২০১৪ সালের ১১ই আগস্ট ফাঁসিতে ঝুলে বিখ্যাত কমেডিয়ান রবিন উইলিয়ামস চিরদিনের জন্য চলে যান। ভক্তদের জন্য এটি ছিল বিরাট এক ধাক্কা। আমাদের মনে হতে পারে- জীবনে সফলতার চরম শিখরে পৌঁছে গিয়েও কী অপূর্ণতা ছিল যে তাকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হলো? বর্তমান সময়ে সফলদের আত্মহত্যার প্রবণতা আমাদেরকে এ কথাই বলে যে, শুধু সফলতাই মানুষকে সুখী করতে পারে না। সাফল্যমণ্ডিত জীবন আর অর্জনের ঝুলি মানুষকে সুখী করে না। কোথায় তাহলে কমতি রয়ে গিয়েছিল?
বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার কেট স্পেড কিংবা সেলিব্রেটি শেফ অ্যান্থনি বোরডেইনের আত্মহত্যা দেখে এটা সহজেই অনুমেয় যে, সফল এবং ধনী ব্যক্তিরাও বাকিদের মতো একই ধরনের দুশ্চিন্তা ও হতাশার মধ্যে থাকেন। কখনো বা আরো বেশি। সবকিছু ঠিকঠাক চলার পরও তারা আত্মহননের পথে পা বাড়িয়েছেন। তবে এখানে তারাই প্রথম না। রবিন উইলিয়ামস (৬৩), অ্যারন শোয়ার্টজ (২৬), কার্ট কোবেইন (২৭), সিলভিয়া প্লাথ (৩০), অ্যালান টিউরিং (৪১), চেস্টার বেনিংটন (৪১), ভার্জিনিয়া উল্ফ (৫৯), আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (৬১) আর ভ্যান গখ (৩৭) এর মতো অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। এদের কয়েকজন জীবিতাবস্থায় অনেক সফলও ছিলেন।
এই তালিকাটি যতক্ষণে আপনি পড়ে শেষ করবেন ততক্ষণে পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে কেউ হয়তো আত্মহননের পথ বেছে নেবে। পৃথিবীতে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করে। সিডনি ইউনিভার্সিটির ২০১৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। তবে অবশ্যই এর সমাধান আছে। সফলদের মাঝেই বা আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি কেন? এসব নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
কেউই আত্মহনন থেকে নিরাপদ নয়। আমরা যদি ভাবি সফলতা আত্মহত্যার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেবে, তাহলে হয়তো আমরা ভুল। সফল এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের আত্মহত্যা আমাদেরকে সেই সত্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়। অর্থাভাব কিংবা স্বাধীনতার তো কোনো কমতি তাদের ছিল না।
বরং যাদের দিকে সারাক্ষণ মানুষের চোখ পড়ে থাকে, তারা আরো বেশি ডিপ্রেশনে ভুগে থাকেন। তারা হয় আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছেন কিংবা নিজেরাই নিজেদের দক্ষতার চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন কখনো কখনো। এসব সেলিব্রেটি বা বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের দিকে গণমাধ্যমের চোখ হরহামেশাই থাকে; মানুষ তাদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করতে পছন্দ করে। তারাও নিজেদের নিয়ে অধিক সচেতন থাকতে পছন্দ করেন। কোথাও কোনো ভুল হয়ে গেল কি না! যদি হয়, তাহলে তো ভারি বিপদ! এসবের জন্য তারা সবসময় হতে চান একদম নিখুঁত। যেকোনো ভুলভ্রান্তির প্রতি তাদের থাকে একধরনের বিতৃষ্ণা। আত্মসমালোচনায় থাকেন মুখর।
এজন্য আর দশটা সাধারণ মানুষের চেয়ে তারা বেশি চাপে থাকেন। এই মানসিক চাপ খুব সহজেই ডিপ্রেশনে রূপ নেয়। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়েও কেউ কেউ অবিরত অন্যের সাথে নিজের তুলনা করতে থাকেন। অন্যের মতামত তাদের কাছে এতটাই জরুরি হয়ে পড়ে যে তা থেকে মুক্তি পেতে তাদের চিকিৎসকেরও শরণাপন্ন হতে হয় মাঝে মাঝে।
ক্যান্ডিস লাম একজন মনোবিজ্ঞানী যিনি দীর্ঘ সময় ধরে হংকং আর চীনে শক্তিশালী, বিখ্যাত আর সফল লোকদের কাছ থেকে দেখছেন, তাদের ডিপ্রেশনের চিকিৎসা করছেন। তার অর্ধেক রোগীই সিইও, সেলিব্রেটি কিংবা শক্তিশালী রাজনীতিবিদ। এরা বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে ভোগেন, যেমন- প্যানিক অ্যাটাক, মাদকাসক্তি, ইনসমনিয়া, মুড সুইং, আত্মহত্যার প্রবণতা ইত্যাদি।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফল ব্যক্তিদের সন্তানদেরও আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে। তারা মাঝেমাঝে এই স্পটলাইটটা পেতে চান না। আলাদা একধরনের হতাশাও থাকে তাদের। তারা ভাবেন, এই যশ-খ্যাতি সবই তাদের পারিবারিক সম্পর্কের কারণে। এটা তো তাদের নিজস্ব কোনো অর্জন নয়। এভাবে তারা ডিপ্রেশনের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
ব্যাংকিং কিংবা কর্পোরেট বিজনেসের অনেকেই যারা সফল হয়েছেন, তারা তাদের পেছনে অনেক কিছু ফেলে সামনে এগিয়ে গেছেন। এ পথে এগোতে গিয়ে পারিবারিক বা প্রেমের সম্পর্ককেও তারা জলাঞ্জলি দিয়েছেন। এজন্যই আর দশটা সাধারণ মানুষের থেকে তাদের সাপোর্ট সিস্টেম অনেক বেশি দুর্বল। কাজের চাপ, টাকা-পয়সা আর সবার প্রত্যাশা পূরণ করতে গিয়ে প্রায়ই তারা বন্ধু, পরিবার এবং সন্তানাদিকে ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না। সম্পর্ক খুব দুর্বল হয়ে যায় বা ভেঙে যায়। তারা এত মানুষের ভীড়েও বিশ্বাসযোগ্য কোনো সাহায্যের হাত খুঁজে পান না। মানুষ তাদের কোন চোখে দেখবে তার পরোয়া তারা খুব বেশি করেন। তাই সবসময়ই একটা মিথ্যা মুখশ্রী ধরে রাখার চেষ্টা করেন। অন্যদের থেকেও তারা বাড়তি চাপের মুখোমুখি হন। আরো আরো পাওয়ার চাপ তাদেরকে হতাশার দিকে ঠেলে দেয়।
সফল ব্যক্তি ব্যর্থ হলে তার শূন্যস্থান পূরণ করতে বেশি সময় লাগবে না। কারণ পেছনে আরো অনেকেই এই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে তার জায়গাটি নেওয়ার জন্য। দুঃখজনকভাবে প্রায় সময়ই ব্যক্তিকে এসবের মধ্য দিয়ে একাই যেতে হয়। এসব ভাগাভাগি করার মতো মানুষ তিনি খুঁজে পান না।
আত্মহত্যার পেছনে নির্দিষ্ট কারণ বা ব্যাখ্যা এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। সফল ব্যক্তি বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। দূর থেকে এটা সুখী থাকার জন্য যথেষ্ট বলে মনে হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে এটা যথেষ্ট না। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল আর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও হতাশা, দুশ্চিন্তা, আত্মবিশ্বাসের অভাব আর একাকিত্ব থেকে যেতে পারে। তো প্রশ্ন হতে পারে, কেন তারা এরপরও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন না? উত্তরটি খুবই সহজ। ভয়! তাদের মধ্যে ভয় কাজ করে যে এতে তারা চাকরি হারাবেন অথবা অন্যরা তাদের দুর্বল বা অক্ষম ভাববে। কিংবা সহজভাবে মানসিক অসুস্থতা নিয়ে কথা বলা এখনো ট্যাবুর মতো, কিছুটা পাংশু।
অনেকের ক্ষেত্রে এমনও হয় যে তিনি তার সমস্যাটা বুঝতে পারছেন। ডিপ্রেশনে ভুগছেন কিন্তু চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ এতে তার দুর্বলতা সবার সামনে প্রকাশ পাবে। তার চাকরি বা ব্যবসার ক্ষতি হবে। আর তা তিনি এড়াতেই চান। বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার কেট স্পেড এমনই একজন। তিনি বুঝতে পারছিলেন তার সমস্যাটা। কিন্তু তাতে তার ফ্যাশন ব্র্যান্ডের ইমেজ নষ্ট হবে ভেবে তিনি চিকিৎসকের দ্বারস্থ হননি। বরং মদ্যপানকে আশ্রয় হিসেবে নেন। এর দু’সপ্তাহ পরই তিনি আত্মহত্যা করেন।
২০১২ এর ক্যারোলিন্সকা ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদেরকেই মানসিক রোগ বেশি জেঁকে বসে। শিল্পী আর বিজ্ঞানীদেরকেই স্কিৎজোফ্রেনিয়া আর বাইপোলার ডিসর্ডারে বেশি ভুগতে দেখা যায়। শিল্পকলায় কাজ করা ব্যক্তিরা হতাশায় বেশি ভোগেন নাকি হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিরা শিল্পকলার দিকে ঝুঁকে পড়েন সে বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত।
আসলে আমরা ভুলে যাই যে সফল ব্যক্তিরাও রক্তে-মাংসে গড়া সাধারণ মানুষই। পার্থক্য এতটুকুই তারা কঠোর পরিশ্রম করে সফলতা পেয়েছেন। এ পথে তাদের অনেক বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে, অনেক সমালোচনা কানে নিতে হয়েছে। দুশ্চিন্তা বা হতাশা আমাদের মতো তাদেরকেও জেঁকে বসে। গ্ল্যামারাস জীবনের নেপথ্যে নিত্যনৈমিত্তিক সাধারণ ভাবাবেগগুলো অনুভব করার অধিকার তারা হারিয়ে ফেলেন। সবসময় বাড়তি একটা চাপ থাকে ভালো করার। আর এর কোনো শেষ নেই। সফলতার সিড়িতে ব্যক্তি যত উপরে ওঠে, ততই তা বড়ো হতে থাকে। একইসাথে চাপও ততই বাড়ে।
গত ৬০ বছরে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ব্যাপারে অনেক কিছু জানা গেছে। অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তবে মানসিক রোগ নিয়ে কথা বলাটা এখনো ট্যাবুর মতো। এটি আমরা কাটিয়ে ওঠতে পারিনি। অনেক হতাশা আর চাপের মধ্যে থাকলেও জোর করে ‘ভালো আছি’ বলা সমাজের এক অলিখিত নিয়ম; ভদ্রতার পরিচায়ক। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলাখুলিভাবে আলোচনা না করতে পারলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না তা হলফ করেই বলা চলে।
স্পটলাইটে থাকা হতাশাকে উসকে দেয়। মনের ভেতরকার ডামাডোলের মাঝে থেকে বাইরে একটা সুন্দর মুখশ্রী সবসময় ধরে রাখা অনেক কঠিন কাজ। এছাড়া নিজের কর্মকাণ্ড তো সারাক্ষণই চোখে চোখে রাখতে হয়। কারণ কোনো ভুলচুক হয়ে গেলেই পত্রপত্রিকা আর ভক্তদের সমালোচনার বন্যা বয়ে যাবে। এটি তাদের জন্য বাড়তি একধরনের চাপ।
সফল ব্যক্তিরা যা-ই করতে চান, তা আরো ভালো হতে পারতো। তারা সবসময় এমনটা ভাবেন। তারা সফলতা পেয়ে অভ্যস্ত হওয়ায় সবসময়ই সফল হতে চান। তারা নিজেদের জন্য একটা উঁচু একটা সীমা নির্ধারণ করে রাখেন। যা-ই করেন, মনে হয় যেন কোথাও কোনো অপূর্ণতা রয়ে গেছে। কোনো অর্জনই তাদের কাছে যথেষ্ট না।
রবিন উইলিয়ামস বা চেস্টার বেনিংটনের মতো শিল্পীদের জীবনে কী কমতিই বা ছিল? তারা চাইলেই সবচেয়ে ভালো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে পারতেন। কিন্তু তবু পারেননি। এ অবস্থা থেকে এটা সহজেই বোঝা যায় যে মানসিকভাবে কেউ সংগ্রাম করতে থাকলে সাহায্য চাওয়াটাও তার জন্য কতটা কঠিন হয়ে পড়ে। আত্মহত্যার হাই-প্রোফাইল কেসগুলো মাঝে মাঝে অন্যরাও অনুকরণ করে। যেমন: রবিন উইলিয়ামসের আত্মহত্যার পর এর হার ১০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল।
মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে কিংবা আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসলে, সাহায্য চাওয়াটা অনেকের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু তখন যদি কাছের কোনো মানুষ মনের গতিবিধি বুঝে সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দেয়, এটা কারো জীবনও বাঁচাতে পারে। ঠিক একইভাবে আমাদের উচিত প্রিয়জনকে এমন অবস্থায় দেখলে তার বাড়তি খোঁজখবর নেওয়া আর সাহায্য করা।
প্রতিভা, টাকা-পয়সা, যশ-খ্যাতি, সাফল্যের সাথে আত্মহত্যার কোনো সম্পর্ক নেই। জীবনে সফল হয়েও মানসিক সুস্থতা অধরাই থেকে যেতে পারে।
কাছের মানুষকে এরকম অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে দেখলে তাদের কথা ভালোমতো শোনা উচিত, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। কারো আচরণ সন্দেহজনক বলে মনে হলে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
এছাড়া আত্মহত্যা প্রায়ই আবেগতাড়িত। সেই আবেগটা কেটে গেলে, মানুষ সুন্দর জীবনযাপনে ফিরে আসে। উল্লেখ্য, সবসময় এটি আবেগতাড়িত না। মাঝে মধ্যে এটি পূর্বপরিকল্পিত। যা-ই হোক, হাতের নাগালে আত্মহত্যা করার সরঞ্জাম না থাকলে তা অনেকটা আত্মহত্যার হার কমাতে পারে। যেমন: গোল্ডেন গেট ব্রিজে বেড়ি দেওয়ার পর সেখানে আত্মহত্যা সন্তোষজনকভাবে কমে এসেছে। অস্ট্রেলিয়াতেও আগ্নেয়াস্ত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর তা হয়েছে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে তো আলাদা কোনো ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়নি। তবে আমরা যদি আরেকটু সদয় আর সচেতন হই, তাহলে এটি অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব। আমাদের আরেকটা ভুল ধারণা যে আত্মহত্যা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সাথে কথা বললে তার প্রবণতা বাড়ে। আসলে আমরা যদি সহানুভূতি নিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া সেই মানুষটির দিকে এগোই, সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে মন দিয়ে মানুষটির কথা শুনি, তবে হয়তো এটি প্রতিরোধ করতে পারবো।