বর্তমানে পুরো বাংলাদেশ তো বটেই, পুরো বিশ্বেরই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু করোনাভাইরাস এবং এর সংক্রমণে সৃষ্ট রোগ কভিড-১৯। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী (১৭ মার্চ ২০২০) বাংলাদেশে ১০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে এর পাশাপাশি শত শত মানুষকে ‘হোম কোয়ারেন্টিন’ নামক এক বিশেষ ব্যবস্থায় থাকতে বলা হচ্ছে। তবে, দুঃখজনক হলেও সত্য, তারা অনেক ক্ষেত্রে সেটা তো করছেনই না, বরঞ্চ ঘুরে বেড়াচ্ছেন চারদিকে, দেখা করছেন আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবদের সাথে, যা আসলে ভাইরাসটি ছড়ানোর পথ একেবারে সুগম করে দিচ্ছে (যদি তারা আসলেই আক্রান্ত হয়ে থাকেন)।
আজকের এই লেখায় সেজন্য এই হোম কোয়ারেন্টিন নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। হোম কোয়ারেন্টিন বলতে কী বোঝায়, এই সময় আমাদের কীভাবে থাকা উচিত, জিনিসপত্র কীভাবে ব্যবহার করা উচিত, পরিবারের সদস্যদের সাথেই বা আমাদের সংস্পর্শে আসার ধরন কেমন হওয়া উচিত ইত্যাদি সবকিছুই আলোচনা করা হবে এই লেখায়।
হোম কোয়ারেন্টিন নিয়ে আলাপের গভীরে ঢোকার আগে আমাদের দুটো বিষয়ের মাঝে পার্থক্য বুঝতে হবে- কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন। একজন মানুষকে তখনই আইসোলেশনে রাখা হয় যখন তিনি ইতোমধ্যে একটি সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন এবং তার মাধ্যমে সেটি অন্যদের মাঝে ছড়ানোরও আশংকা রয়েছে। অন্যদিকে, একজন মানুষ যদি কোনো না কোনোভাবে একটি সংক্রামক রোগের সংস্পর্শে এসে থাকেন বা এসেছেন বলে ধারণা করা হয় (যদিও তিনি তখন পর্যন্ত অসুস্থ হননি), তাহলে কোয়ারেন্টিনের সময় তাকে আসলে নজরে রাখা হয় এবং তার চলাফেরা সীমিত করে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে যদিও তিনি তখন পর্যন্ত অসুস্থ হননি, তারপরেও অন্যদের নিরাপদ রাখতেই তাকে এই আলাদা করে রাখার কাজটি করা হয়ে থাকে।
কোয়ারেন্টিন শব্দটা শুনতেই যেন কেমন কেমন লাগে। সত্যি বলতে, এর মধ্য দিয়ে যারা ইতোমধ্যে গিয়েছেন কিংবা এখন যাচ্ছেন, তারাও জানেন যে এটা মোটেও সুখকর কোনো অনুভূতি না। তবে পরিবার, সমাজ, এবং বৃহত্তর দৃষ্টিতে দেখলে দেশের মঙ্গলের জন্যই তারা এই কাজটি করছেন। এখন চলুন এই হোম কোয়ারেন্টিনের একেবারে বেসিক কিছু জ্ঞান অর্জন করে নেয়া যাক।
পৃথকীকরণ
যদি মনে হয় যে আপনি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব পরিবারের সদস্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলুন, তিনি আপনার যত কাছের মানুষই হোক না কেন। কারণ, এই মানুষদের ভালোর জন্যই আসলে আপনি এই কাজটি করছেন।
শুধুমাত্র আপনারই ব্যবহারের জন্য একটি রুম সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে। সম্ভব হলে একটি বাথরুমও। কেন? কারণ আপনি যেখানে স্পর্শ করছেন, যেখানে কফ ফেলছেন, সেই জায়গাটিই ভাইরাসে ‘সংক্রমিত হয়ে যেতে পারে’ (‘সংক্রমিত হয়ে যাবে’ বলা হলো এই কারণে যে আপনি কোয়ারেন্টিনে আছেন, আইসোলেশনে না)।
খবরদার, আপনার সাথে দেখা করতে কেউই যেন না আসে। যদি কারও সাথে দেখা করা দরকারও হয়, তাহলে চেষ্টা করুন সেই মানুষটির সাথে ৩-৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে। কোনো রকম পাবলিক যানবাহন ব্যবহারের কথা তো মাথাতেই আনা যাবে না এই সময়।
মাস্ক
কোয়ারেন্টিনে থাকাকালে যদি আপনাকে কারও সাথে দেখা করতেই হয়, তাহলে অবশ্যই ফেস মাস্ক ব্যবহার করবেন। সেই সাথে যিনি আপনার সাথে দেখা করতে আসবেন তাকেও বলবেন একই কাজ করতে।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
হাঁচি-কাশি দিলে নাক-মুখ অবশ্যই টিস্যু পেপার বা হাত দিয়ে ঢেকে দেবেন। এরপর টিস্যু পেপারটি ভাল করে আটকানো একটি ঝুড়িতে ফেলে দেবেন। আপনার হাতটিও স্যানিটাইজার কিংবা সাবান ও পানি দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধরে ভাল করে ধুয়ে নেবেন।
হাচি-কাশি না দিলেও মাঝে মাঝেই আপনার হাত এভাবে পরিষ্কার করা উচিত। আর হাত না ধুয়ে কোনোভাবেই, আবারও বলছি, কোনোভাবেই আপনার নাক-চোখ-মুখে হাত দিতে যাবেন না।
জীবাণুমুক্তকরণ
