পেরুর বিপ্লবী সংগঠন Túpac Amaru Revolutionary Movement (MRTA) এর ১৪ জন সশস্ত্র গেরিলা ১৯৯৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর পেরুর রাজধানী লিমাতে অবস্থিত জাপানি দূতাবাসে প্রবেশ করে সেই সময় সেখানে অবস্থান করা বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, পদস্থ সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীসহ প্রায় ছয় শতাধিক ব্যক্তিকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। চার মাসেরও অধিক সময় পর বিভিন্ন নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে সেই জিম্মিদশার পরিসমাপ্তি ঘটে।
টুপাক আমারু বিপ্লবী সংগঠনের পরিচিতি
বিংশ শতকের আশির দশকের শুরুর দিকে পেরুর মার্কসবাদী নেতা ভিক্টর পোলোর নেতৃত্বে Túpac Amaru Revolutionary Movement (MRTA) গঠিত হয়। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রবর্তন করার লক্ষ্যে পেরুর বামপন্থী এই গেরিলা সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে পেরুর রাজধানী লিমাতে অবস্থিত জাপানি দূতাবাসে জিম্মি ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততার কারণে সেই সময় টুপাক আমারু ব্যাপক আলোচিত হয়।
জিম্মি ঘটনার সূত্রপাত
১৯৯৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাতে জাপানি রাষ্ট্রদূত মোরিশা অকাইয়ের আমন্ত্রণে জাপানের তৎকালীন সম্রাট আকিহিতোর ৬৩তম জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, পদস্থ সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীসহ প্রায় ছয় শতাধিক ব্যক্তি লিমার জাপানি দূতাবাসে অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ করে সেই মুহূর্তে টুপাক আমারু বিপ্লবী দলের ১৪ জন সশস্ত্র সদস্য জাপানি দূতাবাসে প্রবেশ করে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই দূতাবাসের ভেতরে অবস্থান করা ব্যক্তিদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফেলা হয়। জিম্মিদের মধ্যে পেরুর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফুজিমোরির মা এবং ছোট ভাইও ছিলেন।
জিম্মিকারীদের উদ্দেশ্য
জিম্মিকারীদের নেতা নেস্টর শেরপা কারতোলিনি পেরু সরকারের হাতে বন্দি থাকা টুপাক আমারু বিপ্লবী দলের সব সদস্যকে মুক্তি দিতে এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি খাতে রূপান্তর বন্ধ করতে তথা মুক্তবাজার অর্থনৈতিক নীতি থেকে সরে যেতে সরকারের কাছে দাবি জানায়। এছাড়াও জিম্মিকারীরা পেরু সরকারকে দেওয়া জাপানি বৈদেশিক সাহায্য অর্থের সুষম বণ্টন এবং পেরুর কারাগারের অভ্যন্তরে বিরাজমান বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা নিরসনের জন্য সরকারের কাছে দাবি করে।
জাপানি দূতাবাস লক্ষ্যবস্তু হওয়ার কারণ
পেরুর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফুজিমোরি ছিলেন জাপানি বংশোদ্ভূত। ফলে তার সরকারের সাথে জাপানের খুবই উষ্ণ সম্পর্ক ছিল। টুপাক আমারু বিপ্লবী সংগঠন মনে করত, জাপান সরকার বৈদেশিক অর্থসাহায্য প্রদানের মাধ্যমে পেরু সরকারের উপর অযাচিত প্রভাব বিস্তার করছে। এছাড়াও জাপানি দূতাবাসের সেই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকসহ পেরু সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন, ফলে টুপাক আমারু জাপানি রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে আক্রমণের মাধ্যমে সরকারের উপর চাপ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দৃষ্টি আকর্ষণের একটি সুযোগ হিসেবে দেখে।
সরকারের পদক্ষেপ
জিম্মি ঘটনা শুরু হওয়ার পর পরই পেরুর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফুজিমোরি মন্ত্রীসভার জরুরি বৈঠক আহবান করে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডমিঙ্গো পালের্মোকে জিম্মিকারীদের সাথে আলোচনা করতে দায়িত্ব দেন। ২২ ডিসেম্বর আলবার্তো ফুজিমোরি জনসম্মুখে দেওয়া বিবৃতিতে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে সেটিকে একটি সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড হিসেবে আখ্যা দেন। সেই সাথে তিনি জিম্মিকারীদের দাবিগুলোকে প্রত্যাখান করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে জিম্মিদশা অবসানে চেষ্টা চালানোর ঘোষণা দেন।
জিম্মি ব্যক্তিদের মুক্তি প্রক্রিয়া
ফুজিমোরির বিবৃতির পর ২২ ডিসেম্বর জিম্মিকারীদের নেতা নেস্টর শেরপা কারতোলিনি তাদের দাবিগুলো পূরণ হওয়া নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে প্রায় ২২০ জন জিম্মি ব্যক্তিকে মুক্তি দেন। জিম্মিদশার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য ফুজিমোরি পেরুতে নিযুক্ত তৎকালীন কানাডীয় রাষ্ট্রদূত অ্যান্থনি ভিনসেন্ট, আর্চ বিশপ হুয়ান লুইস এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটিকে দায়িত্ব দেন।
৩১ ডিসেম্বর জিম্মিকারীরা কয়েকজন সাংবাদিককে সেই জাপানি দূতাবাসে প্রবেশের অনুমতি দেয়। পরে অবশ্য জিম্মিকারীরা পর্যায়ক্রমে জাপান ও পেরু সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ৭২ জন কূটনীতিক, পদস্থ সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী ছাড়া বাকি সব জিম্মিকে ছেড়ে দেয়।
