আশির দশকে বিটিভির যে দাপুটে সময় শুরু হয়েছিল তা নব্বইয়ের দশকেও অব্যাহত ছিল। সেই সময়ে কালজয়ী সব নাটকের আলোয় বিটিভি হয়েছিল আলোকিত। শুধুমাত্র দেশীয় নাটকে সীমাবদ্ধ না থেকে দর্শকদের ভিন্ন স্বাদ দেওয়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত এই চ্যানেলটি বিদেশি টিভি সিরিজ দেখানো শুরু করে। কিছু সিরিজ মূল ইংরেজি ভাষাতেই দেখানো হয় আর কিছু সিরিজ বাংলায় ডাবিং করেও দেখানো হয়। ভিন্নধর্মী এই উদ্যোগকে দর্শকরা সাদরে গ্রহণ করেছিল। দীর্ঘ সময়ে অনেকগুলো বিদেশি টিভি সিরিজ প্রচার করেছে বিটিভি। এদের মধ্য থেকে মাত্র তিনটিকে বেছে নেওয়া আসলেই কিছুটা কঠিন। তারপরও উল্লেখযোগ্য তিনটি টিভি সিরিজ নিয়ে আজকের আয়োজন।
১. ম্যাকগাইভার
প্রথম যে বিদেশি সিরিজটি ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল সেটি ম্যাকগাইভার। পুরো দেশকে অন্যরকম নেশায় বুঁদ করে রেখেছিল। আশির দশকে প্রচারিত এই সিরিজটির কাহিনীর মূলে ছিল ম্যাকগাইভার নামক এক যুবক। পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ম্যাকগাইভার একজন বিজ্ঞানী, তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেন। পেশায় গুপ্তচর হওয়া সত্ত্বেও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে সবসময় অনীহা প্রকাশ করেছেন তিনি, শৈশবে অসাবধানতাবশত গুলি চালাতে গিয়ে এক বন্ধুর মৃত্যুই এর মূল কারণ ছিল।
আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে আগ্রহ না থাকলেও গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়ে বহুবার আগ্নেয়াস্ত্রের সম্মুখীন হতে থাকেন তিনি। তাহলে কীভাবে এসব বিপদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে দেশের হয়ে কাজ করবেন? বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বাস্তবে কাজে লাগানোর ক্ষমতাই তার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখেও সেখান অতি অল্প সময়ে কীভাবে নানা ধরনের জটিল যন্ত্র তিনি উদ্ভাবন করতেন তা-ই এই সিরিজের মূল আকর্ষণ।
ম্যাকগাইভার চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন আমেরিকান অভিনেতা রিচার্ড ডিন অ্যান্ডারসন। ১৯৮৫ সালে শুরু হওয়া এই টিভি সিরিজ সাত মৌসুম চলার পর ১৯৯২ সালে শেষ হয়। বাংলাদেশে এই সিরিজটির ব্যাপক জনপ্রিয়তা অন্যান্য বিদেশী টিভি সিরিজ প্রচারের পথ মসৃণ করে দেয়।
২. দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অব সিনবাদ
আটলান্টিস ফিল্ম ও অল আমেরিকান টেলিভিশন- এই দুই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান মিলে ১৯৯৭ সালে তৈরি করে ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অব সিনবাদ’। কানাডীয় এই টিভি সিরিজের সাথে আলিফ লায়লার সিনবাদের একমাত্র মিল ছিল দুটিতেই গল্পের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাগদাদ শহর। বাকি সবকিছু আমূল বদলে ফেলা হয়েছিল।
গল্পের শুরুতে দেখা যায় বাগদাদের রাজার হবু পুত্রবধূকে তুরক নামের এক কালো জাদুকর অপহরণ করে ধরে নিয়ে যায়। তাকে উদ্ধার করার দায়িত্ব সিনবাদের উপরে এসে পড়ে। নিজের ভাই শক্তিশালী ডুবার, বন্ধু আবিষ্কারক ফিরোজ, ছোরা ছুঁড়তে ওস্তাদ রঙ্গারকে সাথে নিয়ে সেই কন্যাকে উদ্ধার করতে যাত্রা শুরু করেন সিনবাদ। পথিমধ্যে সাহায্যের জন্য সিনবাদ তার গুরু ভালো জাদুকর ডিমডিমের সাহায্য নেন। সেখানে দেখা হয় মেইভ নামক এক মেয়ের সাথে যিনি গুরু ডিমডিমের কাছে জাদুবিদ্যা শিখছিলেন।
কালো জাদুকর তুরককে শেষ করে দিয়ে হবু রাজবধূকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও সেটা করতে গিয়ে সিনবাদের গুরু ডিমডিম অজানা এক রাজ্যে হারিয়ে যান। এদিকে তুরকের কন্যা রুমিনা বাবাকে হারানোর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সিনবাদের দলের উপর বার বার আঘাত হানতে থাকে। রুমিনার বাঁধা পার হয়ে সিনবাদ কি তার গুরু ডিমডিমকে ফিরে পাবে? মেইভের পোষা ঈগল পাখি ডারমটের রহস্যটাই বা কি? রুমিনার সাথে মেইভের কিসের শত্রুতা? এরকম নানা প্রশ্ন নিয়ে সিরিজটির কাহিনী এগিয়ে গেছে।
