কাদামাটি জোড়া লাগিয়ে কুমাররা যেমন হরেক রকমের তৈজসপত্র তৈরি থাকেন, তেমনি শৈশবে পরিবার, সমাজ ও কিন্ডারগার্টেন বাচ্চাদের যে দীক্ষা দিয়ে থাকে, সারাজীবন তাদের মাঝে এর প্রভাব বিরাজ করে। ৩-১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের বেড়ে ওঠার বয়স। মুক্তবিশ্বের অজানাকে জানতে চায় সে, মনের ভেতর উঁকি দেয় নানা প্রশ্ন। কৌতূহলী শিশু তার উত্তর জানতে সাথে থাকা মা-বাবাকে জিজ্ঞেস করে- “কেন এটা হয়? কীভাবে হয়?” তারাও অধৈর্য না হয়ে ধীরস্থিরভাবে বোঝাতে থাকেন সব।
ছোটরা যে কার্টুনপ্রিয় তা সর্বজনবিদিত। ডোরিমন ও টম এন্ড জেরীর সিরিয়াল চলাকালে তারাই টিভি সেটের রাজা, অন্য কারো কাছে রিমোট থাকলে ছিঁচকাঁদুনে অভ্যাস তো আছেই। কিন্তু, টিভি দেখে বিনোদন পাবে, একইসাথে জীবনের প্রারম্ভিক শিক্ষা-শিষ্টাচারেরর দীক্ষা পেলে কী দারুণ হবে না ব্যাপারটা? তাতে অভিভাবকের সময় ও শ্রম দুটোই বাঁচে। আবার অনেক অভিভাবক চিন্তিত। কারণ, তাদের কথা বাচ্চারা সেভাবে আমলে নেয় না। কিন্তু, সিসিমপুরে প্রিয় তারকা হালুম, শিকুদের অনুসরণ করে যখন তারা নিয়মানুবর্তী চলাফেরা করে, প্রশান্তিতে বাবা-মায়ের বুক তখন ভরে উঠে।
বাচ্চাদের শিক্ষাকে আনন্দদায়ক ও উপভোগ্য করতে ‘পৃথিবীটা দেখছি, প্রতিদিন শিখছি’ এই মূলমন্ত্র নিয়ে ২০০৫ সালের পহেলা বৈশাখে যাত্রা শুরু হয় সিসিমপুরের। এটি মূলত আমেরিকান অনুষ্ঠান ‘সিসামি স্ট্রিট’ এর বাংলাদেশি সংস্করণ, ‘চলছে গাড়ি সিসিমপুরে…’।
সিসিমপুরের মনোমুগ্ধকর এই থিম সং বেজে ওঠার সাথে সাথে টেলিভিশনের সামনে দৌড়ে ছুটে যায় বাড়ির সকল শিশু।
অনুষ্ঠানের প্রযোজনা ও কনটেন্ট ডেভেলপমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে আসছে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘সিসামি ওয়ার্কশপ’। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দাতা প্রতিষ্ঠান ‘ইউএসএইডে’র অর্থায়নে সিসিমপুর ইতিমধ্যে প্রচার করেছে ১২টি সিজন, যাতে ৭০০টি পর্ব ছিল। শুরুতে কেবল বিটিভির পর্দায় দেখা যেত। এক হিসেবে উঠে এসেছে, শুধু বাংলাদেশ টেলিভিশনেই প্রতি সপ্তাহে দেশের প্রায় এক কোটি দর্শক অনুষ্ঠানটি দেখে থাকেন। মাঝে চ্যানেল আই, দেশ টিভি ও চ্যানেল নাইনে প্রচারিত হলেও বর্তমানে এটি আরটিভি, দিগন্ত ও বিটিভিতে প্রচারিত হচ্ছে। বিটিভিতে সপ্তাহে ৪ বার- শুক্রবার সকাল ৯টা, শনিবার ২:১৫ মিনিট এবং বুধ ও বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টায় দেখানো হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাদের খুব একটা সুযোগ-সুবিধা নেই তাদের জন্য ভ্রাম্যমাণ সিসিমপুর ‘সেভ দ্য চিলড্রেনে’র আর্থিক সহায়তায় ভ্যানের উপর স্ক্রিনে প্রদর্শিত করে তার বিভিন্ন পর্ব। এছাড়াও তারা জনবান্ধব বিষয়াবলীতে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রচারণা চালায়। বিভিন্ন সময় সরকারের সংস্কৃতি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় তাদের সহায়তা দিয়েছে।
সিসিমপুরের সম্প্রচার শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক বছরের মাথায় এত ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় যে, ২০১০ সালে ‘বিবিসি ওয়ার্ল্ড ট্রাস্টে’র জরিপ মতে, শিশুদের সবচেয়ে বেশি দেখা প্রোগ্রাম হলো সিসিমপুর, টেলিভিশন দেখা বাচ্চাদের ৮৬ শতাংশই শিশুই এর দর্শক। শুধু টেলিভিশন সম্প্রচার করে তারা ক্ষান্ত নন, বহুদূর বিস্তৃত এদের কার্যভার। বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে ‘সিসিমপুর গল্পের বই’ বিতরণ ছাড়াও প্রতি বছর একুশে বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিশু চত্বরে ‘সিসিমপুর’ নামে তাদের কর্ণারে শিশুতোষ বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসে। বইমেলায় ‘শিশু প্রহর’ নামে বাচ্চাদের জন্য নিবেদিত কিছু সময় থাকে, সেখানে সিসিমপুরের মাস্কটরা উপস্থিত থাকে, প্রিয় মাপেটদের দেখতে তখন অভিভাবকসমেত উৎসুক বাচ্চাদের ভিড় হয় চোখে পড়ার মতো।
অনুষ্ঠানটি গণিত ও বিজ্ঞানে দক্ষতা, অল্প হলেও সঞ্চয় করা, সহানুভূতি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার শিক্ষা দেয়। মাপেট ও মানবচরিত্রের কথাবার্তা শুনতে শুনতে শুদ্ধ উচ্চারণ এবং মার্জিত কথা বলতে শিখে, অনুষ্ঠানে বর্ণ দিয়ে শব্দ এবং শব্দ দিয়ে বাক্য তৈরির গেম তাদের বেশ আনন্দ জোগায়।
জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়, স্বাস্থ্য সচেতনতা, রাস্তা পারাপারে সতর্কতা, দুর্যোগ প্রতিরোধ, দুর্ঘটনায় বা আঘাত পেলে করণীয়সহ আরো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও মূল্যবোধের দীক্ষা শিশুরা এই প্রোগ্রাম থেকে পেয়ে থাকে।
অনুষ্ঠানটিতে ১২ জন বিভিন্ন চরিত্রে ভূমিকা রাখেন, যাদের ৫ জন মাপেটের খোলনালচে (পুতুলের সাজে) অভিনয় করেন। বাকি ৭ জনকে স্বীয় অবয়বে দেখা যায়। মাপেটের অভিনেতারাই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ। তারা হলো ইকরি, হালুম, টুকটুকি, শিকু ও খেপু। হালুম নামের জাতীয় প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগারের এ মাপেটে অভিনয় করেন আশরাফুল আশীষ। অনুসন্ধিৎসু ছোট্ট মেয়ে টুকটুকির চরিত্রে সায়মা এবং পারভিন হাজির হন। টুকটুকি নিয়মিত স্কুলে যায় ও পড়ালেখায় আগ্রহী। শিয়ালরুপী শিকুর বেশভূষায় দেখা যায় শুভঙ্কর শুভকে। ইকরি মিকরি নামের নীল রঙের মাপেট অনুষ্ঠানে দৈত্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কখনো নওশাবা, কখনো তানজিলা এই চরিত্রে অভিনয় করেন। শিল্পী মুস্তফা আনোয়ারের পরিকল্পনায় সাজানো হয় ‘ইকরির জগত’, যেখানে মাপেটের পরিবেশনায় গল্প-কাহিনীর মোড়কে ফুটিয়ে তোলা হয় ইকরির আদর্শ জীবনাচার। সিসাম স্ট্রিটের আদলে ৯ম সিজনে সংযোজন করা হয় খেপু নামের বিমর্ষচিত্তের মাপেটকে।
মানবচরিত্রের অভিনেতারা হলেন গুনি ময়রা, আশা ময়রা, পলাশ ময়রা, লাল মিয়া, সেমাই আলী, মুকুল ময়রা ও সুমনা ময়রা। সিসিমপুরের সবচেয়ে বিয়োগান্তক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল লাল মিয়ার অন্তর্ধামকে কেন্দ্র করে। প্রথম সিজন শেষ হওয়ার পর এক অনুষ্ঠান চলাকালে মারা যান ডাকপিয়নের চরিত্রে অভিনয় করা এই অভিনেতা। গুনি ও আশা ময়রা পরস্পর স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের ছেলে পলাশ ময়রা। গুনি ময়রা মিষ্টির দোকান পরিচালনা করে জীবিকা নির্বাহ করলেও আশা অনেকটা শখের বশে লাইব্রেরিয়ানের ভূমিকা পালন করেন। আর চলচ্চিত্রে আমাদের সকলের পরিচিত চঞ্চল চৌধুরীকে দেখা যায় মুকুল ময়রা চরিত্রে, বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা এক যুবক, যে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের পরিকল্পনায় পথ চলতে সচেষ্ট। শিশুদের মাঝে ছোটবেলা থেকেই এমন সুচিন্তা লালিত হবে আশা করা যায়।
এসিপিআর ২০০৭ সালে বড় ধরনের এক জরিপ চালিয়েছে। এতে দেখা যায়, যেসকল শিশু অনুষ্ঠানটি নিয়মিত দেখে, তারা তাদের এক বছরের বড় যারা দেখে না, তাদের চেয়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়, গণিত ও অক্ষরজ্ঞানে বেশ পারদর্শী। সিসিমপুরের রয়েছে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনও, যেটি ‘এখানেই সিসিমপুর’ নামে গুগল প্লেস্টোরে পাওয়া যাবে। এর মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি কখন, কোন চ্যানেলে প্রচারিত হবে ইত্যাকার তথ্য পাওয়া যাবে। অ্যাপটিতে শিশুদের স্বাস্থ্য, সচেতনতা ও শিক্ষা সম্পর্কিত টিপস জানা ছাড়াও বিভিন্ন রকমের ভিডিও গেম ও বই কেনার সুবিধা থাকছে।
সিসিমপুর ছাড়াও ইউনিসেফের অর্থায়নে পরিচালিত ’মীনা কার্টুন’ ছোটদের কাছে ভীষণ প্রিয়। এটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সচেতনতাসহ মূল্যবোধের শিক্ষা দিয়ে থাকে। তবে একটা, দুটো দিয়ে হবে না, শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে এমন শিশুতোষ শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান আরো হওয়া চাই।