জো গোল্ডবার্গ নিউ ইয়র্কের একটি বইয়ের দোকানের ম্যানেজার। একদিন তার দোকানে আসে একটি মেয়ে। সোনালী চুল, গাঢ় বাদামী রঙের শার্ট আর জিন্স পরিহিত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জো এর নজর আটকে যায়। বইয়ের তাকগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে মেয়েটি। জো দূর থেকে সব পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। অবশেষে মেয়েটি তার সামনে এসে হাজির হয়। মেয়েটির কমনীয় চাহনি আর সুন্দর ব্যবহার তাকে অনেক মুগ্ধ করে। প্রথম দেখাতেই সে মেয়েটির প্রেমে পড়ে যায়।
এভাবেই শুরু হয় টিভি সিরিজ ইউ এর প্রথম এপিসোড। প্রথমে লাইফটাইম নামের একটি স্ট্রিমিং সার্ভিসে মুক্তি পেলেও পরে নেটফ্লিক্স এই সিরিজের সত্ত্ব কিনে নেয়। গত বছরের শেষের দিকে এটি নেটফ্লিক্স অরিজিনাল হিসেবে তাদের ওয়েবসাইটে চলে আসে।
শুরুর বর্ণনা পড়ে অনেকের মনে হতে পারে এটি একটি নিতান্ত রোমান্টিক টিভি সিরিজ। অন্তত প্রথম এপিসোডের শুরুর দশ মিনিট দেখে দর্শকের তাই মনে হবে। কিন্তু এটি তার থেকেও ভিন্ন কিছু। মার্কিন লেখক ক্যারোলাইন কেপনেসের একই নামের জনপ্রিয় উপন্যাস অবলম্বনে এটি তৈরি হয়েছে। নেটফ্লিক্সের এই সাইকোলজিকাল থ্রিলার যদি কারো ‘অবশ্যই দেখতে হবে’ সিরিজের তালিকায় খুঁজে পান তাহলে তাতে অবাক হওয়ার বিশেষ কোনো কারণ নেই।
কাহিনী সংক্ষেপ
একটি প্রবাদ আছে ‘ভালোবাসা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সব জায়েজ। তবে ভালোবাসা ও আর আচ্ছন্নতা এক নয়। বিপরীত লিঙ্গের কারো প্রতি ভালো লাগার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ভালো লাগাকে কেন্দ্র করে একের পর এক উদ্ভট কান্ড ঘটিয়ে যাওয়া স্বাভাবিকের পর্যায়ে পড়ে না। এমনটিই ঘটেছে সিরিজের মূল চরিত্র জো গোল্ডবার্গের ক্ষেত্রে। সুদর্শন ও বইয়ের পোকা ছেলেটা প্রথম দেখাতেই গল্পের অপর চরিত্র বেক গুইনেভেয়ারের প্রেমে পড়ে যায়। বেকের জীবনে কেবলই ক্ষণিকের অতিথি হতে চায় না সে। সে চায় তার চিরস্থায়ী জীবনসঙ্গী হতে।
আজকালকার আধুনিক প্রেমের কথা বিবেচনা করলে, সবকিছুই শুরু হয় সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। কিন্তু জো এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন ছিল। সে এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পছন্দ করে না। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদিতে তার কোনো অ্যাকাউন্ট নেই। এগুলোতে মানুষের লোক দেখানো নকল জীবনযাপনকে সে খুব একটা সমর্থন করে না। কিন্তু এই অপরিচিত মেয়েটা সম্পর্কে জানার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তাও তার জন্য খোলা নেই।
বাসায় এসেই জো ইন্টারনেটে মেয়েটিকে খোঁজা শুরু করে। বেক গুইনেভেয়ার নামটা একটু ব্যতিক্রম হওয়ায় খুঁজতে তেমন বেগ পেতে হয় না। বেকের ইন্সটাগ্রাম আইডিতে প্রবেশের মাধ্যমেই শুরু হয় জো এর নিবিড় পর্যবেক্ষণ। তার কাছে এটি নিবিড় পর্যবেক্ষণ মনে হলেও আধুনিক ভাষায় একে ‘স্টক’ করা বলে। অর্থাৎ অন্যের অ্যাকাউন্ট ঘেঁটে দেখা, কে কী কমেন্ট করছে, কে কে লাইক দিচ্ছে ইত্যাদি। আর জো যেমন তেমন স্টকার নয়। মানুষকে পর্যবেক্ষণ করার এক অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তার। আচার-আচরণ, চলাফেরার ধরণ ইত্যাদি থেকে সে একজন মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছু বলে দিতে পারে। তার এই পর্যবেক্ষণ দক্ষতাকে কাজে লাগায় বেক ও তার আশেপাশের মানুষ সম্পর্কে জানার জন্য।
স্টক করা কত প্রকার ও কী কী তা জো গোল্ডবার্গকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। প্রথমে সে বেকের ইন্সটাগ্রাম আইডি থেকে তার প্রাত্যহিক জীবন, বন্ধুবান্ধব ইত্যাদির খুঁটিনাটি বের করে ফেলে। এরপর গুগল ম্যাপের মাধ্যমে পেয়ে যায় তার বাসার ঠিকানা। পরদিন সকালেই সে বেকের বাসার সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়। সেখানে গিয়ে যে বিষয়টা সে খেয়াল করে তা হলো, বেক বেশ এলোমেলো জীবনযাপন করে।
বাসার জানালাগুলোতে কোনো পর্দা নেই। কে কী দেখলো তাতে তার কিছু যায় আসে না। একজন সাধারণ ব্যক্তি হয়তো এ পর্যন্ত এসেই তার অনুসন্ধানের সমাপ্তি ঘটাতো। কিন্তু জো গোল্ডবার্গ সাধারণ মানুষদের কাতারে পড়ে না। মনে চিরস্থায়ী জায়গা পাওয়ার জন্য তাকে বেক সম্পর্কে আরো অনেক জানতে হবে বলে মনে করে সে। বেকের ভূত তার মাথায় পুরোপুরি জেঁকে বসে। বেকের খালি বাসায় লুকিয়ে ঢুকে পড়তেও তাই সে কোনো দ্বিধা বোধ করেনি।
একা বসবাসকারী বেক নিয়মিত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করলেও এসব ক্ষেত্রে সে মোটেই কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখতো না। এ কারণে বেকের ল্যাপটপ অন করতে জো এর কোনো অসুবিধা হয়নি। সেখানে সে বেক সম্পর্কে প্রচুর তথ্য পেয়ে যায় এবং ব্যক্তিগত চ্যাট হিস্টোরি ঘাঁটতেও জোয়ের হাত কাপে না। যতই সে বেক সম্পর্কে অযাচিতভাবে ব্যক্তিগত তথ্য জোগাড় করতে থাকে ততই তার কৌতূহল আরো বাড়তে থাকে।
জো ঠিক করে যে, যখন সত্যি সত্যি সে বেকের মন জয় করবে, তখন ওর সব ভুলত্রুটি আর সমস্যাগুলো দূর করে দিবে। প্রথমে সে দূর থেকে লুকিয়ে প্রতিটা পদক্ষেপে বেককে অনুসরণ করতে থাকে। তবে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার মাধ্যমে জোকে অবশেষে বেকের মুখোমুখি হতে হয়।
যেসব কারণে সিরিজটি অসাধারণ
দশ এপিসোডের এই টিভি সিরিজ অনেকে এক বসাতেই দেখে ফেলতে পারেন। উপন্যাসের এই গল্পকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য কৃতিত্ব দিতে হবে এর নির্মাতা গ্রেগ বারল্যান্তি ও সেরা গ্যাম্বলকে। তারা মূল উপন্যাসের সাথে সিরিজের গল্পের খুব একটা হেরফের করেননি। এখন যেসব কারণে সিরিজটি এতটা আকর্ষণীয় তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
১. গল্প বলার কৌশল
ক্যারোলাইন কেপনেসের ‘ইউ’ উপন্যাসে গল্প বলার কৌশল ছিল ফার্স্ট পারসন ন্যারেটিভ। অর্থাৎ মূল চরিত্রের নিজের করা বর্ণনা দিয়ে কাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে। টিভি সিরিজেও এর ব্যতিক্রম করা হয়নি। আর এই গল্প বলার কৌশলই হলো সিরিজটির মূল আকর্ষণ। সিরিজের একেবারে প্রথম সেকেন্ড থেকেই জো গোল্ডবার্গ নিজ মুখে গল্প বলা শুরু করে। চলে একেবারে শেষ সেকেন্ড পর্যন্ত।
নিজের সব কর্মকাণ্ড সে তার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যাখা করেছে। গল্পটি তার। তাই শোনানোর দায়িত্বও সে পুরোপুরি নিজের কাঁধে তুলে নেয়। পুরো সিরিজ জুড়ে দর্শককে তার কথার মোহে আটকে থাকতে হবে। দর্শক কখনো তার সাথে একমত হবেন। কখনো তার বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিত্বের সমালোচনা করবেন। মানসিক বিকারগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও তার কিছু বাস্তবমুখী কথা দর্শককে চিন্তা করতে বাধ্য করবে। জো গোল্ডবার্গ এই সিরিজের নায়ক না। আবার ভিলেনও না। এ ধরনের চরিত্রকে অ্যান্টি-হিরো বলা হয়ে থাকে।
২. অভিনয়
মনে হয় না সিরিজের প্রধান চরিত্র জো গোল্ডবার্গ সম্পর্কে আর কিছু বলা প্রয়োজন। পেন ব্যাজলি এই চরিত্রের মাধ্যমে নিজের সেরাটা বের করে এনেছেন। তার ডাবিংকেও এজন্য বাহবা দিতে হবে। মুগ্ধকর ব্যক্তিত্বের মাঝে লুকানো রহস্যময় এই চরিত্রটিকে সে সফলভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছে।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় প্রধান চরিত্রের কাছে। জো নিয়ে আলোচনা করতে করতে বেকের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। বেক গুইনেভেয়ার একজন উঠতি লেখক এবং আজকালকার অধিকাংশ আধুনিক নারীর প্রতিচ্ছবি। এ চরিত্রে অভিনয় করেছে এলিজাবেথ লেইল। উপন্যাসের বেকের সহজ-সরল ব্যক্তিত্ব, হৃদয় হরণ করা চাহনি, সবার মনোযোগ আকর্ষণ করার প্রবণতা ইত্যাদির শতভাগ প্রতিফলন ঘটেছে টিভি সিরিজের বেকের মধ্যে। সিরিজে এক পর্যায়ে জো এর বদলে হুট করে বেকের মুখ থেকে গল্প বলা শুরু হয়। এই হঠাৎ পরিবর্তন দর্শককে কিছুটা নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করবে।
অন্যান্য পার্শ্ব চরিত্রে আছে জো এর প্রতিবেশী বালক পাকো, বেকের তিন বান্ধবী পিচ, আনিকা ও লিন এবং আরো অনেকে। অল্প কয়েকটি চরিত্র নিয়ে এই সিরিজ। তাই প্রতিটি চরিত্রকে অনেক গুছিয়ে তৈরি করা হয়েছে। প্রত্যেক অভিনয়শিল্পী এই চরিত্রগুলোকে অনেক সাবলীলভাবে পর্দায় উপস্থাপন করেছেন।
বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে অভিনেত্রী শে মিচেলের কথা। ‘প্রিটি লিটল লায়ারস’ খ্যাত এই অভিনেত্রী বেকের বান্ধবি পিচের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। বেকের দৈনন্দিন জীবনের উপর তার বান্ধবী পিচের কর্তৃত্ব স্থাপন আর আবেগের দোহাই দিয়ে বেককে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল এই সিরিজের এক উল্লেখযোগ্য অংশ।
