প্রায় অর্ধশতক ধরে সৌদি আরবের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি খনিজ তেল। ধূসর মরুর বুকে গড়ে ওঠা সুরম্য অট্টালিকা, কর্মব্যস্ত নগর-চত্বর, বিলাসবহুস সব হোটেল কিংবা রাজকীয় প্রাসাদ- সবই হয়েছে তেল সম্পদকে পুঁজি করে। কিন্তু বৈশ্বিক তেলের বাজারে মন্দা, মজুদ কমে আসা এবং তেলের বিকল্প আবিষ্কারসহ নানাবিধ কারণে পরিবর্তনের পথে হাঁটতে শুরু করেছে দেশটি।
সৌদি যুবরাজ এবং তাকে ঘিরে থাকা লোকগুলো খুব ভালো করেই জানে যে একদিন তাদের তেলের মজুদ শেষ হয়ে যাবে। হয়তো তারও আগে ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাপক প্রচলন ঘটবে। ফলে কমে যাবে তেলের চাহিদা। সবমিলিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সৌদি আরব চাচ্ছে না কেবল তেলের উপরই নির্ভরশীল থাকতে। তাই এখন তারা খুঁজে ফিরছে বিকল্প কোনো পথ।
অর্থনৈতিক চাপের মুখে সৌদি সরকারী কাজে নিয়োজিত মোটা অঙ্কের বেতনধারীদের হাতে দেওয়া সুযোগ-সুবিধা সংকুচিত করে আনা হচ্ছে। অর্থনীতিতে বাড়ছে বেসরকারি খাতের গুরুত্ব। ভবিষ্যতে সেখান থেকেই বেশিরভাগ প্রবৃদ্ধি আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় খাত পর্যটন।
সৌদি আরবের ৩৪ বছর বয়সী বর্তমান যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান, বর্তমান বাদশা সালমানের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান বলে পরিচিত। যুবরাজ অবশ্য ভালো করে জানেন, পরিবর্তনের সময় ঘনিয়ে আসছে খুব দ্রুতই। সৌদি আরবের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের বয়স তার সমান বা তার চেয়েও কম। এছাড়া সরকারি বৃত্তির আওতায় হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করে এসেছে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো থেকে। স্বভাবতই তারা এখন দেশে এসে কর্মের খোঁজ করছে। অথবা ধর্মীয় অনুশাসনের নিগড়ে বাধা স্বদেশে বিনোদনের জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে। অথচ সেদেশে মাত্র কিছুদিন আগেও সিনেমা হল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল।
সৌদি আরবের আয়ের ৯০ শতাংশ আসে তেল বিক্রির মাধ্যমে। এরই মধ্যে যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান ২০১৬ সালে ঘোষণা করেছেন ‘ভিশন ২০৩০’ নামের এক বিশাল মহাপরিকল্পনার, যার নাম গিগাপ্রজেক্ট। মোটা বেতনে গাদা গাদা বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করে তৈরি করা হয়েছে এই মহাপরিকল্পনা। আর এই মেগা প্রকল্পগুলোর একটি হলো সৌদি আরবের বিলাসবহুল বিনোদন নগরী বা এন্টারটেইনমেন্ট সিটি।
কেমন হবে বিনোদন নগরী
সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ থেকে মাত্র ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আল কিদিয়া নামক স্থানে নির্মিত হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এন্টারটেইনমেন্ট সিটি। সেজন্য এই শহরের নামও দেয়া হয়েছে ‘আল কিদিয়া’, যেখানে থাকবে বিনোদনের সব ব্যবস্থা। এই বিনোদন নগরীকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায় সৌদি আরব। এতে বিনোদন, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডসহ সব ধরনের ব্যবস্থা থাকবে। গড়ে তোলা হবে সাফারি পার্ক এবং থিম পার্ক।
সৌদি আরবের তেল নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার জন্য গৃহীত প্রকল্পগুলোর মধ্যে এটি একটি। বিশেষ করে মরুর বুকে পর্যটনশিল্পকে সমৃদ্ধ করার জন্যই এমন পদক্ষেপ। পাশাপাশি বৈদেশিক পর্যটকদের আকৃষ্ট করাও উদ্দেশ্য।
