১
১৫৭৬ সালের মাঝামাঝির দিকে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলায় নিজের নিয়ন্ত্রণ বুঝে নেন।
মুঘল জেনারেল হোসেন কুলি খান তুর্কমান রাজমহলের যুদ্ধে বাংলার পরাজিত বাদশাহ দাউদ খানকে হত্যা করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি আলোচনা চালিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু, মুঘল অফিসারদের চাপে পড়ে তিনি বাদশাহ দাউদ শাহকে হত্যার নির্দেশ দিতে বাধ্য হলেন। বাংলার বাদশাহ দাউদ শাহকে হত্যা করা হলো। ধারণা করা হয়েছিল, এতে আফগানরা একেবারে ঠান্ডা হয়ে যাবে। কিন্তু হলো হিতে বিপরীত।
১৫৭৭ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত আফগানরা হতভম্ব হয়ে কিছুদিন চুপচাপ ছিলো বটে। কিন্তু, চূড়ান্তভাবে তারা দমে যায়নি। দাউদ শাহের বিশ্বস্ত জেনারেল কালাপাহাড়, বাহাদুর বাদাখশি, সুলাইমান মানক্বালি আর ‘ভাটির রাজা’ খ্যাত ঈশা খান নতুন করে বিদ্রোহের ডাক দিলেন। বাংলা আক্ষরিক অর্থেই তখন অশান্ত। ‘খান জাহান’ উপাধীপ্রাপ্ত হোসেন কুলি খান তুর্কমানের ঘাড়ে দায়িত্ব পড়ে বাংলার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা ও বিদ্রোহীদের দমন করা। কিছুটা সফলতা পেলেও তিনি আফগান বিদ্রোহ পুরোপুরি দমন করতে পারেননি।
বাংলা আসলে সুরক্ষিত ছিল এর ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে। জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নদ-নদীর এই অঞ্চল নিজেই যেন এক সুরক্ষিত দুর্গ। তার উপর ভরা বর্ষায় বাংলার বুকে যেন সমুদ্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো। চারদিকে অথৈ পানি। এরকম অঞ্চলে যুদ্ধ করতে বা যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে কোনো ভূমি দখল করে রাখার মতো পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ মুঘল সেনাবাহিনীর ছিল না।
এদিকে এরকম রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থায় ১৫৭৯ সালে মারা যান খান জাহান হোসেন কুলি খান তুর্কমান। পরবর্তী গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পেলেন মুজাফফর খান তুরবাতী। একইসাথে রজভী খানকে (প্রকৃত নাম মীর্জা মীরক) বখশী, মীর আদহাম ও রায় পত্র দাসকে দিউয়ান ও হাকিম আবুল ফতেহকে সদর নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু মুজাফফর খান তুরবাতী নিজের দায়িত্ব পুরোপুরি বুঝে নেওয়ার আগেই বাংলায় মুঘল সেনাবাহিনীর মাঝেই একটি বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। হতভম্ব হয়ে বাংলার নতুন এই সুবাদার লক্ষ্য করলেন পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
২
