আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড থর্নডাইক ১৯২০ সালে তার ‘দ্যা কনস্ট্যান্ট এরর ইন সাইকোলজিক্যাল রেটিংস’’ পেপারে একটি মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা বর্ণনা করেছিলেন। এ পরীক্ষায় সামরিক বিভাগের কয়েকজন কম্যান্ডিং অফিসারকে তাদের অধীন সৈনিকদের বিভিন্ন রকম দক্ষতা মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছিল। এই দক্ষতার ক্যাটাগরির মধ্যে অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত ছিল: নেতৃত্ব, শারীরিক গঠন, বুদ্ধিমত্তা, বিশ্বস্ততা, নির্ভরতা ইত্যাদি। থর্নডাইকের উদ্দেশ্য ছিল একটি নির্দিষ্ট দক্ষতার মূল্যায়ন কীভাবে অন্যসব বৈশিষ্ট্য মূল্যায়নে প্রভাব ফেলে সে ব্যাপারে অনুসন্ধান করা। তার এই অনুসন্ধান থেকে বের হয়ে এসেছে, কারো প্রথম যে গুণটি মানুষ লক্ষ্য করে তা যদি ইতিবাচক হয় তাহলে তার অন্যান্য বৈশিষ্ট্যকে সাধারণত অতিরিক্ত মূল্যায়ন করা হয়। উদাহরণ দেওয়া যাক।
কোনো সুদর্শন মানুষের সাথে পরিচিত হতে গেলে আমরা তার বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে ধরে নিই যে, তার ব্যক্তিত্বের অন্যান্য সব বৈশিষ্ট্যও ইতিবাচক হবে। আমরা নিজে থেকে এটা ভেবে নেওয়ার প্রবণতা দেখাই যে, লোকটি বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ এমনকি নীতিগতভাবে একজন ভালো মানুষ। বেশিরভাগ সময়েই আমরা চিন্তা করি না যে, এসব বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত তথ্য আমাদের হাতে নেই। অর্থাৎ, এমন কোনো ঘটনার সম্মুখীন হইনি যেখান থেকে মানুষটি বুদ্ধিমান কিংবা নৈতিকভাবে ভালো এই বিচারটি আমরা করে ফেলতে পারি। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক কারো ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণ করার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার প্রবণতা দেখায়। এভাবে আমরা একটি ভ্রান্তির শিকার হই।
থর্নডাইকের পরীক্ষায় দেখা গেছে, অফিসাররা তাদের সৈনিকদের প্রতি নিজেদের ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে তাদেরকে বিচার করছিল। বিচার করার প্রতিটি বৈশিষ্ট্য থেকে সৈনিকের প্রতি নিজের ব্যক্তিগত অনুভূতি আলাদা করতে না পারায় তাদের বিচারে সহজেই ভ্রান্তি ঢুকে গেছে যা তাদের এই বিচারকে মিথ্যা ও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। বিচারের সম্পূর্ণ ভ্রান্তিটি থর্নডাইক তার পেপারে ব্যাখ্যা করেছিলেন। পরে, ১৯৩৮ সালে এস. এম. হার্ভি ভ্রান্তিটির নাম দিয়েছিলেন ‘হেলো ইফেক্ট’। এই নামটি উপমা হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ধর্মীয় চিত্রগুলোতে দেখা যায়, সাধু বা পবিত্র কারো মাথার সাথে একটি আলোর বলয় আঁকা থাকে যেটা দ্বারা স্বর্গীয় মাহাত্ম্য বুঝানো হয়। হেলো ইফেক্ট দিয়ে কাউকে বিচার করতে গেলে তার একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য এরকম অবচেতনভাবে আমাদের মনে এরকম একটি আলো ছড়ায় যার ফলে তার অন্যান্য নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো ঢেকে যায়। সবকিছুই সেই আলোর মাহাত্ম্যে ইতিবাচক হয়ে আমাদের চোখে ধরা দেয়। মানুষটিকে তখন সামগ্রিকভাবে একজন গুণী ও ভালো মানুষ মনে হয়।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, হেলো ইফেক্ট হচ্ছে একটি ভ্রান্তি যার ফলে কোনো মানুষের একটি নির্দিষ্ট গুণ তার অন্য সব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করে। এই ভ্রান্তি শুধু মানুষ নয়, যেকোনো পণ্য কিংবা ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রেও হতে পারে। বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায়, যে মানুষ সহজে অন্যের সাথে মিশে যেতে পারে তাকে সবাই পছন্দ করে। একইসাথে তাকে বুদ্ধিমান, নৈতিকভাবে ভালো ভাবা হয়। কিন্তু আলাপী মানুষ মাত্রই বুদ্ধিমান নয় এই চিন্তাটি বেশিরভাগ মানুষই এড়িয়ে যায়। সবচেয়ে ভালো একটি উদাহরণ হচ্ছে, বিখ্যাত লোকদের প্রতি আমাদের অনুভূতি। যেহেতু তাদেরকে আমাদের কাছে অনেক আকর্ষণীয় মনে হয়, আমরা ধরে নিই তারা একইসাথে উদার, বিচক্ষণ ও ভালো মানুষ।
আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা এই ভ্রান্তিটি খুঁজে পাব: স্কুল থেকে শুরু করে, অফিস এবং মার্কেটিং ক্যাম্পেইনেও। এই ভ্রান্তি যখন আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার উপরে চেপে বসে তখন যেকোনো ব্যাপারেই আমরা বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। এভাবে, অন্যকে ভুলভাবে বিচার করার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায় এবং জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হারিয়ে ফেলি।
হেলো ইফেক্ট তৈরি হওয়ার একটি কারণ হলো, মানুষের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি একটি গঠনমূলক প্রক্রিয়া। যখন কারো ব্যাপারে আমরা ইম্প্রেশন তৈরি করি, আমরা বিষয়গত তথ্যের উপর নির্ভর করে চিন্তা করি না। বরং, এমন একটি প্রতিচ্ছবি আমরা নিজেদের মনে তৈরি করি যেটা ইতোমধ্যেই আমাদের জানা রয়েছে। তবে, চেহারা বা পোষাকী সৌন্দর্য দিয়ে কারো ব্যক্তিত্ব বিচার করা আসলেই বাচ্চাসুলভ। কিন্তু এরপরেও বেশিরভাগ মানুষ তা এড়াতে পারে না। গবেষণায় পাওয়া গেছে, এরকম বাহ্যিক সৌন্দর্যগুলোই সবচেয়ে সহজে হেলো ইফেক্ট তৈরি করে।
হেলো ইফেক্ট সম্পর্কে জানা থাকলে আমরা নিজেদের জীবনে আরেকটু নিয়ন্ত্রণ আনতে পারব। কোনো মানুষকে বিচার করতে গেলে, যেকোনো রাজনৈতিক নির্বাচনে আমরা উপলদ্ধি করতে পারব, কীভাবে একটি ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য সামগ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলছে। এভাবে ভ্রান্তিটি পুরোপুরি দূর করতে না পারলেও অনেকাংশেই আমরা কমিয়ে নিতে পারব।
হেলো ইফেক্ট এড়ানোর একটি উপায় হলো, নিজের যুক্তিপ্রয়োগের প্রক্রিয়াটি ধীর করে ফেলা। অর্থাৎ, দ্রুত কোনো বিচার করে ফেলা যাবে না। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। যেকোনো মানুষের ব্যাপারে একের অধিক সম্ভাব্য ইম্প্রেশন তৈরি করার চেষ্টা করতে হবে। এরপরে বারবার সেগুলোকে প্রশ্ন করতে হবে। ধীরে ধীরে যখন মানুষটির ব্যাপারে আরো তথ্য পাওয়া যাবে তা বিশ্লেষণ করে যে ইম্প্রেশনের সাথে মিলে যাবে সেটি গ্রহণ করতে হবে।
পণ্য বা ব্র্যান্ডের ব্যাপারে অবশ্য হেলো ইফেক্ট এড়ানো সহজ। কোনো ব্র্যান্ডের প্রতি যদি ইতিবাচক ইম্প্রেশন থাকে তখন মানুষ সেই ব্র্যান্ডের জিনিসই বারবার কিনতে চায় এমনকি যদি সেই ইম্প্রেশনের সাথে পণ্যের কোয়ালিটির কোনো সম্পর্ক নাও থাকে। তাই পছন্দের ব্র্যান্ডের কিছু কিনতে গেলেই বাড়তি সতর্কতা নিয়ে বিচার করতে হবে, অন্য ব্র্যান্ডগুলোর সাথে তুলনা করতে হবে। কারণ সবচেয়ে জনপ্রিয় অথবা দামি ব্র্যান্ড মানেই এটা নয় যে তাদের পণ্য সবচেয়ে ভালো।
হেলো ইফেক্ট যদি বিপরীতভাবে কাজ করে সেটাকে ‘হর্নস ইফেক্ট’ বলে। হেলো ইফেক্টের ফলে কারো ইতিবাচক গুণ আমাদের মনে সামগ্রিকভাবে তাদের সম্পর্কে একটি ভালো ধারণা তৈরি করে। হর্নস ইফেক্টের ক্ষেত্রে, কারো নেতিবাচক গুণ তার সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে। যেমন, কারো যদি কোনো পণ্যের চেহারা পছন্দ না হয়, সেটি বাজারের সবচেয়ে ভালো পণ্য হলেও সে তা না কেনার প্রবণতা দেখাবে।
প্রতিদিনের পৃথিবী থেকে হেলো ইফেক্টের উদাহরণ দিতে গেলে দুর্ভাগ্যক্রমে চিকিৎসাক্ষেত্রের কথা চলে আসে। রোগির বাহ্যরূপ দেখে অনেক সময়েই চিকিৎসক তাকে বিচার করে ফেলে। এভাবে কাউকে ভুল চিকিৎসা দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। মানসিক চিকিৎসায় এটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী কাউকে দেখে চিকিৎসকদের সে ‘মানসিকভাবেও’ সুস্থ এরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার প্রবণতা দেখা যায়। কেউ মানসিকভাবে সুস্থ কিনা তা তার সাথে কথোপকথন ও পরীক্ষা না চালিয়ে বুঝার উপায় নেই। এরকম প্রবণোতার ফলে, কিছু কিছু গবেষণা দাবি করেছে যে, বাহ্যিক সৌন্দর্য সুস্থতা বিচার করার প্রক্রিয়াতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
হেলো ইফেক্টের শিকার আরেকটি ক্ষেত্র হলো স্কুল। একটি গবেষণায়, সাড়ে চার হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীর ছবি দেখে আকর্ষণীয়তা বিচার করে তাদেরকে ১ থেকে ১০ এর মধ্যে নাম্বার দেওয়া হয়েছিল। এরপরে তাদের ক্লাসরুমে নেওয়া পরীক্ষার সাথে অনলাইন নেওয়া পরীক্ষার নাম্বার তুলনা করা হয়। আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল, সবচেয়ে আকর্ষণীয় শিক্ষার্থীরা ক্লাসের তুলনায় অনলাইন পরীক্ষায় কম নাম্বার পেয়েছে।
আরেকটি পরীক্ষায়, শিক্ষার্থীদের লেখা রচনা যাচাই করার জন্যে সেগুলো শিক্ষকদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। তবে, কিছু শিক্ষার্থীর নাম পরিবর্তন করে বিখ্যাত ও আকর্ষণীয় ব্যক্তির নাম দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে, বাকিদের সাধারণ নাম দেওয়া হয়েছিল। দেখা গেল, বিখ্যাত লোকদের নাম অনুসরণ করে যাদের নাম দেওয়া হয়েছিল তারা বাকি সবার থেকে ভালো নাম্বার পেয়েছে। এই পরীক্ষাগুলো বলে দেয়, সবচেয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকও হেলো ইফেক্টের ফাঁদে পড়তে পারেন।
কর্মক্ষেত্রেও হেলো ইফেক্ট অনেকরকম ভুলের জন্ম দেয়। এর ফলে অনেকেই উপযুক্ত পারফরম্যান্স বোনাস ও মূল্যায়ন পান না। সুপারভাইজররা অনেক সময় একটি নির্দিষ্ট যোগ্যতার মাপকাঠিতে সবাইকে মেপে ফেলেন। যেমন, একজন কর্মীর উদ্দীপনা আর ইতিবাচক মনোভাব তার জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব ঢেকে দিতে পারে। এভাবে সে তার উপযুক্ত মূল্যায়নের চেয়েও অনেক বেশি সুযোগ পেয়ে যায়। জার্নাল অব ইকোনমিক সাইকোলজিতে প্রকাশ হওয়া একটি গবেষণা বলে, সুদর্শন ফুড সার্ভাররা অন্যদের তুলনায় বছরে ১২০০ ডলার বেশি বখশিশ পেয়ে থাকে। ভোক্তা মার্কেটে একই কারণে বিখ্যাত সেলেব্রিটিদেরকে দিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন ও বিজ্ঞাপন চালানো হয়। এভাবে ভোক্তাদেরকে প্রয়োজনের বেশি খরচ করার জন্যে প্রভাবিত করা যায়।
আমাদের উচিত কাউকে বিচার করার সময়ে তার কোন ব্যাপারগুলো সত্যিকার অর্থে ভালো এবং খারাপ সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। আমরা কি একটি গুণের সাপেক্ষে আরেকটি বিচার করে ফেলছি কিনা তা বিশ্লেষণের অভ্যাস তৈরি করা জরুরী। অবশ্য, হেলো ইফেক্ট সম্পর্কে জানা থাকলেই তা এড়ানো সহজ হয়ে দাঁড়ায় না। এটা অনেকগুলো ভ্রান্তির মধ্যে একটি যা মানুষকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে কিন্তু সেই সিদ্ধান্তে ভুল রেখে যায়।