রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কট্টর সমালোচক অ্যালেক্সেই নাভালনি বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় এসেছেন। তিনি পুতিন সরকারের দুর্নীতি নিয়ে খুব সোচ্চার থাকেন সবসময়। এবার তিনি আক্রান্ত হয়েছেন সন্দেহজনক বিষক্রিয়ায়। তিনি বর্তমানে আছেন জার্মানির চ্যারিটে হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে। সেখানে তার শরীরে বিষের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল রাশিয়া সরকারের কাছে আবেদন করেছেন এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য।
তার পরিবার ও সমর্থকরা মনে করছেন এর পেছনে দায়ী ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিন এই ঘটনার জন্য দায়ী কি না তা হয়তো কখনো জানা যাবে না। তবে রাশিয়ায় বিরোধী দলীয় বা ভিন্নমত প্রকাশকারীদের ওপর বিষ প্রয়োগের অভিযোগ নতুন কিছু নয়।
গত বৃহস্পতিবার অ্যালেক্সেই নাভালনি বিমানযোগে সাইবেরিয়া থেকে মস্কোতে আসছিলেন। তিনি বিমানে ওঠার আগে সাইবেরিয়ার বিমানবন্দরে চা পান করেন এবং বিমানের ভেতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিমানটি তখন কাজাখস্তানের কাছে ওমস্ক শহরে জরুরি অবতরণ করে। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে এবং তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। সন্দেহ করা হচ্ছে সেই চায়ে বিষ মেশানো ছিল।
হাসপাতালের চিকিৎসা নিয়ে নাভালনির স্ত্রী বা তার সমর্থকরা খুবই অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাদের ভাষ্যমতে, হাসপাতালের চিকিৎসকরা ক্রেমলিনের চাপে ছিলেন। তারা নাভালনির উপযুক্ত চিকিৎসা করার চেয়ে বিষক্রিয়ার অভিযোগ ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত ছিল। তাদের অভিযোগ, সেখানকার সব ওষুধপত্র ব্যবস্থাপনা রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি (সাবেক কেজিবি) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। এমনকি নাভালনির স্ত্রীকেও হাসপাতালের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
তারা চাচ্ছিলেন নাভালনিকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হোক, তারা অন্য কোনো হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাবেন, যেখানকার চিকিৎসকদের ওপর তারা ভরসা করতে পারেন। গত শুক্রবার বার্লিনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা সিনেমা ফর পিস ফাউন্ডেশন একটি বিমান পাঠায় নাভালনিকে জার্মানিতে নিয়ে চিকিৎসা করার জন্য। কিন্তু রাশিয়ার পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত শনিবারে তাদের অনুমতি দেওয়া হয়।
সাইবেরিয়ার হাসপাতালের চিকিৎসকদের ভাষ্য অনুযায়ী নাভালনি বিষক্রিয়ার শিকার হননি। বরং তিনি মেটাবলিক ডিজঅর্ডারে ভোগে শরীরে সুগারের পরিমাণ কমে যাওয়ায় অচেতন হয়ে গেছেন দাবি করছেন তারা। তার শরীরে কোনো বিষের নাকি অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এবারই প্রথম নয়, গত বছরও নাভালনি বিষক্রিয়ার শিকার হয়েছিলেন। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার, আক্রমণের শিকার তো হয়েছেনই।
কে এই অ্যালেক্সেই নাভালনি?
৪৪ বছর বয়সী অ্যালেক্সেই নাভালনি পেশাগত জীবনে একজন আইনজীবী। তার রাজনীতির শুরুটা হয় ২০০৮ সালে। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বড়ো বড়ো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি ও অসঙ্গতি নিয়ে ব্লগিং করতেন। পরে পুতিনের ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। তিনি তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
২০১১ সালে রাশিয়ার সংসদ নির্বাচনের সময় ভোটারদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, পুতিনের ইউনাইটেড রাশিয়া ছাড়া যেকোনো দলকে ভোট দিতে। তিনি পুতিনের পার্টিকে ‘অসৎ ও চোরের দল’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে পুতিন জয়ী হন। তার বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতির অভিযোগে তখন মস্কোসহ রাশিয়ার অন্যান্য বড়ো বড়ো শহরে আন্দোলন শুরু হয়।
সেই আন্দোলনের সময় নাভালনিকে ১৫ দিন জেলে আটকে রাখে পুতিন সরকার। এরপর পুনঃনির্বাচনেও পুতিন সহজেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তখন নাভালনিকে কঠোর জেরার সম্মুখীন হতে হয়। তার অতীতের কার্যক্রম নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। এমনকি তার আইনজীবী হওয়ার বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।
২০১৩ সালে তাকে জালিয়াতির অভিযোগে পাঁচ বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে অপ্রত্যাশিতভাবে মস্কোর মেয়র নির্বাচনের সময় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পুতিন ঘরানার সের্গেই সোবিয়ানিনের সাথে মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গেলেও নাভালনি ২৭% ভোট পান। এটাকে তার জন্য একপ্রকার বিজয়ই ধরা হয়েছিল। কারণ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন বা মিডিয়ায় তার প্রবেশাধিকার ছিল না। শুধুমাত্র ইন্টারনেট ও জনগণের মুখের কথার ওপর নির্ভর করে এত ভোট পাওয়া ছিল অবিশ্বাস্য।
ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতে বলা হয়, নাভালনির সাথে অন্যায্য আচরণ করা হয়েছে। তখন তার অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৭ সালে তাকে পুনরায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে পুতিনের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বীতার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেটাকে ভঙ্গুর করে দিতেই তাকে প্রহসনমূলক বিচারের সম্মুখীন করা হচ্ছে বলেছিলেন তিনি।
২০১৭ সালের এপ্রিলে তার মুখে এন্টিসেপ্টিক সবুজ রঙ ঢেলে দেয় পুতিন সমর্থকরা। এতে তিনি তার চোখের নিকটবর্তী অংশে রাসায়নিক দহনের শিকার হন। গত বছরও জেলে থাকা অবস্থায় এলার্জিজনিত রোগ কন্ট্যাক্ট ডার্মাটাইটিসে আক্রান্ত হন। সন্দেহ করা হয়, তাকে তখনও বিষ প্রয়োগ করা হয়।
তিনি স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে মস্কোতে থাকেন। ছোটোবেলায় ছুটির সময়টা কাটাতেন চেরনোবিল শহরের নিকটবর্তী অঞ্চলে, যেখানে তার বাবা ও অন্যান্য আত্মীয়রা থাকতেন। তাদের কাছে চেরনোবিলের নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের পরবর্তী সময়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পার্টির সদস্যদের দুর্বব্যবহার ও দুর্নীতির গল্প শুনে সরকার বিরোধী হওয়ার অনুপ্রেরণা পান।
নাভালনির ওপর বিষ প্রয়োগের জন্য কি পুতিন দায়ী?
পুতিনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সরাসরি কোনো প্রমাণ নেই। তবে রাশিয়ায় ভিন্নমত প্রকাশকারীদের ওপর বিষ প্রয়োগের ইতিহাস আর পুতিনের কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা সেদিকে অনেকটাই ইঙ্গিত দেয়।
২০০৪ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ান ভিক্টর ইউশচেনকো। তিনি নির্বাচনী প্রচারনীতে পুতিন বিরোধী বক্তব্য দেন। সেই সময় ডাইওক্সিন নামক বিষাক্ত পদার্থ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থারা এতে জড়িত ছিল।
২০০৬ সালে লন্ডনে সাবেক রাশিয়ান গুপ্তচর আলেক্সান্ডার লিটভিনেঙ্কোর চায়ে পোলোনিয়াম-২১০ নামে তেজস্ক্রিয় রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে দেওয়া হয়। এতে দুই সপ্তাহ পর তিনি মারা যান। এর পেছনেও পুতিনকে দায়ী মনে করা হয়।
অতীতের ইতিহাস যদি না-ও বিবেচনা করা হয়, নাভালনির ঘটনায় পুতিনের জড়িত থাকার পেছনে দুই ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
প্রথমত, যদি নাভালনির পরিবারের দাবি অনুযায়ী ওমস্ক শহরের হাসপাতালে রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির জড়িত থাকার ঘটনা সত্য হয়, তাহলে পুতিন বা তার ঘনিষ্ঠ কেউ নিবিড়ভাবে নাভালনির পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। জার্মানি থেকে বিমানে আসা চিকিৎসকদের হাসপাতালে নাভালনিকে দেখতে দেওয়া হয়নি।
এটা সত্য হয়ে থাকলে ইঙ্গিত দেয় তারা কিছু লুকাতে চাচ্ছিল। হয়তো পুতিন বিরোধী নেতার শরীরে বিষের অস্তিত্ব বিদেশি ডাক্তাররা খুঁজে পাওয়ার ভয় ছিল। পুতিন সাবেক কেজিবি-র স্পাই ছিলেন। তাই এই কাজ পরিচালনা করা তার জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেই হাসপাতালে বিষের অস্তিত্ব পাওয়ার কথা অস্বীকার করা এবং জার্মানির হাসপাতালে বিষের প্রমাণ পাওয়া এই সন্দেহ আরো ঘনীভূত করে তুলেছে। পুতিন যদি নিজে জড়িত না-ও হন, তাকে খুশি করতে অতি উৎসাহী কোনো মহলও এটা করে থাকতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ভ্লাদিমির পুতিনের সময় এখন ভালো যাচ্ছে না। একদিকে করোনাভাইরাসের মহামারি সামলাতে হচ্ছে, তার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে আন্দোলন হচ্ছে, আবার বেলারুশে তার মিত্র সরকার আন্দোলনের সম্মুখীন হচ্ছে। এই অবস্থায় পুতিন হয়তো তার প্রতিপক্ষকে একটা কঠোর বার্তা দিয়ে রাখতে চাচ্ছেন।
যদি এটা তার পরিকল্পনা হয়ে থাকে, তবে তা আদৌ কতটুকু কাজে দেবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ নাভালনি যদি সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন, তাহলে তিনি পুতিন বিরোধী নেতা হিসাবে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবেন। সন্দেহজনক আক্রমণের শিকার হওয়ায় জনগণের সহানুভূতিও তার প্রতি বেশি থাকবে। পুতিন তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দিতে গিয়ে তাকে হয়তো আরো শক্তিশালী করে ফেলছেন। সেটা হবে কি না বা পুতিন ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন কি না তা সময়ই বলে দেবে।