১
১৫৩৭ সাল থেকে ১৫৫৪ পর্যন্ত গুজরাটের সুলতান ছিলেন সুলতান তৃতীয় মাহমুদ শাহ। গুজরাট সালতানাতের সাথে এসময় জলদস্যু পর্তুগীজদের লাগাতার যুদ্ধ চলছিলো। সুরাটে সুলতানের সামরিক উপস্থিতি কিছুটা দুর্বল ছিলো। এই দুর্বলতার সুযোগে পর্তুগীজরা বেশ কয়েকবার শহরটিতে ব্যাপক লুটপাট এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। বিশ্ববাণিজ্যিক দিক থেকে এত গুরুত্বপূর্ণ এরকম একটি শহরে পর্তুগীজ দস্যুদের লাগাতার আক্রমণে সুলতান তৃতীয় মাহমুদ শাহ বেশ বিরক্ত হলেন।
পর্তুগীজ দস্যুদের দমন করার জন্য শেষপর্যন্ত সুলতান সুরাটে একটি শক্তিশালী দুর্গ নির্মাণের নির্দেশ দিলেন। সুলতানের নির্দেশ পেয়ে সাফি আগা (খোদাবন্দ খান) দুর্গের নির্মাণকাজে হাত দিলেন। ১৫৪৬ সালে দুর্গটির নির্মাণ কাজ শেষ করা হলো। নির্মাণকাজ চলাকালেও অবশ্য পর্তুগীজ দস্যুরা দুর্গটির নির্মাণকাজে বাধা দেবার চেষ্টা চালাতে থাকে। প্রথমে তারা খোদাবন্দ খানকে ঘুষ দেয়ার প্রস্তাব দেয়। খোদাবন্দ খান এই ঘৃণ্য প্রস্তাবে সায় না দিলে পর্তুগীজরা সামরিক আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করে। অসামান্য দৃঢ়তা নিয়ে খোদাবন্দ খান এই জলদস্যুদের হুমকিকে পাশ কাটিয়ে দুর্গের নির্মাণকাজ শেষ করেন।
সময়ের পরিক্রমায় আকারে তুলনামূলক ছোট কিন্তু সুরাটের নিরাপত্তায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ দুর্গটি বিদ্রোহী মির্জাদের দখলে চলে যায়। মির্জারা এই দুর্গকে কেন্দ্র করেই আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করতে থাকেন। তাই আকবরও দুর্গটির উপর নজর দিতে বাধ্য হলেন। মির্জাদের পুরোপুরি দমন করতে হলে এই দুর্গটি দখল করা ছাড়া আকবরের হাতে অন্য কোনো উপায় নেই। কাজেই বরোদা ফিরে গিয়ে আকবর আবারও সুরাটে অভিযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত নিলেন।
২
প্রাথমিকভাবে দুর্গটি অবরোধের উদ্দেশ্যে মুঘল সম্রাট আকবর শাহ কুলি খান মাহরাম ও সাদিক খানের নেতৃত্বে একটি অগ্রবর্তী বাহিনী পাঠান। এরপর আকবর নিজে মূল সেনাবাহিনী নিয়ে ১১ জানুয়ারি (১৫৭৩ সাল) সুরাটের কাছাকাছি চলে যান। ১১ জানুয়ারি রাত থেকেই মূল অবরোধ শুরু হয়। মুঘল সেনাবাহিনীর অবরোধের কারণে দুর্গটি বাইরের দুনিয়া থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
এদিকে ইব্রাহীম হোসেন মির্জা সরনালের যুদ্ধে পরাজয়ের পর সিরোহীতে পালিয়ে যাওয়ার পথে পাটানে অন্যান্য বিদ্রোহী মির্জাদের সাথে আলোচনায় বসেন। ইতোমধ্যেই আকবর যে সুরাট অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছেন, তা তিনি জেনে গিয়েছেন। কাজেই ইব্রাহীম হোসেন মির্জা নতুন পরিকল্পনা করলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি সেনাবাহিনী নিয়ে সরাসরি দিল্লি, আগ্রা অথবা ফতেহপুর সিক্রির দিকে এগিয়ে যাবেন এবং মুঘল সেনাবাহিনীর সাথে সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে যতটুকু বিশৃঙ্খলা তৈরি করা যায়, করবেন।
