দাবাপ্রেমীদের কাছে গ্যারি ক্যাসপারভ খুবই পরিচিত একটি নাম। দাবার জীবন্ত কিংবদন্তীদের ভেতর নিঃসন্দেহে তার নাম চলে আসবে। অনেকের মতেই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দাবাড়ু। ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর রাশিয়ান রেডিও ইকো মস্কভিতে দেওয়া ঘণ্টাব্যাপী এক সাক্ষাৎকারে গ্যারি আলোচনা করেন অনেক কিছু নিয়েই। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন মিখাইল তাল। এছাড়াও সোভিয়েত দাবার স্বর্ণোজ্জল দিনগুলো এবং তার পূর্বসূরিদের অনেকের কথাই বলেছেন তিনি। আলোচনা করেছেন আনাতলি কারপভ, অ্যালেক্সান্ডার অ্যালেখাইন, হোসে রাউল কাপাব্লাঙ্কা, বরিস স্পাস্কি, মিখাইল বতভিনিক, ভাসলি স্মিস্লভ, তিগ্রান পেত্রসিয়ান, পাউল কেরেসদের মতো দাবার কিছু মাস্টারমাইন্ডকে নিয়েও। বিশাল এই সাক্ষাৎকারটি নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন। পাঠকের সুবিধার্থে কয়েকভাগে বিভক্ত করে আমরা সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরব। দ্বিতীয় পর্ব গত হয়েছে, আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব।
উপস্থাপক: তালের কথা বলতে গিয়ে আমরা সোভিয়েত দাবার পুরো ইতিহাসই আলোচনা করছি। আপনি আরো দুটি নাম উল্লেখ করেছেন। দুজন দাবাড়ু যারা দাবার সিংহাসন একটুর জন্য মিস করেছেন, পল কেরেস এবং ভিক্টর কোর্চনোই। আপনি কি একমত?
গ্যারি: অবশ্যই। কেরেসকে চিরদিনের জন্য দ্বিতীয় বলা হত, কারণ তিনি কখনোই বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ খেলার জন্য প্রার্থী হওয়ার সেই বাধা অতিক্রম করতে পারেননি। যদিও তিনি ৩০ এর দশকের শেষের দিকে একজন সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, এবং আমি মনে করি শুধুমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তিনি অ্যালেখাইনের সাথে জিততে পারেননি। যদিও তরুণ কেরেসের ফলাফল অ্যালেখাইনকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য যথেষ্ট ছিল। সেসময় কেরেস আর বতভিনিকের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা চলছিল।
বতভিনিক সফল হন। তিনি এই ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সঠিক অবস্থান পেয়েছেন। বতভিনিক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব করেন, কেরেস নিজের জন্য জায়গা খুঁজে পাননি, কারণ তিনি যুদ্ধের সময় এস্তোনিয়ায় বাস করতেন, জার্মান অঞ্চলে। তিনি জার্মান টুর্নামেন্টে খেলতেন, সেখানে আলেখাইনকে মোকাবিলা করতে হত। এবং এটা ছিল কেরেসের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা। তিনি কেন দেশত্যাগ করেননি, এর বিভিন্ন রকম বর্ণনা পাওয়া যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাসের প্রথম বছর তার জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল, এবং বতভিনিককে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো শক্তি তার ছিল না।
কিন্তু তারপর তিনি আর পেরে ওঠেননি। কেউ না কেউ সবসময় একধাপ এগিয়ে ছিল। প্রথমে স্মিসলভ, তারপর তাল, তারপর পেত্রসিয়ান। কেরেস সবসময় টুর্নামেন্টগুলোতে দ্বিতীয় হতেন। কোর্চনোইয়ের ব্যাপারটা আলাদা ছিল, তিনি একটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচ খেলেন। কিন্তু সেটা পরে, যখন তার বয়সের অন্যান্য খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স পড়তির দিকে। কোর্চনোই ৫০ এর দশক থেকেই ইউএসএসআর চ্যাম্পিয়নশিপ খেলেছেন, তিনি ১৯৫৪ সালে রৌপ্য পদকও জিতেছেন। কিন্তু তিনি তাল, পেত্রসিয়ান, স্পাস্কিকে অতিক্রম করতে পারেননি। কোর্চনোই দ্রুত উন্নতি করতে সক্ষম হন যখন তাদের ফলাফলের অবনতি ঘটে, বিশেষ করে ইউএসএসআর থেকে তার অভিবাসনের পর। কোর্চনোই ১৯৭৭ সালে খুব ভাল খেলেছেন।
বয়স্ক হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কোর্চনোই দারুণ খেলতেন। ৫০ এর কাছাকাছি এসেও খুব ভালো খেলেছেন তিনি। যদিও তিনি কারপভকে হারানোর জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলেন না। তবুও দাবায় কোর্চনোইয়ের অবদান বিশাল। যখন তার বয়স ৮০ এর কাছাকাছি, তখনও তিনি সাগ্রহে উদ্ভাবনীভাবে খেলছেন। এটা কৌতূহলোদ্দীপক ছিল, কীভাবে একজন ৭৫ বছর বয়স্ক প্রবীণ তার নাতির বয়সী দাবাড়ুদের পরাজিত করতেন।
উপস্থাপক: এটা প্রচলিত আছে যে, কোর্চনোইয়ের খেলার একটি বিশেষ শৈলী ছিল, খুবই রক্ষণাত্মক খেলতেন তিনি। তাই কি?