কাহিনীর মূল প্রেক্ষাপট ধরে রেখে প্রতিটি পর্বেই এক একটি নতুন গল্প উপস্থাপন করা হতো। সেই গল্পে রুমিনা ছাড়াও আরো অনেক শত্রুর সম্মুখীন হতো সিনবাদ ও তার বন্ধুরা। এসব রোমাঞ্চকর অভিযানের কারণে প্রতিটি পর্বই দর্শকরা খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতো। এই অভিযানের সাথে সিনবাদ ও মেইভের দুষ্টু-মিষ্টি সম্পর্ক বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে যোগ হয়েছিল। সিনবাদ চরিত্রে জেন জেসনার ও মেইভ চরিত্রে জ্যাকুলিন কোলেনের মতো অসামান্য সুদর্শন দুইজন থাকায় এই জুটি প্রায় সবার মনেই আলাদা জায়গা করে নিয়েছিল।
এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে জর্জ বুজা, টিম প্রগোশ, অরিস এরহুয়েরোর অভিনয়ও বেশ প্রশংসনীয় ছিল। বিশেষ করে খলনায়িকা রুমিনা চরিত্রে জুলিয়ান মরিস অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। প্রথম মৌসুমের ২২টি পর্বের মধ্যে যেসব পর্বে রুমিনা থাকতো সেসব পর্বের গল্প অনেক বেশি জমজমাট হতো। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে দ্বিতীয় মৌসুমে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন প্রথম মৌসুমের সেই উত্তেজনায় পানি ঢেলে দেয়। পারিবারিক সমস্যার কারণে জ্যাকুলিন কোলেন সরে যাওয়ায় সবার প্রিয় জুটি সিনবাদ-মেইভকে দ্বিতীয় মৌসুমে আর দেখা যায়নি। সে কারণে মেইভ চরিত্রটিকে সরিয়ে দিয়ে ব্রাইন নামক একটি চরিত্রকে গল্পে আনা হয়।
তবে ব্রাইন চরিত্রে মারিয়া শারলে দর্শকমহলে সেভাবে সাড়া ফেলতে পারেনি। তাছাড়া দ্বিতীয় মৌসুমে মূল খলনায়িকা রুমিনাও অনুপস্থিত থাকায় গল্পের জৌলুসও অনেকখানি কমে যায়। পরিকল্পনা ছিল তৃতীয় মৌসুমের মাধ্যমে সিরিজটি আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ করা হবে। কিন্তু দুই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্বের কারণে কাজ আর শুরু হয়নি। ফলে তুমুল জনপ্রিয় এই টিভি সিরিজটি অসমাপ্তভাবেই শেষ হয়ে যায়।
৩. দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার্স অব রবিনহুড
ধনীদের কাছ থেকে সম্পদ লুটে নিয়ে নিপীড়িত সাধারণ মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া রবিনহুডের গল্প আমরা কমবেশি সবাই শুনেছি। সেই গল্পের সূত্র ধরেই ১৯৯৭ সালে নির্মাণ করা হয় ‘দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার্স অব রবিনহুড’। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে প্রজারা নানাভাবে অত্যাচারিত হতো। সেই অত্যাচারী রাজদরবারের বিরুদ্ধে রবিনহুড নামের এক যুবক বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে তিনি নিজেই একটা বাহিনী গঠন করে ফেলেন যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন সুন্দরী ম্যারিয়ন, যোদ্ধা লিটল জন ও জ্ঞানী ফ্রায়ার টাক।
মূল রবিনহুড গল্পে জাদুবিদ্যার কোনো প্রয়োগ ছিল না কিন্তু টিভি সিরিজে কিছুটা বাড়তি আকর্ষণ যোগ করার জন্য জাদুবিদ্যার প্রয়োগ দেখানো হয়েছিল। অত্যাচারীদের বিভিন্ন কালো জাদুর হাত থেকে কীভাবে রবিনহুডের দল সাধারণ প্রজাদের রক্ষা করে সেটা নিয়েই মূল গল্প এগিয়ে গেছে। পৌরাণিক চরিত্র হিসেবে রবিনহুড এমনিতেই জনপ্রিয়, টিভি সিরিজে কিছুটা ভিন্নভাবে এই চরিত্রটিকে উপস্থাপন করায় দর্শকরা সিরিজটির ব্যাপারে আরো বেশি আগ্রহ অনুভব করে।
তাছাড়া রবিনহুড চরিত্রে ম্যাথু পোরেটাকে বেশ ভালো মানিয়েছিল। ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ির সুদর্শন যুবক পোরেটা সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গিয়েছিল। তার সাথে সাথে ম্যারিয়ন চরিত্রে অভিনয় করা অ্যানা গ্যালভিনের জুটিটাও বেশ জমে উঠেছিল। কিন্তু সিনবাদের মতো এই সিরিজটিতেও অভিনেতা পরিবর্তনের কারণে অনেককিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় মৌসুমে ম্যারিয়ন চরিত্রে গ্যালভিনের পরিবর্তে বারবারা গ্রিফিনকে নিয়ে আসা হয়। গ্রিফিনের চেহারা কিছুটা গ্যালভিনের মতো হওয়ায় এই পরিবর্তনে তেমন ক্ষতি হয়নি।
আসল ধাক্কাটা আসে তৃতীয় মৌসুমে, সিরিজের মূল আকর্ষণ রবিনহুড চরিত্রের ম্যাথু পোরেটার বদলে নিয়ে আসা হয় জন ব্রাডলিকে। অত্যন্ত সুদর্শন যুবক পোরেটার বদলি হিসেবে কিছুটা বয়স্ক ব্রাডলিকে রবিনহুড চরিত্রে একদমই মানাচ্ছিল না। তাই সিরিজটির জনপ্রিয়তাও বেশ কমে যায়। শেষপর্যন্ত চার মৌসুম চলার পর সিরিজটি আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়।