বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক, অভিযাত্রী, গবেষক– কী নন তিনি! ৬৯টি ভাষায় পারঙ্গম, ৭২টি আবিষ্কারের আবিষ্কর্তা, হায়ারোগ্লিফিক পড়ার ক্ষমতাসম্পন্ন, মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার দুর্বোধ্য লিপির পাঠোদ্ধারকারী। পাঁচটি মহাদেশের বিজ্ঞানীগণের দ্বারা টমাস আলভা এডিসনের পরে মহান উদ্ভাবক হিসেবে স্বীকৃত তিনি। ব্রাজিলের রাটানটান ইনস্টিটিউট থেকে ডক্টরেট লাভ; সুইডিশ আকাদেমি অব সায়েন্স থেকে বিশেষ সম্মান। প্রফেসর শঙ্কুর ঝুলিতে কী নেই? তিনি যত বড় বিজ্ঞানী ঠিক তত বড় একজন অভিযাত্রীও বটে। সাহারা মরুভূমি থেকে আফ্রিকার বনভূমি, ব্রাজিলের আমাজন থেকে মিশরের তুতানখামেনের সমাধি, সমুদ্রের তলদেশ থেকে অজানা উদ্ভট দ্বীপ- সবখানেই প্রফেসর শঙ্কুর বিচরণ। আমাদের প্রতিবেশী গ্রহ মঙ্গলেও তার পায়ের ছাপ পড়েছে! সেখান থেকে তিনি তার অদ্ভুত ডায়েরিটি একটি উল্কার পিঠে চাপিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ডায়েরিটির অদ্ভুতুড়ে গুণটি হলো এর লেখাগুলো ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায় এবং পাতাগুলো নষ্ট হয় না। ডায়েরির দিনলিপিগুলো থেকেই আমরা প্রফেসর শঙ্কুর চমৎকার আবিষ্কার ও দুঃসাহসিক অভিযানগুলোর ব্যাপারে জানতে পারি।
সত্যজিতের অমর সৃষ্টি শঙ্কু
অমর স্রষ্টা সত্যজিতের অমর সৃষ্টিগুলোর মধ্যে একজন প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। সত্যজিৎকে অধিকাংশ লোকেই চেনে চলচ্চিত্রকার হিসেবে। চলচ্চিত্রকার হিসেবে যতটা খ্যাতি তিনি পেয়েছিলেন ততটাই পেয়েছিলেন সাহিত্যিক হিসেবে।
বাংলা ভাষার পাঠকরা শার্লক হোমস, প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের অভাব কোনোদিন বুঝতে পারেননি ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কুকে পেয়ে। ১৯৬১ সালে সত্যজিতের চল্লিশতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত হয় তার পারিবারিক পত্রিকা ‘সন্দেশ’ এর তৃতীয় সংস্করণ। সন্দেশ এর পাতা ভরানোর উদ্দেশ্যেই সত্যজিৎ রায় প্রফেসর শঙ্কুকে সৃষ্টি করেন।
প্রথম গল্পটি ছিল ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি’। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দ বা ১৩৬৮ বঙ্গাব্দে সন্দেশ এর আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ তিন সংখ্যায় গল্পটি ছাপা হয়। গল্পটি ছাপার পরেই ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়। সত্যজিৎ এরকম একটি চরিত্র সৃষ্টি করার জন্য আগে থেকে কোনো পরিকল্পনা বা শর্টনোট করেননি। তবে একটি কথা স্বীকার করে গেছেন যে, প্রফেসর শঙ্কুর মতো একটি চরিত্র সৃষ্টির ব্যাপারে তিনি অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন বাবা সুকুমার রায়ের “হেসোরাম হুঁশিয়ারি-র ডায়েরি” থেকে।
