প্রচলিত ব্যবস্থা ও তত্ত্বসমূহের বিচারে মোটাদাগে উন্নয়নের পথ দু’টি। একটি হচ্ছে বহুল পরিচিত সময় ও খরচসাপেক্ষ পথ, যেখানে উন্নয়নের মাপকাঠি হলো জিডিপি। শিল্প-কারখানা বাড়িয়ে প্রযুক্তির সহায়তায় বাড়াতে হবে উৎপাদন, তার দ্বারা নিজেদের চাহিদা মেটার পাশাপাশি বাড়বে রাষ্ট্রীয় আয়, বাড়বে জিডিপি- মোটামুটি প্রথম ধারার উন্নয়নের প্রাথমিক ফর্মুলা এটাই।
এই পন্থায় ঈস্পিত লক্ষ্য হলো যে কোনো মূল্যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন, আর সেটি অর্জনের জন্য বিসর্জিত হয় অনেক রক্ত ও ঘাম। এত ত্যাগ, কর্মচাঞ্চল্য কীসের জন্য? উচ্চ আয়ের দেশ হতে হবে যে! দেশের সবাইকেই হতে হবে ধনী, তার আগ পর্যন্ত কোনো নিস্তার নেই ‘উন্নয়ন’এর এই দক্ষযজ্ঞ থেকে।
কিংবদন্তি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন অন্য আরেকটি পথ অনুসরণ করবার পরামর্শ দেন। তার মতে, উন্নয়ন মানে শুধু দেশের আয় ও ধনসম্পদ বৃদ্ধি নয়, বরং উন্নয়ন প্রকৃত অর্থবহ হয় স্বাধীনতায়, উন্নয়ন মানেই হচ্ছে স্বাধীনতা! ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়ার কৃতিত্বও এই ভাবনাটির।
অমর্ত্য সেন বলেন, উন্নয়নের পথ খুবই শিথিল, মানুষের আয় বৃদ্ধির বদলে সে পথ মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, কল্যাণ ইত্যাদি নিশ্চিত করে। তার কালজয়ী গ্রন্থে তিনি শুধু এই একটি কথাই বার বার নানা ভঙ্গী, নানা উদাহরণ, নানা রকম তত্ত্বের বিশ্লেষণ ও তার সমালোচনার মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন। সেটি হলো- শুধু আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে কখনোই মানুষের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করা যায় না।
সাধারণত ধরা হয়ে থাকে যে, দরিদ্র দেশের অবকাঠামো নেই বলেই সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য কম হয় এবং এই কারণেই সেই স্থানের সব মানুষের আয় কম। সুতরাং সেসব দেশকে প্রচুর পরিমাণ আর্থিক সহায়তা দিলে তাদের ব্যবসা-বানিজ্য ও আয় বৃদ্ধি পাবে।
কিন্তু অমর্ত্য সেনের মতে, দরিদ্র দেশের মানুষের স্বাধীনতা নেই, তাই তারা দরিদ্র। আর এই কারনেই অতীতে এই দেশগুলোকে অনেক অর্থনৈতিক সাহায্য ও অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়েও তাদের উন্নতি সম্ভব হয়নি।
উদাহরণ হিসেবে তিনি কেরালাবাসী, আমেরিকান আর আফ্রিকান-আমেরিকানদের তুলনা করে দেখান। এই তিন গোষ্ঠীর মধ্যে কেরালাবাসীদের আয় সবার নিচে, তারপর আফ্রিকান-আমেরিকানদের আর তারপর আমেরিকানদের। অথচ এদের মধ্যে আফ্রিকান-আমেরিকানরা সবচেয়ে কম বাঁচেন (তাদের গড় আয়ু ৪০ এর মত)। আর কেরালাবাসীদের গড় আয়ু ৭০ এর কাছাকাছি।
যদি আয় বাড়লেই মানুষ সুখী হয়, তাহলে কেরালাবাসীদের আয় কম হয়েও তাদের আয়ু এত বেশি কেন? কারণ তারা প্রয়োজনীয় স্বাধীনতাগুলো (freedoms) ভোগ করে থাকে, যা আফ্রিকান-আমেরিকানরা পায় না। আফ্রিকান-আমেরিকানদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সবক্ষেত্রেই কমতি রয়েছে। তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য বীমা নেই, যদিও সকল আমেরিকানদের এই বীমা থেকে থাকে। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে তাদের মধ্যে অপরাধমূলক কাজে জড়ানোর প্রবণতাও বেশি।
ধনী-দরিদ্র সব মানুষই চায় সুস্থ-সবল শরীর নিয়ে অনেক দিন বাঁচতে। যদি অনেক টাকা আয় করেও কেউ বেশিদিন বাঁচতেই না পারে, তাহলে তো ঠিক যুত হলো না, তাই না?
এরিস্টটল এক সময় বলেছিলেন, পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুরই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে। একটি গ্লাসের উদ্দেশ্য পানি ধরে রাখা, জ্ঞানের উদ্দেশ্য মানুষকে সত্যের সন্ধান দেওয়া, মানুষকে আরো সভ্য করে তোলা। তাহলে প্রশ্ন চলে আসে, উন্নয়নের মূল উদ্দেশ্য কী? কেন উন্নয়ন চাই? উন্নয়নের বিশাল সাগরের অপর প্রান্তে কী রয়েছে? কখন একটি দেশ বলতে পারে যে আমরা উন্নত?
