মানুষের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা খাদ্য কোনটি? উত্তরটি খুবই সহজ- দুধ। একটি নবজাতক শিশুর জন্মের পর প্রথম ছয় মাস তাকে শুধুই মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো আবশ্যক। শিশুর সঠিক বৃদ্ধির জন্য তার বয়স অন্তত দুই হওয়া পর্যন্ত তাকে অন্যান্য স্বাভাবিক খাদ্যের পাশাপাশি বুকের দুধ খাওয়ানো উচিৎ।
কিন্তু দুই বছর বয়স পেরিয়ে গেলেই কি একজন মানুষের শরীরে দুধের চাহিদা শেষ হয়ে যায়? মোটেই না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরও তার শরীরের প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর জন্য দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার বা ২৫০ গ্রাম দুধ পান করা উচিৎ।
গরুর দুধের পুষ্টিগুণ
প্রাপ্তবয়স্কদের পানের জন্য দুধের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হলো গরু। গরুর দুধ পান করে ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনের চাহিদা তো মেটেই, সেই সাথে গরুর দুধে রয়েছে- পানি ৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ, ল্যাকটোজ ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, ফ্যাট ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, প্রোটিন ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। তাই গরুর দুধকেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে নবজাতক ব্যতীত আর সকল মানুষের সবচেয়ে সেরা পুষ্টির আধার ও শক্তির উৎস। এমনকি ক্যান্সার ও হৃদরোগের মতো জীবননাশী রোগ প্রতিরোধেও গরুর দুধের জুড়ি মেলা ভার।
মানবদেহে দুধের উপকারিতা ঠিক কতটা, তা যাচাইয়ের জন্য বহু গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। যেমন- বছর কয়েক আগে সুইডেনে ৪৫ হাজার লোকের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গিয়েছিল, যারা সপ্তাহে দুই গ্লাস দুধ পান করে, তাদের চেয়ে যারা প্রতিদিন দেড় বা দুই গ্লাস দুধ পান করে, তাদের রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক কম।
বাংলাদেশে দুধ পানের বর্তমান চিত্র
দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের মানুষের গরুর দুধ পানের সুযোগ ও দুধের যোগান চাহিদার তুলনায় কম। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে জনপ্রতি দুধ পানের যে পরিমাণ, সে তুলনায় বাংলাদেশে এ হার নিতান্তই নগণ্য। বিশ্বব্যাপী বছরে জনপ্রতি দুধ পানের গড় পরিমাণ ১০৮ লিটার, যেটি ফিনল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি- ৩৬১ লিটার। এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, আমাদের দেশে এই গড় পরিমাণ মাত্র ৯.৯ লিটার। এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোও বাংলাদেশের চেয়ে বিপুল ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে ৬৮.৭ লিটার, নেপালে ৪১ লিটার, মালদ্বীপে ৭৯ লিটার, এবং পাকিস্তানে ১৫৯ লিটার।
দুধ উৎপাদনের স্বল্পতা
বাংলাদেশের মানুষের দুধ পানের এই স্বল্পতার পেছনে প্রধান কারণ হলো এদেশে দুধ উৎপাদনের স্বল্পতা। সরকারি হিসেবে দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশে বর্তমানে দৈনিক মাথাপিছু দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ১৬৫ মিলিলিটার। এর সাথে দুধ পানের হিসেব মেলালে বোঝা যায়, উৎপাদনের ছয় ভাগের এক ভাগ দুধ পৌঁছাচ্ছে মানুষের কাছে।
মাথাপিছু দুধ উৎপাদন ও দুধ পানের ফারাক থেকেই কিন্তু বেশ বোঝা যায়, কেবল দুধ উৎপাদন হওয়া মানেই সকল জনগোষ্ঠীর কাছে সেই দুধ পৌঁছানোর নিশ্চয়তা পাওয়া নয়। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো দুধের দাম। বর্তমানে প্রাণ সহ বিভিন্ন দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ আছে বলেই এখনও দেশে নিয়মিত দুধ উৎপাদন হচ্ছে, এবং এর মূল্য যথাসাধ্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা হয়েছে। দুধের উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারলে এই মূল্য আরও কমিয়ে নিয়ে আসাও অবশ্যই সম্ভব।
