চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্রমোন্নতির সাথে সাথে মানুষের অসুখ সারানোর কাজটাও সহজ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু একটা সময় ছিল পৃথিবীতে মানুষ দৈনন্দিন চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী এমন সব ওষুধের শরাণাপন্ন হত, যেগুলো রোগ সারানোর চেয়ে বরং তাদের শরীরে তৈরি করত বিরূপ প্রতিক্রিয়া। আজকের লেখায় অতীতের এমন কিছু ওষুধের কথা জানাবো যেগুলোর ক্ষতিকর দিকের কথা চিকিৎসকদের জানতে সময় লেগেছে বহু বছর।
তামাক
সতের এবং আঠারো শতকে চিকিৎসকেরা মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের চিকিৎসায় কী ব্যবহার করত জানেন? তামাক! জীবন বাঁচানোর জন্য ব্যক্তির পায়ুপথ দিয়ে তামাকের মিশ্রণের ধোঁয়া প্রবেশ করিয়ে দিতেন তারা! আর এজন্য রীতিমতো একটা যন্ত্রও তৈরি করা হয়েছিল যার নলটি প্রবেশ করানো হত পায়ুপথে, যেটার মাধ্যমে ধোঁয়া গিয়ে একেবারে ধাক্কা দিত ফুসফুসে।
আসলে তামাকের ধোঁয়া শরীরের ভেতরে গেলে সেটা মুহূর্তের মধ্যে প্রায়-মৃত শরীরে স্পন্দন সৃষ্টি করত এবং দ্রুত হয়ে যেত ঐ ব্যক্তির শ্বাস-প্রশাস প্রক্রিয়া। প্রথমদিকে পানিতে ডুবে যাওয়াদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলেও, পরবর্তীতে ঠাণ্ডা লাগা, মাথাব্যথা, হার্নিয়া, টাইফয়েড জ্বর, কলেরা ইত্যাদি সারানোর কাজেও এটি কার্যকরী বলে ধারণা করা হত। এমনকি মৃত্যুর হাত থেকে পর্যন্ত মানুষকে ফিরিয়ে আনতে পারে এটি, এমন ধারণাও বিদ্যমান ছিল।
মূল ব্যাপারটি আসলে নিহিত ছিল তামাকের একটি উপাদান ‘নিকোটিন’ এর ভেতরে। নিকোটিন এমন এক সক্রিয় উপাদান, যেটি শরীরে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এটি অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিগুলোকে উদ্দীপ্ত করে এগুলোতে এপিনেফ্রিন হরমোন তথা অ্যাড্রিনালিন উৎপন্ন করতে সহায়তা করে। তামাকের ব্যবহার যে আসলে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সেটা নির্ণয় করতে অনেক সময় লেগেছিল গবেষকদের। ১৮১১ সালে নিকোটিনের বিষাক্ত প্রভাবগুলো আবিস্কৃত হবার পর থেকে এই অভিনব চিকিৎসাপদ্ধতিটি বন্ধ হয়।
মরফিন
ব্যথানাশক ওষুধের উপাদান হিসেবে চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিচিত নাম মরফিন। এই লেখার তালিকার মধ্যে একমাত্র মরফিনই এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে চিকিৎসার কাজে, যদিও প্রাচীনকালে এর ব্যবহারপদ্ধতি ছিল অনেক ভয়ানক।
মানুষের মানুষের মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ড নিয়ে যে প্রধান স্নায়ুতন্ত্র রয়েছে তার উপরে সরাসরি প্রভাব ফেলে ব্যথার অনুভূতি কমানোর কাজ করে মরফিন। একই সাথে মানুষকে এতে আসক্ত করে তোলে এবং নানান পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত করে ফেলে বলে এর ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণও বটে। প্রথমবারের মতো ১৮১৭ সালে মরফিন বাজারজাত করেছিলেন ফ্রেডেরিখ সার্টার্নার।
গ্রিক পুরাণের স্বপ্নের দেবতা মর্ফিয়াসের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় মরফিন। আজ থেকে ২০০ বছর আগে ব্যবহার শুরু হওয়া এই ওষুধ এখনো প্রতি বছর ২৩০ টনেরও বেশি উৎপাদিত হয়। পপি গাছ থেকে যে আফিম পাওয়া যায় তার অন্যতম প্রধান উপাদান মরফিন। অথচ প্রথমবার বাজারে আনার পর ব্যথার ওষুধের পাশাপাশি এর পরিচিতি ছিল আফিম ও অ্যালকোহলের প্রতি আসক্তির প্রতিষেধক হিসেবেও!
