যথাযথ দৈহিক বিকাশের পাশাপাশি সুস্থ ও নীরোগ দেহের জন্য চাই সবরকমের পুষ্টি গুণাগুণ সমৃদ্ধ খাবার। শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ, চর্বি আর পানি- খাদ্যের এ ছয়টি পুষ্টি উপাদান প্রাত্যহিক আহারে যথেষ্ট পরিমাণে উপস্থিত না থাকলে দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি তো ব্যহত হবেই, দেখা দেবে নানান জটিলতা। তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা ঠিক করতে হবে পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনা একাই সফল করে দিতে পারে কেবল একটি খাবার, সেটি হলো দুধ।
খাদ্যের ছয়টি পুষ্টিগুণের উপস্থিতির কারণে দুধকে বলা হয় আদর্শ খাবার। প্রতিবেলা আহারে মাত্র এক গ্লাস দুধ খাওয়া মানেই দেহে ভিটামিন এ, বি (১,২,৬,১২), ডি, ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য খনিজ, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট আর ফ্যাটের যোগান দেয়া। কিন্তু পুষ্টিকর খাঁটি গরুর দুধ সহজলভ্য নয় বলে কিংবা অধিক দামের কারণে অনেকেই এটি খেতে পারেন না। তাদের জন্য একটি সহজ সমাধান হলো গুঁড়ো দুধ।
কিন্তু এখানেও রয়েছে বিপত্তি। গুঁড়ো দুধ সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষের মনেই একটি নেতিবাচক ধারণা প্রচলিত আছে যে গুঁড়ো দুধ প্রকৃত গড়ুর দুধের চেয়ে বিকৃত এবং এতে ক্ষতিকর উপাদান থাকে। এরকম নেতিবাচক ধারণার প্রধান কারণ হলো অজ্ঞতা। গুঁড়ো দুধ কীভাবে তৈরি ও প্রক্রিয়াজাত করা হয়, সেটি সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষেরই ধারণা নেই। বাজারের সেরা গুঁড়ো দুধের ব্র্যান্ডগুলো যথার্থ মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে খাঁটি গরুর দুধ সংগ্রহ করে তা থেকে গুঁড়ো দুধ তৈরি করে। ঠিক যেমন বলা যায় শত বছরেরও বেশি সময় দুধ উৎপাদন করে চলা বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান আরলার ডানো গুঁড়ো দুধের কথা।
কঠোর ইউরোপীয় মান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অনুসরণ করেই তারা বাংলাদেশের বাজারে নিয়ে আসে ডানো গুঁড়ো দুধ। তাদের গরুর দুধ সংগ্রহ থেকে শুরু করে ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন প্রক্রিয়া পর্যন্ত পুরোটাই অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং ভোক্তাদের জন্য অবারিত। ডানোর উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত জানবার পর ডানোকে তরল গরুর দুধের এক দারুণ বিকল্প তো মনে হবে!
উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপটি হলো রোগমুক্ত, সুস্থ সবল গরুর খাঁটি দুধ সংগ্রহ। এখানে জেনে রাখা ভালো, এই গরুগুলো লালন-পালনের সময় কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করা হয় না। ফলে দুধেও কোনোরকমের অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি না থাকার বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়, যেটি নিশ্চিত করে ডেনমার্কের পরিবেশ ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ড্যানিশ ভেটেরেনারি ও খাদ্য বিষয়ক প্রশাসন।
গরুর দুধের মান সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্য ডানো তাদের ইউরোপের খামারগুলো থেকে সরাসরি খামারিদের নিকট থেকে এবং বিশ্বস্ত স্থানীয় ও নিজস্ব কালেকশন চেইন থেকে দুধ সংগ্রহ করে। এই খামারিরাই কিন্তু আরলার মালিকানার সরাসরি অংশীদার। আর তাই নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের প্রতি দায়বদ্ধতা ও বিশ্বস্ততার জায়গা থেকেই গরুর লালন পালনের প্রতিটি ধাপে থাকে খামারিদের সর্বোচ্চ যত্নের ছোঁয়া।
দুধ সংগ্রহের জন্য ডানোর থাকে একটি প্রশস্ত কালেকশন নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কের আওতায় প্রতিদিন বড় বড় সব ‘তাপমাত্রা-নিয়ন্ত্রিত কন্টেইনার’-এর মাধ্যমে বিভিন্ন খামার থেকে তরল ও তাজা গরুর দুধ পৌঁছে যায় ডানোর ফ্যাক্টরিগুলোতে। উত্তর ইউরোপের ৭টি দেশের প্রায় ১০ হাজার খামারির কাছ থেকে দুধ নিয়ে সমবায়ে পরিচালিত হয় আরলার দুধ সংগ্রহের কাজ। প্রত্যেক খামারিই মেনে চলেন দুধ উৎপাদন বিষয়ে আরলার নীতিমালা ‘আরলাগার্ডেন’। মালিকানার শরীক হিসেবে এই খামারিরা সরাসরিই সম্পৃক্ত থাকেন দুধের দাম নির্ধারণসহ আরলার মূল কার্যক্রমের সাথে। দুধ সংগ্রহ শেষে শুরু হয় প্রক্রিয়াজাতকরণ।
সংগ্রাহক লরি থেকে দুধ নামিয়ে প্রথমে একটি বিশালাকার ট্যাংকে রাখা হয়। এই ট্যাংকে খনিজ (ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস) ও ভিটামিন (এ, বি, ডি) মিশ্রিত করা হয়। প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রথম ধাপ হলো দুধে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ যোগ করা যেন বাষ্পীভবনের অন্যান্য ধাপে এসব পুষ্টি উপাদান কিছুটা কমে গেলেও তা তরল দুধের সম পরিমাণেই থাকে।
পরবর্তী ধাপ হলো পাস্তরিতকরণ। দুধে উপস্থিত নানারকম ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে এইচটিএসটি বা ‘হাই টেম্পারেচার শর্ট টাইম’ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এ পদ্ধতিতে প্রথমে দুধের তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি করা হয়, প্রায় ১৬১° ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। তবে এ তাপমাত্রায় মাত্র ১৫ সেকেন্ড রেখেই তার চেয়ে দ্রুততায় তাপমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। এতে করে দুধের কিছু ব্যাকটেরিয়া মারা যায় যেগুলো মূলত দুধ দ্রুত নষ্ট হবার জন্য দায়ী।
পাস্তরিত দুধকে এবার একটি ভ্যাকিউম ট্যাংকে স্থানান্তর করা হয় এবং সেখানে ধীরে ধীরে অল্প তাপে বাষ্পীভবন করা হয় যেন এর স্বাদ নষ্ট হয়ে না যায়। পাশাপাশি ফ্যাট ইমালশনের মাধ্যমে এর পুষ্টি গুণাগুণও ঠিক রাখা হয়। ভ্যাকিউম ট্যাংকেই দুধের তরল অংশের শতকরা ৮০ ভাগ শুষে নেয়া হয়। এরপর খানিকটা আর্দ্রতা অবশিষ্ট থাকা সেই দুধকে একটি বড় ইভাপোরেশন ট্যাংকে অত্যন্ত উচ্চ চাপে অল্প অল্প করে অনুপ্রবেশ করানো হয় এবং এর সাথে ২২০° ডিগ্রি তাপমাত্রার গরম বায়ু মিশ্রিত করা হয়। এরপরেও অতি সামান্য পরিমাণ আর্দ্রতা থেকে যায়, যা দূর করবার জন্য এতে সয় লেসিথিন যোগ করা হয়। সয় লেসিথিন এর আর্দ্রতা দূরীকরণের পাশাপাশি এর স্থায়ীত্বও বৃদ্ধি করে।
উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে গেলে গুঁড়ো দুধ বিভিন্ন ওজনের প্যাকেটে ও কৌটায় আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্যাকেটজাত করা হয় এবং মেয়াদ ও মূল্যের সিল সহ বাজারজাত করা হয়। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় সম্পূর্ণ ডানোর নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। ডেনমার্ক হোক কিংবা নাইজেরিয়া বা বাংলাদেশ- ডানো যেসব দেশে কার্যক্রম চালায়, প্রতিটি দেশেই তাদের নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে উন্নত প্রযুক্তি সম্বলিত গবেষণাগার রয়েছে যেখানে প্রতিনিয়ত দুধের মান যাচাই করা হয়, মানোন্নয়নে গবেষণা করা হয়, উৎপাদন প্রক্রিয়া আরো কার্যকরী করার জন্য নতুন প্রযুক্তি তৈরি করা হয়। বাংলাদেশে আসার আগেই, ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, খামার থেকে সংগৃহীত তরল দুধ গুঁড়ো দুধে পরিণত হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে চলে কঠোর মাননিয়ন্ত্রণ। দেশে আসার পর চলে দুই ধাপে মান যাচাইয়ের পরীক্ষা। প্রথমে বন্দরে প্রতিটি লটের চালান পরীক্ষা করে বিএসটিআই, এরপর আবার ফ্যাক্টরিতে পরীক্ষা করে আরলা ফুডস বাংলাদেশ।
ডানোর গুঁড়ো দুধ উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়ায় স্পষ্ট হয় যে, ডানোর গুঁড়ো দুধ আর তরল দুধের মধ্যে পার্থক্য মূলত একটাই, সেটি হলো আর্দ্রতা। তরল দুধের আর্দ্রতা শুষে নিয়ে তাকে গুঁড়ো দুধ হিসেবে বাজারজাত করা হয়। এতে ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো হয়, এমন ধারণা ভুল। বরং ডানোর গুঁড়ো দুধে প্রকারভেদে সাধারণ তরল গরুর দুধের চেয়েও অধিক পুষ্টি উপাদান থাকে। যেমন ফুল ক্রিম গুঁড়ো দুধ সম্পূর্ণই তরল দুধের অনুরূপ। কিন্তু ইনস্ট্যান্ট ফিলড দুধে প্রাণীজ ফ্যাট প্রক্রিয়াকরণ করে বাদ দিয়ে দেয়া হয় এবং তাতে যোগ করা হয় ভেজিটেবল ফ্যাট, যা স্বাস্থ্যকর ।
সেইসাথে ডানোর দুধ শিশুদের দৈহিক বিকাশ ও পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য অতিরিক্ত ভিটামিন, মিনারেল, কোলিন, ভেজিটেবল ওয়েল, সুক্রোজ, ল্যাক্টোজ আর এসিডিটি রেগুলেটর মেশানো হয়।
সবদিক বিবেচনা করলে এধরনের বিখ্যাত ব্র্যান্ডের গুঁড়ো দুধের বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার আসলে কোনো উপায় নেই। এর উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এমন কোনো ধাপই নেই যাতে করে গরুর দুধের গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যাবে। বরং এই গুঁড়ো দুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে পানিতে মেশালে সেটি গরুর দুধের অনুরূপ হয়ে উঠবে, কেননা সুস্থ গরুর সম্পূর্ণ খাঁটি দুধ সংগ্রহের ব্যাপারটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ডানো। আর উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বাড়তি পুষ্টি উপাদানের সংযোজন একে নিয়ে যায় অন্য মাত্রায়।