Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যেভাবে বাইরের দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে

২০১৬ সালের নভেম্বর মাস। আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের গরম হাওয়া বইছে পুরো বিশ্ব জুড়েই। ডেমোক্রেট হিলারি ক্লিনটন বনাম রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প। কে চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউসের অধিপতি হবেন? পোল খুলে মার্কিনিদের জনমত বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে। অধিকাংশ পোলেই হিলারি ক্লিনটন এগিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মার্কিনিরা একজন নারী প্রেসিডেন্ট পেতে যাচ্ছে, এই বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন সবাই।

কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলের সময় সবার অনুমান ভুল প্রমাণিত হয়ে গেল। হিলারি ক্লিনটনের পরিবর্তে আলোচিত-সমালোচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়ে মসনদে বসলেন। এরকম হুট করে পালাবদলের ঘটনায় নড়েচড়ে বসলেন অনেকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ নিয়ে কথা উঠতে শুরু করলো। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রণোদনাপ্রাপ্ত হ্যাকারদের দিকে সন্দেহের তীর ছুঁড়ে দেয়া হলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনবরত প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর মাধ্যমে ট্রাম্পের পক্ষে প্রচারণার জন্য পুতিনের দেশকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো। লিক হওয়া বিভিন্ন ই-মেইলের জন্য হিলারি ক্লিনটনের শেষ মুহুর্তে বিপাকে পড়ে সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট হওয়া থেকে ছিটকে গেলেন, এর পেছনে রুশ গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবিকে দায়ী করা হলো।

য়ননয়সননয়
২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুতিনের রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছে, যেটি গোয়েন্দাসংস্থাগুলোর জন্য নতুন কিছু নয়;
image source: time.com

বিদেশি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ বিখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য নতুন কিছু নয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করাটা আসলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অন্ধকার দিকগুলোর একটিকে সামনে উন্মোচন করে দেয়। খোদ আমেরিকার সিআইএ-র বিরুদ্ধে অসংখ্য নির্বাচনে হস্তক্ষেপ এর অভিযোগ রয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পৃথিবী মোটামুটি দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ব্লক, আমেরিকার নের্তৃত্বে গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্লক। সোভিয়েত রাশিয়া কিংবা আমেরিকা– দুটি শক্তিধর দেশই নিজেদের মতাদর্শ প্রচারের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। নিজেদের শিবিরে অন্যদের সমবেত করার জন্য দুটি দেশ কোনো ছাড় দেয়নি।

রাষ্ট্রের স্বাভাবিক নিয়মেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতীয় নির্বাচনে সমাজতান্ত্রিক দল ও ডানপন্থী পুঁজিবাদী দলগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিল সরকার গঠনের জন্য। ডানপন্থী দলগুলো জয়ী হলে দেশ আমেরিকার ব্লকে যোগ দেবে, আর বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক দলগুলো সরকার গঠন করতে পারলে সোভিয়েত রাশিয়ার ব্লকে যোগ দেওয়া হবে, এটিই ছিল সেই সময়ের সহজ সমীকরণ। একেই মূলত একটি দেশের জাতীয় নির্বাচনে বৈদেশিক হস্তক্ষেপের মূল কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কারণ আমেরিকা কিংবা রাশিয়া নিজ মতাদর্শের অনুকূলে থাকা দলগুলোকে জয়ী করতে পারলে নিজেদের মতাদর্শিক অগ্রসরতা প্রমাণিত হয়ে যাবে, নিজেদের ব্লক আরেকটু ভারী হবে, জোট-নিরপেক্ষ থাকা দেশগুলোর কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে– এসব চিন্তা করেই হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই বিপরীত মতাদর্শের প্রসার দমনের জন্য শক্তিশালী দেশগুলোর কাছে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে; image source: history.com

কিন্তু কীভাবে হস্তক্ষেপ করে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নির্বাচনের ফলাফলকে নিজেদের পার্টির অনুকূলে নিয়ে আসতো? এর সহজ উত্তর– প্রচুর অর্থ ব্যয় ও অনবরত প্রোপাগান্ডা প্রচার করা। সেই সাথে বিভিন্ন সহায়তার আশ্বাস দেয়া কিংবা সহায়তা বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়া এবং যারা নির্বাচনী ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেন, তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা।

১৯৪৮ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইতালিতে জেনারেল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷ ইতালির সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া অর্থনীতির মতো সংকটকে সামনে রেখে ইতালিয়ান সোশ্যালিস্ট পার্টি ও ইতালিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির বামপন্থী জোটের জাতীয় জেনারেল নির্বাচনে জয় হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এরকম সময়ে আমেরিকার দুশ্চিন্তা হলো, যদি সমাজতান্ত্রিক জোট কোনোভাবে জিতে যায় নির্বাচনে, সেটি ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর কমিউনিস্ট পার্টিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়া আকাঙ্ক্ষাকে শক্তিশালী করে তুলবে। ইউরোপে পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র পতনের দিকে আরেকটু এগিয়ে যাবে।

এজন্য কীভাবে ইতালির কমিউনিস্ট-বিরোধী ডানপন্থী পার্টির জোটকে জেতানো যায় নির্বাচনে, সেজন্য দৌঁড়ঝাপ শুরু করে ওয়াশিংটন। গোপনে প্রচুর অর্থ দেয়া হয় ডানপন্থী জোটের নির্বাচনের ক্যাম্পেইন পরিচালনার জন্য। পত্রিকাগুলোতে ডানপন্থী জোটকে কেন নির্বাচনে জয়ী করা উচিত, তার পক্ষে অসংখ্য কলাম লিখিয়ে নেয় সিআইএ। লাখ লাখ ডলার খরচ করে লিফলেট, পুস্তিকা বানিয়ে বিলি করা হয় জনগণের মাঝে। পত্রিকার কলামগুলোতে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়, যদি কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করে, তবে ইতালিতে গণতন্ত্রের বদলে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটবে। আরও নানারকম প্রোপাগান্ডার ছড়ানো হয়। এমনকি যদি নির্বাচনে ডানপন্থীরা জেতার ফলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, সেক্ষেত্রেও ডানপন্থী জোটের জেনারেলকে সহায়তা করার জন্য আমেরিকা নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও অস্ত্রশস্ত্রের বহর পাঠিয়ে দেয়।

ণনণনণা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালিতে অর্থ সাহায্য প্রদান, ক্যাম্পেইন পরিচালনা এবং প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর মাধ্যমে জেনারেল নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেয় সিআইএ। পরবর্তীতে ইতালির মডেল অনুসরণ করা হয় লাতিন আমেরিকায়;
image source: thoughtco.com

লাখ লাখ ডলার খরচ করা, পত্রিকায় কলাম লিখিয়ে নেয়া, প্রোপাগান্ডা ছড়ানো, অস্ত্রশস্ত্র ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা পাঠিয়ে দিয়ে গৃহযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আগাম সতর্ক থাকা, এত কিছুর শেষ ফলাফল কী? শেষ ফলাফল- নির্বাচনে ডানপন্থী পুঁজিবাদী রাজনীতির বিজয়, ইতালিকে সোভিয়েত ব্লকের হাত থেকে বাঁচানো, ইউরোপের কমিউনিস্ট দলগুলোকে সতর্কবার্তা দেয়া। সিআইএ পরবর্তীতে ইতালির মডেল প্রয়োগ করে লাতিন আমেরিকায়, এবং সফল হয়।

গোয়েন্দা সংস্থাগুলো টার্গেট করে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমগুলোকে। কারণ প্রোপাগান্ডা ও মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করা জন্য দক্ষ সাংবাদিক দরকার, যারা নিখুঁতভাবে জনগণের সামনে প্রোপাগান্ডামূলক সংবাদ প্রচার করতে সিদ্ধহস্ত থাকবে। আর একটি দেশের সবচেয়ে তুখোড় সাংবাদিকরা স্বাভাবিকভাবেই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে কাজ করে থাকে। আর এই জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমগুলোর বিপুল পরিমাণ পাঠক থাকে। ফলে প্রোপাগান্ডা দেশের একটা বিশাল অংশের জনগণের কাছে পৌঁছানো যায়।

১৯৬৪ সালে চিলিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার খুব কাছে ছিলেন সালভাদর আলেন্দে। কিন্তু মার্ক্সিস্ট ঘরানার সমাজতান্ত্রিক নেতা হওয়ার ফলে ওয়াশিংটন তাকে কোনোভাবেই চিলির রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখতে চায়নি। তাই নির্বাচনের সময় তার বিরুদ্ধে মাঠে নামে সিআইএ। চিলির সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা ‘এল মারকুরিও’-কে টার্গেট করে সিআইএ অনবরত মিথ্যা সংবাদ ও প্রোপাগান্ডা ছড়াতে থাকে। সেই নির্বাচনে সালভাদর আলেন্দে হেরে যান। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আলেন্দে জিতেছিলেন বটে, কিন্তু সিআইএ-সমর্থিত সামরিক অভ্যুুত্থানে তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয়।

শুধু সিআইএ–ই কিন্তু নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে, এমনটা ভাবলে ভুল হবে। রাশিয়ার কেজিবি-ও কম যায় না। কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডোভ লেভিনের মতে, ১৯৪৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিআইএ প্রায় ৮০টি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে, যেখানে রাশিয়ার কেজিবি হস্তক্ষেপ করেছে প্রায় ৩৬টি নির্বাচনে। এর মধ্যে সিআইএ অনেকবার নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা করেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা কম হয়। সেগুলোও কিন্তু তাদের জাতীয় স্বার্থে নির্বাচনে হস্তক্ষেপের মতো কাজে পিছিয়ে নেই।

হআহআআু
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বর্তমানে প্রোপাগান্ডা ও মিথ্যা সংবাদ ছড়ানোর বড় প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে;
image source: revelance.com

গোয়েন্দা সংস্থা মানে শুধুই যে বিভিন্ন সোর্স থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গোপন তথ্য সংগ্রহ করে জাতীয় নীতিনির্ধারকদের হাতে পৌঁছে দেয়া কিংবা গোপনে বিভিন্ন সামরিক মিশন পরিচালনা করা– নির্বাচনে হস্তক্ষেপের পরিসংখ্যান দেখলে সেটি মনে হওয়ায় কারণ নেই। জাতীয় স্বার্থে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে গোপনে নির্বাচনে হস্তক্ষেপের মতো স্পর্শকাতর কাজে লাগানো হয়। এক্ষেত্রে বিশাল অংকের অর্থ খরচ করতে হয়, হস্তক্ষেপের খবর ফাঁস হয়ে পড়লে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতির ঝুঁকি থাকে। কিন্তু জাতীয় স্বার্থের কারণে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে একটু ঝুঁকি নিতেই হয়, কারণ নির্বাচনের ফলাফলের উপর অনেক কিছুই নির্ভর করে।

Related Articles