মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তি এসেছেন স্লিপ ক্লিনিকে। ঘুমের সমস্যা তার দীর্ঘদিনের। প্রায় এক যুগ অনিদ্রা তার নিত্যসঙ্গী।ইদানীং দেখা দিয়েছে নতুন বিপদ। ঘুমের মধ্যে মাথায় জোরে জোরে শব্দ হয়! মনে হয় টিনের চালে ঢিল মারছে কেউ! ফলে ঘুমটাই যায় টুটে! চিকিৎসক কথা বলে জানতে পারলেন মাসে এক-দুবার এমন হয়। শেষপর্যন্ত চিকিৎসক যা বললেন তাতে ভদ্রলোকের আক্কেলগুড়ুম। তিনি নাকি ভুগছেন এক্সপ্লোডিং হেড সিনড্রোম বা ইএইচএস-এ (Exploding head syndrome)। যাহ্ বাবা, মাথাটা ফেটে তো যায়নি! তাহলে এক্সপ্লোডিং কেন?
এক্সপ্লোডিং হেড সিনড্রোম
ঘুমের একধরনের সমস্যা এই রোগ। আক্রান্ত ব্যক্তি ঘুমের মধ্যে মাথার ভেতর জোরালো আওয়াজ পান। ফলে ভেঙে যায় ঘুম। অনেকের কাছে এই শব্দ বোমা বিস্ফোরণের মতো প্রচণ্ড মনে হয়, সেকারণেই রোগের এই নাম। কারো কারো ক্ষেত্রে মনে হয় দরজায় ধামাধাম বাড়ি দিচ্ছে কেউ। তবে যেকোনো ধরনের জোরালো শব্দই হতে পারে। সাথে অনেক সময় মনে হয় চোখে আলো ফেলেছে কেউ। মাংসপেশিতেও অনিয়ন্ত্রিত কাঁপন হতে পারে। ব্যথা এই রোগে হয় না। তবে দুর্লভ ক্ষেত্রে কেউ কেউ মাথায় মুহুর্তের জন্য তীব্র ব্যথা অনুভব করতে পারেন।
সাধারণত কোনো পূর্বাভাস ছাড়া হঠাৎ করেই আরম্ভ হয় এই রোগ। মাসে কয়েকবার সমস্যা হতে পারে, এবং প্রতিবার সেকেন্ডখানেকের বেশি শোনা যায় না শব্দ। অনেক রোগীর ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় বাদে বার বার হতে পারে এমনটা। মারাত্মক কিছু না হলেও রোগীর ঘুমে অসুবিধা হয়, দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রা দেখা দিতে পারে।
আবিষ্কার
১৮৭৬ সালে মার্কিন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ সাইয়ালস মিশেল (Silas Weir Mitchell) সর্বপ্রথম এমন রোগীর কথা উল্লেখ করেন। তিনি তার চিকিৎসাধীন দুজন রোগীকে নিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করলে চিকিৎসকসমাজের নজরে আসে ইএইচএস। মিশেলের লেখা থেকে জানা যায় তার রোগীরা বিভিন্ন শব্দ শোনার কথা জানিয়েছিলেন। পিস্তলের গুলি, কাচ ভাঙা, ঘণ্টা বাজা ইত্যাদি নানারকম আওয়াজ বাজতো তাদের মাথায়। ২০০৫ সালের আগপর্যন্ত একে ঘুমের রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হতো না।
প্রাণঘাতি না হলেও আক্রান্ত ব্যক্তিকে ভয় পাইয়ে দিতে ইএইচএসের জুড়ি নেই। তার পক্ষে মনে করা অসম্ভব নয় যে স্ট্রোক বা ব্রেইন টিউমারের মতো মারাত্মক রোগ দেখা দিয়েছে তার। এরকমটা হলেই কেবল চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তিনি। যদি সেরকম মনে না হয় তাহলে কিন্তু হাসপাতাল বা ডাক্তারের চেম্বারের ধারেকাছে আসেন না তিনি। এ কারণে এই রোগ ঠিক কী পরিমাণে জনগোষ্ঠীর মধ্যে আছে সেটা নির্ণ্য় করা যায় না।
কীভাবে বা কাদের হয় এই রোগ?
ইএইচএসের সঠিক কারণ বিজ্ঞানীদের এখনও অজানা। প্রাথমিক যুগে কানের ভেতরে গোলমালের কারণে এই রোগ হতে পারে বলে কিছু মত এসেছিল। তবে তা এখন খারিজ হয়ে গেছে। বর্তমানে সবচেয়ে প্রচলিত ধারণা হলো- ঘুমাতে যাওয়ার সময় মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলোর ভেতর সংকেত আদানপ্রদানে ব্যত্যয় হওয়া থেকে উৎপত্তি ইএইচএসের।
কী কী কারণে রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে সেটা নিয়েও বিস্তর গবেষণা চলছে। উদ্বেগ আর মানসিক চাপকে অনেক গবেষক ঝুঁকি বৃদ্ধির কারণ মনে করেন। পারিবারিক ইতিহাস খুব একটা গুরুত্বপুর্ণ ইস্যু নয়। তেমন কোনো জেনেটিক ফ্যাক্টরও পাওয়া যায়নি। তবে রোগীর স্লিপ প্যারালাইসিস (sleep paralysis) জাতীয় রোগ থাকলে ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
নারী-পুরুষ সবাই আক্রান্ত হতে পারে এই রোগে। মেয়েদের ক্ষেত্রে একটু বেশি হয়- এই যা! একসময় মনে করা হতো মধ্যবয়স্ক মহিলারাই ইএইচএসের প্রধান শিকার। তবে এখন জানা গেছে- যেকোনো বয়সে হানা দিতে পারে রোগ। এমনকি দশ বছর বয়সের রোগীও পাওয়া গেছে। রোগীর সঠিক পরিসংখ্যান জানা না গেলেও একটি গবেষণায় (Sharpless B. A) কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের শতকরা ১৬ ভাগের মধ্যে এক্সপ্লোডিং হেড সিনড্রোম পাওয়া গেছে।
চিকিৎসা
ল্যাবরেটরি টেস্ট করে রোগ শনাক্তের উপায় নেই। ভরসা করতে হবে রোগীর ইতিহাস এবং লক্ষণের ওপর। তিনটি বিষয় থাকলে চিকিৎসক এক্সপ্লোডিং হেড সিনড্রোম সন্দেহ করতে পারেন। মাথার ভেতর অকস্মাৎ প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়া, কোনো ব্যথা না থাকা এবং জেগে উঠে রোগী আতঙ্কিত হয়ে পড়া। চিকিৎসা বলতে রোগীকে কাউন্সেলিং। উদ্বেগ কমানোর ওষুধ দেয়া যেতে পারে। সময়ের সাথে সাথে সাধারণত রোগী পুরোপুরি ভালো হয়ে যান।