বিচিত্র পৃথিবীতে রয়েছে অবারিত রহস্যের হাতছানি। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল, এরিয়া-৫১‘র মতো বাস্তবিক রহস্য যেমন রয়েছে, তেমনি আছে ইয়েতি, ক্রাকেন, সাসকোয়াশ, বুনিপ, লক নেস মনস্টার, চুপাকাবরা ইত্যাদির মতো রহস্যময় কল্পদানব। এদের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে না থাকলেও মানুষ এদের নিয়ে সবসময় উৎসাহ দেখিয়েছে। জাঁকজমক করে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে এদের খোঁজার জন্য। কিন্তু চিরকালই অধরা থেকে গেছে এই কিংবদন্তিতুল্য জীবগুলো, তারপরও এদের সম্পর্কে মানুষের আগ্রহের কোনো কমতি হয়নি।
স্কটল্যান্ডের ইনভার্নেসের কাছে এক বিশাল হ্রদের নাম নেস। স্কটিশ গেলিক ভাষায় হ্রদকে লক (Loch) বলা হয়, আর উচ্চারণ করা হয় ‘লখ’। এই লক নেসেই এক রহস্যময় কল্পিত দানবের বাস বলে কিংবদন্তী প্রচলিত রয়েছে। অনেকেই তাকে দেখেছে বলে দাবি করলেও প্রাণীটির অস্তিত্ব সম্বন্ধে এখনো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। নেস হ্রদের এই দানবকে ‘নেসি’ বলেও ডাকা হয়। নেসি শব্দের অর্থ হলো ‘পবিত্র’। লক নেস মনস্টারকে আক্ষরিক বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘নেস হ্রদের দানব’। গ্রেট ব্রিটেইনের স্বাদুপানির সবচেয়ে একক বৃহত্তম উৎস এ হ্রদটির আয়তন ২২ বর্গ কিলোমিটার, গভীরতা ৮০০ ফুটেরও বেশি।
নেসি’র উৎস
নেসি’র কিংবদন্তির উৎস খুঁজতে হলে আমাদেরকে অনেক পেছনে ফিরে যেতে হবে, একেবারে সেই প্রথম শতকে। রোমানরা নর্দার্ন স্কটল্যান্ডে পদার্পণ করার পর স্থানীয় পিক্ট জাতির তৈরি পাথরচিত্রে তারা এক অচেনা প্রাণী দেখতে পায়। রোমানরা প্রাণীটিকে বর্ণনা করে ‘পায়ের বদলে ফ্লিপার (সাঁতার কাটার ডানা) বিশিষ্ট দীর্ঘচঞ্চু অদ্ভুত জানোয়ার’ হিসেবে। সে সময় অবশ্য স্কটল্যান্ডে নেসি’র মতো আরও অনেক জলদানবের উপস্থিতির কথা জানা যায়। পুরনো অনেক নথিপত্রেই সাগরে বাস করা বিশালকার সাপ, কেলপি (ঘোড়াকৃতির প্রেতাত্মা), সাগরচারী ঘোড়া ইত্যাদি কাল্পনিক জন্তুর উল্লেখ পাওয়া যায়।
নেসি’র প্রথম লিখিত উল্লেখ দেখা যায় আজ থেকে ১,৫০০ বছর আগে সন্ত কলম্বা নামক এক মিশনারির জীবনীতে। ষষ্ঠ শতকে এ ধর্মপ্রচারক স্কটল্যান্ডে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেন। তিনি দানবটির মোকাবেলা করেন বলে তার জীবনীগ্রন্থে বর্ণনা করা আছে। একদিন ইনভার্নেসের কাছে নর্দার্ন পিক্টের রাজার সাথে দেখা করতে যাওয়ার পথে সেইন্ট কলম্বা নেস লকের ধারে কয়েকজন লোককে একটি লাশ কবর দিতে দেখেন। মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে সঙ্গীরা সেই লকের কোনো এক দানবকে দায়ী করে। সাধুবাবা ‘মন্ত্রবলে’ মৃত লোকটিকে জীবিত করে দেন। এরপর তিনি তার এক চেলাকে সাঁতরে লক পাড়ি দিয়ে অপর পাড় থেকে একটি নৌকা আনতে আদেশ করেন। শিষ্যটি সাঁতার কাটতে গিয়ে সেই জলদানবের মুখে পড়ে।
এবার আবারও নিজের শক্তি দেখান কলম্বা। প্রার্থনার জোরে তিনি দানবটিকে বশ করেন। তার হুকুমে জলদানব শিষ্যকে ছেড়ে দিয়ে গভীর পানিতে অন্তর্ধান করে। চোখের সামনে এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা দেখে উপস্থিত লোকজন তৎক্ষণাৎ সাধুর চরণে আশ্রয় নিয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়। তবে সেইন্ট কলম্বা’র এ ঘটনার কোনো শক্ত প্রমাণ নেই। কলম্বাকে স্কটল্যান্ডে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। মনে করা হয়- তাকে মহৎ, অলৌকিক, শক্তিশালীরূপে প্রচার করার জন্য তার জীবনীতে এমন একটি জলদানবের মিথ্যে গল্প ফাঁদা হয়েছে।
আধুনিক সময়ে নেসিকে নিয়ে আবারও আলোড়ন সৃষ্টি হয় ১৯৩৩ সালে। সে বছর লক নেসের পাড় ঘেসে একটি নতুন রাস্তা তৈরি করা হয়। মে মাসের দুই তারিখ স্থানীয় পত্রিকা দ্য ইনভার্নেস কুরিয়ার এক প্রতিবেদনে জানায়, এক দম্পতি ওই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় নেসিকে দেখেছেন। ব্যবসায়ী জর্জ স্পাইসার ও তার স্ত্রী’র ভাষ্যে-
“তিমির মতো বিশালদেহী এক জানোয়ার পানির ওপর ঘুরপাক খেয়ে হ্রদের শান্ত পানিকে উত্তাল করে তুলছে।”
কয়েক সপ্তাহ পরে আরেক মোটরসাইকেল আরোহী একই দাবি তোলেন। এরপর স্বভাবতই চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। এক সার্কাস-মালিক তো বিশ হাজার পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করেন দানবটি জ্যান্ত ধরে দেওয়ার জন্য। লন্ডনের পত্রিকাগুলো লক নেস এলাকায় সাংবাদিক পাঠাতে শুরু করে। ডেইলি মেইল শিকারী মার্মাডুক ওয়েদেরেলকে নিয়োগ করে নেসিকে ধরবার জন্য। কিছুদিন সন্ধান করার পরে ওয়েদেরেল, ‘নরম পা বিশিষ্ট প্রায় কুড়ি ফুট দীর্ঘ খুব শক্তিশালী’ চৌপেয়ে এক প্রাণীর বড় আকারের পায়ের ছাপ পাওয়ার কথা জানান। তার ওপর ভিত্তি করে ডেইলি মেইল খবর ছাপে এরূপ শিরোনামে: MONSTER OF LOCH NESS IS NOT LEGEND BUT A FACT
পরে অবশ্য ওয়েদেরেলের পায়ের ছাপগুলো ব্রিটিশ মিউজিয়াম অভ ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে জানা যায়, সেগুলো আসলে জলহস্তীর পায়ের ছাপ। একই বছরের নভেম্বর মাসে হিউ গ্রে নামক আরেকজন ব্যক্তি নেসি’র আরেকটি ছবি তোলেন। ছবিটিতেও লম্বা ঘাড়বিশিষ্ট কোনো বড় আকারের প্রাণীর অস্পষ্ট অবয়ব ফুটে ওঠে। সমালোচকেরা দাবি করেন, এটি ছিল মুখে লাঠি আঁকড়ে ধরে কোনো কুকুরের সাঁতার কাটার ছবি।
পরের বছর আবারও নেসি’র ‘দেখা’ মেলে। এবার ডেইলি মেইলে সচিত্র প্রতিবেদন ছাপানো হয় ১৯৩৪ সালের ২১ এপ্রিল। পত্রিকাটির প্রথম পাতায় ছাপানো ‘সার্জনের ফটোগ্রাফ’ নামে খ্যাত এ ছবিতে দেখা যায়, লম্বা ঘাড়সম্বলিত একটি সরু আকৃতির মাথা পানির ওপরে উত্থিত হয়ে আছে। ছবিটি ডেইলি মেইলকে সরবরাহ করেন লন্ডনের সেই সময়ের বিখ্যাত ডাক্তার রবার্ট কেনেথ উইলসন। এ ছবি দেখেই অনেকে নেসিকে প্লেসিওসর বলে মনে করেন। প্লেসিওসর হচ্ছে একধরনের সামুদ্রিক সরীসৃপ। ২০৫ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ালেও ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসরদের সাথে এই প্রজাতিটিও বিলুপ্ত হয়ে যায়।
নেসি হয়তো কোনোক্রমে ওই গণবিলুপ্তি থেকে বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু এখানেও একটি প্রশ্ন থেকে যায়। প্লেসিওসররা ছিল শীতল রক্তের প্রাণী। তাই লক নেসের বরফশীতল পানিতে এ প্রাণীটির এত বছর টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। যা-ই হোক, অনেক বছর পরে ১৯৯৪ সালে প্রমাণিত হয়, ছবিটি আসলে ভুয়া ছিল। সে আরেক গল্প!
