ঈদ, পূজা কিংবা অন্য কোনো উপলক্ষ্য সামনে রেখে পরিবারের সবাই একত্র হওয়া বাংলাদেশি সমাজের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রথা। বর্তমানে পেশাগত ও অন্যান্য কারণে যৌথ পরিবারের সংখ্যা কমে গিয়েছে এবং গ্রাম ছেড়ে মানুষ শহরমুখী হয়েছে, হচ্ছে। অতীতে কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজে একান্নবর্তী যৌথ পরিবারগুলোতে সবাই একসাথে থাকতেন, ফলে আলাদা করে কোনো উপলক্ষ্য সামনে রেখে একত্র হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। আমরা দেখে থাকি, বিভিন্ন উৎসবকে সামনে রেখে শহরে থাকা মানুষেরা গ্রামে ফিরে যান, আত্মীয়দের সাথে দেখা করেন, পরিবারের সবার সাথে গল্পগুজবে মেতে ওঠেন। শুধু বাংলাদেশই নয়, পৃথিবীর সব অঞ্চলেই শেকড় থেকে দূরে থাকা মানুষেরা সুযোগ পেলেই নিজের পরিবারের কাছে ফিরে যান, কারণ শেকড়ের টান উপেক্ষা করা সম্ভব নয় মানুষের পক্ষে। আফ্রিকার একটি দেশে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ‘ফ্যামিলি গেট-টুগেদার’-এ জীবিত মানুষদের সাথে যোগ দেয় পরিবারের মৃত সদস্যরাও!
আফ্রিকার একটি দেশ মাদাগাস্কার। পুরো দেশটাই ভৌগলিকভাবে একটি দ্বীপ এবং আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দ্বীপগুলোর তালিকায় এই দেশটির অবস্থান চতুর্থ। এই দেশেরই একটি অদ্ভুত উৎসবের স্থানীয় নাম ‘ফামাদিহানা’। এটি এমন একটি উৎসব, যেখানে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে মাটির নিচ থেকে পরিবারের মৃত সদস্যদের মৃতদেহ উত্তোলন করা হয়, তারপর পুরো এলাকায় সেই মৃতদেহ নিয়ে নাচ-গান করা হয়।
একটি পরিবারের প্রায় সব সদস্যকেই এই উৎসবের সময় একত্রিত করা হয়, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একটি পরিবারের সমস্ত সদস্য মিলিয়ে সংখ্যাটি দু’শো ছাড়িয়ে গিয়েছে। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে দুই শতাধিক মানুষের খাওয়াদাওয়ার ব্যয়ভার বহন করা বেশ ব্যয়বহুল একটি ব্যাপার। তাই উৎসবের আগেই একটি পরিবার প্রায় বছরখানেক ধরে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আফ্রিকায় মৃতদেহকে কেন্দ্র করে যেসব লোকাচারের প্রচলন রয়েছে, সেসবের মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত বোধহয় মাদাগাস্কারের এই ‘ফামাদিহানা’।
মাদাগাস্কারে মানুষকে কবর দেয়ার বিষয়টিও বেশ অদ্ভুত। দ্বীপের বেশিরভাগ মানুষ তাদের পরিবারের জন্য দুটি কবর খনন করে। একটি কবরে থাকে শুধু পরিবারের নারী সদস্যদের মৃতদেহ, অপরটিতে থাকে পুরুষ সদস্যদের মৃতদেহ। নারীদের কবরে কখনও ভুলেও পুরুষদের শায়িত করা হয় না, ঠিক একইভাবে পুরুষদের কবরেও ভুলে নারীদের শায়িত করা হয় না। তবে শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে এই নিয়ম শিথিল করা হয়েছে। প্রতিটি পরিবার কবরের পেছনে বিশাল অংকের অর্থ খরচ করে থাকে। এতই বেশি যে, তাদের বাড়ির চেয়ে গত হওয়া মানুষদের কবর বেশি ব্যয়বহুল ও জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে থাকে। কারণ মাদাগাস্কারে ধরে নেয়া হয়, যার বাড়ির সাথে সংযুক্ত কবর যত বেশি জাঁকজমকপূর্ণ ও দামী, তার সামাজিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক সামর্থ্যও তত উঁচুতে।
ফামাদিহানা উৎসবের আয়োজন করা হয় সাধারণত জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে। এই সময়ে মাদাগাস্কার দ্বীপে শীত থাকে। একজন স্থানীয় জ্যোতির্বিদের মাধ্যমে সময় ঠিক করে নেয়া হয়। বর্ষাকালে বৃষ্টির আশংকা থাকে এবং গ্রীষ্মকালের উষ্ণ আবহাওয়ায় মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে নাচ-গান করা বেশ কষ্টের কাজ– এজন্য শীতকালই বেছে নেয়া হয়েছে।
উৎসবের সময় কবর থেকে পরিবারের মৃত সদস্যদের লাশ উত্তোলন করা হয়। লাশের কংকালকে উত্তোলনের পর নতুন সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে কোনো ম্যাটের উপর রাখা হয়। পরিবারের সদস্যরা সাধারণত সেই ম্যাটের বিভিন্ন প্রান্ত ধরে থাকেন। ম্যাট ও সাদা কাপড়– দুটোকেই সুগন্ধি মাখানো হয় এবং মাখানো হয়ে গেলে সেগুলো ‘পবিত্র’ হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। লাশ উত্তোলন করার জন্য যখন কবরের ভেতরে প্রবেশ করা হয়, তখন সবার হাতে মোমবাতি থাকে। লাশটি উত্তোলনের পর যখন নাচ-গানের পর্ব শুরু হয়, তখন যারা লাশবাহী ম্যাটের বিভিন্ন প্রান্ত ধরে থাকেন, তারা বেশ সতর্ক থাকেন যাতে সাদা কাপড়ে মোড়ানো কংকাল কোনোভাবেই মাটিতে পড়ে না যায়।
মাদাগাস্কার দ্বীপের অধিবাসীরা বিশ্বাস করে, পরিবারের কোনো সদস্যকে যদি বাড়ি থেকে দূরে কোথাও কবর দেয়া হয়, তাহলে সেটি পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে। আরও বিশ্বাস করা হয়, যদি ফামাদিহানা উৎসবের সময় মৃত ব্যক্তির লাশের সাথে ভালো ব্যবহার না করা হয়, তবে পরজন্মে অনেক বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। ফামাদিহানাকে দেখা হয় একটি উপলক্ষ্য হিসেবে, যেসময় পরিবারের মৃত সদস্যরা জীবিতদের সাথে একত্রিত হতে পারেন। আমাদের এই উপমহাদেশে মৃত ব্যক্তির লাশের সাথে অনেক শোক জড়িয়ে থাকে, যখন কোনো ব্যক্তিকে কবরে দাফন করা হয় কিংবা চিতায় পোড়ানো হয়, তখন পরিবেশ আবেগঘন হয়ে ওঠে, মৃতব্যক্তির আত্মীয়স্বজনেরা অতীতের বিভিন্ন স্মৃতির কথা মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মাদাগাস্কারে পুরো উল্টো ঘটনা ঘটে। যখন কবর থেকে পরিবারের মৃত সদস্যদের লাশ উত্তোলন করা হয়, তখন সবাই হাসতে থাকেন। সেখানে মৃত্যু কোনো শোকের বিষয় নয়।
আগেই বলা হয়েছে, এই উৎসব বেশ ব্যয়বহুল। মৃত মানুষের বংশের সমস্ত ব্যক্তিকে ডাকা হয় এবং প্রায়ই সংখ্যা দুশো ছাড়িয়ে যায়। ফামাদিহানা চলে দুই থেকে সাত দিন পর্যন্ত। যিনি আয়োজন করেন, তিনি আগে থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করেন যাতে করে আত্মীয়স্বজন ডেকে আনার পর কোনো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না হয়। আত্মীয়স্বজন বাদ দিয়ে প্রতিবেশীরাও এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেন এবং সৌজন্য হিসেবে আয়োজক পরিবারকে উপহার হিসেবে কিছু অর্থ প্রদান করেন। এই উৎসবের সময় প্রচুর মদ্যপান করা হয়। এমনকি যারা কবরে লাশ উত্তোলন করতে যান, তাদের হাতেও আফ্রিকান রামের বোতল থাকে। যারা লাশ কাঁধে নিয়ে নৃত্য পরিবেশন করেন, তারাও আগে মনমতো মদপান করে নেন। মৃতদেহ আবার কবরে শায়িত করবার আগে যে ম্যাটটিতে বহন করা হয়েছিল, সেটি উৎসবে অংশগ্রহণকারী সবাই স্পর্শ করেন। সবশেষে আয়োজক পরিবার ম্যাটটি নিজের বাড়িতে রেখে দেন এই বিশ্বাসে যে, এটি পরিবারের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে।
এই উৎসবের সময় পরিবারের প্রধান কর্তা পশুও উৎসর্গ করে থাকেন। উৎসর্গীকৃত পশুর মাংস দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করার পাশাপাশি বাড়তি মাংস স্থানীয় দরিদ্র মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, আঠারো শতকের পর থেকে এই প্রথা চালু হয়েছে, তবে একেবারে সঠিক সময়ের খোঁজ পাওয়া যায় না কোথাও। ধারণা করা হয়, একটি যুদ্ধের পর নিহত সেনাদের মৃতদেহ দ্বিতীয়বার কবর দেয়ার ঘটনা থেকেই এই প্রথার প্রচলন ঘটে। ঔপনিবেশিক শাসনামলে যখন খ্রিস্টান মিশনারীদের আগমন ঘটে, তখন তারা এই প্রথার বিরোধিতা করেছিল বটে, কিন্তু স্থানীয় মানুষ কখনও এই প্রথা পালন থেকে সরে আসেনি।
আফ্রিকার দেশগুলোতে মৃতদেহ নিয়ে অদ্ভুত সব প্রথার প্রচলন রয়েছে, ইতিহাস ঘাঁটলেই সেসব দেখা যায়। মিশরের বিখ্যাত পিরামিডের প্রতিষ্ঠাতা ফারাওদের কথাই ধরা যাক। পরকালের জীবনে যাতে কোনো কষ্ট না হয়, সেজন্য দাসী ও পোষা প্রাণীগুলোর মমি বানিয়ে ফারাওয়ের মমির সাথে রেখে আসা হতো এবং সেই সাথে দেয়া হতো অসংখ্য দামী জিনিসপত্র। কিন্তু মাদাগাস্কার দ্বীপের ফামাদিহানা উৎসব ছাড়িয়ে গিয়েছে বাকি সবকিছুকে। পরিবারের সদস্যদের একত্রিত হওয়ার ক্ষেত্রে যখন মৃত সদস্যদেরও অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়, তখন অবাক না হয়ে পারা যায় না। অতিরিক্ত খরচ এবং ক্যাথলিক মিশনগুলো থেকে বিরোধিতা সত্ত্বেও বছরের পর বছর ধরে এই প্রথা চলে আসছে স্রেফ মানুষের বিশ্বাসের উপর ভর করে।