাইবেরিয়ার অংশ। এর ৮০% ভূমিই পার্বত্য অঞ্চল। তিনদিকে রুশ ফেডারেশনের অন্যান্য অঞ্চল এবং অন্য একদিকে মঙ্গোলিয়া অবস্থিত। প্রজাতন্ত্রটির পূর্বে জাবৈকালস্কি সীমান্ত প্রদেশ, উত্তরে বৈকাল হ্রদ, উত্তর–পশ্চিমে ইর্কুতস্ক প্রদেশ ও পশ্চিমে তুভা প্রজাতন্ত্র এবং দক্ষিণে মঙ্গোলিয়া অবস্থিত। প্রশাসনিকভাবে ২১টি জেলা ও ২টি বৃহৎ শহরে বিভক্ত প্রজাতন্ত্রটির রাজধানী উলান–উদে শহর, যেখানে প্রজাতন্ত্রটির মোট জনসংখ্যার প্রায় এক–তৃতীয়াংশ বসবাস করে। এর বর্তমান জনসংখ্যা মাত্র ৯,৮৫,৯৩৭ জন।

‘বুরিয়াতিয়া’ রুশ ফেডারেশনের অন্তর্গত ২২টি প্রজাতন্ত্রের মধ্যে একটি এবং অঞ্চলটিতে বসবাসকারী ‘বুরিয়াত’ জাতিকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের জন্য এই প্রজাতন্ত্রটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বুরিয়াতরা বৃহত্তর মোঙ্গল জাতির অংশ এবং তারা বুরিয়াত ভাষায় কথা বলে, যেটি মূলত সিরিলিক লিপির ওপর ভিত্তি করে সৃষ্ট একটি বর্ণমালার মাধ্যমে লেখা হয়। বিশ্বে মোট জাতিগত বুরিয়াতের সংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ এবং এদের মধ্যে প্রায় ৪,৬০,০০০ বুরিয়াত রাশিয়ায় বসবাস করে। প্রধানত রুশ ফেডারেশনের অন্তর্গত বুরিয়াতিয়া প্রজাতন্ত্র, ইর্কুতস্ক প্রদেশের অন্তর্গত উস্ত–ওর্দা বুরিয়াত জেলা এবং জাবৈকালস্কি সীমান্ত প্রদেশের অন্তর্গত আগিন–বুরিয়াত জেলায় জাতিগত বুরিয়াত বসবাস করে, তবে মঙ্গোলিয়া ও চীনের অন্তর্গত অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়া স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলেও কিছুসংখ্যক জাতিগত বুরিয়াত বসবাস করে।

ঐতিহ্যবাহী জাতীয় পোশাক পরিহিত কিছু বুরিয়াত; Source: iStock

জাতিগত বুরিয়াতরা বুরিয়াতিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। বুরিয়াতিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৬% জাতিগত রুশ, প্রায় ৩০% জাতিগত বুরিয়াত এবং বাকি ৪% অন্যান্য জাতিভুক্ত। ধর্মগতভাবে বুরিয়াতিয়ার মোট জনসংখ্যার ২৭.৪% রুশ অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্ম ও ৬% খ্রিস্টধর্মের অন্যান্য শাখার অনুসারী; ১৯.৮% তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের অনুসারী; ১.৮% তেংরি ধর্ম এবং পীত শামানবাদ ও কৃষ্ণ শামানবাদের অনুসারী এবং বাকিরা কোনো ধর্মের অনুসরণ করে না। প্রজাতন্ত্রটিতে বসবাসকারী জাতিগত রুশরা প্রধানত অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মের এবং জাতিগত বুরিয়াতরা প্রধানত বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। প্রজাতন্ত্রটির রাষ্ট্রভাষা দুইটি– বুরিয়াত এবং রুশ।

প্রজাতন্ত্রটির নিজস্ব সরকার, শাসনব্যবস্থা ও সর্বোচ্চ আদালত রয়েছে এবং এটি নিজস্ব পতাকা, রাষ্ট্রীয় প্রতীক ও সঙ্গীতের অধিকারী। এর ৬৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি আইনসভা রয়েছে, যেটির নাম ‘বুরিয়াদ উলাসাই আরাদাই খুরাল’ বা ‘বুরিয়াতিয়া প্রজাতন্ত্রের গণপরিষদ’। প্রজাতন্ত্রটির রাষ্ট্রপ্রধান রুশ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক মনোনীত হন এবং বুরিয়াতিয়ার আইনসভার অনুমতিক্রমে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। বুরিয়াতিয়ার বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান আলেক্সেই ৎসিদেনভ একজন জাতিগত বুরিয়াত এবং আইনসভার স্পিকার ভ্লাদিমির পাভলভ একজন জাতিগত রুশ, যিনি বুরিয়াত ভাষায় পারদর্শী।