পরবর্তীতে জানা যায়, মরফিন আসলে আফিম বা অ্যালকোহলের চেয়েও বেশি নেশা উদ্রেক করে। ব্যথানাশক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এর পার্শ্বঝুঁকি মারাত্মক। কোষ্ঠকাঠিন্য, চুলকানি, বমি বমি ভাব ইত্যাদি দেখা দেয় মরফিন গ্রহীতার শরীরে।
যুদ্ধের ইতিহাসে মরফিনের ব্যবহার হয়েছে ব্যাপক পরিমাণে। মার্কিন সিভিল ওয়ার এবং বিশ্বযুদ্ধে সৈনিকদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হত এটি। সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটত উনিশ শতকের শেষ ও বিংশ শতকের শুরুর দিকে। যে যার ইচ্ছেমতো কিনতে পারত মরফিন সমৃদ্ধ ওষুধ। এগুলোর ব্যবহারে ছিল না কোনো বিধি-নিষেধ। ঠাণ্ডা, ঘুমের সমস্যা থেকে মাসিকের খিঁচুনি পর্যন্ত সকল রকমের যন্ত্রণা উপশমের জন্য মানুষ গিলত এসব ওষুধ। মরফিন ভরা ইনজেকশন পাওয়া যেত, যে কেউ ইচ্ছে করলেই সেটা কিনে নিয়ে ঢুকিয়ে দিতে পারত শরীরে।
এমনকি দুগ্ধপোষ্য শিশুদেরকে পর্যন্ত মরফিন দেয়া হত ঘুম পাড়ানোর জন্য! মরফিন সমৃদ্ধ ‘মিসেস উইনস্লো’স সুদিং সিরাপ’ নামক সিরাপ শিশুদের খাওয়ানো হত ঘুম পাড়ানোর কিংবা দাঁত ওঠার জন্য। এমন ভয়াবহ নেশা সৃষ্টিকারী দ্রব্যের কী যাচ্ছেতাই ব্যবহার!
রেডিয়াম
১৮৯৮ সালে রেডিয়াম আবিস্কার করেন মেরি কুরি এবং পিয়েরে কুরি। ১৯০৩ সালে এ আবিস্কারের জন্য তারা দুজন নোবেল পুরস্কার পান। আবিস্কারের এক যুগের মধ্যেই রেডিয়ামের অদ্ভুত সব ব্যবহার শুরু হয় বিভিন্ন ব্যবহার্য পণ্য, খাদ্য ও পানীয়র মধ্যে একে মিশ্রিত করবার মধ্য দিয়ে, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
বিকিরণের কারণে শরীরে কী ধরনের ক্ষতি হয় তা সম্পর্কে জানা না থাকার কারণে রেডিয়ামের যথেচ্ছ ব্যবহার চলত সেসময়। এর রোগ সারাবার জাদুকরি ক্ষমতা নিয়ে অতিকথন চালু হয়ে যায় এবং মানুষ রেডিয়াম সমৃদ্ধ বিভিন্ন দ্রব্য ব্যবহারের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠে।
মানসিক সমস্যা সারানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয় রেডিয়ামের ব্যবহার। ডায়রিয়া এবং ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক হিসেবেও ডাক্তাররা একে বেছে নেন। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যপার ছিল, বার্ধক্য রোধের কথিত ক্ষমতার জন্যও রেডিয়াম জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। রেডিয়াম শরীরের কোষের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে যৌবন ধরে রাখে, এই ছিল যুক্তি।
আর্থ্রাইটিস কিংবা জনন অক্ষমতার প্রতিকারেও একে ভাবা হত মোক্ষম ওষুধ। রেডিয়াম মিশ্রিত পানি, চকলেট, টুথপেস্ট ব্যবহার করত মানুষ। সাপোজিটরি, সেঁক দেবার কাজে ব্যবহৃত প্যাড, প্রসাধন সামগ্রীতে চলত রেডিয়ামের ব্যবহার। ত্বক ভালো রাখতে রেডিয়াম মিশ্রিত পানি দিয়ে মালিশ করার চলও তৈরি হয়েছিল।