ক্রিস্টিয়ান স্পার্লিং নামক এক ব্যক্তি জানান যে, ছবিটি ভুয়া এবং তিনি ঘটনাটির সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। আসলে এই স্পার্লিং ছিলেন দানোশিকারী মার্মাডুক ওয়েদেরেলের সৎপুত্র। ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম যখন তার ছবিকে জলহস্তীর বলে প্রমাণ করে, তখন ওয়েদেরেলকে মানুষের অনেক দুয়ো শুনতে হয়। এমনকি খোদ ডেইলি মেইল পত্রিকায়ও তাকে উপহাস করা হয়। রাগে, দুঃখে বেচারা জনসমক্ষে আসা বন্ধ করে দেন। অপমানের শোধ নেওয়ার জন্য তিনি এক দুষ্টু ফন্দি আঁটেন। উলওয়র্থসের দোকান থেকে কেনা খেলনা টিনের সাবমেরিনের সাথে নকল ঘাড় ও মাথা সংযুক্ত করে সেটিকে লক নেসে স্থাপন করে নিজের পুত্র ইয়ান ও সৎপুত্র স্পার্লিংয়ের সহায়তায় একটি ছবি তোলেন। ছবি তোলার পর মডেলটি ডুবে যায় এবং খুব সম্ভবত এটি এখনো হ্রদের তলায় কোথাও ঘুমিয়ে আছে।
কিন্তু সে ছবি ডাক্তার উইলসনের কাছে কী করে পৌঁছাল? আসলে রবার্ট উইলসন তখনকার বিখ্যাত ডাক্তার ছিলেন। তাই গণমাধ্যমে ছবিটি পাঠানোর জন্য ওয়েদেরেল তাকেই নির্বাচন করেন। কিন্তু ডাক্তার কেন এই মজায় নিজেকে শরিক করলেন, তা রহস্যই থেকে গেছে।
দেখতে কেমন নেসি?