প্রজাতন্ত্রটির অর্থনীতি শিল্প ও কৃষিভিত্তিক একটি মিশ্র অর্থনীতি। প্রজাতন্ত্রটি বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং এখানে ইউরেনিয়াম, কয়লা, টাংস্টেন, নিকেল, বক্সাইট, মলিবডেনাম, ম্যাঙ্গানিজ, লৌহ, স্বর্ণ, বিভিন্ন বিরল মাটি ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের বিরাট সম্ভার রয়েছে। বুরিয়াতিয়ায় প্রায় ৭০০টি খনি বিদ্যমান। পশুপালন, পশম সংগ্রহ, শিকার এবং মাছ ধরা জাতিগত বুরিয়াতদের প্রধান পেশা। প্রজাতন্ত্রটির শিল্পের মধ্যে রয়েছে কয়লা উত্তোলন, কাঠজাত শিল্প এবং প্রকৌশল। প্রজাতন্ত্রটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং বৈকাল হ্রদের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যাবলির কারণে পর্যটন শিল্প প্রজাতন্ত্রটিতে বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে প্রজাতন্ত্রটি রুশ ফেডারেশনের দরিদ্রতম অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি।

পার্বত্য অঞ্চল বুরিয়াতিয়ার প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি অত্যন্ত মনোরম; Source: RussiaTrek.org

খ্রিস্টপূর্ব ২০৯ অব্দ থেকে ৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বুরিয়াতিয়া অঞ্চলটি চীনা ‘জিয়ংনু’ রাজ্যের এবং ৯৩ থেকে ২৩৪ সাল পর্যন্ত মোঙ্গল ‘জিয়ানবেই’ রাজ্যের অংশ ছিল। ৩৩০ থেকে ৫৫৫ সাল পর্যন্ত রুরান খাগানাত এবং ৮৪০ থেকে ৯২৪ সাল পর্যন্ত কিরগিজ খাগানাত অঞ্চলটিকে শাসন করে। ১২০৬ সালে অঞ্চলটি চেঙ্গিস খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বৃহৎ মোঙ্গল সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয় এবং ১৩৬৮ সাল পর্যন্ত অঞ্চলটি মোঙ্গল শাসনাধীন ছিল। এ সময় অঞ্চলটিতে বিভিন্ন মোঙ্গল গোত্র বসবাস করত। কিন্তু ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে অনেক মোঙ্গল গোত্র অঞ্চলটি ছেড়ে বৃহত্তর মঙ্গোলিয়ার অন্যান্য অংশে চলে যেতে শুরু করে এবং বুরিয়াতরা অঞ্চলটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়। ১৩৬৮ সালে উত্তর ইউয়ান সাম্রাজ্য অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ লাভ করে এবং প্রায় ৩০০ বছর অঞ্চলটিতে তাদের শাসন বজায় ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে বুরিয়াতদের মধ্য তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম বিস্তার লাভ করে।

সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে রুশরা সম্পদ, পশম ও স্বর্ণের সন্ধানে অঞ্চলটিতে আসতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে অঞ্চলটিতে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। ১৭২৭ সালে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে কিয়াখতা চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে বর্তমান বুরিয়াতিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। রুশ শাসনের প্রভাবে বুরিয়াতরা তাদের যাযাবর জীবনযাত্রা পরিত্যাগ করে কৃষি সমাজে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে বুরিয়াতরা রুশ সাম্রাজ্যে অঙ্গীভূত হতে আরম্ভ করে। ১৮৫১ সালে রুশ সম্রাট প্রথম নিকোলাই সম্ভাব্য চীনা আক্রমণ থেকে এশীয় রাশিয়ার সীমান্ত প্রদেশগুলো রক্ষার উদ্দেশে বৈকাল হ্রদ অঞ্চলে একটি নতুন সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলেন এবং এই বাহিনী বেশ কয়েকটি জাতিগত বুরিয়াত রেজিমেন্ট অন্তর্ভুক্ত ছিল।