আজকের যুগে আমরা জানি, মানুষ রেডিয়াম গলাধঃকরণ করলে এর শতকরা আশি ভাগ শরীর নিজেই রেচন করে ফেললেও, বিশ ভাগ রয়ে যায় শরীরের ভেতরেই। শরীরের হাড়, রক্ত ও টিস্যুর মধ্যে এই রেডিয়ামের বিকিরণের ফলে ক্যানসার, লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা ইত্যাদি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। সেসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেডিয়াম সমৃদ্ধ পণ্য ব্যবহার করে ভয়ানক ক্ষতির শিকার হয়ে পরবর্তীতে মারা গিয়েছিল অনেকে, যাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোড়ন তুলেছিল ‘দ্য রেডিয়াম গার্লস’ নামক পাঁচ নারীর ঘটনা, কারণ তারা মৃত্যুর আগে রেডিয়াম মিশ্রিত পণ্য উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করে জরিমানা পেয়েছিল। রেডিয়ামের বিকিরণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানার পর বন্ধ হয় এর কল্পিত ঔষধি গুণাগুণ আহরণের ভয়ানক পদ্ধতিগুলো।
পারদ
চীনের উপকথায় হুয়াং অ্যান নামক এক ব্যক্তির গল্প আছে যে কিনা খনিজ সিনাবার খাওয়ার কারণে বেঁচে ছিল ১০,০০০ বছর! খনিজ সিনাবার বা মার্কারি সালফাইড হলো পারদের আকরিক উৎস।
গবেষকরা ধারণা করেন, চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াং, যিনি অমরত্ব লাভের চেষ্টা করেছিলেন, তিনি মারা গিয়েছিলেন মদ ও মধুর সাথে সিনাবার মিশিয়ে খাওয়ার কারণে। পারদের বিষক্রিয়ার কারণে মারা যাবার পর তাকে সমাহিত করা হয় মাটির তৈরি বিখ্যাত টেরাকোটা আর্মি দিয়ে ঘেরা অবস্থায়। সেই সমাধিস্থলের নকশা করা হয়েছিল তৎকালীন চীন সাম্রাজ্যের অনুকরণে, আর এর মধ্যে চীনের নদীর অনুকরণে যে নদীগুলো তৈরি করা হয়েছিল তাতে বইয়ে দেয়া হয়েছিল পারদের নহর।
ইতিহাসে এই বিষাক্ত পারদকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের ভয়ঙ্কর সব নজির রয়েছে। চর্মরোগের প্রতিষেধক এবং পচননিবারক হিসেবে ব্যবহৃত হত পারদ। বিশেষ পানীয়, প্রসাধনী ইত্যাদিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মধ্যেও ব্যবহার করা হত এটি। ১৯৪০ এর দশকের আগ পর্যন্ত সিফিলিসের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হত পারদ সমৃদ্ধ মলম, বড়ি কিংবা পানীয়।
দাঁতের চিকিৎসা, টাইফয়েড জ্বর কিংবা শরীরে পরজীবী আক্রমণের চিকিৎসাসহ আরও বিভিন্ন রকমের রোগ সারানোর কাজ করা হত পারদ মিশ্রিত ওষুধ দিয়ে। দাঁত পড়ে যাওয়া, মুখের ভেতর জ্বালাপোড়া, ডায়রিয়া, রক্তশূন্যতা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, হৃদরোগ, রক্তচাপ কমে যাওয়া, চর্মরোগ, দুর্বলতা, নিদ্রাহীনতাসহ হেন কোনো ঘটনা নেই যা এই দীর্ঘমেয়াদী পারদ গ্রহণের কারণে ঘটত না। স্লো পয়জনিং এর মতো ধীরে ধীরে পারদ ধ্বংস করে দিত এর সেবনকারীদের। আঠারো, উনিশ আর বিশ শতক মিলিয়ে অন্তত দেড়শ বছর চিকিৎসকেরা তাদের কাজে অজ্ঞতাবশত ব্যবহার করে গেছেন বিষাক্ত পারদ।