এদিকে বিএলআরআইয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে বর্তমানে যে পরিমাণ দুধ উৎপাদন হয়, তার মাত্র ৭ শতাংশ বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত হয়ে বাজারে আসে। যেমন- সিরাজগঞ্জের খামারিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের উৎপাদিত দুধের সিংহভাগই যায় প্রাণ ডেইরির কাছে। তাহলে বাকি দুধের কী হয়? সেগুলো কোনো প্রকার মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই বাজারে সয়লাব হয়ে যায়, কিংবা ভোক্তার বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেগুলো বিক্রি হয়। বাংলাদেশে যেহেতু বর্তমানে গরমের আধিক্য বেশি, তাই গ্রীষ্মকাল তো বটেই, এমনকি বছরের অন্যান্য মৌসুমেও অনেক সময় গরমের কারণে উৎপাদিত দুধের একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায়।
দুধের যত উপকারিতা
দুধের উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। দুধের প্রধানতম কৃতিত্ব হলো, এটি ক্যালসিয়ামের সবচেয়ে বড় উৎস, যা মানুষের দাঁত ও হাড়ের গঠন মজবুত করে। যারা নিয়মিত দুধ পান করে, তাদের সহজে দাঁতের ক্ষয়রোগ হয় না, এবং হাড়ের গঠন ও মাংসপেশি দৃঢ় থাকায় বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ে না।
তাছাড়া ক্লান্তি দূরীকরণেও দুধের ভূমিকা অতুলনীয়। কর্মব্যস্ত সময় পার করার পর এক গ্লাস গরম দুধ খেলেই ক্লান্ত পেশিগুলো সতেজ হয়ে যায়, আর শরীর চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তাছাড়া দুধ পান করলে শরীরে মেলাটনিন ও ট্রাইপটোফ্যান হরমোন নিঃসৃত হয়, যাতে করে ঘুম ভালো হয়। এভাবে দুধ মানসিক অবসাদও কমিয়ে দিতে পারে।
হৃদপিণ্ডের সুস্থতা বজায় রাখতেও রয়েছে দুধের অবদান। দুধের পটাশিয়াম ও অন্যান্য খনিজ উপাদান হৃদপিণ্ডকে সচল রাখে, ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। আবার দুধের ফ্যাটি ও অ্যামাইনো অ্যাসিডের ফলে চুল পড়া বন্ধ হয়, এবং চুল হয়ে ওঠে ভেতর থেকে মজবুত ও উজ্জ্বল। দুধ ত্বকেরও যথেষ্ট উপকার করে। দুধের নানা ভিটামিন উপাদান ত্বককে করে কোমল, নরম ও মসৃণ।
এসবের পাশাপাশি দুধ রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ, দেহের ইমিউন সিস্টেমের উন্নতি, মলাশয় ও স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস, দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি, কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণ প্রভৃতিতে সাহায্য করে।
দুধের অভাবে শিশুকাল থেকেই মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে মস্তিষ্কের গঠন-প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়ে মেধার বিকাশ স্থবির হয়ে যায়। তারা হয়ে ওঠে নিম্ন আইকিউ সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। এছাড়া দুধের অভাবে অল্প বয়স থেকেই হাড়ের গঠন দুর্বল হয়ে হাড় ভঙ্গুর হয়ে যেতে পারে, যা পরবর্তীতে অন্য কোনো খাবার খেয়ে পুষিয়ে দেয়া সম্ভব নয়।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, মানবদেহকে সুস্থ-সবল ও কর্মক্ষম রাখতে, এবং সম্ভাব্য নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষায় দুধের ভূমিকা কতটা বেশি। দুধের এত সব গুণ দেখে নিশ্চয়ই বলা যায়, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যারা প্রাত্যহিক খাদ্য তালিকা থেকে দুধের মতো জরুরি একটি জিনিসকে বাইরে রাখছেন, তারা সত্যি বোকামিই করছেন।
খামারিরা যেভাবে উপকার করছেন জাতির
বাংলাদেশে দুধের উৎপাদন কম হতে পারে, কিন্তু এর পেছনে মূল ভূমিকা কাদের? বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খামারিরাই এর পেছনের প্রধান কারিগর। দেশের মানুষের পুষ্টির চাহিদা জোগানে প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন তারা।