১৯৬৪ সালে শঙ্কুকে নিয়ে দ্বিতীয় গল্প প্রকাশের মাধ্যমে তিনি যথাযথভাবে শঙ্কু সিরিজের সূচনা ঘটান। দ্বিতীয় গল্পটির নাম ‘প্রফেসর শঙ্কু ও হাড়’। পরের বছর শঙ্কুকে নিয়ে প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ। এর নাম দেওয়া হয় ‘প্রফেসর শঙ্কু’। পরের তিরিশ বছরে প্রফেসর শঙ্কু সিরিজের আটটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। পরে মোট ৩৮টি পূর্ণাঙ্গ গল্প ও দুটি অসম্পূর্ণ গল্প নিয়ে শঙ্কুসমগ্র প্রকাশিত হয়।
প্রফেসর শঙ্কুর জীবনবৃত্তান্ত
তদানীন্তন বিহারের (অধুনা ঝাড়খণ্ড) গিরিডিতে প্রফেসর শঙ্কু স্থায়ীভাবে বাস করেন। পিতা শ্রী ত্রিপুরেশ্বর শঙ্কু পেশায় একজন খ্যাতিমান আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। পুরো গিরিডিতে তার একক জনপ্রিয়তা। গরীব-অভাবীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেন তিনি। তবে তিনি মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন।
বাবা শঙ্কুকে আদর করে ডাকতেন ‘তিলু’। শঙ্কুর প্রপিতামহের নাম জানা যায় “প্রফেসর শঙ্কু ও ভূত” গল্পে, বটুকেশ্বর শঙ্কু। প্রফেসর শঙ্কু গিরিডির এক স্কুল থেকে মাত্র ১২ বছর বয়সে ম্যাট্রিক, ১৪-তে কলকাতার কলেজ থেকে আইএসসি এবং ১৬ বছর বয়সেই ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রিতে ডবল অনার্সসহ বিএসসি পাশ করেন। বিএসসি পাশের পর পিতার ইচ্ছায় বছর চারেক বেদ, উপনিষদ, আয়ুর্বেদ সহ বিভিন্ন সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। তারপর মাত্র ২০ বছর বয়সেই কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন।
প্রফেসর শঙ্কু জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু ভূত-প্রেত ও তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। গিরিডির বাড়িতে শঙ্কু তার ২৪ বছর বয়স্ক পোষ্য-বিড়াল নিউটন ও চাকর প্রহ্লাদকে নিয়ে থাকেন। এটাই তার পরিবার। মাঝে মাঝে প্রতিবেশী অবিনাশ চন্দ্র মজুমদার তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা করতে আসেন। অবিনাশ মজুমদার কিছুটা গোঁড়া ও সেকেলে ধাঁচের লোক। তাই প্রফেসর শঙ্কু প্রায়ই তার কথায় বিব্রত ও বিরক্ত হতেন। প্রফেসর শঙ্কুর বাড়িতে আরেকজন স্থান পেয়েছে, সে হচ্ছে বিধুশেখর। বিধুশেখর হলো শঙ্কুর তৈরিকৃত রোবট।
প্রফেসর শঙ্কুর দুজন বন্ধু আছেন। একজন ব্রিটিশ এবং অন্যজন জার্মান। একজন ভূতত্ত্ববিদ জেরেমি সন্ডার্স, অন্যজন বায়োলজিস্ট জন সামারভিল।
প্রফেসর শঙ্কুর অভিযানসমূহ
ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি-তে দেখা যায়, প্রফেসর শঙ্কু তার বিড়াল নিউটন, চাকর প্রহ্লাদ ও রোবট বিধুশেখরকে নিয়ে মঙ্গলগ্রহে যাত্রা করেন। সেখানে স্থানীয় প্রাণীদের তাড়া খেয়ে টাফা নামক এক গ্রহে চলে যান ও সেখানেই স্থায়ীভাবে বাস করা শুরু করেন।
প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল গল্পে দেখা যায়, শঙ্কু এক লোকের খপ্পরে পড়েন। যে তাকে পুতুল বানিয়ে দেয়, পরে এক বন্ধুর সাহায্যে তিনি মুক্তি পান।
প্রোফেসর শঙ্কু ও গোলক-রহস্য গল্পে অবিনাশ বাবুর কুড়িয়ে পাওয়া আশ্চর্য গোলকের মধ্যে কী এমন আছে, যাতে গোলকটির নিক্ষেপণে সকল প্রাণী মারা পড়ছে – এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে শঙ্কু জানতে পারেন, গোলকটি আসলে সৌরজগতের ক্ষুদ্রতম গ্রহ টেরাটম্; গ্রহের উন্নত জীবেরা পৃথিবীর সকল জীবকে ধ্বংস করতে চাইছে। শঙ্কু এই গ্রহের সকল প্রাণীসহ গ্রহটি ধ্বংস করে দিতে বাধ্য হন।
প্রোফেসর শঙ্কু ও চী-চিং এ প্রফেসর শঙ্কু চীনা জাদুকর চী-চিং এর মুখোমুখি হন, যে তাকে সম্মোহিত করে।
প্রোফেসর শঙ্কু ও ভূত গল্পটিতে গিরিডিতে শঙ্কুর মতো দেখতে একটি ভূতের আবির্ভাব হয়। নিজের আবিষ্কৃত নিও-স্পেকট্রোগ্রাফের সাহায্যে শঙ্কু জানতে পারেন, এই ভূত আর কেউ নন, চারশো বছর আগের তার পূর্বপুরুষ তান্ত্রিক বটুকেশ্বর শঙ্কু, যিনি শঙ্কুর বিজ্ঞান ও নিজের তন্ত্রশক্তির সাহায্যে কয়েকটি অসমাপ্ত কাজ শেষ করার উদ্দেশ্যে কিছু সময়ের জন্য পার্থিব শরীর ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু গল্পে শঙ্কু একটি অত্যাধুনিক রোবট উদ্ভাবন করেন, যার মাধ্যমে তিনি জার্মান বিজ্ঞানীর শয়তান রোবট ধ্বংস করেন।
প্রোফেসর শঙ্কু ও রক্তমৎস্য রহস্য-তে জাপানি বিজ্ঞানী হামাকুরা ও তানাকা, শঙ্কু ও অবিনাশ বাবু সমুদ্রের তলদেশে অদ্ভুত লাল মাছের সন্ধানে অভিযান চালান। জানতে পারেন এই লাল মাছ আসলে ভিনগ্রহের প্রাণী, যারা স্থলের তুলনায় জলেই বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করে। পৃথিবীর পরিমণ্ডল সুবিধাজনক না হওয়ায় তারা আবার মহাশূন্যে ফিরে যায়। শঙ্কুরা এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকেন।
প্রোফেসর শঙ্কু ও কোচাবাম্বার গুহা গল্পে দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়ায় মার্কিন বিজ্ঞানী ডাম্বার্টনের সঙ্গে একটি সদ্য-আবিষ্কৃত প্রাগৈতিহাসিক গুহা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে শঙ্কু সেই গুহায় এক পঞ্চাশ হাজার বছর বয়সী গুহামানব এবং বেশ কিছু প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর সন্ধান পান। কিন্তু তাদের চোখের সামনেই একটি প্রচণ্ড ভূমিকম্পে সেগুলি মাটির তলায় বিলীন হয়ে যায়।
এরকম আরো অনেক রহস্যপূর্ণ ও রোমাঞ্চকর অভিযানের কথা প্রফেসর শঙ্কুর ডায়েরিতে পাওয়া যায়।