১৯১১ সালে বাহির মঙ্গোলিয়া (বর্তমাজ স্বাধীন মঙ্গোলিয়া রাষ্ট্র) চীনের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এই ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়ে রুশ সাম্রাজ্যের বুরিয়াত–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে কিছু ক্ষুদ্র স্বাধীনতাকামী সংগঠনের সৃষ্টি হয়। একই সময়ে বুরিয়াতদের একটি অংশ বলশেভিক ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়। ১৯১৭ সালের মার্চে পেত্রোগ্রাদে একটি বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং একটি অস্থায়ী সরকার রাশিয়ার শাসনভার গ্রহণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লিপ্ত এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত এই অস্থায়ী সরকার রাশিয়ার প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়নি। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বুরিয়াত জাতীয়তাবাদীরা ১৯১৭ সালের এপ্রিলে ‘নিখিল–বুরিয়াত কংগ্রেস’ আহ্বান করে এবং এই কংগ্রসে তারা রাশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯১৭ সালের ২৫ এপ্রিল বুরিয়াতদের প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র ‘বুরিয়াত–মঙ্গোলিয়া রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

রুশ বিপ্লবের পর বুরিয়াত জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘বুরিয়াত–মঙ্গোলিয়া রাষ্ট্রে’র পতাকা; Source: Wikimedia Commons

কিন্তু বুরিয়াত বলশেভিকরা এর বিরোধিতা করে। তারা বুরিয়াতিয়াকে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে এবং সমাজতান্ত্রিক বুরিয়াতিয়াকে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করতে আগ্রহী ছিল। ১৯১৮ সালের প্রারম্ভে ট্রান্সবৈকাল সোভিয়েত কংগ্রসে বুরিয়াত বলশেভিকরা সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে যোগদানের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ফেব্রুয়ারিতে বলশেভিক লাল ফৌজের সহায়তায় ‘বুরিয়াত–মঙ্গোলিয়া রাষ্ট্র’কে উৎখাত করে বুরিয়াতিয়ায় বলশেভিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। ইতোমধ্যে প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের ভূখণ্ড জুড়ে বলশেভিক ও বলশেভিকবিরোধীদের মধ্যে তীব্র গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি (ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, জাপান, গ্রিস, রুমানিয়া, চীন ও অন্যান্য) রাশিয়া আক্রমণ করে। জাপানি সৈন্যরা ইতোমধ্যেই রাশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলীয় প্রদেশগুলো দখল করে নিয়েছিল। ১৯১৮ সালের গ্রীষ্মকালে জাপানি সৈন্যরা ট্রান্সবৈকাল অঞ্চল আক্রমণ করে। তারা এ সময় বুরিয়াতিয়া আক্রমণ করে এবং সেখানকার বলশেভিক সরকারকে উৎখাত করে গ্রিগোরি সেমিয়োনভের নেতৃত্বে একটি জাপানি–নিয়ন্ত্রিত পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করে।

এ সময় বুরিয়াতিয়া ৪টি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বুরিয়াতিয়ার একাংশ জাপানি–নিয়ন্ত্রিত গ্রিগোরি সেমিয়োনভের পুতুল সরকারের অধীনে ছিল; একাংশ বুরিয়াত জাতীয়তাবাদীদের কর্তৃত্বাধীন ‘বুরিয়াত–মঙ্গোলিয়া রাষ্ট্রের’র শাসনাধীনে ছিল; একাংশে বুরিয়াত ধর্মীয় নেতাদের দ্বারা ‘বালাগাত রাষ্ট্র’ নামক একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; এবং আরেক অংশে প্যান–মোঙ্গল জাতীয়তাবাদীরা ‘বৃহৎ প্যান–মোঙ্গল রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করেছিল ও ‘বৃহত্তর মঙ্গোলিয়া’র সঙ্গে যুক্ত হতে ইচ্ছুক ছিল। প্রতিটি রাষ্ট্রেই বুরিয়াত বলশেভিকরা গেরিলা যুদ্ধ চালাচ্ছিল। অবশেষে ১৯২০ সালের ২ মার্চ বলশেভিক লাল ফৌজ বুরিয়াত বলশেভিক গেরিলাদের সহযোগিতায় সমগ্র বুরিয়াতিয়া অধিকার করে নিতে সক্ষম হয়। বলশেভিকরা বুরিয়াতিয়ার পশ্চিমাংশকে ‘মোঙ্গল–বুরিয়াত স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ’ নামকরণ করে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করে এবং বুরিয়াতিয়ার পূর্বাংশকে ‘বুরিয়াত–মোঙ্গল স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ’ নামকরণ করে বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত ‘দূর প্রাচ্য প্রজাতন্ত্রে’র সঙ্গে সংযুক্ত করে

১৯২২ সালে ‘দূর প্রাচ্য প্রজাতন্ত্র’ রাষ্ট্রটি সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে অঙ্গীভূত হয় এবং এর ফলে দ্বিখণ্ডিত বুরিয়াতিয়া আবার একত্রিত হয়। ১৯২৩ সালের ২০ মে সোভিয়েত ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে বুরিয়াতিয়াকে ‘বুরিয়াত–মোঙ্গল স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ নামকরণ করে এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে। এসময় বুরিয়াতিয়ার শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। ১৯৩৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত কেন্দ্রীয় সরকার বুরিয়াত জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারাকে দুর্বল করে ফেলার জন্য বুরিয়াতিয়া থেকে উস্ত–ওর্দা (২২,১৩৮ বর্গ কি.মি.) ও আগিনস্কি (১৯,৩১২ বর্গ কি.মি.) জেলা দুইটিকে পৃথক করে এবং এর মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের বুরিয়াত জনসংখ্যাকে তিন ভাগে বিভক্ত করে ফেলে। জেলা দুইটি ‘উস্ত–ওর্দা বুরিয়াত স্বায়ত্তশাসিত জেলা’ ও ‘আগিন–বুরিয়াত স্বায়ত্তশাসিত জেলা’ হিসেবে যথাক্রমে ইর্কুতস্ক প্রদেশ ও চিতা প্রদেশের (বর্তমান জাবৈকালস্কি সীমান্ত প্রদেশের অংশ) অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫৮ সালের ৭ জুলাই প্রজাতন্ত্রটির নাম থেকে ‘মোঙ্গল’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। সোভিয়েত শাসনামল জুড়ে প্রজাতন্ত্রটিতে জাতিগত রুশদের অভিবাসন ও বসতি স্থাপন অব্যাহত ছিল।

‘বুরিয়াত স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে’র পতাকা; Source: Wikimedia Commons

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রাক্কালে ১৯৯০ সালের ৮ অক্টোবর প্রজাতন্ত্রটির নেতৃবৃন্দ প্রজাতন্ত্রটিকে ‘সার্বভৌম’ ঘোষণা করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯২ সালের ২৭ মার্চ প্রজাতন্ত্রটি ‘বুরিয়াতিয়া প্রজাতন্ত্র’ নাম ধারণ করে। প্রজাতন্ত্রটি কখনোই রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেনি, বরং এর নেতাদের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অর্জন। রুশ কেন্দ্রীয় সরকার ও বুরিয়াত প্রজাতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর ১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই রুশ ফেডারেশন ও বুরিয়াতিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে স্বায়ত্তশাসন লাভ করে।

কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষমতায় আরোহণের পর পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। প্রাক্তন কেজিবি কর্মকর্তা পুতিন রাশিয়ার প্রদেশগুলোর রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং এজন্য ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তিনি রাশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলোর স্বায়ত্তশাসন হ্রাস করতে শুরু করেন। ২০০২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রুশ কেন্দ্রীয় সরকার বুরিয়াতিয়ার সঙ্গে ১৯৯৫ সালে স্বাক্ষরিত স্বায়ত্তশাসন বিষয়ক চুক্তিটিকে বাতিল ঘোষণা করে। এর মধ্য দিয়ে বুরিয়াতিয়ার ওপর মস্কোর নিয়ন্ত্রণ স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সে সময় বুরিয়াতিয়ার জনসাধারণ এই সিদ্ধান্তের কোনো বিরোধিতা করেনি বললেই চলে।

বুরিয়াতিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে প্রাক্তন রুশ রাষ্ট্রপতি (বর্তমানে রুশ নিরাপত্তা পরিষদের উপ-সভাপতি) দিমিত্রি মেদভেদেভ; Source: Wikimedia Commons

কিন্তু ২০১০–এর দশকে বুরিয়াতিয়ায় আঞ্চলিকতাবাদ ও কেন্দ্রীয় সরকারবিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এই পরিস্থিতির জন্য বেশকিছু কারণ দায়ী।

