যদি টাইম ট্রাভেল বা সময় পরিভ্রমণ বলতে কিছু থেকে থাকে, তাহলে কেন আমরা এখন পর্যন্ত কোনো টাইম ট্রাভেলারকে পেলাম না? আর যদি আমরা কোনো টাইম ট্রাভেলারকে পেয়েও থাকি তাহলে কীভাবে বুঝব যে সে সত্যিকার অর্থেই ভিন্ন কোনো টাইমলাইন বা প্যারালাল ইউনিভার্স থেকে এসেছে? টাইম মেশিন কেমন এবং তা কীভাবে কাজ করে? টাইম ট্রাভেলের কোনো নির্ধারিত নিয়ম আছে কি? আর থাকলে যদি কোনো টাইম ট্রাভেলার তা ভেঙে ফেলে তাহলে তার পরিণতি কী হবে?
এই প্রশ্নগুলো মাঝে মাঝেই আমাদের মাথায় ঘুরপাক খায়। এগুলোর উত্তর দিতেই নিজেকে টাইম ট্রাভেলার হিসেবে দাবি করে বসেন এক ব্যক্তি, নাম যার জন টিতোর!
কে এই জন টিতোর
জুলাই ২৯, ১৯৯৮; আর্ট বেল কোস্ট টু কোস্ট এএম নামে একটি প্যারানরমাল রেডিও শো-তে উপস্থাপনা করছিলেন। এমন সময় তার কাছে নিম্নের ফ্যাক্সটি আসে:
নভেম্বর ২, ২০০০; Time-Travel_0 নামে একজন টাইম ট্রাভেল ইনস্টিটিউটের একটি ফোরামে কোস্ট টু কোস্ট রেডিও প্রোগ্রামে দেওয়া মেসেজের মতো আরেকটি পোস্ট করেন:
এরপর থেকে তিনি নিয়মিত জন টিতোর ছদ্মনামে বিভিন্ন আলোচনায় অংশগ্রহণ করা ও মানুষের প্রশ্নের বিভিন্ন উত্তর দিতেন। তিনি দাবি করেন, তার টাইমলাইনে বিখ্যাত আমেরিকান কোম্পানি জেনারেল ইলেকট্রিক টাইম মেশিন তৈরি করেছে। তার ভাষ্যমতে, “আমি একজন সৈনিক এবং আমি ২০৩৬ সাল থেকে এসেছি। ২০১৯ সালে একটি কম্পিউটার ভাইরাস পুরো পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দেবে।“
এই ধ্বংসের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য তাদের দরকার একটি আইবিএম ৫১০০ কম্পিউটার। কম্পিউটারটি নেওয়ার জন্য তিনি ১৯৭৫ সালে ফিরে যেতে চান, কারণ ঐ বছরই কম্পিউটার বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসে। কিন্তু ২০০০ সালে আসার কারণ হচ্ছে একটি সংক্ষিপ্ত আরএন্ডআর(Rest and Relaxation) এবং টাইম ফেব্রিকের প্রচলিত মতবিরোধ ভেঙে নিজের তিন বছরের সত্তাকে দেখতে আসা। টাইম ট্রাভেল নিয়ে তার উত্তরগুলো ছিল বিভিন্ন জটিল অ্যালগরিদম নিয়ে পরিপূর্ণ। তিনি সব সময় বলতেন, টাইম ট্রাভেল সম্ভব এবং অল্টারনেট ইউনিভার্স সত্যিই আছে। তিনি তার টাইম মেশিনের ছবি এবং এর কার্যাবলী ইন্টারনেটে শেয়ার করেন।
মার্চ ২৪, ২০০১;“Bring a gas can with you when the car dies on the side of the road”-
এটাই ছিল জন টিতোরের শেষ কথা। এরপর থেকে তার আর কোনো ধরনের পোস্ট পাওয়া যায়নি। ঠিক যেভাবে ঝড়ের বেগে এসেছিলেন আবার সেভাবে হারিয়ে গেছেন। কিন্তু কেউই জানে না তিনি দেখতে কেমন অথবা তার কন্ঠ কেমন ছিল, শুধু জানে জন টিতোর হচ্ছে একটি ইন্টারনেট সত্তা যে নিজেকে টাইম ট্রাভেলার বলে দাবি করেছিল।
স্টিফেন হকিংয়ের দেওয়া পার্টি
স্টিফেন হকিং আধুনিক তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার একজন পথপ্রদর্শক। সবার মতো টাইম ট্রাভেল নিয়ে উৎসাহ থেকে তিনি ২০০৯ সালে টাইম ট্রাভেলারদের জন্য পার্টি দিয়ে বসেন। শ্যাম্পেন থেকে শুরু করে ক্যাভিয়ার পর্যন্ত ছিল খাবারের মেনুতে। একটি বড় পোস্টার দেয়ালে ঝুলানো ছিল যেখানে লেখা ছিল “ওয়েলকাম টাইম ট্রাভেলার“।
পার্টির মূল বিষয়বস্তু ছিল টাইম ট্রাভেলের সম্ভাব্যতা যাচাই করা। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো তিনি ইনভাইটেশন কার্ড পরে প্রকাশ করেন। এটা করে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, সময় পরিভ্রমণ ভবিষ্যতে সম্ভব হলেও অন্ততপক্ষে অতীতে সম্ভব নয়। তিনি পার্টির ইনভাইটেশন “Into the universe with Stephen Hawking” নামক মিনি সিরিজে প্রকাশ করেন। দুঃখের বিষয় হলো তার পার্টিতে কেউই আসেনি!
স্টিফেন হকিং পরে তার পার্টি সম্পর্কে মজা করে বলেন, “আমি ভেবেছিলাম ভবিষ্যতের কোনো মিস ইউনিভার্স আমার রুমের দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে।” পরবর্তীতে তিনি টাইম ট্রাভেলের নানা বিপদ তুলে ধরেন। ২০১২ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটি টাইম ট্রাভেলের সকল বিষয় নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু স্থান-কালকে বাঁকিয়ে যদি টাইম ট্রাভেল করাও যায়, তখন মহাকর্ষ বলের প্রভাবে এমন একধরনের তেজষ্ক্রিয়তার সৃষ্টি হবে যা স্পেসশিপ এবং পুরো স্পেস-টাইম ফেব্রিককে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।
হয়তো এ কারণেই সম্ভাব্য টাইম ট্রাভেলার আসতে পারেননি বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরো বলেন,
আমি সাধারণ গবেষণা করতে পছন্দ করি। আমার এই ইনভাইটেশন হাজার বছর বেঁচে থাকবে এবং একদিন না একদিন তা টাইম ট্রাভেলারদের চোখে পড়বে।
যদি বিজ্ঞান টাইম ট্রাভেলের সত্যতা প্রমাণ করতে পারে তাহলে তা হবে এক নতুন যুগের সূচনা। আইনস্টাইন সময়কে চতুর্মাত্রিক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। স্থান হচ্ছে ত্রিমাত্রিক, যা আমাদেরকে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা সম্পর্কে জানায়। অপরদিকে সময় আমাদেরকে জানায় দিক। স্থান-কাল এ দুটো মিলে তৈরি হয় স্থান-কাল সন্ততি বা কন্টিনাম যা মহাকর্ষ দ্বারা প্রভাবিত হয়। ধরুন, আপনি একটি মহাকাশযান নিয়ে কৃষ্ণগহবর (যেমন- স্যাগারিটাসে) চারপাশে ঘুরছেন, আর অন্য একটি মহাকাশযান পৃথিবীর চারপাশে ঘু্রছে। সেখানে কৃষ্ণগহবর চারপাশে ভ্রমণরত মহাকাশযানের গতি পৃথিবীর চারপাশে ভ্রমণরত মহাকাশযানের গতির অর্ধেক হবে। অথাৎ এটা করে কৃষ্ণগহ্বরের পাশে কয়েক মিনিটের অবস্থান পৃথিবীতে কয়েক বছর সময় পেরিয়ে যেতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, আমরা আমাদের পৃথিবীতেও কিন্তু টাইম ট্রাভেলারদের দেখি। মহাকাশে অবস্থানরত নভোচারীরা আমাদের বাস্তব জীবনের টাইম ট্রাভেলার। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী মহাকাশযানে তাদের কক্ষপথে উচ্চ ঘূর্ণনগতির জন্য নভোচারীদের বয়স পৃথিবীর মানুষের তুলনায় ধীরে বাড়ে। একে বলা হয় টাইম ডাইলেশন বা সময় প্রসারণ। এর মানে হচ্ছে- যখন তারা পৃথিবীতে ফিরে আসে তখন তাদের স্বাভাবিকের চেয়ে একটু কম বয়স্ক দেখায়, তার মানে তারা একটু ভবিষ্যতে চলে এসেছে। একটু বলার কারণ পার্থক্যটা আসলেই খুবই কম। ছয় মাস ইন্টারন্যাশনাল স্পেস ষ্টেশনে থাকার পরও নভোচারীদের বয়সের সাথে আমাদের বয়সের পার্থক্য মাত্র ০.০০৫। সুতরাং যখন স্বনামধন্য নভোচারী স্কট কেলি তার এক বছর ব্যাপী ইন্টারন্যাশনাল স্পেস অবস্থান শেষে পৃথিবীতে ফিরে আসেন, তখন তার সাথে তার যমজ ভাই মার্ক কেলি, যিনি পৃথিবীতেই ছিলেন, বয়সের পার্থক্য ছিলো মাত্র ০.০১ সেকেন্ড।
ওয়ার্মহোলের মাধ্যমেও সময় পরিভ্রমণ সম্ভব, যদিও তা খুবই ক্ষুদ্র এবং অল্প সময়ের জন্যই এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। তবুও স্টিফেন হকিং আশা করেন একদিন টাইম ট্রাভেলাররা ওয়ার্ম হোল (যেটাকে আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজও বলা হয়) ব্যবহার করে তার পার্টিতে চলে আসবে।
হয়তো টাইম ট্রাভেল বিষয়টা এতটা সহজ নয়। হয়তো তারা পার্টিতে এসেছিল, কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। হয়তো বা অতীতে ফিরে আসা টাইম ট্রাভেলারদের জন্য নিষিদ্ধ। হয়তো টাইম ট্রাভেল ব্যাপারটা এতটাই গোপনীয় যে অল্প কয়েকজনই তা জানে। সকল সম্ভাবনার জবাব তখনই পাওয়া যাবে যখন আমরা একজন টাইম ট্রাভেলারের দেখা পাবো। আশা করি তখন তাকে হকিংয়ের পার্টির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে ভুল হবে না কারোরই!