৩. চিত্রনাট্য ও আবহ সঙ্গীত
গল্প ভালো হলেও চিত্রনাট্য ও আবহ সঙ্গীত গল্পের সাথে মানানসই না হলে তা সিরিজের আবহ নষ্ট করে ফেলে। এই সিরিজের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি। এর চিত্রনাট্য অনেক যত্ন করে রচনা করা হয়েছে। একটি এপিসোড দেখতে দেখতে কখন শেষ হয়ে গেল তা দর্শক টেরই পাবেন না। অথচ গতি ছিল স্বাভাবিক। তবে দশটা এপিসোডের মধ্যেই হয়তো সিরিজটি শেষ করার কথা ছিল। যার কারণে অনেকের মনে হতে পারে সিরিজের সমাপ্তি একটু তাড়াহুড়া করে টানা হয়েছে। গল্পের ইতি টানার জন্য আরো দুইটা এপিসোড বাড়ালে শেষটা আরো সুন্দর হতো। এটিই এই সিরিজের একমাত্র নেতিবাচক দিক।
আবহ সঙ্গীত ছিল মানসম্মত। রোমান্টিক সিনের সময় কিছু ভালো গান ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে ওঠে। সাসপেন্সের সময় আবহ সঙ্গীতের রূপান্তর ছিল প্রশংসাযোগ্য। সব দৃশ্যের পিছনেই যে জোর করে কিছু একটা যোগ করতে হবে এমন করা হয়নি। ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে ওঠা যন্ত্র সঙ্গীত গল্পের প্রতি দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখবে।
৪. বাস্তব জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা
ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদির বাস্তব চিত্র এই সিরিজের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। অন্ধ ভালোবাসা আর পাগলামীর মাঝে অনেক পার্থক্য রয়েছে। ভালোবাসার নামে কাউকে মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা কতটা বিপদজনক তা এখানে উঠে এসেছে। এখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বিদ্রুপ করে বলা প্রত্যেকটা কথার সাথে না চাইলেও একমত হতে হবে।
বাস্তব জগত থেকে মেকী ও লোক দেখানো এই জগত প্রতিনিয়ত আমাদের গ্রাস করে চলেছে। বন্ধুত্বের নামে নিজের স্বার্থ হাসিল করা, ইচ্ছা করে বন্ধুর ক্ষতি করে আবার কষ্ট পাওয়ার অভিনয় করা ইত্যাদির সাথে দর্শক বাস্তব জীবনের উদাহরণ খুঁজে পাবেন। এই চরিত্রগুলোর কেউই দোষ শূন্য নয়। সবার মাঝেই কিছু না কিছু খুঁত রয়েছে। চরিত্রগুলোর প্রতি যেমন এক সময় সহানুভূতি তৈরি হবে, তেমনি তাদের নেওয়া কিছু সিদ্ধান্ত আবার বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে। আর এসবই বাস্তব জীবনের অংশ।
শেষ কথা
এখানে কেবল গল্পের চুম্বক অংশ ব্যাখা করা হয়েছে, যা না বললেই নয়। সিরিজটি শেষ হয়েছে একটি ক্লিফহ্যাঙ্গার (অসম্পূর্ণ কাহিনী) দিয়ে। যার অর্থ দ্বিতীয় সিজন আসবে। ক্যারোলাইন কেপনেসের ‘ইউ’ উপন্যাসেরও একটি দ্বিতীয় কিস্তি রয়েছে। তার সেই উপন্যাস ‘হিডেন বডিজ’ এর উপর ভিত্তি করেই ইউ এর পরবর্তী সিজন তৈরি হবে।