প্রথমত, প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বুরিয়াতিয়া এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিকভাবে রুশ ফেডারেশনের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলগুলোর একটি। তদুপরি, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা বিশ্বের আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ ও সাম্প্রতিক কোভিড–১৯ মহামারীর ফলে রুশ অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং এটি বুরিয়াতিয়ার অর্থনীতির জন্য মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। তদুপরি, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যমতে, রাশিয়ায় দুর্নীতির মাত্রা অত্যন্ত ব্যাপক ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মস্কো এখনো পুরোপুরি সফল হয়নি। এরকম আর্থ–সামাজিক পরিস্থিতি বুরিয়াতিয়ার জনসাধারণের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে।

দ্বিতীয়ত, ২০০২ সালে স্বায়ত্তশাসন বাতিলের পর থেকে মস্কো বুরিয়াতিয়ায় যাদেরকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছে, তাদের প্রায় সকলেই প্রজাতন্ত্রটির বাইরে থেকে আগত। ফলে বুরিয়াতিয়ার ভাষা, সংস্কৃতি ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা যথেষ্ট সচেতন নন এবং এটিকে বুরিয়াতরা নিজেদের জন্য অপমানসূচক হিসেবে বিবেচনা করে। উল্লেখ্য, বুরিয়াতিয়ার বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান আলেক্সেই ৎসিদেনভ একজন জাতিগত বুরিয়াত হওয়া সত্ত্বেও তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় বুরিয়াতিয়ার বাইরে কাটিয়েছেন এবং বুরিয়াত ভাষাতেও তার পুরোপুরি দখল নেই। স্বভাবতই বুরিয়াতিয়ায় তিনি জনপ্রিয় নন।

তৃতীয়ত, রাশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের মতো বুরিয়াতিয়ায় রাষ্ট্রপতি পুতিনের দল ‘সংযুক্ত রাশিয়া’র একচ্ছত্র আধিপত্য নেই। রুশ ফেডারেশনের কমিউনিস্ট দলের বুরিয়াতিয়া শাখা প্রজাতন্ত্রটিতে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং দলটির বুরিয়াতিয়া শাখার নেতা ও আইনসভার সদস্য ভিয়াচেস্লাভ মার্খায়েভ একজন সমর্থ বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। এজন্য স্বভাবতই মস্কোর সঙ্গে বুরিয়াতিয়ার জনসাধারণের একটি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে স্থানীয় নির্বাচনে অনিয়মের প্রতিবাদে বুরিয়াতিয়ার পতাকা হাতে বিক্ষোভরত জনসাধারণ; Source: Vkontakte/sobytiao3 via The Moscow Times

চতুর্থত, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে মস্কোর নির্দেশে বুরিয়াতিয়া ‘দূর প্রাচ্য কেন্দ্রীয় জেলা’র অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইতিপূর্বে বুরিয়াতিয়া ‘সাইবেরীয় কেন্দ্রীয় জেলা’র অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং সুলভ মূল্যের খনিজ তেল লাভ করত। কিন্তু সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে প্রজাতন্ত্রটির জনসাধারণ এই সুবিধাটি হারিয়েছে। এজন্যও প্রজাতন্ত্রটির জনসাধারণ মস্কোর ওপর ক্ষিপ্ত।

পঞ্চমত, ২০১৯ সালের প্রথমদিকে সাইবেরিয়ার ইয়াকুতিয়া প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ইয়াকুতস্ক শহরে বসবাসকারী একজন শামান রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিনকে ‘দানব’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং ঘোষণা করেন যে, পুতিনকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তিনি ৮,০০০ কি.মি. দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মস্কোয় যাবেন। নিঃসন্দেহে এটি ছিল একটি ‘পাবলিসিটি স্টান্ট’, কিন্তু পুলিশ আলেক্সান্দর গাবিশেভ নামক ঐ শামানকে গ্রেপ্তার করে। এই অদ্ভুত লোকটি কিছু কিছু রুশদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং বুরিয়াতিয়ার একজন ব্লগার তার সমর্থনে প্রচারণা চালালে সেও পুলিশি হেনস্থার শিকার হয়। এ কারণে বুরিয়াতিয়ার জনসাধারণ মস্কোর ওপর রাগান্বিত হয়। উল্লেখ্য, ‘শামান’ বলতে এমন ব্যক্তিদেরকে বুঝানো হয় যারা ভালো বা মন্দ আত্মাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে বা তাদেরকে প্রভাবিত করতে পারে!