“মেদহীন লম্বা সবুজ রঙের দেহের ওপর কালো কুঁজের ছাপ, লেজবিশিষ্ট, সর্পাকৃতির মাথাওয়ালা আর একটু একটু লাজুক।”
ভিজিটস্কটল্যান্ড ওয়েবসাইটে নেসি’র এমন বর্ণনাই দেওয়া আছে। কিন্তু যেহেতু নেসিকে স্পষ্টভাবে দেখার কোনো প্রমাণ নেই বা কোনো বিশ্বাসযোগ্য ছবিও আজ অব্দি কেউ তুলতে পারেনি, তাই নেসি যে আদতে কী জন্তু- তা জানা অসম্ভব। তবে স্পাইসার দম্পতি নেসিকে লম্বা ঘাড়বিশিষ্ট বলে উল্লেখ করেছিলেন। স্কটিশ দ্য ইনভার্নেস কুরিয়ার পত্রিকার সম্পাদক ইভান ব্যারন তাদের প্রতিবেদনে নেসিকে ‘দানব’ হিসেবে অ্যাখ্যা করেন বলে নেসি’র পরিচয় আজও জলদানবই রয়ে গেছে।
জলদানবের খোঁজে
সেই ১৯৩৪ সালেই সংগঠিত হয়ে নেসিকে খোঁজা আরম্ভ হয়। ২০ জন লোককে দৈনিক দুই পাউন্ড করে দেওয়া হয়েছিল দানবটিকে ‘পাহারা’ দেওয়ার জন্য। কিন্তু কেউই কিছু দেখতে পায়নি। তারপরও নেসি’র পেছনে আরও অনেক অনুসন্ধান অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অনেক শৌখিন তদন্তকারী প্রায় বিরামহীন রাত্রিজাগরণ করে নেসিকে খুঁজেছেন। ১৯৬০-এর দশকে অনেক ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় সোনার (Sonar) প্রযুক্তি ব্যবহার করে লেকটিতে অভিযান পরিচালনা করে। অকাট্যভাবে কোনো প্রমাণ না পাওয়া গেলেও সোনার যন্ত্রে পানির নিচে এমন সব বড় মাপের বস্তুর নড়াচড়া ধরা পড়েছিল, যার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
এরপর ১৯৭৫ সালে বোস্টনের অ্যাকাডেমি অভ অ্যাপ্লাইড সায়েন্স আরেকটি উল্লেখযোগ্য অভিযান পরিচালনা করে। এবার সোনারের পাশাপাশি আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। একটি ছবি বিশ্লেষণ করার পর প্লেসিওসরের মতো কোনো প্রাণীর বিশালাকৃতির ফ্লিপারসদৃশ বস্তু ধরা পড়ে। ১৯৮০ ও ‘৯০-এর দশকে আরও সোনার সন্ধান করেও এ রহস্যের কোনো মীমাংসা হয়নি। ২০০৩ সালে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের (বিবিসি) আগ্রহ ও অর্থায়নে ৬০০টি সোনার বিম ব্যবহার করেও কারও ভাগ্যে কোনো শিকে ছেঁড়েনি। কেলডোনিয়ান খাল নামক একটি প্রশস্ত চ্যানেলের মাধ্যমে লক নেস উত্তর সাগরের সাথে সংযুক্ত থাকায় অনেকে মনে করেন, নেসি বা নেসিসদৃশ প্রাণী হয়তো সাগরে চলে গেছে।
ডিএনএ গবেষণা
নিউজিল্যান্ডের ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক লক নেসের পানি থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তার ডিএনএ পরীক্ষা করেন। এনভায়রনমেন্টাল ডিএনএ শনাক্তের এ পদ্ধতিতে সাবজেক্ট জলাশয়ের বিভিন্ন অংশ থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়। পানিতে বাস করা জীবগুলো যখন চলাচল করে তখন এগুলো শরীরের ত্বক, আঁশ, লোম, মল, প্রস্রাব ইত্যাদি থেকে ডিএনএ’র ক্ষুদ্র অংশ পেছনে রেখে যায়। এরপর এই ডিএনএগুলো বিদ্যমান বৃহৎ তথ্যভাণ্ডারের সাথে মিলিয়ে দেখে জানা যায়, জলাশয়ে কী কী জীব বাস করছে।
অধ্যাপক নিল গেমেলের নেতৃত্বে লক নেসের পরীক্ষায় তিন হাজার ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। এগুলোর বেশিরভাগই ছোট ছোট প্রাণী। এর বাইরে মানুষ, শূকর, হরিণ, কুকুর, গবাদিপশু, পাখি, খরগোশ ইত্যাদির ডিএনএ-ও পাওয়া যায়। কিন্তু প্লেসিওসর বা এরকম কোনো প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর ডিএনএ পাওয়া যায়নি। একইভাবে ক্যাটফিশ বা হাঙরের দাবিও ধোপে টেকে না।
