Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভেনিস নগরী নির্মাণের গল্প

সমুদ্রের নীল পানির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট একটি শহর। মনে হচ্ছে, পানির উপরে হাওয়ায় ভেসে আছে শহরটি এবং হঠাৎ করেই জোরে আসা কোনো ঢেউয়ের আঘাতে হয়তো চলে যাবে আরেক প্রান্তে। দৃষ্টিনন্দন ও অনন্য এই ভাসমান শহরটির নাম ভেনিস। ভ্রমণপ্রিয় যেকোনো ব্যক্তিরই ইচ্ছা থাকে এই সুন্দর শহরে একবারের জন্য হলেও ঘুরে আসার। এটি ইউরোপের এমন একটি শহর, যেখানে আপনাকে যাতায়াত করতে হবে হেঁটে কিংবা নৌকার মাধ্যমে। চাইলেই কোনো গাড়ি, বাস বা ট্রেনে চলাচল করতে পারবেন না। কারণ, এরকম কোনো ব্যবস্থাই সেখানে নেই। মোটরচালিত যানবাহন নেই, তাই কালো ধোঁয়াও নেই। অন্যান্য আধুনিক বা বড় শহরের মতো পরিবেশ দূষণের দেখা মেলে না ভেনিসে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত শহর হওয়ায় ভেনিস নগরী সকলের নিকটই আকর্ষণীয়। বিখ্যাত এই শহরটি ‘ভাসমান শহর’ নামেও পরিচিত। 

১১৮টি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত ভেনিস নগরী। ভূমধ্যসাগরের অ্যাড্রিয়াটিক অংশের দিকে ভেনেতিয়ান উপহ্রদে এই নগরীর অবস্থান। দ্বীপগুলোকে পরস্পরের সাথে যুক্ত করে রেখেছে ৪০০টিরও বেশি সেতু এবং এ শহরে রয়েছে ১৭৭টি খাল। তবে ১০০টির বেশি দ্বীপ নিয়ে শহরটি গড়ে উঠলেও বেশিরভাগ ভবন এবং বাসস্থান দ্বীপগুলোতে সরাসরি নির্মাণ করা হয়নি। ভাসমান শহর ভেনিসের ভবন এবং সেতুগুলো পানিতে ভেসে আছে কাঠের তৈরী খুঁটির সহায়তায়। দ্বীপ রেখে সমুদ্রের উপর শহর নির্মাণ করা থেকে শুরু করে কাঠের খুঁটির উপর তৈরি করার পরও কাঠের খুঁটি পচে যায়নি কেন; এসবের পেছনেই রয়েছে আলাদা আলাদা গল্প। আর এগুলোই আজকের আলোচ্য বিষয়।

ভেনিস নগরী; Image source: earthtrekkers.com

ভেনিস শহর নির্মাণের পেছনের গল্প

ভেনিস নির্মাণের ইতিহাস শুরু হয় পঞ্চম শতকের দিকে। সময়টা ছিল পশ্চিমা রোমান সাম্রাজ্যের পতনের শুরুর দিক। উত্তরের দিক থেকে বর্বর ও অসভ্য জাতি রোমের প্রাক্তন অঞ্চলগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য উঠে পড়ে লাগে। নিরীহ বাসিন্দাদের উপর বর্বর হামলা চালানো এবং লুটপাট খুব সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এসব হামলা থেকে বাঁচার জন্য বাসিন্দারা অন্য কোথাও ঘরবাড়ি তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ভূমি ছেড়ে জলাভূমির উপরই বাসস্থান নির্মাণ করা তাদের কাছে উপযুক্ত বলে মনে হয়। বালুময় তিনটি দ্বীপ- টরসেলো, জেসোলো এবং মালামোক্কোর কাছেই শুরু হয় ভেনিস শহরের নির্মাণ।

মানচিত্রে টরসেলো, জেসোলো এবং মালামোক্কো; Image source: unive.it

শুধুমাত্র বর্বর জাতির হামলা থেকে বাঁচার তাগিদেই সাময়িক সময়ের জন্য এই নির্মাণকাজ করার কথা থাকলেও, ধীরে ধীরে তা স্থায়ী রূপ নেওয়া শুরু করে। শুরুর দিকে এই কাজ শুধুমাত্র জেলেদের পরিবার, অর্থাৎ যাদের সাঁতার এবং পানির উপর ভেসে ভেসে ঘুরে থাকার অভিজ্ঞতা দু’টোই রয়েছে, তাদের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরের দিকে তা বিস্তৃতি লাভ করতে শুরু করে। প্রথমদিকে কম মানুষ থাকায় কিছু কাঠ, খড় এবং মাটির সহায়তায় কম ওজনের বাড়িঘর তৈরি করে বসবাসের কাজে ব্যবহার করা হয়। তবে পরবর্তী সময়ে অস্থায়ী বাসস্থানে প্রচুর মানুষের ধকল সামলাতে মজবুত এবং শক্ত ভিত্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সেখানকার বাসিন্দারা।

দিনে দিনে এসব জায়গায় মানুষের আগমনের কারণ ছিল বহিঃশত্রুদের আক্রমণ। এদের জন্য জলাভূমিতে আক্রমণ করা কষ্টকর ছিল। সেজন্যই ধীরে ধীরে সবাই নিজেদের আবাসস্থল ছেড়ে সমুদ্রের উপরই বসবাসের সিদ্ধান্ত নেয়। বাসস্থানের ভিত্তিকে মজবুত এবং টেকসই করতে কোনো শক্ত মাধ্যমের প্রয়োজন আছে, আর এক্ষেত্রে বাসিন্দারা এই প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে ব্যবহার করে কাঠ। কাঠের খুঁটি, কাঠের পাটাতন একের পর এক জোড়া লাগিয়ে শুরু হয় ভেনিস নির্মাণের কাজ। দুর্ভোগের সময় ভিত্তি তৈরির জন্য শুধু কাঠের যোগাড় করাই তাদের পক্ষে করা সম্ভব ছিল। তাছাড়া, এসব নির্মাণকাজে তখন আধুনিক যন্ত্রপাতিও ছিল না। তাই কাঠই হয়ে দাঁড়ায় তাদের ভিত্তি নির্মাণের মূল উপকরণ। 

নির্মাণ ও টিকে থাকার রহস্য

সাধারণত কোনো ভবন বা সেতু তৈরিতে লোহার বা কোনো শক্ত মাধ্যম ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আসল কথা হলো, এমন কোনো ভিত্তি লাগবে, যা কাঠামোর ভার নিতে পারবে এবং দীর্ঘমেয়াদেও সহজে নষ্ট হবে না। লোহা এবং কংক্রিটের ব্যবহার দেখে অভ্যস্ত লোকেদের কাঠের ভিত্তির উপর এমন নির্মাণ দেখে আশ্চর্য হতেই হয়। আর কিছু না হোক, পানির নিচে কাঠের খুঁটি থাকা সত্ত্বেও তা পচে যাচ্ছে না কেন, তা তো ভাবার মতোই একটি বিষয়। ভিত্তিতে কোনো রকম পচন দেখা যায়নি ভেনিসের ক্ষেত্রে। 

ওক গাছ; Image source: wholesalenurseryco.com

ভেনিস শহর নির্মাণে ব্যবহৃত হয় ওক এবং লার্চ গাছের কাঠ। প্রায় ৬০ ফুট লম্বা কাঠের খুঁটি পানির নিচে নরম কাদা এবং পাথরের নিচে শক্ত করে প্রতিস্থাপিত হয়। শত শত বছর ধরে পানির নিচে থাকা এসব গাছের কাঠের তৈরি খুঁটি এবং তক্তাই নগরীর ভবনগুলোকে নিজের জায়গায় ধরে রেখেছে। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে যে, কাঠের খুঁটি এত বছর ধরে পানির নিচে থাকা সত্ত্বেও টিকে আছে কীভাবে? এতদিনে তো এগুলো পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। এক্ষেত্রে কিছু বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায়। কাঠের পচন শুধুমাত্র তখনই শুরু হয়, যখন পরিবেশে পানি এবং অক্সিজেন উভয়ই উপস্থিত থাকে। গভীর সমুদ্রে বা জলাশয়ে অক্সিজেন অনুপস্থিত। যদি থাকেও, তাহলে তা পরিমাণে একেবারেই নগণ্য। আর একারণেই পানির গভীরে থাকার পরও কাঠে পচন ধরতে পারে না। ফলে, নগরীর ভিত্তিগুলোও শক্তভাবে টিকে আছে। তাছাড়া ভিত্তিগুলো তৈরিতে ব্যবহৃত ওক এবং লার্চ গাছের কাঠ অত্যন্ত পানি প্রতিরোধী।

ভেনিস টিকে থাকতে পারত না যদি তার ভিত্তিগুলো নড়বড়ে হতো কিংবা সরে যেত; Image source: instasaver.org

ভেনিস নগরী টিকে থাকতে পারত না যদি তার ভিত্তিগুলো নড়বড়ে হতো কিংবা সরে যেত। এ যাত্রাও সফলভাবে পার করতে সক্ষম হয়েছে শহরটি। সাগরের গভীরে পলিমাটির নিচে একটি স্তর থাকে, যা শক্ত মাটি দিয়ে তৈরি। একে বলা হয় ক্যারান্টো। লবণাক্ত পানিতে থাকা খনিজ পদার্থ দিয়েই তৈরী স্তরটি। এ স্তরে খুঁটিগুলো স্থাপন করার ফলে ভিত্তিও বেশ মজবুত হয়। তাছাড়া জলাভূমির গভীরে থাকা খুঁটির নিচের অংশে প্রতিনিয়ত নুড়ি, পাথর, মাটি এসে জমা হয়, যা খুঁটিগুলোর সাথে মাটির সংযোগ আরো মজবুত করে। ফলে দিনের পর দিন খুঁটি সরে যাওয়ার বদলে তা আরো টেকসই হয়। কাঠ এসব পলিমাটি শোষণ করে শক্ত খুঁটিতে পরিণত হয়েছে। আর এক্ষেত্রে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি সহায়তা করেছে। পানিতে থাকা খনিজ পদার্থগুলো এই ভিত্তি শক্ত করতে ভূমিকা রেখেছে।

সান্তা মারিয়া ডেলা স্যালুট চার্চ; Image source:airfrance.com.tr

১৭ শতকে লেখা একটি বইয়ের তথ্য মোতাবেক ভেনিস শহরে অবস্থিত সান্তা মারিয়া ডেলা স্যালুট চার্চ নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে ১১,০৬,৬৫৭টি কাঠের খুঁটি। প্রতিটি খুঁটির উচ্চতা ছিল প্রায় ৪ মিটার। চার্চটি নির্মাণ করতে সময় লাগে দু’ বছর দু’মাস। প্রক্রিয়াটি বেশ কষ্টকর, তাই সময় বেশি লাগারই কথা। তাছাড়া কাঠের যোগাড় করতে হতো অন্য জায়গা থেকে। আর যোগাড় করে পানিপথে আনা হতো কাঠগুলো। এ শহর নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত কাঠগুলোর অধিকাংশই আসে স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া এবং মন্টিনিগ্রো থেকে।

মানচিত্রে স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া এবং মন্টিনিগ্রো; Image source: kompas.net

এভাবেই নির্মিত হয় ভেনিস নগরী। তবে অনন্য সৌন্দর্যে ঘেরা শহরটির পরিস্থিতি এখন অবনতির পথে। কাঠের ভিত্তির উপর তৈরি ভাসমান নগরী ভেনিস ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে পানির নিচে। ২০০০ থেকে ২০১০ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি বছর গড়ে ০.০৪ থেকে ০.০৮ ইঞ্চি ভূমি চলে যাচ্ছে সাগরের নিচে। এর একটি কারণ অবশ্যই সমুদ্রের পানির স্তর বেড়ে যাওয়া। আর এর পেছনে দায়ী বৈশ্বিক উষ্ণতা। তবে, এই একটি কারণেই ঐতিহ্যবাহী ভেনিস শহরকে এই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে না। আরো কারণ রয়েছে। যেমন- মাটির গভীর থেকে প্রতিনিয়ত পানি উত্তোলন করা। এর ফলে সমুদ্রের তলদেশের খনিজ স্তর আরো নিচের দিকে চলে যাচ্ছে। ফলে শহরটির ভিত্তি হয়ে যাচ্ছে দুর্বল। তবে মাটির গভীরতলে পানি উত্তোলন হওয়ায় এই ঝুঁকি কমে গেলেও বাকি ঝুঁকি রয়েই গেছে। 

This article is in Bangla language. It's about how Venice city was built.

References have been hyperlinked inside the article. 

Featured image: earthtrekkers.com
 

Related Articles