যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপলিস শহরে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের জের ধরে দেশটিতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে বিক্ষোভ। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই অপেক্ষায় ছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বক্তব্যের। কারণ, তিনিই যে ২০০৮ সালে আশা এবং পরিবর্তনের বার্তা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সময়ের প্রয়োজনে মুখ খুলেছেন ওবামা। ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে চলতি আন্দোলনের ভেতরই আশার আলো দেখার কথা জানিয়েছেন তিনি। এ আন্দোলন থেকে কীভাবে সত্যিকারের পরিবর্তন নিয়ে আসা যায়, সে ব্যাপারেও তিনি দিয়েছেন কিছু মূল্যবান পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য থাকছে তার সেই লেখার বাংলা অনুবাদ।
দেশজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। তারা সরব হচ্ছে জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে। তারা কথা বলছে বিচার ব্যবস্থার অসাম্যতা নিয়ে চলমান সমস্যা প্রসঙ্গে। এরই মধ্যে অনেকেই আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। তাদের প্রশ্ন, কীভাবে আন্দোলনের এই গতিকে কাজে লাগিয়ে সত্যিকারের পরিবর্তন নিয়ে আসা যায়।
দিনশেষে আসলে গোটা বিষয়টিই নির্ভর করছে নতুন প্রজন্মের আন্দোলনকারীদের উপর। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তারাই সঠিক কৌশলটি বেছে নেবে। তবে আমার বিশ্বাস, ইতোপূর্বের কিছু প্রচেষ্টাকে স্মরণ করে, সেগুলো থেকেও আমরা মৌলিক কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।
প্রথমত, দেশব্যাপী যে প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে, সেটি কিন্তু মানুষের সত্যিকারের এক হতাশার প্রতিনিধিত্ব করে। সেই হতাশার কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ ব্যবস্থা, কিংবা আরো বৃহত্তর অর্থে, অপরাধ বিচার ব্যবস্থার সংস্কার আনয়নে ব্যর্থতা। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সিংহভাগই অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ, সাহসী, দায়িত্ববান, এবং উৎসাহব্যঞ্জক। তারা আমাদের শ্রদ্ধা ও সম্মানের দাবিদার। অথচ ক্যামডেন ও ফ্লিন্টের মতো শহরগুলোর পুলিশ উল্টোটা বুঝে আসছে। ভাবছে, এই মানুষগুলোর প্রতি বুঝি তাদের নিন্দাজ্ঞাপনই কর্তব্য।
অপরদিকে সংখ্যায় নিতান্তই মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের দেখাও মিলছে, যারা বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার জন্ম দিচ্ছে। তাদের এই কাজের নেপথ্যে হয়তো রয়েছে প্রকৃত ক্রোধ। কিংবা তারা হয়তো নিছকই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। তবে সে যা-ই হোক, তারা নিরীহ মানুষকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। যেসব এলাকায় ইতোমধ্যেই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে, ফলে বিভিন্ন পরিষেবা ও বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে, সেগুলো আরো ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
আমি আজই এক কৃষ্ণাঙ্গ বৃদ্ধার সাক্ষাৎকার দেখলাম। তার চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত। কারণ তার এলাকায় যে একটিমাত্র মুদির দোকান ছিল, সেটিও তছনছ করে দেয়া হয়েছে। যদি ইতিহাস থেকে কোনো দিকনির্দেশনা মেলে, তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি, ওই দোকানটির পূর্বাবস্থায় ফিরতে বহু বছর সময় লেগে যাবে। তাই দয়া করে সহিংসতাকে বৈধতা প্রদানের চেষ্টা করবেন না। এর পেছনে যুক্তি খুঁজবেন না। এবং নিজেরা এতে অংশও নেবেন না। আমরা যদি চাই, আমাদের অপরাধ বিচার ব্যবস্থা, কিংবা সামগ্রিকভাবে আমেরিকান সমাজ উচ্চতর নৈতিকতায় পরিচালিত হয়, তবে সেই নৈতিকতার দৃষ্টান্ত আমাদের নিজেদেরকেই স্থাপন করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমি শুনেছি কেউ কেউ বলছে, আমাদের অপরাধ বিচারব্যবস্থায় বিদ্যমান বর্ণবৈষম্য থেকে নাকি এটিই প্রমাণিত হয় যে, বিক্ষোভ ও সরাসরি আক্রমণই পরিবর্তন বয়ে আনার একমাত্র উপায়। তারা আরো বলছে, ভোটপ্রদান কিংবা নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নাকি নিতান্তই সময়ের অপব্যয়।
আমি এই চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করছি। আন্দোলনের লক্ষ্য হলো জনসচেতনতা বৃদ্ধি, অন্যায়-অবিচারগুলোকে পাদপ্রদীপের আলোর নিচে নিয়ে আসা, এবং ক্ষমতায় যারা আছে, তাদের অবস্থানকে নড়বড়ে করে দেয়া। প্রকৃতপক্ষে, আমেরিকার গোটা ইতিহাস জুড়েই দেখা যায়, কেবল প্রতিবাদ ও জন-অসহযোগের প্রতিক্রিয়াস্বরূপই রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলোর সমস্যাগুলোকে আমলে নেয়। তবে শেষ পর্যন্ত, দাবি-দাওয়াগুলোকে কিছু নির্দিষ্ট আইন এবং প্রাতিষ্ঠানিক চর্চাতেই অনূদিত করতে হবে। এবং একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, সরকার নির্বাচনের মাধ্যমেই শুধু এ দাবি-দাওয়াগুলো আদায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব।
তাছাড়া এটিও আমাদের জন্য উপলব্ধি করা জরুরি যে, কোনো পর্যায়ের সরকারের পক্ষে পুলিশ ও অপরাধ বিচার ব্যবস্থার উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছি, যারা রাজনীতির কথা ভাবতে বসে কেবল প্রেসিডেন্সি কিংবা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের উপরই আমাদের যাবতীয় মনোযোগ ব্যয় করি। একথা অবশ্যই সত্যি যে, আমাদের লড়াই করতে হবে একজন প্রেসিডেন্ট, একজন কংগ্রেস, একটি বিচার বিভাগ এবং একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারকগোষ্ঠীর জন্য, যারা আমাদের সমাজে চলমান বর্ণবাদের ভয়াবহতা আঁচ করতে পারে এবং এর বিরুদ্ধে কিছু করতেও চায়। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, পুলিশ বিভাগ এবং অপরাধ বিচার ব্যবস্থার সংস্কারে যাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, তারা কাজ করে রাষ্ট্রীয় ও স্থানীয় উভয় পর্যায়েই।
প্রতিটি শহরের মেয়র এবং কাউন্টি নির্বাহীরাই কিন্তু অধিকাংশ পুলিশ প্রধানকে নিয়োগ দিয়ে থাকে। এবং তারাই পুলিশ ইউনিয়নগুলোর সাথে বিভিন্ন চুক্তিতে সমঝোতার জন্য দরাদরি করে থাকে। এদিকে জেলা অ্যাটর্নি এবং রাষ্ট্রীয় অ্যাটর্নিরা ঠিক করে, কোনো ঘটনার তদন্ত করা হবে কি না, এবং পুলিশের মধ্যে কারো অসদাচরণের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কি না। এ সকল পদেই নির্বাচন হয়। কিছু কিছু জায়গায় পুলিশদের আচরণবিধি মনিটরিং করে যে রিভিউ বোর্ড, সেগুলোর জন্যও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, স্থানীয় পর্যায়ের এসব নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ থাকে খুবই নগণ্য। অনেক ক্ষেত্রে মাত্র কয়েক হাজার, কখনো কখনো আবার কয়েকশো ভোটেও, এসব পদের জন্য প্রার্থী নির্বাচিত হয়। অথচ ভেবে দেখুন, এসব নির্বাচনে নির্বাচিতদেরই কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন সামাজিক বিচার ইস্যুতে প্রধানতম ভূমিকা পালন করার কথা।
মোদ্দাকথা হলো, আমরা যদি সত্যিকারের পরিবর্তন চাই, সেক্ষেত্রে আমাদের প্রতিবাদ ও রাজনীতির মধ্য থেকে যেকোনো একটিকে বেছে নিলে চলবে না। আমাদের প্রয়োজন দু’টিকেই। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের রাস্তায় নামতে হবে যেমন, ঠিক তেমনই আমাদেরকে ব্যালটের লড়াইয়েও শামিল হতে হবে, যেন আমাদের আকাঙ্ক্ষিত সংস্কারগুলো কার্যকর করার মতো যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হয়।
সর্বশেষ কথা হলো, অপরাধ বিচার ও পুলিশ ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য আমাদের দাবিগুলোকে আমরা যত বেশি নির্দিষ্ট করে তুলব, নির্বাচিত কর্মকর্তাদের জন্যও কাজটি ততই কঠিন হয়ে যাবে। কারণ তখন তারা কেবল মৌখিক আশ্বাস দিয়েই পার পাবে না। প্রতিবাদের তেজ কমে আসা মাত্রই তারা তাদের চিরচেনা রূপে ফিরে যেতেও পারবে না।
সংস্কারের বিষয়সূচি ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হবে। একটি বড় শহরের হয়তো এক ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, আবার একটি মফস্বল শহরের প্রয়োজন অন্য আরেক ধরনের সংস্কার। কিছু এজেন্সির প্রয়োজন পড়বে পুরোদস্তুর পুনর্বাসনের জন্য। এদিকে অন্যদের সামান্য কিছু উন্নয়নেই চলবে। প্রতিটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সুস্পষ্ট কিছু নীতিমালা থাকতে হবে। তাদের মধ্যে থাকতে হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ একটি অংশ, যেটি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত চালিয়ে দেখবে।
প্রতিটি সম্প্রদায়ের সংস্কারের জন্য প্রয়োজন হবে কিছু স্থানীয় কর্মী ও সংগঠনের। তারা গবেষণা চালাবে, এবং নিজ নিজ সম্প্রদায়ের বাদবাকিদের জানাবে কোন কৌশলগুলো তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো কাজে দেবে।
আমি জানি বিগত কয়েকমাস ছিল খুবই কঠিন এবং সংশয়ময়। মহামারির ভীতি, দুঃখ ও অনিশ্চয়তা আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছিল। এরই মাঝে আমেরিকান সমাজব্যবস্থার পক্ষপাতিত্ব ও অসাম্যের বিষয়টি পুনরায় আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। সব মিলিয়ে গোটা পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে আরো খারাপ।
তবে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তরুণ প্রজন্মের বিক্ষোভ ও আন্দোলন দেখে আমি ফের আশাবাদী হয়ে উঠেছি। আমাকে আরো আশান্বিত করেছে জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের এগিয়ে আসার বিষয়টি। যদি সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে আমরা আমাদের যুক্তিসঙ্গত ক্ষোভকে শান্তিপূর্ণ, টেকসই ও কার্যকর পদক্ষেপে রূপান্তরিত করতে পারি, তাহলে এই মুহূর্তটিই হয়ে উঠতে পারে আমাদের জাতির সর্বোচ্চ আদর্শকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পথে সত্যিকারের টার্নিং পয়েন্ট।
তাই চলুন, এই লক্ষ্য নিয়েই কাজ শুরু করি।