গ্যারি: তার খেলা আদর্শ ছিল না, যেমনটা তালের ছিল। এটা ছিল ভারসাম্যহীন। কিন্তু যখন তাল আক্রমণ করতেন, কোর্চনোই সেই আক্রমণ গ্রহণ করতেন। এজন্যই তালের পক্ষে তার বিরুদ্ধে খেলা এত কঠিন ছিল, কোর্চনোই তার আক্রমণের ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতেন না। তাল একটার পর একটা ঝড় সৃষ্টি করতেন, আর কোর্চনোই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতেন, যতক্ষণ না তা শান্ত হয়। কিন্তু ভুলে যাবেন না, এটা তাদের শৈলীর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তাদের খেলার অন্যান্য দিক খারাপ ছিল। কোর্চনোইয়ের কৌশল বয়সের সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়। আশির দশকে তার এন্ডগেম কৌশল এত শক্তিশালী ছিল যে এমনকি কারপভও তার বিরুদ্ধে গুরুতর ঝামেলায় পড়তেন।
উপস্থাপক: সোভিয়েত দাবার সোনালি ইতিহাস সম্পর্কে কিছু বলুন?
গ্যারি: আসলে, ১৯১৭ সালের আগে থেকেই রাশিয়ায় দাবা দ্রুত বিকশিত হচ্ছিল। একটা রাশিয়ান দাবা স্কুল ছিল। চিগোরিন সেসময়কার সবচেয়ে বিশিষ্ট দাবাড়ু ছিলেন, কিন্তু তার আগেও ভাল খেলোয়াড় ছিল, এবং তার হাত ধরে, এ এক নতুন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। তাই সেই সূত্র ধরে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রাশিয়ান সাম্রাজ্যের কিছু প্রতিভাবান দাবা খেলোয়াড় ছিল, শুধু আলেখাইনই নন। উদাহরণস্বরূপ, রুবিনস্টাইন, নিমজোভিচ, এটা পুরো রাশিয়ান সাম্রাজ্য জুড়েই ছিল। বাল্টিক রাষ্ট্র, পোল্যান্ড এগুলো থাকলেও তখন থেকেই রাশিয়া শীর্ষে ছিল। সেখানে জার্মানি ভাল অবস্থানে ছিল, কিন্তু রাশিয়া ছিল সবচেয়ে বিশিষ্ট।
নিয়মিত দাবা টুর্নামেন্ট, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের দুটি সেরা টুর্নামেন্ট ১৯০৯ এবং ১৯১৪ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে আয়োজিত হয়। সেগুলো দাবার উন্নয়নে অনেক অবদান রেখেছে। এবং তারপর এই প্রচেষ্টায় সোভিয়েত সরকারের কারণে বিঘ্ন ঘটে। তারা অনেক তরুণ প্রতিভাবান দাবা খেলোয়াড়দের আকৃষ্ট করে। দাবা এক নতুন, উদীয়মান সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। এর সাথে আবার যোগ হয় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টগুলো। মস্কোতে ১৯২৫ সালে নির্মিত হয় বিখ্যাত সিনেমা চেস ফিভার। অনেক অভ্যন্তরীণ টুর্নামেন্ট ছাড়াও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টও আয়োজিত হতে থাকে। এবং এই সব কিছুর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সমর্থন, দাবার প্রতি মনোযোগ, একটি দাবা স্কুলের উন্নয়ন ঘটায়। এবং এটা বিকশিত হতে থাকে। প্রতিভা সব জায়গাতেই থাকে, শুধু এটা খুঁজে নেয়ার পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে।
দুঃখজনকভাবে, রাশিয়ায় সম্পূর্ণ বিপরীত কিছু ঘটে। পূর্বে বুদ্ধিমত্তাকে খুব গুরুত্ব দেয়া হচ্ছিল এবং এই বুদ্ধিমত্তাকে খুঁজে বের করার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে বুদ্ধিমত্তার প্রতি অনাগ্রহ দাবার উপর প্রভাব ফেলছে। আমি মনে করি, রাশিয়ার জাতীয় দাবা পুরুষ এবং মহিলা দল উভয়ের অবস্থাই পুরোপুরি বিপর্যয়কর।
উপস্থাপক: আমার স্কুলের শৈশবের কথা মনে আছে। আমার ক্লাসে এটা বিবেচনা করা হত যে, যদি আপনি ভাল মার্কস পান, তাহলে আপনার ভাল দাবাও খেলা উচিত।
গ্যারি: এটা কিছুটা সংস্কৃতিরই অংশ ছিল। দাবা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম কলিং কার্ড। হকি, দাবা, ফিগার স্কেটিং এগুলোর ব্যাপারে আমরা জানতাম যে, আমরা সবার চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু এখন, দুঃখজনকভাবে, এর সব হারিয়ে গেছে, প্রধানত এর প্রতি শ্রদ্ধা দ্রুত হ্রাস পেয়েছে, বিশেষ করে সরকারের কাছ থেকে।
উপস্থাপক: সেখানে পাইওনিয়ার প্যালেসসহ বিভিন্ন টুর্নামেন্ট ছিল।
গ্যারি: হ্যাঁ, বস্তুত একটা সিস্টেম ছিল। তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অভিজ্ঞতার সঞ্চার ঘটাত। সেখানে দাবা স্কুল ছিল, সেখানে বতভিনিকের দাবা স্কুল ছিল, পরবর্তীতে যা বতভিনিক এবং কাসপারভের দাবা স্কুল হয়ে ওঠে। সবসময় নবীনদের দ্বারা সেই অতীত অভিজ্ঞতা পাওয়ার একটা সম্ভাবনা চালু ছিল। প্রজন্মের পরিবর্তন বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। তালের কথা বলতে গেলে, আমি ৯ নভেম্বর তালের জন্মদিনে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম।
উপস্থাপক: তালের জন্মদিনে?