নির্মাণাধীন এই শহরের আয়তন হবে ৩৩৪ বর্গ কিলোমিটার, যা জার্মানির মিউনিখ থেকেও বড়। এমনকি প্যারিস শহরের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বড়। শহরের প্রায় ৩০ শতাংশ জায়গা জুড়ে থাকবে বিভিন্ন স্থাপনা। বাকি জায়গাগুলো সাজিয়ে তোলা হবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। এর ক্রীড়া অংশে থাকবে চোখধাঁধানো কয়েকটি ইনডোর ও আউটডোর স্টেডিয়াম। এছাড়া থাকবে প্রশিক্ষণ একাডেমি, ডেজার্ট ও অ্যাসফাল্ট কার রেসিং, স্নো হাইকিং, বিস্তৃত জায়গা জুড়ে থাকবে বিশাল একটি সাফারি পার্ক এবং একটি থিম পার্ক।
মধ্যপ্রাচ্যের ‘ক্যাপিটাল অফ এন্টারটেইনমেন্ট স্পোর্টস এন্ড আর্টস’ নামে খ্যাত এই বিনোদন নগরীকে সাজানো হয়েছে পাঁচটি স্তরে। চলুন এই পাঁচটি স্তর সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
১. পার্কস অ্যান্ড অ্যাট্রাকশন্স
পার্ক এবং আকর্ষণীয় স্থাপনাগুলো এমনভাবে তৈরি করা হবে যা মানুষের কল্পনাশক্তিকেও ছাড়িয়ে যায়। পরিবার নিয়ে উপভোগ করা যাবে কিছুটা সময়, যা সৌদির মানুষকে নতুন কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করবে, চিন্তার জগৎকে করবে প্রসারিত। এই শহর হবে তাদের চেনা-জানা সৌদি আরবের বাইরে এক অন্য পৃথিবী।
থিম পার্কে থাকবে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী রোলার কোস্টার। এখানকার অ্যাট্রিয়ামে থাকবে বিভিন্ন ধরনের আইকনিক আকর্ষণ। সারা বিশ্বের বিভিন্ন শহরের বিখ্যাত ইভেন্টগুলো পাওয়া যাবে এক শহরের মধ্যেই। থাকবে ২০০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট খাড়া পাহাড়ে মাধ্যাকর্ষণভিত্তিক বিভিন্ন বিস্ময়কর রাইড। সিক্স ফ্লাগস কিদিয়াতে থাকবে ৬টি আলাদা জগত। এগুলো হলো-
• থ্রিলস সিটি,
• ডিসকভারি স্প্রিংস,
• স্টিম টাউন,
• টোবলাইট গার্ডেন,
• ভ্যালি অফ ফরচুন, এবং
• গ্র্যান্ড এক্সপোজিশন।
২. স্পোর্টস অ্যান্ড ওয়েলনেস
কিদিয়াতে তৈরি হবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্পোর্টস হোস্টগুলোর মধ্যে একটি। এখানে থাকবে একাধিক ইনডোর ও আউটডোর স্টেডিয়াম। নারীদের জন্য থাকবে পুরো আলাদা এক ক্রীড়াভুবন। তাদের প্লে-গ্রাউন্ডে প্রবেশ করতে পারবে শুধু নারীরাই। সুস্থ সমাজ গড়তে এবং যুবসমাজকে ক্রীড়ামুখী করাই এর মূল উদ্দেশ্য। এমনিতেই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরব খেলাধুলায় বেশ ভালো করছে। ফিফা বিশ্বকাপ-২০১৮-তে খেলার সুযোগ পেয়েছিল দেশটি। এছাড়া সাঁতার, ভলিবল, হকি, গলফসহ সবগুলোতেই ভালো আন্তর্জাতিক অবস্থানে রয়েছে দেশটি। স্পোর্টস এন্ড ওয়েলনেস অংশটিতে যে সমস্ত আকর্ষণ থাকবে-
• স্টেডিয়াম
• স্পোর্টস হাব
• 18-Hole চাম্পিয়নশিপ গলফ কোর্স
• প্রাইভেট স্পোর্টস স্কুল
• ফিমেল স্পোর্টস এন্ড ওয়েলনেস সেন্টার
• অ্যাকুয়াটিক সেন্টার
‘ফিমেল স্পোর্টস এন্ড ওয়েলনেস সেন্টার’-এ নারীদের ফুটবল, ভলিবল, হকি, বাস্কেটবল, সাঁতার, বক্সিং, গলফসহ সব ধরনের খেলাধুলার জন্য আলাদা আলাদা প্লে-গ্রাউন্ড থাকবে। এটি হবে বিশ্বের বৃহত্তম লিঙ্গভিত্তিক স্পোর্টস হাব।
আল কিদিয়াতে এই স্পোর্টস হোস্টের অবকাঠামো হবে পৃথিবীর সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর এবং অনন্য। ভিআইপি গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা থাকবে। খেলা উপভোগের পাশাপাশি থাকবে বিনোদনের সবরকম ব্যবস্থা। এটি তৈরির মূল কারণ সৌদি আরবের অ্যাথলেটদের দক্ষতা বৃদ্ধি। পাশাপাশি নতুন অ্যাথলেটদের আকৃষ্ট করা এবং পেশাদার ক্যারিয়ার উন্মুক্ত করাও এর লক্ষ্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরব ক্রীড়া খাতে বেশ ব্যয় করছে। বিলাসবহুল এই স্পোর্টস হোস্ট তৈরির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সৌদি আরবের ভাবমূর্তি ও প্রভাব বৃদ্ধি পাবে নিঃসন্দেহে।
৩. মোশন এন্ড মোবিলিটি
এই অংশটিকে বলা হচ্ছে টেকনোলজিক্যাল হোস্ট। কারণ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখানে থাকবে চমকপ্রদ সব ইভেন্ট। যেকোনো দর্শক মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকবেন এসব বিনোদনের প্রযুক্তি দেখে।