আপনার ব্যবহৃত থালা, গ্লাস, কাপ, তোয়ালে, বিছানার চাদর অর্থাৎ এমন কিছু যেখানে আপনার স্পর্শ লেগেছে তা কোনোভাবেই অন্য কারো সাথে শেয়ার করতে যাবেন না। ব্যবহারের পর সেগুলো অবশ্যই ভাল করে ধুয়ে নেবেন।
যে জায়গাগুলোতে আপনার স্পর্শ নিয়মিতভাবেই লেগে থাকে (যেমন- টেবিল, মোবাইল, কিবোর্ড, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, দরজার হাতল, বাথরুম ইত্যাদি) সেগুলো অবশ্যই পরিষ্কারের ব্যবস্থা নিতে হবে।
আপনার দেহ থেকে নির্গত তরল (সেটা রক্ত ও মলমূত্রও হতে পারে) যেসব স্থানে পড়ে, সেসব স্থানও পরিষ্কারের ব্যবস্থা নিতে হবে।
পর্যবেক্ষণ
নিজের শরীরের দিকে খেয়াল রাখুন। যদি আপনার দেহে ভাইরাসে আক্রান্ত হবার উপসর্গ দেখা দেয় কিংবা পরিস্থিতি খারাপ হয়, তাহলে ডাক্তার ডাকতে দেরি করবেন না।
পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা
পরিবারের একজন সদস্য যখন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকবেন, তখন অন্যদের যে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা স্থবির করে বসে থাকতে হবে এমনটা ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। তারা নিজেদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ঠিকই অব্যহত রাখতে পারবেন। তবে এর পাশাপাশি কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষটির দেখাশোনার ভারও তাদের নিতে হবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে পুরো ঘরই। রোগীর উপসর্গগুলোর দিকে নজর রাখতে হবে, শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে ডাকতে হবে ডাক্তার।
যদি উপসর্গ দেখা দিয়েছে এমন কারও সাথে দেখা করতে হয়, তাহলে সেসময় অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করবেন। যদি সেই ব্যক্তির দেহ-নিঃসৃত তরলের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে অবশ্যই হাতে গ্লাভস ব্যবহার করবেন। কাজ শেষে এই মাস্ক ও গ্লাভস অবশ্যই ফেলে দেবেন। সামান্য কিছু টাকা বাঁচানোর জন্য সেগুলো পুনরায় ব্যবহারের কথা মাথাতেও আনা যাবে না।
পরিবারের বয়স্ক সদস্য এবং যাদের বিভিন্ন রোগবালাই আগে থেকেই আছে, তাদের ক্ষেত্রে এই ভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মক হয়ে দেখা দিতে পারে, হতে পারে মৃত্যুও। তাই কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তির সংস্পর্শে তাদের না যাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।
আমাদের পরিবারের সদস্যদের দেখাশোনার দায়িত্ব আসলে আমাদেরই। তাই নিজেদের পরিবারকে সুরক্ষা দিতে আমাদের নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে। যদি আপনার পরিবারের কারও মাঝে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার উপসর্গ (জ্বর, ক্লান্তি, শুকনা কাশি, গায়ে ব্যথা, নাক বন্ধ, সর্দি, গলা ব্যথা, ডায়রিয়া) দেখা দেয়, তাহলে যোগাযোগ করতে পারেন চিকিৎসকের সাথে। এজন্য রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) হটলাইন নাম্বার। এগুলো হলো:
০১৪০১১৮৪৫৫১, ০১৪০১১৮৪৫৫৪, ০১৪০১১৮৪৫৫৫, ০১৪০১১৮৪৫৫৬, ০১৪০১১৮৪৫৫৯, ০১৪০১১৮৪৫৬০, ০১৪০১১৮৪৫৬৩, ০১৪০১১৮৪৫৬৮, ০১৯২৭৭১১৭৮৪, ০১৯২৭৭১১৭৮৫, ০১৯৩৭০০০০১১, ০১৯৩৭১১০০১১, ০১৫৫০০৬৪৯০১, ০১৫৫০০৬৪৯০২, ০১৫৫০০৬৪৯০৩, ০১৫৫০০৬৪৯০৪ এবং ০১৫৫০০৬৪৯০৫
জ্ঞানার্জন তখনই সার্থক হয় যখন সেটা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এই লেখার পাঠকদের প্রতি তাই অনুরোধ রইল- বার্তাগুলো আপনার পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, প্রিয়জনদের মাঝে ছড়িয়ে দিন। এতে করেই বাঁচব আপনি, আমি, আমাদের পরিবার-প্রিয়জনেরা। সেই সাথে বাঁচবে সমাজ, বাঁচবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি।
করোনাভাইরাস নিয়ে আরও জানতে পড়ে নিন এই লেখাগুলো:
১) করোনাভাইরাস নিয়ে যত গুজব
২) করোনাভাইরাস বনাম চীনা প্রযুক্তি: এক আশাজাগানিয়া যুদ্ধের গল্প
৩) বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের কালো থাবা
৪) ছবিতে দেশে দেশে করোনাভাইরাসের প্রভাব
৫) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত একজনের বেঁচে ফিরে আসার গল্প