কিন্তু আমাদের দেশের গাভীর উৎপাদন ক্ষমতা কম হওয়ার কারণে খামারিরা চাহিদার পুরোটা মেটাতে পারছেন না। এছাড়াও বাংলাদেশের খামারিদের নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় দুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে। যার মধ্যে প্রধান হলো- কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের অভাব। সেইসাথে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে ভেটেরিনারি চিকিৎসক সংকট, গাভীর জাত উন্নয়ন ও প্রাণিখাদ্য উৎপাদনে সঠিক পরামর্শ না পাওয়া। উৎপাদিত দুধ কীভাবে প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ করতে হবে, সে ব্যাপারেও প্রয়োজনীয় জ্ঞানের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে এখনও। এসবের বাইরে খামারিদের আরও ভুগতে হয় স্বল্পসুদে ঋণ না পাওয়া, সহজে বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়া, পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও ওষুধের অভাবে।
কিন্তু এত সমস্যার পরও নিজেদের কাজ থেকে পিছপা হচ্ছেন না বাংলাদেশের খামারিরা। সমস্যায় হতাশ হয়ে এই খামারিরা যদি গাভী পালন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন, তাহলে বাংলাদেশকে আরও চরম মাত্রা পুষ্টি সংকটে পড়তে হতো। তাই চতুর্মুখী সমস্যা সত্ত্বেও যে এদেশের খামারিরা গাভী পালন ও দুধ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশবাসীর পুষ্টির চাহিদা মেটানোর কাজটি অব্যাহত রেখেছেন, এজন্য তারা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
আশার কথা হলো, দেরিতে হলেও বর্তমানে বাংলাদেশে গাভী পালন একটি লাভজনক ও সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে। কীভাবে এ শিল্পকে আরো সমৃদ্ধ করে তোলা যায়, সে ব্যাপারেও নিয়মিত গবেষণা চলছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু গাভীর খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবাটুকুও যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলেই দেশের বিদ্যমান গাভী থেকে দুধ উৎপাদন এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব। এছাড়া দেশের বাইরে থেকে উন্নতমানের গাভী আমদানি করেও দুধের উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করা সম্ভব। এই মুহূর্তে বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে স্বল্পসুদে ঋণও পাওয়া যাচ্ছে, এবং তার ফল মিলতেও শুরু করেছে।
বর্তমানে দেশে সরকারিভাবে নিয়োজিত ভেটেরিনারি সেবার পরিমাণ খুবই অপ্রতুল। প্রতি দুই হাজার গরু, ভেড়া, ছাগল ও মহিষের জন্য রয়েছে মাত্র একজন সেবা প্রদানকারী। তাই ভেটেরিনারি ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ানোটা এখন খুব জরুরি। সেই সাথে দুগ্ধশিল্পের জন্য পৃথক বোর্ড ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপনও এখন সময়ের দাবি।
আমাদের দেশে দুধ উৎপাদন ও পানের চাহিদার তুলনায় যেমন ঘাটতি রয়েছে, তেমনই দুগ্ধশিল্প বিকাশের প্রচুর সম্ভাবনাও রয়েছে। আর এই দুটি বিষয় পারস্পরিক সাংঘর্ষিক নয়। বরং এদেশে যদি খামারিদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে দেওয়া যায়, তাদের সকল প্রয়োজন মেটানো যায়, তাহলে তাদের হাত ধরে দেশের দুগ্ধশিল্পের যেমন বিকাশ ঘটবে, তেমনই দেশে দুধের উৎপাদনও বেড়ে যাবে অনেকগুণ।
দুধ উৎপাদনে দেশ যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে তাহলে সাথে সাথে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের জন্য ব্যয়ও সাধারণ মানুষের জন্য আরও সহজসাধ্য হয়ে উঠবে। এভাবেই সম্ভব দেশের সিংহভাগ মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটানো। যারা দুধ উৎপাদন করছেন এবং যারা তা পৌঁছে দিচ্ছেন সারা দেশের মানুষের কাছে, তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার সীমা নেই।