ডিএনএ পরীক্ষায় বোঝা যায়, লক নেসে যথেষ্ট পরিমাণে ইল মাছের উপস্থিতি রয়েছে। এ থেকেই গবেষকেরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, লক নেস মনস্টার আসলে একটি বিশালাকৃতির ইল। অধ্যাপক গেমেল বলেন,
“মানুষ রহস্য পছন্দ করে। আমরা বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেছি লক নেস রহস্যে আরেকটি অধ্যায় যোগ করতে।”
তিনি বলেন,
“আমাদের প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক প্লেসিওসরের ধারণাটি সম্ভব নয়। তেমনিভাবে আমাদের তথ্যভাণ্ডারে কোনো হাঙরের ডিএনএ-ও নেই। নেই ক্যাটফিশ বা স্টার্জনের (বৃহৎ সামুদ্রিক মৎস্যবিশেষ) ডিএনএ।”
ইল প্রসঙ্গে তার মত হলো,
“আমাদের গবেষণায় যথেষ্ট পরিমাণ ইলের ডিএনএ পাওয়া গেছে। বলা যায়, প্রতিটি স্থানভিত্তিক নমুনাতেই ইলের ডিএনএ’র উপস্থিতি রয়েছে- এগুলো হতে পারে হয়তো অসংখ্য ইলের ডিএনএ অথবা বিশালকার কোনো একক ইলের ডিএনএ। যেহেতু এর আকৃতি সম্বন্ধে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই, তাহলে এত এত ডিএনএ পাওয়ার একটা অর্থ হতে পারে যে, লক নেসে কোনো দানবতুল্য ইল মাছের আস্তানা রয়েছে। সুতরাং, আমাদের লক নেস মনস্টার একটা বিশাল আকারের ইউরোপিয়ান ইল, এ ধারণাটি একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না।”
কিন্তু ওই হ্রদে কখনো কোনো বিশাল ইল ধরা পড়েনি। আর সবচেয়ে বড় আকারের ধৃত ইউরোপিয়ান ইলটির ওজন ৫.৩৮ কিলোগ্রাম। গেমেলের অভিমত, হয়তো ইলের আকার আশ্চর্যজনকরকম বড় নয়; কিন্তু তাদের গবেষণায় যে ফলাফল পাওয়া গিয়েছে, তাতে সম্ভাবনাটিকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তবে দানব পাওয়া যাক বা না যাক, লক নেসের সবরকম প্রজাতির একটি শক্তিশালী তথ্যভাণ্ডার যে গবেষণাটির মাধ্যমে তৈরি হয়েছে, তাতে আর সন্দেহ নেই। এ হ্রদের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে এখন আরও বেশি বৈজ্ঞানিক তথ্য আহরণ করা সম্ভব হয়েছে গবেষণাটি দ্বারা।
দাবি নাকচ
লক নেস মনস্টার একটি দানবাকৃতির ইল মাছ- এমন দাবি নাকচ করে দিয়েছেন স্টিভ ফেল্থাম নামক একজন ‘পেশাদার দানো-শিকারী’। ১৯৯১ সাল থেকে নেসি’র খোঁজ করছেন এই ভদ্রলোক। ২৯ বছর ধরে চোখে বাইনোকুলার আর টেলিস্কোপ লাগিয়ে নেসি’র খোঁজে লক নেস তন্নতন্ন করে ফেলার জন্য গিনেস বইয়েও নাম উঠেছে তার। ৫৬ বছর বয়সী এই অনুসন্ধিৎসু নতুন গবেষণাটিকে ‘অ্যান্টি-ডিসকভারি’ বলে অভিহিত করেছেন।
“লক নেসে ইল আছে বলার মানে দাঁড়ায় অনেকটা এরকম যে ‘আমরা দু বছর গবেষণা করে জেনেছি এ হ্রদে মাছ পাওয়া যায়।’ যে কেউ হ্রদে জাল ফেললে বলতে পারবে এখানে ইল পাওয়া যায়। আমি ১২ বছর বয়সে এ হ্রদ থেকে ইল ধরেছিলাম।”
টাইমস অভ লন্ডনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অবশ্য তিনি জানান, জীবনের ২৯ বছর নেসি’র পেছনে ব্যয় করেও তার এতটুকু আফসোস নেই। ফেল্থামের মতে, নেসি খুব সম্ভবত ওয়েলসের স্থানীয় জাতের ক্যাটফিশ, যেটি দৈর্ঘ্যে ১৩ ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে।
উল্লেখ্য, রিভার মনস্টার্স টিভি সিরিজের জেরেমি ওয়েডের বিশ্বাস লক নেসে গ্রিনল্যান্ড শার্কের আবাস রয়েছে। এ হাঙর ২০ ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে আর এদের কোনো পৃষ্ঠপাখনা থাকে না।
লক নেসে সাঁতার কাটতে চান?