গ্যারি: হ্যাঁ। আমার মনে আছে, ৮ নভেম্বর কারপভের সাথে শেষ খেলার আগেরদিন, আমি আমার শিক্ষক বতভিনিক এবং তালের কাছ থেকে ফোন পেয়েছিলাম। বতভিনিক বলেন, তুমি ১২:১১-তে এগিয়ে থেকে প্রমাণ করেছ যে তুমি এই এই ম্যাচের যোগ্য। তিনি খুব অবিচল ছিলেন। তাল এরকম কিছু বলেনি। তিনি শুধু মনে করিয়ে দিলেন, ভুলে যেও না বৎস, আগামীকাল আমার জন্মদিন। প্রজন্মের বন্ধন সবসময়ই ছিল। দাবার দল ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়, ১৯৮০ সালে আমি আমার প্রথম দাবা অলিম্পিয়াড খেলি, এবং তালও সেই দলে ছিলেন।
প্রজন্ম বদলে যাচ্ছিল। এবং এটা পরিষ্কার ছিল, যেকোনো কিছুই সম্ভব, কারণ নতুন প্রজন্ম এসে গেছে। এটা সেসময় ছিল, কিন্তু এখন চারপাশে অনেক প্রতিভাবান দাবাড়ু থাকা সত্ত্বেও, এমন কোনো ব্যবস্থা নেই যা বাবা-মাকে তাদের সন্তানদের মধ্যে একটি দাবা প্রতিভা খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করছে।
উপস্থাপক: কিন্তু আমরা এখন ভালো টেনিস খেলি। এটাও একটা উদাহরণ।
গ্যারি: অনেক টেনিস কোর্ট বানানো হয়েছে, এতে টেনিসের উন্নতি হয়েছে। ফলাফল খুব দ্রুত এসেছে। এটাই প্রমাণ করে যে, প্রতিভা সর্বত্র আছে। শুধু তাদের জন্য চাই উপযুক্ত সিস্টেম।
উপস্থাপক: আমাদের একজন দাবাপ্রেমী প্রেসিডেন্ট দরকার।
গ্যারি: দাবার জন্য আসলে টেনিস বা ফুটবলর মতো খরচও করতে হয় না।
উপস্থাপক: এটা সত্য, বেশি খরচ করার দরকার নেই।
গ্যারি: ১৯৮৯-৯০ সালে যখন শামিল তারপিশেভ তার কার্যক্রম শুরু করেন যা পরবর্তীতে সারা দেশকে গ্রাস করে ফেলে, তখন দেশে ইতোমধ্যে একটি শক্তিশালী দাবার ঘাঁটি ছিল। কিছুই নতুন করে আবিষ্কার করার দরকার ছিল না। ঐ দাবা সেন্টারের অবশিষ্টাংশ এখনও বিদ্যমান। একটা সময় ছিল যখন প্রথম স্থান বাদে বাকি সবগুলোই সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে পরাজয় ছিল। সবচেয়ে কৌতূহলজনক বিষয় হচ্ছে দাবার এই ঐতিহ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য অঙ্গরাজ্যে স্থানান্তরিত হয়েছে।
কিন্তু তারপরেও, সোভিয়েত দাবার ইতিহাস এমন কিছু যা নিয়ে আমরা গর্ব করতেই পারি। এটা লক্ষণীয় যে, কারপভের সাথে আমার হেড-টু-হেড দাবা বোর্ডের সম্পর্ক খুবই উত্তেজনাপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু যখন আমরা আমাদের দেশের হয়ে খেলি, আমরা বুঝতে পারি যে আমরা একটি সাধারণ লক্ষ্য অনুসরণ করছি। এবং একসাথে আমরা বেশ ভালোভাবেই সেই কাজ করেছি।
চলবে …