মৃতদেহ ভক্ষণ
আজকের যুগে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের ঘটনা চিকিৎসা জগতে বিস্ময়কর অগ্রগতি এনে দিচ্ছে, এই পদ্ধতি নিয়ে চলছে ক্রমাগত গবেষণা। কিন্তু একটা সময় ছিল দুনিয়াতে সম্পদশালী মানুষ রোগমুক্তির জন্য সরাসরি খেয়ে ফেলত মৃত মানুষের শরীরের নানা অংশ! দ্বাদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত চলেছে এই ধরনের চিকিৎসা।
বিশেষত মিশরীয় মমির গুঁড়ো ওষুধ হিসেবে অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে উঠেছিল ইউরোপে। মাথা ব্যথা হলে কঙ্কাল থেকে নেওয়া হাড়ের গুঁড়ো খাওয়া, মৃগীরোগের ওষুধ হিসেবে শুকিয়ে যাওয়া হৃৎপিণ্ড খাওয়া, রক্তপাত বন্ধ করা ও নতুন চামড়া তৈরির জন্য মৃতদেহের ক্ষতস্থানে চামড়া লাগানো, বধিরতা কাটানোর জন্য মৃতদেহের শুকিয়ে যাওয়া পিত্তথলী গুঁড়ো করে মদের সাথে মিশিয়ে খাওয়া- এমন অদ্ভুত সব চিকিৎসা পদ্ধতি চালু ছিল সেই আমলের ইউরোপে।
মমিকে সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত ওষুধের উৎস হিসেবে ধরা হত তখন। কোনো আঘাতের কারণে শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণ হলে তা সারানোর ওষুধ হিসেবে বিবেচিত হত হট চকলেটের মধ্যে কঙ্কালের খুলির গুঁড়ো মিশিয়ে খাওয়া। এমনকি ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস নিজেই ‘কিংস ড্রপস’ নামক একটি বিশেষ পানীয় পান করতেন যেটা বানানো হত অ্যালকোহলের সাথে মাথার খুলির গুঁড়ো মিশিয়ে। জার্মানির ডাক্তাররা এমনও ভাবতেন, মৃতদেহের চর্বির সাথে ব্যান্ডেজ ঘষে সেটা গেঁটেবাত আক্রান্ত রোগীর আক্রান্ত স্থানে লাগালে বাতের ব্যথা দূর হবে।
এসব ভুল ধারণার উৎপত্তি ঘটেছিল মূলত একটি শব্দগত ভুল বোঝাবুঝির কারণে। প্রাচীন চিকিৎসাবিদ্যায় ব্যবহৃত বিটুমিনের একটি পারসিক প্রতিশব্দ ছিল ‘মামিয়া’। এদিকে মিশরীয়রা মমি বানানোর সময় রেসিন বা রজন হিসেবে একটি উপাদান ব্যবহার করত যার নাম ‘মামিয়া’, সেটি অবশ্য বিটুমিন ছিল না। ভুল করে বিটুমিন ভেবেই এই মামিয়া সংগ্রহের জন্য প্রাচীন মিশরীয় কবর থেকে মমি তোলা হত। আর মমিগুলো মামিয়ার উৎস হিসেবে বিক্রি করা হত। মমির সংকট দেখা দিলে কেউ কেউ আবার নতুন লাশকে মমি বানিয়ে ভুয়া মমি হিসেবে বিক্রি করত। এভাবে মমি বিক্রি একটা বড় লাভজনক ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেকে ভাবত, এই মৃতদেহের অংশ খাওয়ার সময় এর মধ্যকার আত্মাই রোগ সারানোর জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে!