এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বিখ্যাত উক্তি ধনীদের ঐশ্বর্য বৃদ্ধির পেছনে দরিদ্রের অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত করার নিষ্ঠুর সত্যকে ইঙ্গিত করে। কিন্তু সময়ে সময়ে অনেক দীনবন্ধুর আবির্ভাব হয়েছে, এই পৃথিবীতে যারা উদারহস্তে নিজের সর্বস্ব দান করে গেছেন মানবতার সেবায়। আবার কেউ ধনীর ধন লুট করে বিলিয়ে দিয়েছেন দরিদ্রদের মাঝে। ইংরেজি সাহিত্যের রবিন হুডের কাহিনী শোনেনি এমন মানুষ খুব কমই আছে। আঠারো শতকের এমন একটি চরিত্র এই বাংলাতেই পাওয়া যায়। তিনি হলেন দেবী চৌধুরানী।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের অমর কীর্তিসমূহের অন্যতম দেবী চৌধুরানী উপন্যাসটি। বঙ্কিমচন্দ্রের জাদুকরী লেখার মধ্যে যেকোনো পাঠক নিজেকে হারিয়ে ফেলতে বাধ্য। ঘটনার দৃশ্যবদল মনে হবে চোখের সামনে দিয়ে ঘটে চলছে। আর দেবী চৌধুরানী উপন্যাসের প্রথম শব্দ থেকে শেষ পর্যন্ত নিখাঁদ রোমাঞ্চকর বললে অত্যুক্তি হবে না। একটু সংক্ষেপ জানা যাক সেই কাহিনী।
উপন্যাসের শুরু হয় এক ব্রাহ্মণ পিতৃহীন বিবাহিত মেয়েকে দিয়ে। নাম তার প্রফুল্ল। বিয়ের পরেই তার শ্বশুর বাগদি অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দেন এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য চুরি-ডাকাতি করতে বলেন। সে ফিরে যায় এবং অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ধনীর যম ও দীনের বন্ধু ডাকাত সর্দার ভবানী ঠাকুরের সাথে দেখা হয়।
ভবানী ঠাকুর তাকে গ্রহণ করেন এবং দীর্ঘ পাঁচ বছরে গণিত, দর্শন, বিজ্ঞান ও কুস্তি শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতায় প্রফুল্ল ডাকাতদের রানী হয়ে যায়। সংসার ত্যাগের দশ বছরের মধ্যে সারা বাংলায় সে দেবী চৌধুরাণী নামে পরিচিত হয়।
দেবী চৌধুরানী নিয়মিত ধনীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে দরিদ্রদের সাহায্য করতেন এবং তপস্বী জীবনধারা নিয়ে তার শিকড়ের কাছে নম্র থাকতেন। একবার দেবী তার শ্বশুরকে ফেরত শর্তে অর্থসাহায্য করেন। তার শ্বশুর অর্থ ফেরত না দেওয়ার জন্য ব্রিটিশদেরকে দেবীর অবস্থান সম্পর্কে অবগত করেন। ব্রিটিশ বাহিনী দেবী চৌধুরানীকে ধরতে আসলে ডাকাতদের সাথে সংঘর্ষ হয়। তার উপস্থিত বুদ্ধি ও ধূর্ত পরিকল্পনার ফাঁদে ইংরেজ মেজর বন্দি হয় এবং সর্বনিম্ন প্রাণহানীর সাথে তিনি এটি পরিচালনা করতে সক্ষম হন। পুনরায় বিয়ের শর্তে দেবী চৌধুরানী শ্বশুরকে মুক্তি দিতে রাজি হন এবং স্বামীর সাথে আবারও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ফিরে যাওয়ার সাথে সাথে দেবীকে পরিবারে গ্রহণ করা হয়। পরিবারে ফিরে গিয়ে তিনি দরিদ্রদের সাহায্য করা বন্ধ করেননি, বরং হয়ে ওঠেন গরীবের মা।
উপন্যাসের কাহিনী এ পর্যন্তই গড়ায়। তবে বাস্তবে এই দেবী চৌধুরানী কে তা জানার জন্য অনুসন্ধিৎসু চিত্তে নেট দুনিয়ায় ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। যতদূর বোঝা গেল, দেবী চৌধুরানী সম্পর্কে খুব বেশি ইতিহাস সংরক্ষণ করা হয়নি। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, তিনি রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার শিবুকুণ্ঠিরাম গ্রামের ব্রজ কিশোর রায় চৌধুরী ও কাশীশ্বরী দেবীর মেয়ে জয়দূর্গাদেবী। পীরগাছার জমিদার নারায়ণ চন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে তার বিয়ে হয় এবং সন্ন্যাস বিদ্রোহের সময় তিনি জমিদার ছিলেন।
ইংরেজ সরকারের তৎকালীন নথিতে দেবী চৌধুরানী নামে কেউ জমিদার ছিলেন কি না এ সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। তবে তিনি প্রজাস্বার্থ সম্পর্কে সচেতন এবং সর্বসাধারণের প্রতি উদার থাকার কারণে তার প্রতি তৎকালীন জনসাধারণের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং জনসমর্থন ছিল। ইংরেজরা তাই তাকে ‘নারী ডাকাত’ হিসেবে চিহ্নিত করে।
সেই সময় রংপুর অঞ্চলের কালেক্টর হয়ে আসেন জোনাথন গুডল্যাড এবং দেওয়ান নিযুক্ত করা হয় দেবীসিংহকে। দেবীসিংহের নেতৃত্বে রাজস্ব আদায় শুরু হয়। তাদের অত্যাচারে কৃষক, এমনকি জমিদাররাও অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। অত্যাচারের বিরুদ্ধে সমগ্র উত্তরবঙ্গে ফকীর মজনুশাহ, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী ও নুরুল দীন দুর্জয় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
সমগ্র বাংলা ব্রিটিশদের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রকম্পিত হয়। একের পর এক খণ্ড যুদ্ধ হতে থাকে। ১৭৮৩ সালে দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংঘটিত রংপুর কৃষক বিদ্রোহে দেবীর সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া যায়।
দেবী চৌধুরানী ব্যক্তিগতভাবে বিরাট বরকন্দাজ বাহিনী লালন করতেন। বরকন্দাজ বাহিনীর নাম উপন্যাসেও উল্লেখ করা হয়েছে। তার ও ভবানী পাঠকের সঙ্গে ইংরেজ সেনাপতি লেফটেন্যান্ট ব্রেনানের ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে গোবিন্দগঞ্জের কাছে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ভবানী পাঠক ও তার দল সম্মুখযুদ্ধে ক্যাপ্টেন ব্রেনানের হাতে সদলবলে নিহত হন।
দেবী চৌধুরানীর স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণের অভাবে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। রংপুরের কৈকুড়ী ইউনিয়নের পূর্ব মকসুদ খাঁ হাজীপাড়া গ্রামে দেবী চৌধুরানীর পুরোনো স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। ওখানে ইটের টুকরা ছাড়া আর তেমন কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। এছাড়া পশ্চিমদিকে ঘাঘট নদীর তীরে পশ্চিম মকসুদ খাঁ ডাক্তারপাড়া গ্রামে ছিল আরেকটি স্থাপনা। এই স্থাপনার জায়গাটি এখন ঘন গাছপালায় পরিপূর্ণ। স্থাপনার জায়গা ঘিরে এখনও রয়েছে সেই আমলে তৈরি করা একটি খাল। স্থাপনা দুটি মাটির নিচে ডেবে গেছে অনেক আগেই।
এছাড়া কৈকুড়ী ইউনিয়নের চৌধুরানী বাজারের উত্তর পাশে মসজিদ সংলগ্ন দেবী চৌধুরানীর একটি বিশাল পুকুরের দেখা মিলবে। বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকায় অবস্থিত দেবীগঞ্জ উপজেলা। অনেকের মতে, সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম রূপকার ও খ্যাতিমান নেত্রী দেবী চৌধুরানীর অবাধ বিচরণস্থল ছিল এ এলাকাটি। করতোয়া, তিস্তা, আত্রাই ও কুড়ুম নদীতে ঘেরা এখানকার ঘন বনাঞ্চলে ব্রিটিশদের সাথে তিনি কয়েক দফা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বিজয়ী হন। তার স্মৃতি থেকেই এর নামকরণ হয় দেবীগঞ্জ। তবে এই নামের পেছনে অন্য একটি মতও আছে। এ জনপদটি পূর্বে হিন্দু-অধ্যুষিত ছিল। কেউ কেউ বলেন, তাদের দেব-দেবীর নাম থেকেই দেবীগঞ্জ নামটি আসতে পারে। এছাড়াও রংপুরের দেবী চৌধুরানী রেলস্টেশন, চৌধুরানী ডিগ্রি কলেজ এবং চৌধুরানী বাজার আজও তার স্মৃতি বহন করে চলেছে।
দেবী চৌধুরানীর স্মৃতিচিহ্ন পশ্চিমবঙ্গেও পাওয়া যায়। জলপাইগুড়ি শহর ছুঁয়ে ২৭ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণ করার জন্য জলপাইগুড়ি দেবী চৌধুরানীর কালী মন্দিরের জমির একটি অংশ নেয় প্রশাসন। ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য প্রয়োজন সেই দলিল, যা মন্দির কমিটির হাতে নেই বা এমন কোনো নথি মন্দির কমিটির হাতে আসেনি যা দিয়ে প্রমাণ করা যায় যে মন্দিরটি দেবী চৌধুরানীর। তাই মন্দির কমিটি বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের পাতা হাজির করে প্রমাণ করতে চেয়েছেন নিজেদের কথা!
দেবী চৌধুরাণী সম্পর্কে সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ করা হয়নি। কালের আবর্তে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে চলেছে তার তেজোদ্দীপ্ত ইতিহাস। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস ইতিহাসকে খুব অল্পই ধারণ করে। এমনকি তিনি নিজেই বলেছেন,
দেবী চৌধুরানী গ্রন্থের সঙ্গে ঐতিহাসিক দেবী চৌধুরানীর সম্বন্ধ বড় অল্প। দেবী চৌধুরানী, ভবানী পাঠক, গুড্ল্যাড় সাহেব, লেফটেনান্ট বেনান এই নামগুলি ঐতিহাসিক। দেবী চৌধুরানীকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বিবেচনা না করিলে বড় বাধিত হইব।
ইতিহাস সংরক্ষণ হোক বা না হোক, সময়ে সময়ে দেবী চৌধুরানী, ভবানী পাঠকদের মতো বিপ্লবীদের আবির্ভাব হয়েছে, যারা আড়ালে থেকে অসহায় মানুষদের রক্ষার জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। হয়তো সেই অভিব্যক্তি থেকে সাহিত্য সম্রাট উপন্যাসের শেষে জুড়ে দিয়েছেন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ গীতার একটি শ্লোক,
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।