এসবের উত্তরে অমর্ত্য সেন বলেন যে, উন্নয়নের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। মানুষ যেন খেতে চাইলে খেতে পায়, শিক্ষিত হতে চাইলে শিক্ষিত হতে পারে, অসুখ হলে চিকিৎসা পায়। এই স্বাধীনতাই উন্নয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
সেন পাঁচটি স্বাধীনতার কথা বলেন, যথা-
- সামাজিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা (যেমন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা প্রদান)
- রাজনৈতিক স্বাধীনতা (গণতন্ত্র ও মুক্ত গণমাধ্যম)
- অর্থনৈতিক স্বাধীনতা (দ্রব্য ও শ্রমবাজারে প্রবেশের অধিকার)
- সামাজিক নিরাপত্তা (পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের জন্য ভাতা ও কোটার ব্যবস্থা)
- তথ্যের অবাধ ও স্বাধীন প্রচার।
সেনের মতে এই পাঁচটি স্বাধীনতা নিশ্চিত করা মানেই সমাজের উন্নতি লাভ করা। শুধু অর্থনৈতিক জিডিপি বা দেশের আয় বৃদ্ধি পেলেই যে এই স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই- তা পূর্বে উল্লিখিত আফ্রিকান-আমেরিকানদের উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। গত এক দশকে দেশের আয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ এই আয়ের বেশিরভাগই গিয়েছে ধনীদের পকেটে। ফলে দিনকে দিন বেড়েছে ও বাড়ছে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য।
আয় বৈষম্য নির্ধারক গিনি-কোয়েফিশিয়েন্টে বাংলাদেশ ২০১০ এ পেয়েছিল ০.৪৫, যা ২০১৬ তে এসে দাঁড়ায় ০.৪৮-এ। যার অর্থ বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়ছে। উল্লেখ্য, গিনি-কোয়েফিশিয়েন্টে আয় বৈষম্য মাপা হয়, যেখানে ১ মানে দেশে খুবই তীব্র পর্যায়ের বৈষম্য আর ০ মানে দেশে বৈষম্য নেই।
এইসব কারণেই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উচিত তার নিজের স্বার্থেই তার জনগণের জন্য ‘স্বাধীনতা’ নিশ্চিত করা। আর এই স্বাধীনতা নিশ্চিত করলে শুধু মানুষের মানবিক উন্নতিই হবেনা, বরং তার সাথে দেশের আয়ও বাড়বে।
এই স্বাধীনতা উন্নয়নের একই সাথে মাধ্যম (means বা instrumental role) ও লক্ষ্য (ends বা constructive role)। স্বাধীনতাকে উন্নয়নের মাধ্যম বলা হচ্ছে এই অর্থে যে, স্বাধীনতা নিশ্চিত করলেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। যেমন, যেসব দেশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে এগিয়ে তারা জিডিপিতেও এগিয়ে। আর স্বাধীনতাকে উন্নয়নের লক্ষ্য বলা হচ্ছে এই অর্থে যে, জিডিপি বৃদ্ধির জন্য নয়, স্বাধীনতাকে জনগণের মৌলিক অধিকার বিবেচনা করেই নিশ্চিত করতে হবে, কেননা মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা-ব্যতীত উন্নয়নের আলাপ মাত্রই অপলাপ।
এছাড়াও স্বাধীনতার উন্নয়নের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই পাঁচটি স্বাধীনতা একে অন্যের পরিপূরক। কোনো দেশ যদি তার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য (সামাজিক স্বাধীনতা) নিশ্চিত করে, কিন্তু তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই- তাহলে তাকে উন্নয়ন বলা যায় না।
যেমন- দেশের সকল মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য আছে, কিন্তু তারা তার যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছে না। কারণ দেশে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই। কর্মক্ষেত্রের অভাবের পাশাপাশি রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি, অনেকক্ষেত্রেই চাকরির জন্য লাগে মামা-ভাগ্নের সম্পর্ক, ঘুষ! এই সকল কারণেই স্বাধীনতা একে অপরের পরিপূরক।
অমর্ত্য সেনের উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট এই সামাজিক স্বাধীনতার ধারণা মানুষকে যোগ্য ও সক্ষম করে গড়ে তোলার কথা বলে, এবং সেই যোগ্যতাকে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য স্বাধীনতার দ্বারা কাজে লাগিয়ে সমাজে সুষ্ঠুভাবে বাঁচার সুযোগ করে দিতে বলে। গরিবকে যেন আজীবন ভিক্ষাই করে যেতে না হয়, গরিব দেশগুলোকে যেন আজীবন পশ্চিমাদের কাছে হাত পেতেই যেতে না হয়, সেজন্য দরকার শিক্ষা, স্বাধীনতা ও সক্ষমতা (capabilities)। এ তিনের সমন্বয় ঘটলেই মানুষ হাত পাতার বদলে চাকরি করে বা ব্যবসায় উদ্যোগ নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। সেই সঙ্গে পরনির্ভরশীলতার শিকল থেকে ছাড়িয়ে একটি দেশ হতে পারবে স্বয়ংসম্পূর্ণ।