প্রফেসর শঙ্কুর আবিষ্কার
প্রথমেই বলতে হবে অ্যানাইহিলিন পিস্তলের কথা। চার ইঞ্চি লম্বা এই পিস্তলের বিশেষত্ব হলো- এটি যার উপর প্রয়োগ করা হবে তার মৃত্যু হবে না, বরঞ্চ অদৃশ্য বা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। উপনিষদে বর্ণিত এক বৃক্ষ সপ্তপর্ণী থেকে শঙ্কু তৈরি করেছিলেন মিরাকিউরল বড়ি, এটি সর্বরোগনাশক। তবে এই বড়ি তৈরির কৃতিত্ব শঙ্কু নিজে নিতে নারাজ। কারণ, সপ্তপর্ণীর সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন এক সাধুবাবা থেকে। ঘুমের বড়ি সমনোলিন। হিটলারের সহযোগীর উপর প্রয়োগ করা হয়েছিল এই বড়ি। একবার খেলে ১০ মিনিটের মধ্যে চোখে নামে সাত রাজ্যের ঘুম। হারানো স্মৃতি ফিরিয়ে আনার জন্য তৈরি করেছিলেন রিমেমব্রেন যন্ত্র। পরলোক চর্চা বা আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য শঙ্কু বানিয়েছিলেন কম্পুডিয়াম মেশিন। শঙ্কুর আরেকটি অনবদ্য আবিষ্কার হলো নস্যাস্ত্র। এটি রক্তপাত ঘটায় না, প্রাণেও মারে না। একবার প্রয়োগে চল্লিশ ঘণ্টা ব্যক্তি হাঁচতে থাকে। শঙ্কু তার চাকর প্রহ্লাদের উপর রেগে গিয়ে একবার এটি প্রয়োগ করেছিলেন।
বটিকা-ইন্ডিকা। একটা বড়ি ক্ষুধা-তৃষ্ণা সব মিটিয়ে দেয়। বটফলের রস থেকে শঙ্কু এটি তৈরি করেছিলেন। মাইক্রোসনোগ্রাফ নামক একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন শঙ্কু। মানুষের কানে যে শব্দগুলো পৌঁছায় না সেগুলো এ যন্ত্রের সাহায্যে শোনা যায়। রোবু নামে একটি রোবট তৈরি করেছিলেন। এটি তৈরিতে ব্যয় হয়েছিল ৩৩৩ টাকা সাড়ে সাত আনা। শঙ্কু শ্যাঙ্কোভাইট নামক একপ্রকার ধাতু তৈরি করেছিলেন, যা মাধ্যাকর্ষণকে উপেক্ষা করতে সক্ষম। এই ধাতু দিয়ে তিনি মঙ্গলে যাওয়ার জন্য একটি প্লেন তৈরি করেন, যেটির নাম তিনি দিয়েছিলেন শ্যাঙ্কোপ্লেন। মানুষের বিবর্তন দেখার জন্য তৈরি করেন এভিটিউটন। শঙ্কুর আরেকটি চমকপ্রদ আবিষ্কার হলো এক্স ও অ্যান্টি-এক্স। এক্সের প্রয়োগে কয়েক মিনিটের মধ্যে মানুষ হিংস্র দানবে পরিণত হয়। অ্যান্টি-এক্স এর প্রয়োগে সেই প্রভাব নষ্ট হয়।
প্রফেসর শঙ্কুর ডায়েরিতে তাঁর মোট ৭২টি আবিষ্কারের কথা জানা গেছে। এই আবিষ্কারগুলো তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে মহান উদ্ভাবকগণের কাতারে। শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, শঙ্কু ও তাঁর অভিযানসমূহের গল্প পৃথিবীর অনেক দেশে জনপ্রিয়। শঙ্কুর রোমাঞ্চকর অভিযান, কল্পবিজ্ঞানের সাথে খাঁটি ভারতীয়তার মিশেল, পরতে পরতে ফ্যান্টাসির সমারোহ; এগুলোর সাথে সত্যজিৎ রায়ের নিজস্ব বর্ণনাভঙ্গি– বোঝাই যাচ্ছে গল্পগুলো কত মজার ও মনোমুগ্ধকর। একবার বসলে শেষ না করে ওঠা মুশকিল।