অন্যদিকে, মুহাম্মদ হোসেন মির্জা ও শাহ মির্জাকে দায়িত্ব দেন কূটনৈতিকভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শের খান ফুলাদীকে সাথে নিয়ে পাটান অবরোধ করার জন্য। এতে আকবর উভয়দিক থেকেই চাপে পড়বেন। একদিকে তিনি পাটান হারাতে চাইবেন না, কারণ তাতে সুরাট বিজয় করলেও ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। অন্যদিকে তিনি যখন খোদ তার রাজধানীর আশেপাশে থেকেই বিশৃঙ্খলার সংবাদ শুনবেন, তখন যত দ্রুত সম্ভব গুজরাট ত্যাগ করে রাজধানীতে ফিরে যেতে চাইবেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, শের খান ফুলাদীকে সাথে নিয়ে মুহাম্মদ হোসেন মির্জা আর শাহ মির্জা অবরোধ করে বসলেন পাটান দুর্গকে। পাটান দুর্গের মুঘল অফিসার সৈয়দ মুহাম্মদ খান বারহা দ্রুত রক্ষণাত্মক অবস্থানে চলে গেলেন। একইসাথে দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে পাটান থেকে দূতেরা ছুটলেন আকবরের কাছে।
পাটান দুর্গকে সহায়তার জন্য আকবর আযম খানকে নির্দেশ দিলেন। একইসাথে আকবরের বার্তা গেলো কুতুবুদ্দীন মুহাম্মদ খান, শাহ মুহাম্মদ খান, রুস্তম খান, শেখ মুহাম্মদ বুখারী দেহলভী, আব্দুল মতলব খান, মুহাম্মদ মুরাদ খান, নৌরাঙ্গ খানসহ মালব, রায়সীন আর চান্দেরীর জমিদারদের নিকটে। বার্তা পাওয়া মাত্রই যে যার মতো করে পাটানের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেলেন।
৩
১৫৭৩ সালের ২২ জানুয়ারি পাটান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে এসে বাহিনীগুলো একত্র হলো। অবস্থা বেগতিক দেখলেন শের খান ফুলাদী আর মির্জারা। একইসাথে দু’দিকের আক্রমণ ঠেকানো কঠিন হয়ে যাবে। তাই শের খান ফুলাদী আর মির্জারা আগে আযম খানের বাহিনীকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন।
যুদ্ধ শুরু হলো। শুরু দিকে মির্জারা বেশ ভালো অবস্থানে ছিলেন। আযম খান বেশ চাপের মুখে পড়ে গেলেন। তার বাহিনীর ডানপাশ পুরোপুরি ভেঙে পড়লো। শাহ মুহাম্মদ খান আহত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করলেন, কুতুবুদ্দীন মুহাম্মদ খানকে পুরোপুরি বিধ্বস্ত করা হলো। শেখ মুহাম্মদ বুখারী মির্জাদের আক্রমণের প্রচণ্ড ধাক্কায় যুদ্ধক্ষেত্রেই মারা গেলেন। তুলনামূলক ভালো অবস্থানে ছিলেন নৌরাঙ্গ খান, আব্দুল মতলব খান আর রুস্তম খান। তারা যার যার অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছিলেন।
আযম খান সহজেই বুঝে গেলেন, যুদ্ধটি মির্জাদের পক্ষে চলে যাচ্ছে। মুঘলদের প্রতিরোধ আর কিছুক্ষণের মাঝেই ভেঙে পড়বে। তবে ভাগ্যের যে কত দ্রুত পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে, তা কে না জানে?
যুদ্ধে বিজয় হয়েছে ভেবে শের খান ফুলাদী আর মির্জাদের সম্মিলিত সেনাবাহিনী যুদ্ধের দিকে মনোযোগ না দিয়ে গনিমত সংগ্রহের দিকে মনযোগ দেয়। ফলে মির্জাদের সম্মিলিত বাহিনীর সেনাবিন্যাস ভেঙে পড়ে, বাহিনী পুরোপুরি ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। আযম খান দেখলেন, এটিই শেষ সুযোগ। যুদ্ধক্ষেত্রের পরীক্ষিত জেনারেল বিদাঘ খান ও সঙ্গে থাকা অল্প কিছু সেনা নিয়ে আযম খান মরণ আঘাত হানেন মির্জাদের বাহিনীর উপর। বিপর্যস্ত মুঘল সেনাবাহিনীর অন্য ইউনিটগুলো যখন এই প্রচণ্ড আক্রমণ দেখতে পেলো, তারাও তখন পূর্ণোদ্যমে মির্জাদের উপর আঘাত হানলেন। চোখের পলকেই মির্জাদের প্রতিরোধ ভেঙে গেলো। বিদ্রোহী যোদ্ধাদের অধিকাংশই মৃতদেহ হিসেবে যুক্ষক্ষেত্রে পড়ে রইলেন, বাকিরা যে যার জীবন নিয়ে পালিয়ে বাঁচলেন।
পাটানের এই পরাজয়ের পর শের খান ফুলাদী জুনাগড়ের দিকে পালিয়ে গেলেন, মুহাম্মদ হোসেন মির্জা আর শাহ মির্জা পালালেন দাক্ষিণাত্যের দিকে। অন্যদিকে পাটান দুর্গের নিরাপত্তা সৈয়দ মুহাম্মদ খান বারহার উপরে ন্যস্ত করে আযম খান ছুটলেন সুরাটের দিকে।
৪
ইতোমধ্যেই সুরাটে আক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছিলো। সুরাট দুর্গের দ্রুত পতন নিশ্চিত করতে আকবর সেনাবাহিনীর আর্টিলারী ইউনিটের কামানগুলো মোতায়েন করার নির্দেশ দেন। কামানগুলোর পূর্ণ কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে উঁচু মঞ্চের উপর স্থাপন করা হলো। এরপর শুরু হলো বৃষ্টির মতো গোলা নিক্ষেপ। একইসাথে দুর্গ প্রাচীরের নিচে মাইন মোতায়েন হলো।
আকবরের মোকাবেলার জন্য দুর্গের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন হামযাবান নামের এক ব্যক্তি। বিদ্রোহী মির্জারা সুরাট দুর্গটি দখলের পর তাকেই দুর্গের রক্ষাকর্তা নিয়োজিত করেছিলো। মজার বিষয় হলো, আকবরনামার বর্ণনানুযায়ী, এই হামযাবান ছিলেন স্বয়ং আকবরের দেহরক্ষী দলের একজন সদস্য। আর বদায়ুনীর মতে, হামযাবান ছিলেন মরহুম সম্রাট হুমায়ুনের দেহরক্ষী দলের সদস্য। ঘটনা যা-ই হোক না কেন, হামযাবানের সাথে মুঘল দরবারের যে সরাসরি যোগাযোগ ছিলো, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
সুরাট অভিমুখে মুঘল সেনাবাহিনীর মার্চ করার সংবাদ পেয়ে হামযাবান যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু, মুঘল সেনাবাহিনীর এই তীব্র আক্রমণে তিনি হকচকিয়ে গেলেন। পরবর্তী কয়েকদিনের মাঝেই হামযাবান প্রমাদ গুনতে লাগলেন। দুর্গ যে আর ধরে রাখা যাবে না, তা তিনি বুঝে গেলেন। কিন্তু একটু চেষ্টা করলে তো নিজের প্রাণটা ধরে রাখা যাবে! তিনি আকবরের কাছে আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
আত্মসমর্পণের বার্তা নিয়ে আকবরের কাছে গেলেন হামযাবানের শ্বশুর মাওলানা নিজামুদ্দিন লারী। আকবর অযথা রক্তপাত ও শক্তিক্ষয় এড়াতে চাইছিলেন। তাই হামযাবানের এই আত্মসমর্পণ প্রস্তাবে তিনি রাজি হলেন।
এরপরের ঘটনা খুবই সাধাসিধে। হামযাবান আত্মসমর্পণ করলেন। মুঘল সেনাবাহিনীও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দুর্গের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল। এই ঘটনা ১৫৭৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারির। দুর্গের দখল বুঝে পাওয়ার পর আকবর সাধারণ সৈন্য বা দুর্গে বসবাসকারীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। তবে হামযাবানসহ কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের আটক করলেন বিদ্রোহের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকার অপরাধে।
৫
বিজয়ীর বেশে আকবর দুর্গে প্রবেশ করেন ২৭ ফেব্রুয়ারি। দুর্গে প্রবেশ করে দুর্গটি রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত করেন কিলিজ মুহাম্মদ খানের উপর। একইসাথে অবরোধে দুর্গের ক্ষয়ক্ষতি হিসেব করে দ্রুত দুর্গটি সংস্কার করার নির্দেশ দেন।
সুরাট দুর্গ পরিদর্শনের সময় আকবর তিনটি অটোমান (উসমানী সালতানাত) কামান দেখতে পেলেন। ১৫৩৮ সালে পর্তুগীজ দস্যুদের বিরুদ্ধে দিউ দুর্গ অবরোধের জন্য উসমানী মহান সুলতান সুলায়মান একটি অভিযান প্রেরণ করেন। উসমানী অ্যাডমিরাল সুলায়মান পাশার নেতৃত্বে পরিচালিত এই অভিযানে ব্যবহারের জন্য এই কামানগুলো আনা হয়েছিলো। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় শাসকদের অসহযোগিতার কারণে অভিযানটি পরিত্যক্ত হলে সুলায়মান পাশা কামানগুলো ফেলেই চলে যান। সুরাট দুর্গ নির্মাণের সময় কামানগুলো গিয়ে পড়ে খোদাবন্দ খানের হাতে। তিনি কামানগুলো সুরাট দুর্গেই রেখে দেন। কিন্তু সুরাটের মতো ছোট একটি দুর্গ রক্ষার জন্য এত বড় কামানের প্রয়োজন ছিলো না। আকবর তাই কামানগুলো আগ্রায় পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এদিকে সুরাট দুর্গের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ও প্রশাসনিক সব কাজ গুছিয়ে সম্রাট আহমেদাবাদের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন ১৫৭৩ সালের ৮ মার্চ। আহমেদাবাদ পৌঁছে আকবর আযম খানকেই পুনরায় গুজরাটের গভর্নর নিয়োগ দেন। এর কিছুদিন পরই তিনি গুজরাট ত্যাগ করে ফতেহপুর সিক্রির উদ্দেশে রওয়ানা হন।
৬
পথে আকবরের জন্য আরেকটি চমক অপেক্ষা করছিলো। আজমীরের কাছাকাছি যাওয়ার পর আকবরের কাছে মুলতানের গভর্নর সাঈদ খানের থেকে একটি বার্তা এসে পৌঁছায়। বার্তায় আকবরকে জানানো হয় পলাতক বিদ্রোহী ইব্রাহীম হোসেন মির্জা মৃত্যুবরণ করেছেন!