বিশ্ব নেতাদের তৎপরতা
জিম্মিদশার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য ফুজিমোরি বিভিন্ন দেশের নেতাদের সাথে আলোচনা করছিলেন। তিনি কিউবার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো, বলিভিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গঞ্জালো সানচেজ এবং জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাশিমাতোর সাথে বৈঠক করেন। জাপানি প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে আলবার্তো ফুজিমোরি জাপানি জিম্মিদের নিরাপদে উদ্ধারের ব্যাপারে আলোচনা করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৯৭ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং ৩রা মার্চ ডমিনিকান রিপাবলিকের প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠক করেন।
সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি
জিম্মি ঘটনার পর পরই পেরুর পুলিশ বাহিনী পুরো জাপানি দূতাবাস ঘিরে অবস্থান নেয়। ২১ জানুয়ারি পুলিশের সাথে জিম্মিকারীদের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।
পেরু সরকার আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি গোপনে সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করে। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পেরুর সামরিক বাহিনীর একটি বিশেষ স্কোয়াড জাপানি দূতাবাস ঘিরে অবস্থান গ্রহণ করে।
জাপানি দূতাবাসের ভবনটির দরজা-জানালা ভেঙে প্রবেশ করা খুবই দুরূহ ছিল এবং জিম্মিকারীরা ভবনটির প্রবেশমুখে মাইন স্থাপন করে রেখেছিল। সেজন্য সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে দূতাবাস ভবনের নিচে কয়েকটি সুড়ঙ্গ খনন করা হয়। অভিযানকারী দল লাউড স্পিকারের শব্দ ব্যবহার করে কৌশলে জিম্মিকারীদের কাছ সুড়ঙ্গ খননের শব্দ আড়াল করেছিল। এছাড়াও সেই সময় চারপাশের রাস্তাগুলোতে ট্যাঙ্ক টহল দিতে শুরু করে।
মার্চ মাসের শুরুর দিকে জিম্মিকারীরা সামরিক অভিযানের আশঙ্কায় সরকারের সাথে আলোচনা বন্ধ করে দেয়। তাদের কাছে তখনও জাপান ও পেরু সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় ৭২ জন ব্যক্তি বন্দি অবস্থায় ছিল। আলোচনার মাধ্যমে যখন দু’পক্ষ একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, তখন পেরু সরকার অত্যন্ত সুপরিকল্পিত উপায়ে জিম্মি উদ্ধারের জন্য চূড়ান্ত সামরিক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়।
চূড়ান্ত সামরিক অভিযান
লিমার জাপানি দূতাবাসে জিম্মি ঘটনার শুরু চার মাসেরও বেশি সময় পর ১৯৯৭ সালের ২২ এপ্রিল সন্ধ্যায় প্রায় ১৪০ জন বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমান্ডো অভিযান শুরু করে। তাদের মধ্যে ৭০ জন কমান্ডো নয়টি সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে দূতাবাস চত্বরে প্রবেশ করতে সক্ষম হন।
কমান্ডোরা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অভিযান শুরু করেন। তারা ভবনে প্রবেশের চেষ্টা চালালে জিম্মিকারীদের সাথে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। বিশেষ অভিযানটি প্রায় ২২ মিনিট ধরে চলে। সেই অভিযানে টুপাক আমারু বিপ্লবী সংগঠনের ১৪ জন জিম্মিকারীর সবাই নিহত হয়।
উদ্ধার অভিযান পরিচালনার সময় ২ জন কমান্ডো এবং পেরুর নাগরিক একজন জিম্মি নিহত হয়েছিলেন। সেই ঘটনায় সর্বমোট ৭১ জন জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। সেই অভিযানের মাধ্যমে প্রায় ১২৬ দিন ধরে চলা জিম্মি সংকটের সমাপ্তি ঘটে।
সামরিক অভিযানের নামকরণ
পেরুর একটি উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হচ্ছে Chavín de Huántar, যেটি এর ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ পথের জন্য বিখ্যাত। প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক পর্যটক এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে পেরুতে ভ্রমণ করে থাকে।
জাপানি দূতাবাসের জিম্মিদশা নিরসনে পরিচালিত অভিযান দূতাবাস ভবনের নিচে কয়েকটি সুড়ঙ্গ খনন করার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। সেজন্য প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফুজিমোরি সেই বিশেষ অভিযানকে “Operation Chavín de Huántar” হিসেবে নামকরণ করেন। এই অভিযানের সফলতা ফুজিমোরির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির একটি কারণ হিসেবে কাজ করে।
পেরুর লিমায় অবস্থিত জাপানি দূতাবাসের জিম্মি ঘটনাকে উপজীব্য করে কয়েকটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়। সেগুলোর মধ্যে ১৯৯৯ সালে নির্মিত “Endgame: The Untold Story of the Hostage Crisis in Peru” এবং ২০১৪ সালে নির্মিত “Black Ops: The Japanese Embassy Siege” অন্যতম। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি বইও প্রকাশিত হয়। এছাড়াও ১৯৯৯ সালে “Lima: Breaking the Silence” নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, যেটির পরিচালক ছিলেন মেনাহেম গোলান।