ষষ্ঠত, ২০১৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বুরিয়াতিয়ার রাজধানী উলান–উদে শহরের মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে ক্রেমলিনের সমর্থনপুষ্ট ইগর শুতেনকভ ৫২% ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কমিউনিস্টরা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ করে এবং তাদের সমর্থকরা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ শুরু করে। তারা এই নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে নতুন করে সুষ্ঠু নির্বাচন করার দাবি জানায় এবং একপর্যায়ে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের দমনের জন্য শক্তি প্রয়োগ করলে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। এই ঘটনা বুরিয়াতিয়ার জনসাধারণের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটিয়েছে।

বুরিয়াতিয়ায় বিক্ষোভরত কমিউনিস্ট দলের সমর্থকরা; Source: sibreal.org/The Moscow Times

সর্বোপরি, সম্প্রতি রুশ কেন্দ্রীয় সরকার বুরিয়াতিয়ায় চীনা অভিবাসীদের জন্য এক হেক্টর জমি বরাদ্দ করেছে এবং বৈকাল হ্রদের তীরে তাদের বসতি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বুরিয়াতিয়ার অধিবাসীরা বিষয়টিকে মোটেই ভালো চোখে দেখছে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চীনা–বিরোধিতা জাতিগত বুরিয়াতদের একটি ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য বলা চলে এবং এজন্য জাতিগত বুরিয়াতরা তাদের প্রজাতন্ত্রের জমি চীনাদেরকে প্রদান করতে রাজি নয়। তাদের আশঙ্কা রয়েছে, চীনারা ভবিষ্যতে এই অঞ্চলটির ওপরে মালিকানা দাবি করতে পারে। বুরিয়াতিয়ায় বসবাসরত জাতিগত রুশরাও সরকারের এই সিদ্ধান্তের পক্ষে নয়। ২০০৪ সালে রাশিয়া চীনের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য উসুরি নদীতে অবস্থিত তারাবারভ দ্বীপ, দামানস্কি দ্বীপ, বলশয় উসুরিয়স্কি দ্বীপের অর্ধাংশ এবং আরো প্রায় ৭০০টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ চীনকে হস্তান্তর করেছে, যেগুলোর মোট আয়তন প্রায় ৭২০ বর্গ কি.মি.। সাইবেরীয়রা এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছিল এবং এজন্য চীনাদের আর কোনো ধরনের ছাড় দিতে তারা নারাজ।

এমতাবস্থায় বুরিয়াতিয়ার জনসাধারণ যে মস্কোর প্রতি ক্ষিপ্ত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য যে, বুরিয়াতিয়ার অধিবাসীরা এখন পর্যন্ত রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনো দাবি উত্থাপন করেনি এবং বুরিয়াতিয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারবিরোধী আন্দোলনে জাতিগত বুরিয়াতদের পাশাপাশি জাতিগত রুশরাও অংশ নিয়েছে। তাদের মূল দাবি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত এবং এই দাবিগুলো বিবেচনা না করে নিষ্পেষণের পথ বেছে নিলে সেটা মস্কোর জন্য সুফল না এনে কুফল নিয়ে আসার সম্ভাবনাই বেশি। এখন পর্যন্ত বুরিয়াতিয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো দাবি উত্থাপিত হয়নি, কিন্তু রাজনৈতিক নিষ্পেষণ ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা অব্যাহত থাকলে এই আঞ্চলিকতাবাদ বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে মোড় নিতেও পারে।

২০০৪ সালে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে সীমান্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ার পরও সাম্প্রতিক সময়ে চীনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভ্লাদিভোস্তকসহ রুশ দূরপ্রাচ্যকে ‘চীনা ভূমি’ হিসেবে দাবি করা হয়েছে। এমতাবস্থায় বুরিয়াতিয়ার জনসাধারণের চীনাবিরোধী মনোভাব বস্তুত মস্কোর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এই পরিস্থিতিতে মস্কো কীভাবে বুরিয়াতিয়ার সমস্যার সমাধান করে, সেটিই দেখার বিষয়।

This is a Bengali article about growing regionalism in Buryatia, a Russian republic. Necessary sources are hyperlinked within the article.

Source of the featured image: Real Russia

Related Articles