ইব্রাহীম হোসেন মির্জা পরিকল্পনামতো গুজরাট থেকে দিল্লি বা আগ্রার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। মিরাটের কাছাকাছি এসে তিনি আগ্রাগামী একটি কাফেলা বহরে হামলা চালিয়ে লুটপাট করে নাগোরের দিকে অগ্রসর হন। যেহেতু ইব্রাহীম হোসেন মির্জার উদ্দেশ্য ছিলো সাম্রাজ্য জুড়ে অরাজকতা সৃষ্টি করা, তাই তিনি নাগোরে দুর্গ অবরোধ না করে দুর্গকে পাশ কাটিয়ে লুটপাট করে নারনৌলের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এদিকে ইব্রাহীম হোসেন মির্জার তাণ্ডব ঠেকাতে এগিয়ে আসেন রায় রাম ও রায় সিংহ। আকবর তাদের নেতৃত্বে বেশ কিছু সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছিলেন মুঘল সেনাবাহিনীর চলাচলের পথ নিরাপদ রাখতে।
রায় রাম ও রায় সিংহ নাগোর দুর্গের রক্ষক ফররুখ খানকে নিয়ে মির্জাকে বাধা দিতে এগিয়ে যান। কিন্তু ইব্রাহীম হোসেন মির্জা আবারও মুঘল সেনাবাহিনীকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যান। সম্ভল হয়ে তিনি পাঞ্জাবের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। পথে যে জায়গায় যেভাবে পেরেছেন, লুটপাট আর বিশৃঙ্খলা করতে করতে এগুচ্ছিলেন।
ইব্রাহীম হোসেন মির্জাকে বাধা দিলেন পাঞ্জাবের গভর্নর হোসেন কুলি খান। ভাগ্য এবার আর মির্জার সহায় হলো না। তার ভাই মাসুদ হোসেন মির্জা মুঘল সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হলেন। তবে ইব্রাহীম মির্জা আবারও পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। কিছুদিন পরে তিনি মুলতানে মুঘল সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লেন এবং আহতও হলেন। আহতাবস্থায় বেশি দূর আর পালাতে পারেননি তিনি। স্থানীয় লোকজন তাকে চিনে মুলতানের গভর্নর সাঈদ খানের হাতে তুলে দেয়। কারাগারেই সাঈদ খানের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়।
৭
গুজরাট থেকে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েই আকবর রাজধানীতে গিয়ে পৌঁছান। তবে আকবর বেশিদিন নিশ্চিন্ত থাকতে পারলেন না। আকবর ফতেহপুর গিয়ে পৌঁছেছিলেন ১৫৭৩ সালের ৩ জুন। এর ক’দিন পরেই আকবরের কাছে গুজরাট থেকে আবারও একটি বার্তা পাঠানো হলো। সংবাদ বেশ গুরুতর, গুজরাটে আবারও বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠেছে।
বিদ্রোহের মূলে সেই মির্জারাই। আকবর গুজরাট ত্যাগ করার পর পরই মুহাম্মদ হোসেন মির্জা টার্গেট করেন সুরাটকে। আর আহমেদাবাদ হলো ইখতিয়ারুল মুলকের লক্ষ্যবিন্দু। তবে মুঘল সেনাবাহিনীর বাধায় মুহাম্মদ হোসেন মির্জা পিছু হটে ইখতিয়ারুল মুলকের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে আহমেদাবাদ অবরোধ করেন। আকবরকে বাধ্য হয়েই আরেকবার গুজরাটের দিকে এগুতে হলো।
আকবরের এবারের অভিযানটি ছিলো অত্যন্ত দ্রুতগতির। ১৫৭৩ সালের ২৩ আগস্ট ফতেহপুর ত্যাগ করে মাত্র আটদিনের মাথায় প্রায় ৮০০ কিলোমিটার পথ দিসায় পৌঁছে গেলেন। সম্রাট যখন আহমেদাবাদ শহরের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন, বিদ্রোহীরা তখন রীতিমতো হতভম্ব! তারা এত দ্রুত সম্রাটকে গুজরাটে আশা করেনি।
সম্রাটের হুট করে উপস্থিত হওয়ায় বিদ্রোহীরা ভড়কে গেলেও মুহাম্মদ হোসেন মির্জা মাথা ঠাণ্ডা রাখলেন। সম্রাট আর আযম খানের মাঝামাঝি বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিদ্রোহীরা। তাই তার প্রথম পদক্ষেপ হলো আহমেদাবাদে অবরুদ্ধ আযম খানকে আকবরের কাছে যেতে না দেওয়া। এই কাজের জন্য মোতায়েন করা হলো ইখতিয়ারুল মুলককে। মুহাম্মদ হোসেন মির্জার ধারণা ছিলো, এতে আকবর কিছু সময়ের জন্য হলেও আক্রমণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হবেন। আর নিজেদের গুছিয়ে নিতে এই সময়টুকুই দরকার বিদ্রোহীদের।
কিন্তু আকবর মোটেও সময় নষ্ট করতে চাইলেন না। পরের মাসের ২ তারিখে সবরমতি নদী পাড়ি দিয়ে তিনি বিদ্রোহীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আকবরের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুললেন মুহাম্মদ হোসেন মির্জা, সাথে দেড় হাজারের কিছু বেশি সৈন্য। তবে শেষপর্যন্ত মির্জারা আকবরের এই তীব্র আক্রমণের মুখে বেশিক্ষণ টিকতে পারলেন না। মির্জাদের বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করলো। মুহাম্মদ হোসেন মির্জা নিজেও আহত হয়ে মুঘল সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হলেন।
৮
বিদ্রোহীরা যখন ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলো, মরিয়া হয়ে ইখতিয়ারুল মুলক শেষ চেষ্টা চালালেন। আযম খানের পথ অবরোধ করে তিনি আহমেদাবাদের কাছাকাছি অবস্থান করছিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ হোসেন মির্জার পরাজয় দেখে প্রায় ৫০০০ সৈন্য নিয়ে তিনি মুঘল সেনাবাহিনীর উপর মরণ আঘাত হানলেন। যুদ্ধ শুধুমাত্র সৈন্য বা উন্নত অস্ত্র দিয়ে জেতা যায় না, যুদ্ধ জিততে সাথে প্রয়োজন সৈন্যদের মনোবল। একের পর এক ধাওয়া খেতে খেতে ইতোমধ্যেই বিদ্রোহীরা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলো। তাই শেষপর্যন্ত ইখতিয়ারুল মুলকের আঘাত তেমন কাজে দিলো না। তার বাহিনী পরাজিত হলো, তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হলেন, সাথে নিহত হলো তার সাথে থাকা সৈন্যদের অন্তত ২০০০ জন। অন্যদিকে মুহাম্মদ হোসেন মির্জাকে বন্দী অবস্থাতেই হত্যা করা হয়।
আকবরের নির্দেশে মৃত ২০০০ বিদ্রোহী সৈন্যের মাথা দিয়ে একটি পিরামিড বানানো হলো। কাজটি করা হলো বিদ্রোহীদের প্রতি প্রতিশোধের প্রতীক হিসেবে। আকবর বিদ্রোহীদের কিছুতেই ক্ষমা করবেন না।
আকবর পরবর্তী কিছুদিন আহমেদাবাদে অবস্থান করলেন। এসময়ের মাঝে তিনি গুজরাটের প্রশাসনিক কার্যক্রম, নিরাপত্তা ব্যবস্থা আর অর্থনীতি ঢেলে সাজানোর নির্দেশ দিলেন। এরপর ১৫৭৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি আহমেদাবাদ ত্যাগ করেন। আহমেদাবাদ থেকে মাহমুদাবাদ, মাহমুদাবাদ থেকে সিরোহী হয়ে আজমিরে যান তিনি। ৫ অক্টোবর আকবর ফতেহপুর গিয়ে পৌঁছান। আর এর সাথে সাথেই আকবর তার গুজরাট অভিযানের ইতি টানলেন। মোটের উপর আকবরের গুজরাট অভিযান সফল ছিলো। পরবর্তী প্রায় ২০০ বছর গুজরাট মুঘল সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সাথে ছিলো।
৯
গুজরাটকে সম্পূর্ণভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের সাথে একীভূত করতে আকবরের প্রায় এক বছরের কিছু বেশি সময় লেগেছিলো। এসময় তিনি গুজরাট থেকে যতটা না প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি বাধা পেয়েছিলেন বিদ্রোহী মির্জাদের থেকে। তবে শেষপর্যন্ত সামরিক অভিযানের মাধ্যমেই মির্জাদের এই বিদ্রোহকে চূড়ান্তভাবে দমন করা হয়।
গুজরাটের অভিযান সফল হয়েছে। ফের বিদ্রোহেরও তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। পরবর্তী কয়েক বছরের জন্য হলেও বিদ্রোহী মির্জারা আর উঠে দাঁড়াতে পারবেন না। আকবর এখন কিছুদিন রাজধানীতে অবস্থান করবেন। লাগাতার যুদ্ধে তিনি এবং তার সেনাবাহিনী বেশ ক্লান্ত। আপাতত কিছুদিন বিশ্রাম দরকার। বিশ্রাম নিয়েই আকবরকে দ্রুত আরেকটি অভিযানে নামতে হবে। আকবরের লক্ষ্য এবার বঙ্গ!
[এই সিরিজের পূর্বে প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘ইতিহাস’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/