চাইলেও পারবেন না। কে জানে, যদি নেসি এসে পা কামড়ে ধরে! অবশ্য আপনি যদি দুঃসাহসী হন, নেসিকে কুছ পরোয়া না করেন, তবুও এ হ্রদে সাঁতার কাটা খুব একটা সম্ভব হবে না। কারণ, নেসের পানি আপনার হাড় কাঁপিয়ে দেবে। বছরে এখানে গড় তাপমাত্রা থাকে ৫° সেলসিয়াস। এ নিম্ন তাপমাত্রার পানিতে সাঁতার কাটতে গেলে নেসি’র কামড় না খেলেও হাইপোথার্মিয়া ঠিক জেঁকে বসবে।
নেসি’র দর্শন পাওয়ার আশা নিয়ে প্রতি বছর প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ লক নেসে ঘুরতে যান। স্কটল্যান্ডের অর্থনীতিতে তা বছরে প্রায় ৪১ মিলিয়ন পাউন্ড অবদান রাখে। আপনিও লক নেস দেখতে যেতে পারেন, কিন্তু খুব সম্ভবত নেসি’র সাথে মোলাকাত হবে না। তাতে ষোলকলা পূর্ণ না হলেও লেকপাড়ের হরিৎশোভা আর লেকের ‘কাকচক্ষুর ন্যায় টলটলে’ পানির অনিন্দ্যসৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। সেইসাথে ছবির মতো সুন্দর, সবুজে মোড়া স্থানীয় গ্রামগুলোতো আছেই।
তবে আপনার কপালগুনে যদি নেসি’র দেখা পেয়ে যান, তাহলে ‘লক নেস মনস্টার সাইটিং রেজিস্টার’-এ তা লিখে রাখতে ভুলবেন না যেন। ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে গ্যারি ক্যাম্পবেল নামক এক ভদ্রলোক নেসি’র সঙ্গে মোলাকাত করেন। পানিতে আলোড়ন দেখে তার বিশ্বাস জন্মে, ওটা নেসি’র অবদান। সে দর্শনের কথা লিখে রাখতে গিয়ে তিনি একটি ওয়েবসাইট চালু করেন। তার এই রেজিস্টারে এখন পর্যন্ত ১১১৮টি দর্শনের কথা উল্লেখ করেছেন বিভিন্নজন। এগুলোর মধ্যে নিউজপেপার রিপোর্ট, পুরনো নথিপত্র, সরাসরি দেখার রিপোর্ট রয়েছে।
অবিনাশী নেসি
গেমেলের পরীক্ষাতে লক নেস দানবের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অন্যান্য পরীক্ষার মতো এর ফলও ‘নেগেটিভ’ এসেছে। তার ফলে নেসি’র অস্তিত্বের সম্ভাবনা আরও ফিকে হয়ে গেছে। কিন্তু তাই বলে নেসিকে প্রামাণিকভাবে বাতিল করে দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়াম অভ ন্যাচারাল হিস্ট্রি’র মতে, আজ পর্যন্ত নেসি’র অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলেই যে তার সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দিতে হবে, তা কিন্তু মোটেও নয়। কারণ, একজন বৈজ্ঞানিক বা অনুসন্ধিৎসু মানুষ হিসেবে যথেষ্ট পোক্ত প্রমাণ ছাড়া কোনোকিছুরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো উচিত নয়। স্মিথসোনিয়ান এনসাইক্লোপিডিয়ায় লেখা আছে, দানবটির কঙ্কাল বা জীবিত আটক হওয়ার মতো শক্ত প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করা উচিত।