বিদ্রোহের কারণ ছিল অনেকগুলোই। এর মাঝে একটি কারণ ছিলেন সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় সরকারের দিওয়ান বা অর্থমন্ত্রী খাজা শাহ মনসুর। মানুষ হিসেবে ভালো এবং সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত হলেও ব্যক্তিজীবনে বেশ রূঢ় ছিলেন তিনি। তার আচার-আচরণে অধীনস্থ কর্মকর্তারা খুব বিরক্ত ছিল। অন্যদিকে, বাংলা আর বিহারের মুঘল সৈন্যদের আবহাওয়াগত প্রতিকূলতা ও ব্যয় বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে আকবর এই ফ্রন্টে থাকা সৈন্যদের বেতন বৃদ্ধির ফরমান পাঠিয়েছিলেন। এই ফরমান অনুযায়ী বিদ্রোহপ্রবণ বাংলার সৈন্যদের ১০০% বেতন বৃদ্ধি ও বিহারের সৈন্যদের বেতন ৫০% বৃদ্ধির নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু, খাজা শাহ মনসুর এই অতিরিক্ত ভাতা কমিয়ে যথাক্রমে ৫০ ও ২০ ভাগ হারে বেতন বৃদ্ধি করেন। এতে সৈন্যদের মাঝে চাপা ক্ষোভ জমে ওঠে।
ক্ষোভ বৃদ্ধির আরেকটি কারণ ছিল, সাম্রাজ্যজুড়ে বাধ্যতামূলক ঘোড়ার দাগ প্রচলন করার সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলা আর বিহারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ফুঁসলে উঠলো। মূল বিষয় হলো, সম্রাট আকবর সামরিক ও বেসামরিক দুই খাতকেই মানসবদারি পদ্ধতির আওয়াত নিয়ে এসেছিলেন। সামরিক ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে মূল রাজকীয় বাহিনী ছাড়াও সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অধীনে ছোট ছোট সেনাবাহিনী থাকতো। সেনাবাহিনীর এসব ইউনিটের আকার কর্মকর্তাদের পদমর্যাদার উপরে নির্ভর করতো। এসব বাহিনীর প্রশিক্ষণ, বেতন-ভাতা কোষাগার থেকেই দেওয়া হতো।
ফোঁকরটা পাওয়া গেল এখানেই। মানসবদারি পদ্ধতিতে নিজের বাহিনীর ব্যয়ভার রাষ্ট্র থেকে নগদে পাওয়ার পর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা হিসাবে গরমিল করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া শুরু করলো। দেখা যেত যার অধীনে ১,০০০ সৈন্য থাকার কথা, সত্যিকার অর্থে তার কাছে আছে এর চেয়েও অনেক কম। কিন্তু, নেওয়ার সময় ঠিকই ১,০০০ সৈন্য ভরণ-পোষণের অর্থ নিত। একই সমস্যা ছিলো ঘোড়ার হিসাবের ক্ষেত্রেও। হয়তো থাকার কথা ১০০ ঘোড়া, কিন্তু বাস্তবে ৫০টি ঘোড়াও নেই। নিজেদের ভেতরে অদলবদল করে ১০০ ঘোড়ার হিসাব মিলিয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থ হাতিয়ে নিত তারা। এই কারণেই সেই সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির আমল থেকেই ঘোড়ার কপালে দাগ দেওয়ার পদ্ধতি শুরু হয়। ঘোড়ার কপালে দাগ দিয়ে ঘোড়ার নাম্বার, মালিকের নাম ইত্যাদি তথ্য জুড়ে দেওয়া হতো, যাতে পরবর্তীতে দুর্নীতি না হয়।
আকবর এই পদ্ধতি পুনরায় কঠোরতার সাথে প্রয়োগ করলে বাংলা আর বিহারের কর্মকর্তারা ফুঁসলে উঠে। কারণ তাতে দুর্নীতির রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে।
বিদ্রোহের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, সম্রাট আকবর বাংলা বিজয় করলেও আক্ষরিক অর্থে বাংলার পূর্ব আর দক্ষিণাঞ্চল তখনো সাম্রাজ্যের আওতার বাইরে ছিলো। ভাটিতে ঈশা খার নেতৃত্বে বার ভূইয়ারা নিজেদের প্রতিরোধ শক্ত করছিল। এমনিতেই বাংলার আবহাওয়াগত প্রতিকূল অবস্থা, তার উপর ঈশা খার শক্ত প্রতিরোধে মুঘল সেনাবাহিনী বাংলায় থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। তারা রাজধানীতে ফিরে সুখী জীবন-যাপনের স্বপ্নেই বিভোর ছিল তখন।
৩
তবে সবকিছু ছাপিয়ে বাংলা বিহারে মুঘল সেনাবাহিনীর বিদ্রোহের কারণ হয়ে উঠলেন স্বয়ং আকবর। আকবর ইতোমধ্যেই প্রচন্ড স্পর্শকাতর কিছু বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করলেন, যা কেউই পছন্দ করলো না। এমনকি আকবর এই অপছন্দের বিষয় নিয়ে কারও ধার ধারলেন না, যা শেষ পর্যন্ত বাংলা বিহারের কর্মকর্তাদের চূড়ান্ত বিদ্রোহের দিকে ঠেলে দিতে বাধ্য করলো।
ধর্মবিশ্বাসের দিক দিয়ে সম্রাট আকবরের ব্যক্তিজীবন ঘাটতে গেলে তা বেশ কয়েকটি অংশে ভাগ করা যায়। বুঝ হওয়ার পর থেকে মোটামুটি ১৫৭৪ সাল পর্যন্ত বলা যায় আকবর একজন পূর্ণ মুসলিম ছিলেন। এসময় তিনি ইসলামি নিয়মকানুন মেনে চলতেন, ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলতেন। তবে ১৫৬৫ সাল থেকে সম্রাটের ধর্মীয় চিন্তাজগতে বেশ পরিবর্তন দেখা যায়। তিনি হিন্দুরীতিতে পূজায় অংশগ্রহণ করা শুরু করেন। ধারণা করা হয় এর পেছনে সম্রাট আকবরের হিন্দু ধর্মাবলম্বী স্ত্রীদের প্রভাব ছিল।
সে যা-ই হোক, সমস্ত অঘটনের সূত্রপাত ১৫৭৫ সাল থেকেই। আকবর এই বছর তার নতুন রাজধানী ফতেহপুর সিক্রিতে একটি ইবাদতখানা খুললেন। ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অভিজ্ঞ পন্ডিতদের আলোচনা শুনতেন এখানে আকবর। মুসলিম পন্ডিতদল ছাড়াও হিন্দু, খ্রিস্টান, জৈন, জরথুস্ত্রবাদীরাও এখানে আসার আমন্ত্রণ পেতেন। আকবর তাদের সবার কথাই মন দিয়ে শুনতেন।
সমস্যা হলো, আকবর নিজে পড়তে জানতেন না। অন্যদের আলোচনা থেকেই তিনি শিখতেন। আকবরের দুর্ভাগ্যই বলতে হয়, এসময় আকবরের আশেপাশে এমন কিছু আলেম এসে জুটেছিলেন, যারা ইসলামের চেয়েও নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দিতেন। বিষয়টা আকবরকে বেশ বিব্রত করেছিল। তার উপর ইবাদতখানায় শুরুর দিকে যখন শুধুমাত্র মুসলিম স্কলারদের প্রবেশের অনুমতি ছিল, তখন তারা নিজেদের মাঝে দলাদলিতেই ব্যস্ত থাকতেন। প্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোন বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা তাদের থেকে পাওয়া যেত না। এতে ইসলাম সম্পর্কে আকবরের জ্ঞান অনেকটাই ভাসা ভাসা রয়ে গেল।
একপর্যায়ে আকবর সিদ্ধান্ত নেন, সবগুলো ধর্মের মূলকথা ও ভালো বিষয়গুলো এক করে নতুন একটি ধর্ম তৈরি করবেন! এতে ধীরে ধীরে মুসলিম স্কলারদের মনে ক্ষোভ জমে উঠতে শুরু করল।
অন্যদিকে, মুসলিম স্কলাররা এসময় রাষ্ট্রীয় কাজে নিজেদের মতামত দিতে পারতেন। প্রশাসনেও তাদের বেশ প্রভাব ছিল। আকবর চাচ্ছিলেন রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে। এরই প্রেক্ষিতে আকবর ১৫৭৯ সালের ২২ জুন নতুন একটি নির্দেশনা জারি করলেন। এই নির্দেশনা অনুযায়ী তিনিই হবেন এখন থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের ধর্মীয় অভিভাবক। মানে সম্রাট এখন একই সাথে সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অভিভাবক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। ধর্মীয় বা রাষ্ট্রীয় যেকোনো বিষয়ে তার মতই চূড়ান্ত হবে। এমনকি ধর্মীয় বিষয়ে আকবরকে ইজতিহাদ করার স্বাধীনতাও দেওয়া হয়, যার যোগ্য আসলে আকবর ছিলেন না। ইতোপূর্বে আকবরের ধর্মীয় মতবাদ আর এবারে আলেমদের ক্ষমতা সীমিতকরণ থেকে অনেকেই ধারণা করলেন আকবর নিজের ধর্ম ইসলাম ত্যাগ করতে যাচ্ছেন। ফলে স্কলার আর জনসাধারণের মনে জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ হলো এবার।
১৫৮০ সালে জৌনপুর থেকে কাজী মুহাম্মদ ইয়াজদী আকবর মুরতাদ বা ধর্মত্যাগী হয়ে গিয়েছেন, এই মর্মে ফতোয়া প্রদান করলেন। তিনি হিন্দুস্তানের প্রতিটি মুসলিমকে আহ্বান জানালেন আকবরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে।
৪
বাংলা সীমান্তের অবস্থা তখন বেশ নাজুক। ১৫৭৫ সালের প্লেগে বাংলার মুঘল সেনাবাহিনী যথেষ্ট বিপর্যস্ত। প্রায় ৫০০০ মুঘল সৈন্য আর ১৪ জন জাঁদরেল জেনারেলের প্রানহানীতে মুঘল সেনাবাহিনী কোনো যুদ্ধ ছাড়াই বিধ্বস্ত। প্লেগে মুঘল গভর্নর মুনিম খান পর্যন্ত মারা গেলেন। বিষয়টিকে আকবরের ধর্মবিদ্বেষী কর্মকান্ডের ফল হিসেবে দেখা হলো।
এই বিপর্যয়ের মাঝেই বাদশাহ দাউদ শাহ উড়িষ্যা থেকে কটকের চুক্তি ভঙ্গ করে এগিয়ে এলেন। অন্যদিকে সরাইলের জমিদার ঈশা খান মুঘল নৌবাহিনীর কমান্ডার শাহ বরদীকে পরাজিত করে বাংলার গোটা মুঘল নৌবহর ধসিয়ে দিলেন। ঘটনা এখানে থামলেও হতো। কিন্তু তা না হয়ে শাহ বরদী ভূঁইয়াদের প্ররোচনায় মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করে বসলেন। অবশ্য পরে খান জাহানের কাছে আত্মসমর্পণ করে সাম্রাজ্যের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন। যা-ই হোক, বাংলা-বিহারে আবারও বাদশাহ দাউদ শাহ কররানী নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করলেন। এর পরের বছরেই মুঘল সেনাবাহিনীর হাতে রাজমহলের যুদ্ধে তিনি পরাজিত হলেন ও প্রাণ হারালেন।
দাউদ শাহ প্রাণ হারালেন। কিন্তু বিদ্রোহ চলতে লাগলো তার ঘনিষ্ট ও বিশ্বস্ত জেনারেলদের মাধ্যমে। এই বিদ্রোহে যোগ দিলেন স্বয়ং ঈশা খানও। এদিকে ইতোমধ্যেই নিজের ধর্মীয় মতবাদের কারণে জনসাধারণের মন থেকে আকবর শ্রদ্ধার আসন হারিয়ে ফেলেছিলেন। ফলে ঈশা খানের নেতৃত্বাধীন বার ভূইয়ারা সাধারণ জনগণের সমর্থন পেতে লাগলেন।
৫
নতুন সুবাদার মুজাফফর খান তুরবাতী প্রশাসক হিসেবে যথেষ্ট দক্ষ ও পরীক্ষিত হলেও বাংলার সুবাদারির দায়িত্ব পাওয়ার সময় বেশ বয়স্ক ছিলেন। সাধারণত এ ধরনের সময়ে যা হয়, তা-ই হলো। উদ্যমী হয়ে তিনি বিদ্রোহীদের সাথে তেমন ফলপ্রসু কোনো আলোচনাই করতে পারলেন না, মীমাংসা তো পরের কথা।
অবশেষে বিদ্রোহের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটলো ১৫৮০ সালের ১৯ জানুয়ারি। বিদ্রোহীরা এদিন রাজধানী তান্ডা ত্যাগ করে নদী পাড় হয়ে অন্য পাশে চলে গেলো। বাবা খান কাকশাল, সাঈদ তকবাই, হাজী লঙ্গ, আরব বখশী, সালিহ, মীরকী খান, মুরতুজা কুলী, ফররুখ ইরগালীক প্রমুখ ছিলেন বিদ্রোহীদের নেতা। অন্যদিকে উড়িষ্যায় কিয়া খান, ফতেহাবাদের মুরাদ খান আর সোনারগাঁয়ে অবস্থানরত শাহ বরদী বিদ্রোহীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ না করলেও তাদের আনুগত্যে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ ছিল।
বিদ্রোহী বাহিনীকে দমন করার জন্য মুজাফফর খান তুরবাতী আরেকটি বাহিনী প্রেরণ করলেন। রাজমহলে গঙ্গাকে মাঝখানে রেখে দুই বাহিনী দুই দিকে অবস্থান নিলো। বিদ্রোহীরা অবশ্য আশাবাদী ছিল যে সম্রাট তাদের অভিযোগের সংবাদ শুনে এর প্রতিকার করবেন। তাহলেই আর বিদ্রোহ চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন থাকবে না।
বাংলার এই বিদ্রোহের সংবাদ আকবরের কানে পৌঁছে গেল মুহূর্তেই। আকবর বিদ্রোহীদের অভিযোগ শুনে তা প্রতিকার করার আশ্বাস দিলেন। বাবা খান কাকশালের নিকট প্রেরিত পত্রে তার অনেক প্রশংসা করা হয়। অন্যদিকে মুজাফফর খান তুরাবাতীকে নির্দেশ দিলেন কাকশালদের জায়গীর ফেরত দিতে। আপাতত এতে দুই পক্ষই খুশি হলো। আলোচনার জন্য বিদ্রোহী শিবিরে একটি দল পাঠানো হলো। কিন্তু, এই দলে থাকা রায় পত্র দাসের কিছু লোক বলাবলি করছিলো যে আলোচনার সুযোগে বিদ্রোহী নেতাদের হত্যা করে ফেললেই তো হয়। বিদ্রোহ তাহলে চূড়ান্তভাবে দমন হয়ে যাবে। কোনোভাবে এই কথা বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহীরা বিপদের আশংকা করে পুনরায় আক্রমণাত্মক অবস্থানে চলে গেল!
৬
আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর বিদ্রোহীরা এবার সোজাসুজি বাংলার রাজধানী তান্ডায় আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। মুহাম্মদ বেগ কাকশাল ও হামজাবানের নেতৃত্বে বিদ্রোহীদের একটি বাহিনী নদী পাড়ি দিয়ে তান্ডার দিকে অগ্রসরও হয়। মুজাফফর খান তাদের হাত থেকে রাজধানীকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হন। বিদ্রোহীরা পরাজিত হয়ে পিছু হটে। তবে তারা বারবার সমঝোতার আহ্বান জানাচ্ছিলো।
এদিকে একই দাবীতে বিহারের মুঘল সৈন্যরাও বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলো। এই সম্ভাবনা খুবই প্রবল ছিল যে বাংলা ও বিহারের বিদ্রোহীরা একজোট হয়ে যাবে। কিন্তু, তবুও মুজাফফর খান বিদ্রোহীদের আহ্বানে কান না দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তুললেন। কয়েকদিনের মাঝেই বাংলা আর বিহারের বিদ্রোহীদের মাঝে একটি সহযোগীতামূলক চুক্তি হয়ে গেল।
ইতোমধ্যেই ঘটলো আরেক ঘটনা। বিদ্রোহীরা কাবুলে সম্রাটের ভাই মীর্জা হাকিমের সাথে যোগাযোগ করে আকবরকে সরিয়ে তাকে মুঘল সিংহাসনে বসানোর পরিকল্পনা করে বসে। এর সাথে সাথেই সামান্য দাবী-দাওয়া আদায়ের একটি বিদ্রোহ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি মাত্রা পেলো।
মুঘল সম্রাট আকবরের হাতে এবার শক্ত হওয়া ছাড়া আর বিকল্প কোনো উপায় থাকলো না।
[এই সিরিজের পূর্বে প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে । সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]