এখানে থাকবে এয়ার রেস, মোটর রেস, ড্রোন রেস, গতিশীল ট্যুরিস্ট রেলসহ চমকপ্রদ সব বিনোদনের ব্যবস্থা। বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গড়ে তোলা হবে এই গতিশীল রেসিং ওয়ার্ল্ড। মোশন এবং মোবিলিটি বেশ কয়েকটি চমৎকার ইভেন্টের মাধ্যমে সাজানো হয়েছে। এখানে যেসব ব্যয়বহুল স্থাপনা থাকবে তার মাঝে আছে-
• এয়ার স্পোর্টস এন্ড অ্যারোড্রাম
• প্রফেশনাল রেস ট্রাক
• কার্টিং (Karting)
• ড্রাগ স্ট্রিপ
• রেলিক্রস এন্ড রেলি স্টেজ
• ট্রেনিং ফ্যাসিলিটি
• মোটর স্পোর্টস এন্ড বিজনেস পার্ক
বিনোদন এবং ব্যবসা উভয় ক্ষেত্রকে সামনে রেখেই এই পার্কটি গড়ে তোলা হবে। বিনোদন এবং পেশাদার সুযোগের এই ক্ষেত্রটি একটি উদ্ভাবনী এবং পরীক্ষামূলক মোটরস্পোর্ট ইকোসিস্টেম কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা তৈরি করবে। পাশাপাশি সৌদি আরবের এয়ার রেসারদের এক নতুন ভাগ্য উন্মোচিত হবে।
৪. আর্ট এন্ড কালচার
বর্তমানে সৌদি আরবে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু সিনেমা হল। সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের বিভিন্ন কনসার্টে পারফর্ম করছে পশ্চিমা তারকারা। ফলে সংস্কৃতি চর্চার এক নতুন ক্ষেত্রই উন্মোচিত হচ্ছে দেশটিতে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘আল কিদিয়া’ বিনোদন নগরীতে ‘আর্টস এন্ড কালচার’-এ থাকবে জমকালো সব আয়োজন, যা সৌদি আরবের মানুষসহ সারা পৃথিবীর পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে।
যেসব আকর্ষণীয় স্থাপনা দিয়ে সাজানো হবে স্পোর্টস এন্ড কালচার অংশটি-
• অ্যারেনা
• ক্রিয়েটিভ ভিলেজ
• ফেস্টিভাল গ্রাউন্ড
• পারফর্মিং আর্টস
• মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হল
৫. ন্যাচার এন্ড এনভায়রনমেন্ট
গতানুগতিক মরুর দেশে রুক্ষ আবহাওয়ার মাঝে একটু শান্ত-সবুজ ও স্নিগ্ধ পরিবেশ মেলাটা বেশ ভার। তাই মরুর রুক্ষতা কাটিয়ে একটু সবুজের পরশ মেলাতে বিনোদন নগরীতে তৈরি হবে ‘ন্যাচার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ সেকশন। সাধারণত সৌদি আরবের মানুষেরা মরুতেই অভ্যস্ত। কিন্তু এই অংশে প্রবেশ করলে এক নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করা যাবে। সবুজ-শ্যামলে ঘেরা ন্যাচার এন্ড এনভায়রনমেন্ট বিস্তৃত থাকবে বিনোদন নগরীর প্রায় ৭০ শতাংশ জায়গা জুড়ে।
শহরের কোলাহল ও মরুর শুষ্কতা ছেড়ে সজীব হাওয়ায় একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে আসা পর্যটকরা যেন বিনোদনের সবটুকু বুঝে পায়, সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা থাকবে এখানে। বিভিন্ন ধরনের বিরল প্রজাতির প্রাণী, রঙ-বেরঙের পাখির ঝাঁক, কয়েক হাজার উদ্ভিদসহ মনোরঞ্জনের সব উপাদানই থাকবে। এছাড়া থাকবে ঘোড়া, গাধা ও উটের রাইড।
যেসব স্থাপনা এবং ইভেন্ট দিয়ে সাজানো হবে এই অংশটি-
• ইকোয়েস্ট্রিয়ান সেন্টার
• অ্যানিমেল এনকাউন্টারস
• সিনেক এন্ড ন্যাচারাল এক্সপেরিয়েন্স
• আউটডোর অ্যাডভেঞ্চার এন্ড এক্সপ্লোরেশন
• সাফারি পার্ক এন্ড ইকো-লজ
এই রাজকীয় এন্টারটেইনমেন্ট সিটি দশ সদস্যের বোর্ড অফ ডাইরেক্টরসের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে। বোর্ডের চেয়ারম্যান সেদেশের বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। এছাড়া এই সিটির এক্সিকিউটিভ সিইও হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মাইকেল রিইঞ্জারকে।
এই মেগাপ্রজেক্ট নির্মাণের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবে পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড অব সৌদি আরাবিয়া। এছাড়া অসংখ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এখানে বিনিয়োগ করবে। আমেরিকান এন্টারটেইনমেন্ট কোম্পানি সিক্স ফ্ল্যাগস এখানে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে।