মেসোপটেমিয়ার টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে আজ থেকে প্রায় ৪,৫০০ বছর আগে গড়ে উঠেছিল সুপ্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা। পৃথিবীর প্রথমদিককার সভ্যতাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। প্রাচীন শহর নিপ্পুরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের সময় বেশ কিছু মাটির ব্লক (ট্যাবলেট) পাওয়া যায়, যাতে সুমেরীয় সভ্যতায় মানব সৃষ্টির গল্প লেখা ছিল। একে ‘এরিডু জেনেসিস’ বলা হয়। গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, আজ থেকে প্রায় ২,১৫০ বছর আগে ‘এরিডু জেনেসিস’ লেখা হয়, তবে অনুমিতভাবেই লোকমুখে এ গল্প বহু আগে থেকে চলে আসছে।
সৃষ্টির শুরুতে
আদিতে ছিল এক ঘূর্ণায়মান জলধারা, নাম্মু। আকাশ, পৃথিবী, স্বর্গ, নরক কিছুই ছিল না তখন। নাম্মু থেকে জন্ম হলো স্বর্গ ও পৃথিবীর যুক্ত সত্ত্বার। স্বর্গের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন আনু, যিনি পুরুষ। পৃথিবীর প্রতিনিধিত্বকারী দেবী কি। আনু ও কি’র মিলনে উৎপত্তি হলো বায়ুদেবতা এনলিলের। বায়ুর জোরে তিনি আনু আর কি-কে আলাদা করে ফেললেন। আনু নিজে ঊর্ধ্বমুখী হলেও সন্তানের সাথে কি নেমে এলেন নিচের দিকে।
নিচে নেমে এসে একসময় এনলিল আর তার মা কি স্থির হলেন। কিন্তু চারদিক বড় অন্ধকার। আলো পেতে এনলিল সৃষ্টি করলেন চন্দ্রের দেবতা নান্নাকে। নান্না আবার জন্ম দিলেন সূর্যদেব, উটুর। এবার এনলিল ও কি-র সম্মিলনে বাতাস আর পৃথিবী এক হয়ে সৃষ্টি করল দেবতা এনকির। তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রভু, গাছপালা আর পানির দেবতা। তার নির্দেশে মাটি চিরে প্রবাহিত হলো শক্তিমান টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদী। পানিতে সাঁতার কাটতে লাগল নানা প্রজাতির মাছ, জমি হয়ে উঠল কৃষিকাজের উপযোগী। ধরণীতে দেবতাদের থাকার জন্য এনকি বানালেন শহর। পত্তন হলো প্রাচীনতম নগরী এরিদু, বাদ-তিবিরা, লারসা আর শুরুপ্পাকের।
কালক্রমে আরো বহু দেবদেবীর পদচারণায় পৃথিবী মুখরিত হয়ে উঠল। তাদের কাজ তারা নিজেরাই করতেন। মাটি কাটা, ঘরবাড়ি বানানোসহ আরো বহু কাজ করতে করতে দেবতারা হয়ে পড়লেন ক্লান্ত। তারা আনুর কাছে আবেদন জানালেন, এই দিনভর কাজ থেকে মুক্তি দিতে। আনু ভেবে দেখলেন, সত্যিই তো, তার সন্তানেরা কাজ করতে করতে মরেই যাচ্ছে!
মানুষের জন্ম
এনকি পরামর্শ দিলেন, দেবতাদের দাস হিসেবে তাদের আকার-আকৃতিতে একটা কিছু সৃষ্টি করবার। যে-ই কথা, সে-ই কাজ। আনুর অনুমতি পেয়ে তিনি এক দেবতাকে হত্যা করলেন। মৃত দেবতার রক্ত-মাংস কাদামাটির ছাঁচে ফেলে এনকি তৈরি করলেন প্রথম মানুষ। এদের পাঠালেন তিনি কাজ করতে, আর দেবতারা মনের আনন্দে আমোদ-প্রমোদে মেতে উঠলেন। মানুষ তাদের সেবা করতে লাগল। বলা হয়, প্রথম মানুষ যেখানে সৃষ্টি হয়েছিল, তার নাম ইডেন- দেবতাদের বাগান। বাগানটির অবস্থান ছিল টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিসের মাঝে কোনো এক জায়গাতে।
মানুষ সৃষ্টির পর কাজ করতে হবে না- এ খুশিতে সব দেবতারা ভোজসভায় মিলিত হলেন। এখানে নেশার ঘোরে এনকি আর প্রজননের দেবী নিন্মাহের মধ্যে তর্ক বেঁধে যায়। এনকি বড়াই করলেন, নিন্মাহ যেভাবেই মানব বানান না কেন, তিনি তার জন্য সমাজে কোনো না কোনো স্থান খুঁজে দিতে পারবেন। নিন্মাহ একে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন। তিনি প্রথমে বানালেন এমন এক মানুষ, যার হাত সারাক্ষণ কাঁপতে থাকে। এনকি তাকে রাজদরবারের সভাসদ করে দিলেন। এবার নিন্মাহ সৃষ্টি করলেন এক অন্ধ ব্যক্তির, এনকি তাকে পরিণত করলেন সুকণ্ঠী গায়কে। নিন্মাহ খুঁড়িয়ে চলা এক লোক তৈরি করলে এনকি তাকে কামারের কাজ দিলেন।
নিন্মাহের রোখ চেপে গেল। তিনি পর্যায়ক্রমে বন্ধ্যা এক মানবী এবং না-পুরুষ, না-নারী এক অস্তিত্বের সৃষ্টি করলেন। প্রতিবারই এনকি তাদের কাজের জন্য কোনো না কোনো উপায় বের করে ফেলেন। হতাশ হয়ে নিন্মাহ চলে যান। এনকি এবার নিজেই এক মানুষ সৃষ্টি করেন, যার শরীর ছিল চরমভাবে বিকৃত। তার কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গই সঠিকভাবে গঠিত ছিল না। নিন্মাহ তাকে দেখে প্রচুর রেগে গেলেন। এনকি স্বীকার করলেন, সৃষ্টির ব্যাপারে নিন্মাহ তার থেকে অনেক ভালো। তারা বুঝতে পারলেন, মানুষকে সঠিক আকারে না বানালে তারা দেবতাদের উপাসনা করবে না।
আরেক বর্ণনায় আছে, দেবতারা ভোজসভাতেই মানব সৃষ্টি করেছিলেন। কি কাদামাটি দিয়ে যাদের বানালেন, তারা কেউ সন্তান জন্মদানে সমর্থ ছিল না। ফলে এনকি নতুন করে আরো কিছু মানুষ সৃষ্টি করলেন। কিন্তু তারা ছিল বেশ দুর্বল। সুমেরিয়ানরা বলত, মানুষের দুর্বলতা আর রোগবালাই দেবতাদের নেশার ঘোরে সৃষ্টি করার ফল।
আডাপার গল্প
প্রথমদিকে মানুষ শিশু জন্মদানে অক্ষম হলেও শীঘ্রই দেবতারা বুঝতে পারেন, মানবসংখ্যা বৃদ্ধি করতে হলে প্রজননের ক্ষমতা দিতে হবে। ফলে প্রথম সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে তারা অ্যাডাপাকে সৃষ্টি করলেন। সে কাজ করত এরিদু নগরীতে। মাছ ধরে দেবতাদের মন্দিরে নিয়ে আসত। দখিনা হাওয়ার দাপটে একবার মাছ ধরতে গিয়ে সে দুর্বিপাকের শিকার হয়। ত্যক্ত-বিরক্ত অ্যাডাপা বায়ুকে অভিশাপ দিলে তার ডানা ভেঙে যায়। এতে করে দক্ষিণ বাতাসের উপকারিতা থেকে এরিদুর লোকেরা বঞ্চিত হতে থাকে। আনু অ্যাডাপাকে জবাবদিহিতার জন্য ডেকে পাঠালে এনকি তার প্রিয় সন্তানকে কিছু বুদ্ধি শিখিয়ে দিলেন।
সেই মোতাবেক অ্যাডাপা শোকের পোশাকে আনুর সামনে হাজির হলেন, যাতে দেবতাদের দেবতা তার প্রতি নমনীয় হন। আনু খুশি হয়ে তাকে স্বর্গীয় রুটি আর পানি দিতে চাইলে আডাপা এনকির পরামর্শমতো তা গ্রহণে অপারগতা জানিয়ে আনুর কাছে তেল চেয়ে নিলেন। আনু কৌতুক বোধ করলেন, তবে তিনি সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করেন।
স্বর্গীয় পানি আর রুটি গ্রহণ করে দেবতারা অমর থাকতেন। তাই তা খেয়ে আডাপাও হয়ত অমর হয়ে যেতেন। এর বিশ্লেষণে বেশ কয়েকটি মতের একটি হলো, এনকি চাননি মানবজাতি দেবতাদের মতো অমর হয়ে উঠুক। আবার অনেকে বলেন, দেবতাদের খাদ্য নশ্বর মানবের জন্য নয়। যে রুটি আর পানি দেবতাদের চিরদিন বাঁচিয়ে রাখবে, সেই খাদ্যই মানব শরীরকে নিমেষে হত্যা করবে। যা-ই হোক না কেন, স্বর্গ থেকে অ্যাডাপা নেমে এলেন সুস্থভাবে। মানুষকে শোনালেন আনু আর এনকির মহিমার কথা।
দ্য গ্রেট ফ্লাড
মহাবন্যা বা গ্রেট ফ্লাড প্রাচীন বেশ কিছু সভ্যতার পুরাণে পৃথিবীসৃষ্টির গল্পের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সুমেরীয় উপকথা সেগুলোর মাঝে একটি। জিয়ুদসুরা তখন সুমেরের রাজা আর প্রধান পুরোহিত। দেবতারা সিদ্ধান্ত নিলেন, মানবজাতি বড়ই বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে। ফলে তারা বিশাল এক বন্যার তোড়ে তাদের ভাসিয়ে দিতে মনস্থ করলেন। এনকির কাছ থেকে সে সংবাদ পেয়ে জিয়ুদসুরা তার দেখানো পথে বিরাট এক নৌকা বানালেন। সব জীবজন্তুর থেকে এক জোড়া সেখানে তোলা হলো। এরপর স্ত্রীকে নিয়ে জিয়ুদসুরাও উঠে পড়লেন।
সাত দিন, সাত রাত প্রচণ্ড ঝড় হলো। জিয়ুদসুরা ছাড়া সব মানুষ তলিয়ে গেল। এরপর সূর্যদেব মাথা জাগালে জিয়ুদসুরা তার উদ্দেশে একটি ষাঁড় ও ভেড়া উৎসর্গ করেন। ঝড় থেমে গেলে তিনি শান্ত পৃথিবীতে নেমে এলেন এবং আনু ও এনলিলের সামনে নতজানু হন। দেবতারা তার প্রতি খুশি হয়ে তাকে নিজেদের মাঝে স্থান দেন। তার বংশধরেরাই পৃথিবী শাসন করতে থাকেন।
এই সিরিজের পূর্বের লেখাগুলো পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে: