
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মাঝে বর্তমানে বহুল জনপ্রিয় একটি বিষয় হলো মিম (Meme)। মোবাইল-পিসির স্ক্রিনে ইন্টারনেটের দুনিয়ায় ঘোরাফেরার সময় আমরা মজার মজার অনেক ছবি, ভিডিও দেখতে পাই, যেগুলো মূল ছবি/ভিডিওকে কিছুটা বিকৃত করে বানানো হয়েছে, কিংবা মূল ছবি/ভিডিওর সাথেই নানাবিধ লেখনী জুড়ে দিয়ে সেগুলোকে হাস্যরসাত্মক করে তোলা হয়েছে। এমন ছবি/ভিডিওকেই মিম বলা হয়।

এই মিমগুলো যে আমাদের সবাইকেই কম-বেশি আনন্দ দিয়ে থাকে, সেটা তো না বললেও চলে। সেই সাথে এই মিমগুলো এর পেছনের মানুষটির সৃজনশীলতা, কৌতুকবোধেরও পরিচায়ক। তবে সবসময় এই কৌতুক কিন্তু ভালো ফলাফল বয়ে আনেনি। কখনও কখনও কেবলমাত্র এমন মিম বানানো, তথা এমন কৌতুকই নানাবিধ সর্বনাশ ডেকে এনেছিল অনেকের জীবনে। এমন কিছু কাহিনী নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের এই লেখা।
১
আজকের অদ্ভুত কাহিনীর শুরুতেই থাকছেন তাইওয়ানের মডেল হেইডি ইয়েহ। একবার একটি বিজ্ঞাপনের মডেল হয়েছিলেন এই নারী। ডিজিটাল জমানার নানাবিধ ট্রেন্ডের একটি হলো বিভিন্ন ছবি দিয়ে মজার মজার সব মিম বানানো। হেইডির একটি বিজ্ঞাপনের স্থিরচিত্র দিয়েও ঠিক এমনই একটি মিম বানানো হয়েছিলো। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সেই মিমই পরবর্তীতে তার ক্যারিয়ারে বয়ে আনে উদ্ভট সব ঝামেলা।

আজ থেকে প্রায় বছর সাতেক আগেকার কথা। এক প্লাস্টিক সার্জারি ক্লিনিকের একটি বিজ্ঞাপনে একজন পুরুষ (যিনি বিজ্ঞাপনে ছিলেন তার স্বামীর ভূমিকায়) ও তিনটি বাচ্চার সাথে ছিল হেইডির উপস্থিতিও। তিনি সেখানে ছিলেন তাদের মায়ের রুপে।
বিজ্ঞাপনে হেইডি এবং সেই পুরুষ মডেলের চোখ ও নাক দুটোই ছিল তুলনামূলকভাবে বড়। তাইওয়ানের লোকজনের কাছে এমন বড় চোখ-নাক সাধারণত আকর্ষণীয় হিসেবে বিবেচিত হয়। ওদিকে বাচ্চাদের চোখগুলো ছিল ছোট ছোট, আবার নাকও ছিল বোঁচা। চোখ-নাকের এমন আকৃতিকে দেশটিতে ততটা ফ্যাশনেবল বলে মনে করা হয় না। এই ছবির নিচেই ক্যাপশনে লেখা ছিল,
The only thing you’ll ever have to worry about is how to explain it to the kids.
এর দ্বারা আসলে এটাই বোঝানো হয়েছিল যে, হেইডি এবং তার স্বামী দুজনেই প্লাস্টিক সার্জারি করানোর বদৌলতে আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী হয়ে উঠেছেন। ফলে সাথে থাকা বাচ্চাদের বাবা-মা তারা হলেও চেহারা দেখে সেটা বোঝার উপায় ছিল সামান্যই।
বিপত্তিটা বাঁধলো যখন হেইডি যে ক্লিনিকের সাথে বিজ্ঞাপনটির জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিলেন, তারা আরেকটি প্লাস্টিক সার্জারি ক্লিনিককেও সেই বিজ্ঞাপনটি ব্যবহারের অনুমতি দেয়। নতুন বিজ্ঞাপনে পুরনো সেই ছবিটি থাকলেও আগের কথা পাল্টে নতুন করে লেখা হয়,
Plastic surgery— You can’t hide it forever.
বিষয়টি আরও গুরুতর আকার ধারণ করে, যখন একটি ট্যাবলয়েডে দাবি করা হয় যে, ছবিতে থাকা সেই পুরুষ মডেল বাস্তব জীবনেও হেইডির স্বামী। শুধু এখানে থেমে গেলেও হতো। তারা আরও জানায়, হেইডির সাথে তার স্বামীর বনিবনা হচ্ছে না। কারণ, তার স্বামীর ভাষ্যমতে, তাদের দেখা হবার আগেই প্লাস্টিক সার্জারি করে চেহারার পরিবর্তন করিয়েছিলেন হেইডি। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের সংসারে জন্মানো তিন সন্তানের একজনও বাবা-মা কারও চেহারাই পায়নি। এই খবর একসময় তাইওয়ানের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্লগ, ওয়েবসাইট, ট্যাবলয়েড প্রভৃতি মাধ্যমে জায়গা করে নেয়, হয়ে যায় বহু লোকের মুখরোচক আলোচনার খোরাক।

হেইডি জীবনে কোনোদিনই প্লাস্টিক সার্জারি করাননি। কিন্তু ইন্টারনেটে ঘোরাঘুরি করা মানুষজনের এক বিশাল অংশই সেখানে যা দেখে সেটাই বিশ্বাস করে নেয়। এই অন্ধ বিশ্বাসের কবল থেকে হেইডিও রেহাই পাননি। তাই সবাই তাকে নিয়েই নোংরা কৌতুক করতে লাগলো। যাকে নিয়ে এতসব কথাবার্তা ছড়িয়েছে, তার সাথে কাজ করতে পরবর্তীতে আর কোনো প্রতিষ্ঠানই তেমন একটা আগ্রহ দেখালো না। হেইডি যে এজেন্সির হয়ে কাজ করছিলেন, সেই জে. ওয়াল্টার থম্পসন এবং প্লাস্টিক সার্জারি ক্লিনিকটির বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। তারাও থেমে থাকেনি। পাল্টা বিবৃতিতে তারা জানিয়েছিল, যদি হেইডি আইনের পথ বেছে নেয়, তাহলে তারাও তার নামে পাল্টা মামলা করতে পিছপা হবে না, কারণ হেইডির কারণে তাদেরও সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছিল।
২
এবার চলুন ঘুরে আসা যাক এমন এক মিম থেকে, যা ফিকশন আর বাস্তব দুনিয়ার মাঝে এক ভয়াবহ প্যাচ লাগিয়ে দিয়েছিল।

ফ্যান্টাসি, অ্যাডভেঞ্চার ঘরানার দেশি-বিদেশি বই যারা নিয়মিত পড়েন, তাদের অনেকেই হয়তো জে. আর. আর. টোকিয়েনের লেখা ‘দ্য লর্ড অফ দ্য রিংস’ উপন্যাসটি পড়েছেন। যাদের বই পড়ার অভ্যাস তেমনটা নেই, কিন্তু একই ঘরানার মুভিপাগল, তাদেরও একই উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘দ্য লর্ড অফ দ্য রিংস’ সিনেমাটি দেখে থাকার কথা, যার পরিচালনায় ছিলেন পিটার জ্যাকসন।

২০১৫ সালের কথা। তুরস্কের নাগরিক বিলজিন সিফ্ৎসি এই সিনেমারই এক বিখ্যাত চরিত্র গলাম এবং তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে নিয়ে একটি মিম বানালেন। সেখানে পাশাপাশি তিনটি ছবিতে তাদের দুজনকে একই মুখভঙ্গি করে থাকতে দেখা যায়। এতেই ক্ষেপে যায় ক্ষমতাসীন দলের লোকজন, বিলজিনের বিরুদ্ধে এরদোয়ানকে অবমাননার অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

‘প্রকাশ্যে রাষ্ট্রপতির মানহানি’র অভিযোগ আনা হয়েছিল বিলজিনের বিরুদ্ধে। যদি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হতো, তবে সর্বোচ্চ দু’বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডও ভোগ করতে হতো তাকে। বিচারক অবশ্য চমৎকার এক কাজ করলেন। তিনি লর্ড অফ দ্য রিংস সিনেমাটি আগে দেখেননি। তাই সেটা না দেখে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিয়ে তিনি একদল বিশেষজ্ঞকেই দায়িত্ব দিলেন এই মিমটি আদৌ রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানের জন্য অসম্মানজনক কি না তা যাচাই করতে।
এর প্রতিক্রিয়ায় সিনেমার পরিচালক পিটার জ্যাকসনসহ আরো দুজন মন্তব্য করেন যে, গলামের ছবি দিয়ে বানানো মিমটির মাধ্যমে এরদোয়ানের মানহানির দাবিটি সঠিক নয়। গলামের দুটো ব্যক্তিত্ব ছিলো: খল চরিত্রের গলাম এবং ভালো চরিত্রের স্মীগল। তাদের ভাষ্যমতে, মিমটিতে গলামের যেসব ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল, সেগুলো তার ভালো চরিত্রের, অর্থাৎ স্মীগলের। ফলে এর মাধ্যমে এরদোয়ানের নিন্দার প্রশ্নই আসে না!

বলা চলে, অল্পের জন্যই সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলেন বিলজিন।
৩
এখন আমরা নজর ফেরাবো গ্রেট ওয়াল, টেরাকোটা আর্মি, পদ্ম পাসহ অজস্র জিনিসের জন্য বিখ্যাত পূর্ব এশিয়ার দেশ চীনের দিকে, অফিসিয়ালি যারা পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না (পিআরসি) নামেই পরিচিত।
চীনের বর্তমান রাষ্ট্রপতির নাম শি জিনপিং, যিনি ক্ষমতাসীন দল কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না (সিপিসি) এর জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে আছেন। ২০১২ সাল থেকেই দেশটির ‘সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা’ হিসেবে পরিচিত জিনপিংকে ২০১৬ সালে তার দল থেকেও ‘কোর লিডার’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

চীন আর শি জিনপিংকে নিয়ে এত কথা হচ্ছে দেখে যে কেউই এতক্ষণে বুঝে যাবার কথা, এবারের কাহিনী ঘটেছিল তাকে কেন্দ্র করেই।
এবারের দুর্ভাগার নাম দাই জিয়ানইয়ং। তিনি এমন এক মজা করেছিলেন, যেখানে শি জিনপিংকে তুলনা করা হয়েছিল পশ্চাদ্দেশের সাথে! এর জের ধরেই ২০১৫ সালের ২৬ মে দাইকে গ্রেফতার করা হয়। ‘অনলাইনে বিশৃঙ্খলা ছড়ানো’র অভিযোগ আনা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। পাঁচ বছরের জেলও হয়ে যায় তার।
কিন্তু, আসলে কী করেছিলেন দাই?

দাই শি জিনপিংয়ের এমন একটি ছবি বানিয়েছিলেন, যেখানে তাকে শক্ত করে চোখ-মুখ বন্ধ করে থাকতে দেখা যায়। দাই এর নাম দিয়েছিলেন ‘ক্রিসেনথিমাম ফেস’। এটি একটি ফুলের নাম হলেও চীনে গালি হিসেবে একে পশ্চাদ্দেশের পরিবর্তেও ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ, দাই কি বলতে চাচ্ছিলেন যে, শি জিনপিংয়ের মুখ দেখতে পশ্চাদ্দেশের মতো? হয়তো বা তা-ই!

দাই আরও একটি কাজও করেছিলেন। তিনি এই ছবিতে জিনপিংয়ের মুখে একটি গোঁফও জুড়ে দেন। অনেকের মতেই, এতে জিনপিংকে হিটলারের মতো লাগছিলো, অর্থাৎ এটা করে ইচ্ছাকৃতভাবেই দাই তার দেশের রাষ্ট্রপতিকে স্বৈরশাসক হিটলারের সাথে তুলনা করতে চেয়েছিলেন।