২১ মে, ২০০৩। অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট। ত্রিশোর্ধ্ব এক নারী বসে আছেন বিবাদীর চেয়ারে। তার মুখে আশা-নিরাশার ছায়া। ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়ান ট্যবলয়েডে তাকে শিশুহত্যাকারী তকমা দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে অস্ট্রেলিয়ার নিকৃষ্টতম সিরিয়াল কিলারের টাইটেলও সেঁটে দিয়েছে তার ঘাড়ে। মিডিয়া ট্রায়ালের তোপে জনগণের চোখেও রায় ঘোষণা আগেই অপরাধী বনে গেছেন সেই নারী, ক্যাথেরিন ফলবিগ।
জুরি সিস্টেমে হচ্ছে এই বিচার। ইতোমধ্যে বাদী আর বিবাদী দুই পক্ষের উকিল যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন। জুরিরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা সেরে এখন রায় ঘোষণা করবেন। সুতার উপর ঝুলছে ক্যাথেরিন ফলবিগের ভাগ্য। জুরিদের পর্যবেক্ষণে নিজের চার সন্তানকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলেন ক্যাথেরিন। তিন সন্তানের ব্যাপারে নরহত্যা আর এক সন্তানের জন্য খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে জানালেন জুরিরা। দণ্ড প্রদানের দায়িত্ব এরপর বিচারকের ঘাড়ে চলে গেল। ক্যাথেরিন ভেঙ্গে পড়লেন কান্নায়। বারে বারে জোর দিয়ে বলতে লাগলেন তিনি খুনী নন।
এক দুর্ভাগার গল্প
ক্যাথেরিনের জন্ম ১৯৬৭ সালের ১৪ জুন। শৈশব থেকেই নানা যন্ত্রণা সয়ে বড় হয়েছেন তিনি। তার বয়স যখন মাত্র ১৮ মাস তখন তার পিতা, থমাস ব্রিটন আর তার মা’র মধ্য একবার টাকাপয়সা নিয়ে ঝগড়া লেগে যায়। থমাস তখন মাতাল। ছুরি হাতে স্ত্রীকে তাড়া করলেন তিনি। সিডনির রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করেন তার সন্তানের মা’কে।
ক্যাথেরিন বেড়ে উঠেন নিজের মতো। ১৫ বছর বয়সে পরিচয় হয় ক্রেগ ফলবিগ নামে এক যুবকের সাথে ১৯৮৭ সালে বিয়ে করেন তারা। দুবছর পর তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় প্রথম সন্তান, ছেলে ক্যালেব। ফলবিগ দম্পতির খুশি বেশিদিন স্থায়ী হলো না। জন্মের ১৯ দিনের মাথায় মারা গেল ক্যালেব। চিকিৎসকেরা কারণ হিসেবে উল্লেখ করলেন সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম, সংক্ষেপে এসআইইডিএস।
সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম
কি এই এসআইডিএস? সাদা কথায় ইনফ্যান্ট, বা এক বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে সমস্ত চেষ্টার পরেও যখন কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না তখন তাকে চিকিৎসকেরা সাধারণত এসআইডিএস হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। ১৯৬৯ সালে প্রথম এই শব্দগুচ্ছে ব্যবহার হলেও এই ঘটনা ঘটে আছে হাজার বছর ধরে।
শতকরা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে এসআইডিএসের ঘটনা ঘটে জন্মের পর প্রথম ছয় মাসে। সবথেকে বেশি ঝুঁকি ২-৪ মাস বয়সে। বলা হয় প্রতি ১০০০ শিশুজন্মের মধ্যে এসআইডিএসের হার সর্বনিম্ন ০.২ থেকে ৬ পর্যন্ত হতে পারে। উল্লেখ্য যে বর্তমানে এসআইডিএসের হার অনেক কমে এসেছে, যার একটি কারণ, কীভাবে একে সংজ্ঞায়িত করা হবে তা নিয়ে মতবিরোধ। অনেক শিশুমৃত্যু, যা হয়তো আগে এসআইডিএস হিসেবে শনাক্ত হতো, তা এখন চিকিৎসকেরা অন্য নির্দিষ্ট নামে রিপোর্ট করেন।
হতভাগ্য ক্যাথেরিন
ক্যালেবের মৃত্যুর পর নতুন আশায় বুক বাঁধেন ফলবিগরা। দ্বিতীয় সন্তান ছেলে প্যাট্রিক অ্যালেন জন্ম নেয় ১৯৯০ সালের ৩ জুন। পরের বছর ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে সেও মারা যায়। চিকিৎসকেরা রিপোর্টে লিখলেন খিঁচুনি থেকে শ্বাস বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। প্যাট্রিকের পর বিধ্বস্ত ফলবিগ দম্পতি নিউ সাউথ ওয়েলসে চলে আসেন। ১৪ অক্টোবর, ১৯৯২ তে জন্ম হয় মেয়ে সারাহ’র। দশ মাসের মাথায় ভাইদের পথ ধরল সে। চিকিৎসকেরা ব্যর্থ হন মৃত্যুর কারণ খুঁজে পেতে।
১৯৯৬ সালে সিডনির দক্ষিণে নিউক্যাসেল এলাকায় বাসা বাঁধেন ক্যাথেরিন ও ক্রেগ। ১৯৯৭ সালের ৭ অগাস্ট এখানে জন্ম নেয় চতুর্থ সন্তান, মেয়ে লরা। ১৯৯৯ সালের মার্চে যখন চোখ বুজলো সে তখন তার বয়স ১৮ মাস। একমাত্র লরার মৃত্যুই এসআইডিএসের সময়কালের বাইরে ছিল। প্রাথমিকভাবে তার চিকিৎসক অ্যালান ক্যালা লরার মৃত্যুর কারণ অমীমাংসিত বলে বর্ণনা করেন। তবে ময়নাতদন্তে চিকিৎসকেরা লরার হৃদযন্ত্রে সমস্যা শনাক্ত করেছিলেন।
প্রতিটি মৃত্যুর ক্ষেত্রে ক্যাথেরিনই প্রথম অকুস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন। যেহেতু তিনি মা, সুতরাং এটি খুব অস্বাভাবিক মনে করার কারণ নেই। চারটি সন্তানের মৃত্যুর পরেও কেউ তার দিকে তাই আঙ্গুল তোলেনি। তবে পরবর্তীতে স্বামী ক্রেগ দাবি করেছিলেন যে ছেলেমেয়েদের মৃত্যুতে স্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তার মধ্যে সন্দেহ কাজ করতো। এই সন্দেহ তীব্র হয় লরার মৃত্যুর পরপর, ১৯৯৯ সালের মার্চে। ক্রেগ স্ত্রী’র নিজ হাতে লেখা ডায়েরি খুঁজে পান।
ডায়েরির লেখা দেখে ক্রেগ স্তম্ভিত হয়ে যান। ক্যাথেরিন সেখানে লিখে রেখেছেন সারাহ সামান্য সাহায্য নিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করেছিল। হত্যাকারী পিতার দিকে ইঙ্গিত করে তার মতই হয়েছেন বলেও (I am my father’s daughter) ক্যাথেরিন দাবি করেন ডায়েরিতে। ক্রেগ ছুটে যান পুলিশের কাছে। অভিযোগ করেন স্ত্রীর বিরুদ্ধে। নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিশ তদন্ত শুরু করে ক্যাথেরিন ফলবিগের ব্যাপারে।
তদন্ত শেষে ক্যাথেরিনের নামে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। জুরি নির্বাচন শেষে শুরু হয় বিচার। সরকারি উকিল বা প্রসিকিউটর আর ক্যাথেরিনের উকিলদের বাদানুবাদ চলে সাত সপ্তাহ।
মিডৌজ ল’
প্রসিকিউটর দল ক্যাথেরিনকে খুনী প্রমাণে কাজে লাগায় ব্রিটিশ শিশু চিকিৎসক স্যার রয় মিডৌজের নামে বিখ্যাত হওয়া একটি মতবাদ, যা মিডৌজ ল’ (Meadow’s Law) নামে পরিচিত। এখানে বলা হয়েছিল একই পরিবারে একটি এসআইডিএসের ঘটনা দুর্ভাগ্য, দুটি সন্দেহজনক এবং তৃতীয়টি পরিষ্কার খুন, যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যকিছু প্রমাণিত হচ্ছে।
তবে যখন সরকারি উকিল মিডৌজ ল’ নিয়ে যুক্তিতর্ক সাজাচ্ছিলেন তখন খোদ ইংল্যান্ডেই এই সূত্র নিয়ে চলছিল তুমুল তর্কবিতর্ক। স্যালি ক্লার্ক নামে এক নারীকে দণ্ডিত করা হয়েছিল এর উপর ভিত্তি করে। কিন্তু আপিলের সময় নতুন তথ্য খুঁজে পাওয়া গেলে তাকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে তিন বছর জেল খাটার পর স্যালি বেরিয়ে আসেন।
ডঃ মিডৌজে যে অনুসিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে মিডৌজ ল’র কথা বলেছিলেন অন্যান্য চিকিৎসকেরা তার বিরোধিতা করেন। ব্রিটিশ পরিসংখ্যানবিদদের সোসাইটি জানিয়ে দেন ল’ প্রমাণে মিডৌজ যেসব ডাটা পেশ করেছেন তা সম্পূর্ণই তার মস্তিষ্কপ্রসূত। এর সাথে তাদের কোনো সংশ্রব নেই। চারদিকে শোরগোলে ব্রিটিশ সরকার মিডৌজ ল’র দ্বারা রায় প্রভাবিত এমন কেসগুলি পুনঃতদন্ত করেছিল, যার ফলে আরো কয়েকজন মুক্তি পান। পরবর্তীতে মিডৌজ ল’ বাতিল হয়ে যায়।
বিচার ও রায়
ক্যাথেরিনের বিপক্ষে প্রসিকিউটরের অন্যতম আরেকটি অস্ত্র ছিল তার ডায়েরি। এর লেখাকে তারা হত্যাকারী ক্যাথেরিনের স্বীকারোক্তি হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করেন। ক্যাথেরিনের উকিলদের দাবি ছিল তরুণী এক মা সন্তান হারানোর কষ্ট থেকে নিজেকে দোষী ভাবতেই পারেন, এটা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয় এবং একে স্বীকারোক্তি বলা চলে না। সারার ব্যাপারে তাদের বক্তব্য ছিল ক্যাথেরিন বলতে চেয়েছেন ঈশ্বর সারাকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে সাহয্য করেছেন।
সরকারি উকিল সাক্ষীরূপে হাজির করলেন লরার চিকিৎসক, ডঃ অ্যালানকে। তিনি জানালেন একই পরিবারে পরপর চার শিশুর মৃত্যু কস্মিনকালেও দেখেননি তিনি। প্রসিকিউটর তাকে বিশেষজ্ঞ সাক্ষী হিসেবে নথিভুক্ত করলেও ডঃ অ্যালান নিজের ব্যক্তিগত মতামত ছাড়া নিরপেক্ষ কোনো তথ্যপ্রমাণ দিতে পারেননি।
মিডৌজ ল, ক্যাথেরিনের ডায়েরি আর ডঃ অ্যালানের সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে সরকারি উকিল দাবি করেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসের দশ বছরের ব্যপ্তিতে একই মায়ের পরপর চার সন্তান বিশ্বাসযোগ্য কারণ ছাড়া মৃত্যুর কোনো উদাহরণ নেই। তারা পরিহাস করে বলেন যে এমন ঘটনার চেয়ে বরং মাথায় বজ্রপাত হওয়া বা শুকরছানার ডানা গজানো সহজ।
ক্যাথেরিনের উকিলেরা তাদের যুক্তির মাধ্যমে ক্যাথেরিনের দোষের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি চেষ্টা করেন। মক্কেলের ডায়েরির ব্যাখ্যা দেন তারা শোকে আচ্ছন্ন এক তরুণী মায়ের মানসিক চাপের বহিঃপ্রকাশরূপে। ডঃ অ্যালানের ব্যাপারে বলেন যে লরার মৃত্যুতে হৃদযন্ত্রের সমস্যা একটি কারণ হতে পারে, কাজেই সন্দেহাতীতভাবে ক্যাথেরিনকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। অন্যান্য মৃত্যুর ক্ষেত্রেও ক্যাথেরিনের সরাসরি সম্পৃক্ততার শক্ত কোনো প্রমাণের অভাবও স্থান পায় তাদের যুক্তিতর্কে।
তবে জুরিরা শেষ পর্যন্ত সরকার পক্ষের সাথে একমত হন। প্যাট্রিক, সারাহ আর লরার খুন এবং ক্যালেবের নরহত্যার দায়ে ক্যাথেরিনকে দোষী ঘোষণা করেন তারা। ২৪ অক্টোবর বিচারক তাকে ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেন, ৩০ বছর প্যারোলের সুযোগ পাবেন না তিনি। থেরিন সেসনুক সংশোধন কেন্দ্রে (Cessnock Correctional Center) বন্দিজীবন আরম্ভ করেন। তার উকিলদের আপিলের প্রেক্ষিতে প্যারোলের সুযোগবিহীন কারাবাসের মেয়াদ নামিয়ে আনা হয় ২৫ বছরে।
সন্দেহের বীজ
ক্যাথেরিন বারেবারে দাবি করেছেন তিনি নির্দোষ। একজন অপরাধী নিজেকে নির্দোষ দাবি করতেই পারেন, কিন্তু ক্যাথেরিনের ক্ষেত্রে বিচার নিয়ে তার উকিলেরা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাদের বক্তব্য ছিল পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে জুরি তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। কিন্তু খুনের দায়ে দণ্ডিত হতে গেলে যে শক্ত তথ্য-প্রমাণ দরকার সরকারি উকিল তা সরবরাহে ব্যর্থ হয়েছেন।
একটি বড় সমস্যা ছিল যে সরকারি উকিলের দাবি ছিল ক্যাথেরিন শ্বাসরোধ করে বাচ্চাদের হত্যা করেছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা এর কোনো চিহ্ন মৃতদেহে খুঁজে পাননি। পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন ক্যাথেরিনের কোনো বাচ্চাই মারা যাবার সময় সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল না। লরার হৃদপিণ্ডে সমস্যা তো ছিলই, মৃত্যুর সময় শ্বাসনালীর সংক্রমণেও ভুগছিল বেচারি।
ক্যাথেরিনের উকিলেরা তার বাচ্চাদের জিনগত কোনো সমস্যা ছিল কিনা তা নিয়েও সন্দিহান ছিলেন। ২০০৩ সালে জিন প্রযুক্তি ততটা উন্নত ছিল না। তবে পরবর্তী ১৫-১৬ বছরে এই ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়।
২০১৮ সালে প্রযুক্তির সম্ভাব্যতা দেখে ক্যাথেরিনের উকিলরা তার পরিবারের জেনেটিক বিশ্লেষণের অনুরোধ করেন। এই দায়িত্ব নেনে ক্যানবেরার অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইমিউনোলজিস্ট, অধ্যাপক ক্যারোলা ভিনুসা এবং ডঃ টোডোর আরসভ। ক্যাথেরিনে তার জিনগত বিশ্লেষণের অনুমতি দেন কারাভ্যন্তর থেকে, ২০০৮ সালের অক্টোবরের ৮ তারিখে।
ভিনুসা এবং আরসভ দেখতে পেলেন ক্যাথেরিন এবং তার কন্যারা CALM2 জিনে একটি মিউটেশন বহন করছেন। এই মিউটেশন এসআইডিএসে’র উচ্চ ঝুঁকির সাথে সম্পর্কিত। ক্যাথেরিনের এই মিউটেশনটি অত্যন্ত দুর্লভ বলে চিহ্নিত। বলা হয় তখন অবধি সারা বিশ্বে মাত্র ৭৫ জনের এই মিউটেশন ছিল। এমন ২০টি ক্ষেত্রে আক্রান্ত শিশুর মৃত্যুর কারণ ছিল এসআইডিএস। অন্যান্য ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে, বিশেষ করে অ্যাড্রেনালিন বাড়িয়ে দেয় এমন কোনো ঘটনার পর। লরার মৃত্যুর সময় সে সিউডোএফেড্রিন ওষুধ ব্যবহার করছিল, যা শরীরে অ্যাড্রেনালিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে।
ভিনুসা আর আরসভের পর আরো গবেষক এই দলে যুক্ত হন। তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে। সেখানে জিনের মিউটেশন সারা ও লরার মৃত্যুর কারণ হতে পারে বলে বলে তারা ব্যাখ্যা করেন। ক্যালেব ও প্যাট্রিকের ক্ষেত্রে তারা ভিন্ন একটি মিউটেশনের খোঁজ পান, যা পরীক্ষাগারে শিশু ইঁদুরের খিঁচুনিজনিত মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায় বলে প্রমাণিত হয়।
বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে গবেষকেরা দাবি করেন ক্যাথেরিন ফলবিগ সন্দেহাতীতভাবে তার সন্তানদের হত্যা করেছেন একথা বলার সুযোগ আর নেই। কারণ বিজ্ঞান বলছে প্রাকৃতিক কারণে তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা জোরালো। বহু নামকরা বিজ্ঞানী তাদের সাথে প্রকাশ্যে একমত পোষণ করেন।
দোষ খণ্ডণের চেষ্টা
২০১৮ সালের আগেই ক্যাথেরিনের উকিলেরা আনুষ্ঠানিক আপিলের সব সুযোগ নিয়ে নিয়েছিলেন। নতুন তথ্যের উপর ভিত্তি করে তারা বিষয়টি পুনঃতদন্তের আর্জি জানান। ২০১৮ সালের শেষ থেকে ২০১৯ সালের প্রথমভাগে ভিনুসা তার রিপোর্ট ধারাবাহিকভাবে তদন্ত কমিটির কাছে পেশ করেন। অধ্যাপক ভিনুসা মিলানের বিশ্ববিখ্যাত হৃদরোগ বিশারদ এবং জেনেটিসিস্ট অধ্যাপক পিটার শোয়ার্টজকেও চিঠি লিখেন। অধ্যাপক শোয়ার্টজ তাকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিবারের দুই শিশুর কথা জানান যাদের একইরকম মিউটেশন ছিল। এক শিশু মারা গিয়েছিল, আরেকজন হার্ট অ্যাটাক করলেও বেঁচে যায়।
ভিনুসা তদন্ত দলকে অধ্যাপক শোয়ার্টজের ব্যাপারে অবহিত করেন। কিন্তু ২০১৯ সালের জুলাইতে তাদের রিপোর্টে তারা ক্যাথেরিনের দণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। তারা বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ আমলে না নিয়ে ক্যাথেরিনের ডায়েরির উপর সমস্ত কিছু চাপিয়ে দেন। জানিয়ে দেন এর দ্বারাই ক্যাথেরিনের দোষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। রেজিনাল্ড ব্লানশ, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক যিনি তদন্তদলের প্রধান ছিলেন, বলেন যে বিদ্যমান তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এটাই বোঝা যায় যে ক্যাথেরিনের বাচ্চাদের মৃত্যুর পেছনে প্রাকৃতিক কোনো বিষয় নয়, বরং তাদের মায়ের হাত কাজ করেছিল।
ব্লানশ আরো দাবি করেন শ্বাসরোধের মাধ্যমে ক্যাথেরিন সন্তানদের হত্যা করেছেন এমন যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। বিকল্প কারণের বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ যথেষ্ট শক্ত নয় বলে তিনি তা বাতিল করে দেন। ২০১৯ সালে রেজিনাল্ড ব্লানশের তদন্ত ফলাফলের বিরুদ্ধে করা আপীল খারিজ করে দেয় আদালত। ততদিনে বিষয়টি সংবাদপত্র আর সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কেন আমলে নেয়া হচ্ছে না সেটা নিয়ে জনগণের মধ্যেই অসন্তোষ দেখা দেয়। এর ভিত্তিতে নিউ সাউথ ওয়েলসের সরকার থেকে আশ্বস্ত করা হয় এই বলে যে উপযুক্ত যাচাইবাছাই শেষেই ক্যাথেরিনের দণ্ডাদেশ বহাল রাখা হয়েছে।
গভর্নরের কাছে পিটিশন
আদালত ও বিজ্ঞানের মতদ্বৈততার মাঝে নিউ সাউথ ওয়েলসের গভর্নর মার্গারেট বেইজলির কাছে ২০২১ সালের মার্চে জমা পরে একটি পিটিশন। এতে ক্যাথেরিন ফলবিগকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে আহ্বান জানান অন্তত ৯০ জন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী। এই তালিকায় অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের নামজাদা লোকেরা আছেন। স্বাক্ষরকারীদের অন্যতম অস্ট্রেলিয়ার দুই নোবেল বিজয়ী, এলজাবেথ ব্ল্যাকবার্ন আর পিটার ডোহার্টি, অস্ট্রেলিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেসের প্রধান অধ্যাপক জন শাইন, প্রাক্তন এক প্রধান বিজ্ঞানী, অস্ট্রেলিয়ার দুজন ম্যান অফ দ্য ইয়ার ও অন্যান্য সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব।
পিটিশনে উল্লেখ করা হয় ২০০৩ সালে ক্যাথেরিন ফলবিগকে দোষী করার পেছনে শোকাহত এক মায়ের ডায়েরির কিছু অংশে অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। শ্বাসরোধের চিহ্ন নেই বলা সত্ত্বেও চিকিৎসকদের সেই কথাকে আমলে নেওয়া হয়নি। লরার ময়নাতদন্তের ফলাফলও দেখা হয়নি। ফলে অধ্যাপক জন শাইনের মতে বিদ্যমান বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে ক্যাথেরিনের দোষ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে, তাই তারা গভর্নরকে আপিল করেছেন দ্রুত তাকে ক্ষমা করে মুক্তি ব্যবস্থা করতে।
মার্কিন শিশু জেনেটিসিস্ট অধ্যাপক জোসেফ গেজ পিটিশনে স্বাক্ষর করাদের একজন। তিনি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন ক্যাথেরিনের কন্যাদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে মিউটেশনের প্রভাব যেভাবে জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে, ছেলেদের ব্যাপারে সেটা বলা না গেলেও তা উড়িয়ে দেয়ার উপায়ও নেই। তিনি জানিয়েছেন প্যাট্রিক আর ক্যালেবের মিউটেশন নিয়ে গবেষকেরা এখনো কাজ করছেন।
জোসেফ গেজ ২০১৯ সালের তদন্তের ফলাফলেরও সমালোচনা করতে ছাড়েননি। তিনি উষ্মা প্রকাশ করেছেন এই বলে যে বিজ্ঞান সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত যে ক্যাথেরিনের সন্তানদের মৃত্যুর পেছনে প্রাকৃতিক কারণ থাকার বড় সম্ভাবনা রয়েছে, ২০০৩ সালের বিচারকাজে যা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। কাজেই কীভাবে তদন্তকমিটি আবারো তার দোষের ব্যাপারে নিশ্চিত হলেন সেটা বিস্ময় জাগানিয়া।
অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম শিশু ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফিওনা স্ট্যানলি ক্যাথেরিন ফলবিগের ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণের পরিবর্তে পারিপার্শ্বিক অবস্থার (circumstantial evidence) উপর বিচারকদের জোর দেয়াতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার মতে ক্যাথেরিনের প্রত্যেক সন্তানের মৃত্যু নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত বিকল্প ব্যাখ্যা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট, কাজেই একে হত্যাকাণ্ড বলে রায় দেওয়া সম্ভব নয়।
নিউ সাউথ ওয়েলসের গভর্নর এখনো পিটিশনটি পর্যালোচনা করছেন। যদি তিনিও তা খারিজ করে দেন তাহলে ২০২৮ সাল পর্যন্ত ক্যাথেরিনকে জেলে থাকতে হবে। এরপর তিনি প্যারোলে মুক্তির সুযোগ পাবেন।
ক্যাথেরিনের ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়াতে এখন দুটি দল তৈরি হয়েছে। এক দলের মতে তার দোষ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই, কারণ তার বিচারে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে। অপরদলের মতে যেহেতু তার সন্তানদের মৃত্যুর বিকল্প বিশ্বাসযোগ্য কারণ রয়েছে, কাজেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করা অনুচিত। গভর্নর কোন পথে হাঁটেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ক্যাথেরিন সব সময়েই বলে এসেছেন তিনি সন্তানদের হত্যা করেননি। তবে একজন মা হিসেবে তাদের মৃত্যুর জন্য নিজেকে তার সবসময়েই দায়ী মনে হয়, বিজ্ঞান যাই বলুক না কেন এই কষ্ট কখনোই চলে যাবার নয়।