
পৃথিবী জুড়ে যত নোনা ও মিঠা পানির জলাধার রয়েছে তার মাত্র ৩ শতাংশ পানি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ। সচরাচর এ ধরনের জলাধার হয়তো চোখে পড়ে না। আর এ কারণেই স্বচ্ছ জলাধারের খোঁজে প্রতি বছর এসকল স্থানে অসংখ্য পর্যটক ভিড় জমিয়ে থাকেন। তাদের কেউ কেউ সাঁতার কাটা কিংবা ডাইভিংয়ের উদ্দেশ্যে, আবার অনেকে হয়তো কেবলই চোখ জুড়াতে ভ্রমণ করে থাকেন এসব জায়গায়। বিশ্বের এমনই কয়েকটি স্বচ্ছ জলাধার নিয়ে আজকের এই লেখা।
সিলফ্রা লেক, আইসল্যান্ড
ইউরোপের এই লেকটি স্বচ্ছ পানির লেক হিসেবে পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত। সিলফ্রা লেকের পানি এতটাই স্বচ্ছ যে প্রায় ১০০ মিটার উপর থেকেও পরিষ্কারভাবে লেকের তলদেশ দেখা যায়। নর্থ আমেরিকান ও ইউরেশিয়ান টেকটনিক প্লেটের মাঝে এর অবস্থান। এটি মূলত থিংভ্যালির ন্যাশনাল পার্কের আওতাধীন। দক্ষিণ আইসল্যান্ডের এই লেকটির পানি পৃথিবীর সবচেয়ে স্বচ্ছ পানি হওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এখানকার পানি ভূ-গর্ভস্থ লার্ভার সংস্পর্শে এসে পুরোপুরিভাবে ফিল্টার হয় এবং স্রোতের মাধ্যমে ভেসে আসে। মূলত ভূমিকম্পের ফলে এই লেকের উৎপত্তি।

১৭৮৯ সালে ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে থিংভ্যালির বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব ফাটল দেখা, তার মধ্যে ‘সিলফ্রা ফিসার’ বা সিলফ্রা ফাটল অন্যতম। ভূমিকম্পের পরবর্তী সময়ে আশপাশ থেকে বরফগলিত পানি এই ফাটলের মাঝে আসতে শুরু করে। তাই এর নামকরণ হয় ‘সিলফ্রা’, যা মূলত রুপালী বা ‘silvery’ শব্দটি থেকে এসেছে।
এই স্থানটি বিশ্বের বিখ্যাত দশটি ডাইভিংয়ের অনুকূল স্থানের মধ্যে অন্যতম। তাই স্নরকেল ও ডাইভিংপ্রেমীদের জন্য এটি খুবই ভালো একটি জায়গা। এখানকার পানি যেমন বিশুদ্ধ তেমনি ভলক্যানিক মিনারেলসমৃদ্ধ হওয়ায় সহজেই তা পান করা যায়। সিলফ্রা লেকের পানির তাপমাত্রা প্রায় ২°-৪° সেলসিয়াস (৩৫°-৩৯° ফারেনহাইট)। এতটা ঠাণ্ডা হওয়ার শর্তেও কখনোই এই পানি বরফে পরিণত হয় না। কেননা স্রোত সবসময় পানিকে গতিশীল রাখে। এসব কারণেই সিলফ্রা লেকের পানির স্বচ্ছতা ও বিশুদ্ধতার পরিমাণ এত বেশি।
ডাউকি নদী, ভারত
এই নদীটি ভারত উপমহাদেশের সবথেকে স্বচ্ছ নদী হিসেবে জনপ্রিয়। শীতকালে রুক্ষ থাকলেও বর্ষায় এই নদী অধিক প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এই নদী মূলত ভারতে অবস্থিত হলেও এর শাখা পিয়াইন নদ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পিয়াইন নদের স্বচ্ছ জলধারা বাংলাদেশের জাফলংয়ে অবস্থিত।
ডাউকি নদীতে নৌকা চলাচলের দৃশ্য অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। এখানকার পানি এতটাই স্বচ্ছ যে মনে হয় যেন নৌকাগুলো শূন্যে ভাসছে।এই নদের তলদেশে বিভিন্ন রঙ এবং আকারের পাথর দেখতে পাওয়া যায়। এসব পাথরই এখানকার পানি ফিল্টার করে স্বচ্ছ রাখে।

এই নদীর পানির অন্যতম উৎস এর পাশে অবস্থিত পাহাড় থেকে সৃষ্ট ঝর্ণা, যার সুর ও ছুটে চলার নান্দনিকতা প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে পর্যটকদের। এই নদীর সৌন্দর্য উপভোগের জন্য ইংরেজ শাসকরা ১৯৩২ সালে তৈরি করেন ডাউকি ব্রিজ, যা এখানকার অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
বছরে মাত্র দু’মাস এই নদী শুকনো থাকে। তাই সঠিক সময়ের অপেক্ষায় থাকা হাজার মানুষের ঢল নামে এই স্বচ্ছ নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য।
দ্য ব্লু আই, আলবেনিয়া
আলবেনিয়ায় সবচেয়ে তীব্র স্রোতসমৃদ্ধ লেক এটি। দেশটি বেশিরভাগ পানির চাহিদা এখান থেকেই পূরণ করা হয়ে থাকে। এই তীব্র স্রোত থেকে সেকেন্ডে ১৮ হাজার লিটার পানি বের হয়ে থাকে। এই লেকের পানি গলিত সীসার ন্যায় স্বচ্ছ দেখায়। মাটির অভ্যন্তরের পানি পাথরের সংস্পর্শে আসার কারণে এখানকার পানি এমন স্বচ্ছ।

এই লেকের পানি কাছ থেকে দেখতে স্বচ্ছ হলেও উপর থেকে দেখতে নীল মনে হয়। তাই এর নাম ব্লু আই। ডাইভাররা সর্বোচ্চ ৫০ মিটার গভীর পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন। তাই এর আসল গভীরতা প্রকাশিত হওয়া এখনও বাকি। বহু পর্যটক প্রতি বছর বিশেষত বসন্তকালে এর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখার জন্য এই স্থানে ভিড় জমিয়ে থাকেন। এসময় এর নোনা পানিতে যে রঙের খেলা দেখা যায় তা সত্যিই আকর্ষণীয়।
গিনি স্প্রিংস, ফ্লোরিডা
ফ্লোরিডায় অবস্থিত স্বচ্ছ পানির লেকটি পৃথিবীর অন্যতম স্বচ্ছ পানির জায়গা। এই লেকটি স্যান্টা ফে নদীর দক্ষিণপার্শ্বে অবস্থিত। প্রতিদিন ১১ কোটি ৪৪ লক্ষ লিটার পানি প্রবাহিত হয় এবং স্যান্টা ফে নদীতে গিয়ে মিশে। ফ্লোরিডায় অনেক তলদেশীয় স্রোত রয়েছে যেখান থেকে প্রচুর পানি এই স্থানটিতে এসে থাকে। গিনি স্প্রিংসে পানির গড় তাপমাত্রা ৭২° ফারেনহাইট (বা ২২.২২° সেলসিয়াস), যা পানির সাঁতার কাটা এবং ডাইভিংয়ের জন্য আদর্শ হিসেবে ধরা হয়। আর এ কারণেই হাজার হাজার মানুষ সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি সাঁতার ও ডাইভিংয়ের জন্য এই লেকটি দর্শন করে থাকেন।

এখানের পানি স্বচ্ছ হওয়ার একটি কারণ চুনাপাথর। চুনাপাথর থেকে ফিল্টার হয়ে আসার কারণে এই পানি স্বচ্ছ হয়ে থাকে। তাছাড়া তলদেশীয় স্রোত ও লেকটির পানির এই অপরূপ স্বচ্ছতার সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এই প্রাণোচ্ছ্বল পরিবেশে মাছ, বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ, সাপসহ নানা জলজ প্রাণীর বসবাস রয়েছে। এই লেকের স্বচ্ছ নীলরঙা পানি ৬০০ একর কাঠ দিয়ে ঘেরা। এর স্বর্গীয় পরিবেশ উপভোগ করতে অনেকেই সাপ্তাহিক ছুটিতে পরিবারসহ সময় কাটাতে চলে আসেন।
স্যান ব্লাস্ট, পানামা
এই দর্শনীয় স্থানটি অনেকগুলো দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এই দ্বীপগুলোর সমুদ্রসৈকত অত্যন্ত সুন্দর ও আকর্ষণীয়। এ দ্বীপের স্বচ্ছ নীলরঙা পানি ও আকর্ষণীয় দৃশ্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে। তাই হাজার হাজার পর্যটক এ স্থানটি দর্শন করে থাকেন। এখানকার বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণী ছাড়াও তাজা ও প্রাকৃতিক খাবারের স্বাদও অতুলনীয়। এই দ্বীপে হরহামেশাই স্টার ফিশসহ রঙিন মাছদের আনাগোনা দেখা যায়, যা পর্যটকদের আরও আকৃষ্ট করে।

এখানে মাঝ সমুদ্রের পানি গাঢ় নীল হয়ে থাকে। সেখান থেকে যতই সৈকতের দিকে যাওয়া যায় পানি ততই স্বচ্ছ আর হালকা হতে থাকে। অসীম সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এই দৃশ্য যেমন মনোমুগ্ধকর তেমনই অভাবনীয়। তাই সরকার এখানকার পানি দূষণ রোধ করতে জাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ করেছে। ফলে রক্ষা পেয়েছে প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য আর এখানকার বাস্তুতন্ত্র। সেই সাথে স্বচ্ছ নীলাভ পানি যেন এর সৌন্দর্যকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
 
                                    
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
                       
                       
                      